তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি বিচিত্র ছলনা জালে
...............................................................................
সাম্প্রতিক কালে আমাদের নৈতিক উপলব্ধিতে, সামাজিক উদ্বেগে কিংবা মূল্যবোধে দৃশ্যমান পরিবর্তন এসেছে। প্রযুক্তির নিবিড় ব্যবহার, বিশ্বায়নের প্রভাব, বিশ্বরাজনীতির অভিঘাত, বাজার সংস্কৃতির ধাক্কা ও চরমপন্থী ভাবাদর্শের টানাপড়েনে আমাদের চিরকালীন মূল্যবোধ ভেঙ্গে পড়েছে। নৈতিকতার সীমানা সরে যাচ্ছে প্রথাগত বিশ্বাস ও প্রতিষ্ঠানসংলগ্নতা থেকে। গতিময় জীবনের অভিঘাতে চরম অস্থিরতা ব্যক্তি থেকে ব্যষ্টির ব্যাপ্তিতে বিরাজ করছে। সর্বত্র আহাজারি, শোনার অবসর নিয়ে হাজির নেই কেউ। মানুষ যে নির্বিকার তাও নয়, তারা বিকারগ্রস্থ, পূর্ণমাত্রায় ঘোরগ্রস্থ, কেবল অপ্রত্যাশিত ঘটনাপ্রবাহের সাথে তাল মেলানোতে। তারা এখন এমন সব বিষয়ে আলোড়িত হয়, যে বিষয়ের সাথে তাদের সরাসরি যোগ নেই। থাকলেও তা অনেক ক্ষীণ ও দূরবর্তী কার্যকারণ সম্পর্কে আবদ্ধ। একইভাবে, তারা এমন সব পরিণতি ভোগ করে, যার জন্য তারা নিজেরা দায়ী নয়। আর যারা দায়ী তারা এর পরিণতি ভোগ করেন না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষ বয়সের দিকে এই প্যারাডক্স নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন ছিলেন। তার জিজ্ঞাসা ছিল, বিধি যে এত ছলনার জাল পেতে রেখেছে তা কীভাবে ছিন্ন করা যাবে? মৃত্যুর কিছুক্ষণ আগে মুখে বলে লেখা তার সর্বশেষ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন-
“তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি
বিচিত্র ছলনা জালে
হে ছলনাময়ী।”
প্রকৃতি মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পেতে নিপুণ ছলনায় পুরুষ বা আত্মাকে প্রবঞ্চিত করছে। এই মোহান্ধকার, অজ্ঞতার অমানিশা ও দুঃখবন্ধন কাটছেনা অবিদ্যা দোষে। মিথ্যা বিশ্বাস দিয়ে মানুষ নিজেই কত ভালমন্দ বিচার করে বসে। অথচ বিশ্বাসের সাথে বোধের ফারাক, প্রত্যাশার সাথে পরিণতির দূরত্ব, নিজেরই নৈতিক বোধে নিয়ে আসে টানাপোড়েন। হয়তো অন্তরতলে এক মহৎ স্বরূপ আছে যে কালে কালে কালো কাল দূর করে বিদ্যার আলোতে কূটাভাসের অপসারণ ঘটাবে। কিন্তু বিদ্যার দীপ জ্বলার আগে যদি জীবন প্রদীপ নিভে যায়, মানুষ কখন ছিড়বে সেই ছলনার জাল?
রবীন্দ্র কর্তৃক মহাত্মা উপাধি পাওয়া গান্ধীও একই ছলনার চোরাবালিতে আটকেছিলেন। তিনি যখন ভূমিকম্পের কারণ হিসেবে পাপকে চিহ্নিত করলেন তখন বিজ্ঞানমনস্ক মানুষের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিলো। ভূমিকম্পে যারা প্রাণ হারালো, তাদের পাপের পরিমাণ ও ভোগান্তির পরিমাণ দৃশ্যত বিসদৃশ হওয়ায় দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকেও গ্রহনযোগ্যতা পেলো না। ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিকতার পর্যায়েও এমন অসম সমীকরণ মান্যতা পেলো না। কিন্তু ঘটনাতো ঘটনার নিয়মে ঘটতে আছে, আমরা মানি কি না মানি তার পরোয়া করে না।
বৈজ্ঞানিক ও বস্তুবাদি ধারণা অনুযায়ী, কার্য-কারণ সম্পর্কের ভিত্তিতে পূর্ববর্তী ঘটনার সাথে পরবর্তী ঘটনার মধ্যে অনিবার্য সম্পর্ক থাকার কথা, এবং এই ধরণের কার্য-কারণ সম্পর্কের প্রতি ইঙ্গিত করে বিশেষ ঘটনার দায় দায়িত্ব কিংবা পরিণতি ভোগ করার ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করা যেত। যদি অনিবার্য কার্য-কারণ সম্পর্কে বিশ্বাস স্থাপন করা যায়, তাহলে বস্তুগত ভাবেই স্থান-কাল নির্বিশেষে ঘটনার অভিক্ষেপ সম্পর্কে ভবিষ্যৎবাণী বা অনুমান করার অবকাশ থাকে। কিন্তু এ ধরণের পার্থিব ও সামাজিক ঘটনার হবসীয় ব্যাখ্যা মার খেয়েছে অনেক আগেই। অন্তত হাইজেনবার্গের কোয়ান্টামতত্ত্ব ও অনিশ্চয়তাতত্ত্ব মোতাবেক এই বিশ্বাসে উপনীত হওয়া যায় যে, যে কোন ঘটনার স্থান-কালিক ক্ষণ অপরিমাপযোগ্য, তাই এর পরিণতিও অনুমান অযোগ্য। বাস্তবে সামাজিক ঘটনার ভবিষ্যতবাণী প্রায়ই মিথ্যা প্রমাণিত হচ্ছে। লরেঞ্জের ক্যায়স তত্ত্ব অনুযায়ী ক্ষুদ্র ঘটনা অনেক বড় পরিণতি বয়ে আনতে পারে। বাটারফ্লাই প্রভাব বিশ্লেষণের মাধ্যমে তিনি এই বৈজ্ঞানিক তত্ত্বটির ব্যাখ্যা দেন। ঘটনা যে নিছক বস্তুবাদের নিয়ম মেনে ঘটে না তা প্রমাণ করার জন্য বেশি দূরে যাওয়ার দরকার নেই। ঘটনার অনভিপ্রেত ফলাফল ব্যাখ্যা করার জন্য আমরা বাংলাদেশের যানজট কে একটি টেস্ট কেস হিসেবে নিতে পারি। আমরা যখন রাস্তায় বের হই, মাঝে মধ্যে জটে পড়ি। কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করতে না পেরে, ঐ জটকে পাশ কেটে, সামনের গাড়ি ও পথকে বাইপাস করে নিজের গাড়ি ঢুকিয়ে দিই। ফলে আরও গভীরতর যানজটে আটকে পড়ি। আগে যাওয়ার বদলে, দীর্ঘজটে আটকে পড়াই হয়ে পড়ে নিয়তি। অথচ একটু সবুর করে সামনের গাড়ির পেছনে অপেক্ষা করলেই বিপরীত দিক থেকে আসা গাড়িগুলো পথ পেতো, আর একটু পরে সামনের গাড়ি সরলে জটবিহীন পথে নিজের যাওয়ার পথ উন্মুক্ত থাকতো। সামাজিক ঘটনাগুলোর দিকে দৃকপাত করলে নানা স্ববিরোধ পরিলক্ষিত হয় বলেই আধুনিক সমাজবিজ্ঞানী ও দার্শনিকরা মানুষের ও সমাজের ঘটনাগুলো ব্যাখ্যা করার জন্য শুধুমাত্র বস্তুবাদের ওপর নির্ভর না করে মনস্তত্ত্বের মিশেল ঘটিয়েছেন। ক্ষেত্র বিশেষে সিমুলেশনের মাধ্যমে মেকি ঘটনার আবহ সৃষ্টি করে ঘটনা কোন প্রেক্ষিতে কোন অনুঘটকের প্রভাবে কোন ধরণের ফলাফল উৎপন্ন করে তা নির্ণয়ের প্রয়াস চালানো হয়। আমাদের চার পাশে একটু চোখ তুলে তাকালেই নজরে আসবে অজস্র উদাহরণ।
...............................................................................
সাম্প্রতিক কালে আমাদের নৈতিক উপলব্ধিতে, সামাজিক উদ্বেগে কিংবা মূল্যবোধে দৃশ্যমান পরিবর্তন এসেছে। প্রযুক্তির নিবিড় ব্যবহার, বিশ্বায়নের প্রভাব, বিশ্বরাজনীতির অভিঘাত, বাজার সংস্কৃতির ধাক্কা ও চরমপন্থী ভাবাদর্শের টানাপড়েনে আমাদের চিরকালীন মূল্যবোধ ভেঙ্গে পড়েছে। নৈতিকতার সীমানা সরে যাচ্ছে প্রথাগত বিশ্বাস ও প্রতিষ্ঠানসংলগ্নতা থেকে। গতিময় জীবনের অভিঘাতে চরম অস্থিরতা ব্যক্তি থেকে ব্যষ্টির ব্যাপ্তিতে বিরাজ করছে। সর্বত্র আহাজারি, শোনার অবসর নিয়ে হাজির নেই কেউ। মানুষ যে নির্বিকার তাও নয়, তারা বিকারগ্রস্থ, পূর্ণমাত্রায় ঘোরগ্রস্থ, কেবল অপ্রত্যাশিত ঘটনাপ্রবাহের সাথে তাল মেলানোতে। তারা এখন এমন সব বিষয়ে আলোড়িত হয়, যে বিষয়ের সাথে তাদের সরাসরি যোগ নেই। থাকলেও তা অনেক ক্ষীণ ও দূরবর্তী কার্যকারণ সম্পর্কে আবদ্ধ। একইভাবে, তারা এমন সব পরিণতি ভোগ করে, যার জন্য তারা নিজেরা দায়ী নয়। আর যারা দায়ী তারা এর পরিণতি ভোগ করেন না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষ বয়সের দিকে এই প্যারাডক্স নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন ছিলেন। তার জিজ্ঞাসা ছিল, বিধি যে এত ছলনার জাল পেতে রেখেছে তা কীভাবে ছিন্ন করা যাবে? মৃত্যুর কিছুক্ষণ আগে মুখে বলে লেখা তার সর্বশেষ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন-
“তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি
বিচিত্র ছলনা জালে
হে ছলনাময়ী।”
প্রকৃতি মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পেতে নিপুণ ছলনায় পুরুষ বা আত্মাকে প্রবঞ্চিত করছে। এই মোহান্ধকার, অজ্ঞতার অমানিশা ও দুঃখবন্ধন কাটছেনা অবিদ্যা দোষে। মিথ্যা বিশ্বাস দিয়ে মানুষ নিজেই কত ভালমন্দ বিচার করে বসে। অথচ বিশ্বাসের সাথে বোধের ফারাক, প্রত্যাশার সাথে পরিণতির দূরত্ব, নিজেরই নৈতিক বোধে নিয়ে আসে টানাপোড়েন। হয়তো অন্তরতলে এক মহৎ স্বরূপ আছে যে কালে কালে কালো কাল দূর করে বিদ্যার আলোতে কূটাভাসের অপসারণ ঘটাবে। কিন্তু বিদ্যার দীপ জ্বলার আগে যদি জীবন প্রদীপ নিভে যায়, মানুষ কখন ছিড়বে সেই ছলনার জাল?
রবীন্দ্র কর্তৃক মহাত্মা উপাধি পাওয়া গান্ধীও একই ছলনার চোরাবালিতে আটকেছিলেন। তিনি যখন ভূমিকম্পের কারণ হিসেবে পাপকে চিহ্নিত করলেন তখন বিজ্ঞানমনস্ক মানুষের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিলো। ভূমিকম্পে যারা প্রাণ হারালো, তাদের পাপের পরিমাণ ও ভোগান্তির পরিমাণ দৃশ্যত বিসদৃশ হওয়ায় দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকেও গ্রহনযোগ্যতা পেলো না। ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিকতার পর্যায়েও এমন অসম সমীকরণ মান্যতা পেলো না। কিন্তু ঘটনাতো ঘটনার নিয়মে ঘটতে আছে, আমরা মানি কি না মানি তার পরোয়া করে না।
বৈজ্ঞানিক ও বস্তুবাদি ধারণা অনুযায়ী, কার্য-কারণ সম্পর্কের ভিত্তিতে পূর্ববর্তী ঘটনার সাথে পরবর্তী ঘটনার মধ্যে অনিবার্য সম্পর্ক থাকার কথা, এবং এই ধরণের কার্য-কারণ সম্পর্কের প্রতি ইঙ্গিত করে বিশেষ ঘটনার দায় দায়িত্ব কিংবা পরিণতি ভোগ করার ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করা যেত। যদি অনিবার্য কার্য-কারণ সম্পর্কে বিশ্বাস স্থাপন করা যায়, তাহলে বস্তুগত ভাবেই স্থান-কাল নির্বিশেষে ঘটনার অভিক্ষেপ সম্পর্কে ভবিষ্যৎবাণী বা অনুমান করার অবকাশ থাকে। কিন্তু এ ধরণের পার্থিব ও সামাজিক ঘটনার হবসীয় ব্যাখ্যা মার খেয়েছে অনেক আগেই। অন্তত হাইজেনবার্গের কোয়ান্টামতত্ত্ব ও অনিশ্চয়তাতত্ত্ব মোতাবেক এই বিশ্বাসে উপনীত হওয়া যায় যে, যে কোন ঘটনার স্থান-কালিক ক্ষণ অপরিমাপযোগ্য, তাই এর পরিণতিও অনুমান অযোগ্য। বাস্তবে সামাজিক ঘটনার ভবিষ্যতবাণী প্রায়ই মিথ্যা প্রমাণিত হচ্ছে। লরেঞ্জের ক্যায়স তত্ত্ব অনুযায়ী ক্ষুদ্র ঘটনা অনেক বড় পরিণতি বয়ে আনতে পারে। বাটারফ্লাই প্রভাব বিশ্লেষণের মাধ্যমে তিনি এই বৈজ্ঞানিক তত্ত্বটির ব্যাখ্যা দেন। ঘটনা যে নিছক বস্তুবাদের নিয়ম মেনে ঘটে না তা প্রমাণ করার জন্য বেশি দূরে যাওয়ার দরকার নেই। ঘটনার অনভিপ্রেত ফলাফল ব্যাখ্যা করার জন্য আমরা বাংলাদেশের যানজট কে একটি টেস্ট কেস হিসেবে নিতে পারি। আমরা যখন রাস্তায় বের হই, মাঝে মধ্যে জটে পড়ি। কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করতে না পেরে, ঐ জটকে পাশ কেটে, সামনের গাড়ি ও পথকে বাইপাস করে নিজের গাড়ি ঢুকিয়ে দিই। ফলে আরও গভীরতর যানজটে আটকে পড়ি। আগে যাওয়ার বদলে, দীর্ঘজটে আটকে পড়াই হয়ে পড়ে নিয়তি। অথচ একটু সবুর করে সামনের গাড়ির পেছনে অপেক্ষা করলেই বিপরীত দিক থেকে আসা গাড়িগুলো পথ পেতো, আর একটু পরে সামনের গাড়ি সরলে জটবিহীন পথে নিজের যাওয়ার পথ উন্মুক্ত থাকতো। সামাজিক ঘটনাগুলোর দিকে দৃকপাত করলে নানা স্ববিরোধ পরিলক্ষিত হয় বলেই আধুনিক সমাজবিজ্ঞানী ও দার্শনিকরা মানুষের ও সমাজের ঘটনাগুলো ব্যাখ্যা করার জন্য শুধুমাত্র বস্তুবাদের ওপর নির্ভর না করে মনস্তত্ত্বের মিশেল ঘটিয়েছেন। ক্ষেত্র বিশেষে সিমুলেশনের মাধ্যমে মেকি ঘটনার আবহ সৃষ্টি করে ঘটনা কোন প্রেক্ষিতে কোন অনুঘটকের প্রভাবে কোন ধরণের ফলাফল উৎপন্ন করে তা নির্ণয়ের প্রয়াস চালানো হয়। আমাদের চার পাশে একটু চোখ তুলে তাকালেই নজরে আসবে অজস্র উদাহরণ।
Comments