সরওয়ার কামাল
সাগর কূলে গিরিকুন্তলা মোহিনী মহেশখালী দ্বীপের ৩৮৮ বর্গকিলোমিটার ভূত্বকে প্রায় পাঁচ লক্ষ লোকের বসতি। তাদের বসতি ঘিরে গড়ে উঠেছে উপকূলীয়-দ্বীপাঞ্চলীয় সমাজ। এই সমাজসভ্যদের মানসিক ঐক্য ও জীবনযাপন পদ্ধতি নিয়ে তৈরি হয়েছে শনাক্তযোগ্য বিশেষ স্থানীয় সংস্কৃতি। মানবজাতির চিরকালীন অভিযাত্রার অংশ হিসেবে দেশের নানা জায়গা থেকে হিজরত করে লোকজন এসে বসতি গেড়েছে মহেশখালীতে। তাই তাদের ভাষা ও আচরণে শনাক্ত করা যায় এমন বৈচিত্র্য ও তারতম্য, যা দিয়ে কক্সবাজারের অন্যান্য অঞ্চলের অধিবাসীদের তুলনায় মহেশখালীবাসীকে স্বতন্ত্রভাবে চিহ্নিত করা যায়। যে পার্থক্যসূচক বৈশিষ্ঠ্যাবলী নিয়ে মহেশখালীর সমাজ ও মানুষের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য তৈরি হয়েছে, চাটগাঁইয়া ভাষার উপভাষাতুল্য মহেশখালীর দ্বীপাঞ্চলীয় বুলি তার মধ্যে বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য।[1] তবে সমস্যা হলো, লিখিত সাহিত্য ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের অভাবে স্থানীয় ইতিহাসের মতোই কালিক সূচকের নিরিখে এর জনসংস্কৃতি বর্ণনা করা দুরূহ। একেতো সংস্কৃতি স্বয়ং একটি ব্যাপক ধারণা, তদুপরি, এটি সতত পরিবর্তনশীল। ভাষা ও সংস্কৃতি স্রোতস্বী নদীর মতো বহমান। মানুষের কথা, স্মৃতি, পুরাণ, অভ্যাস, খাদ্য, পোষাক, নির্মাণকৌশল, জীবিকা, মূল্যবোধ, সাহিত্য, সংগীত, বিনোদন, ঐতিহ্য, চিন্তা-চেতনা, মানসগঠন সবকিছু নিয়েই নিয়ত পরিবর্তনশীলতার মধ্য দিয়ে সংস্কৃতি স্বয়ং সময়ের তালে সম্মুখে ধাবমান। একটি বৃহৎ অঞ্চলের অধিবাসীদের উল্লেখযোগ্য সময়ের সামষ্টিক আচরণ ও কর্মকাণ্ডই সংস্কৃতিকে একটি শনাক্তযোগ্য অবয়ব দেয়। দীর্ঘকালব্যাপী রোসাঙ্গ ও চিটাগাঙের অধীন থাকায় চাটগাঁইয়া সংস্কৃতিরই একটি প্রান্তিক ধরণ বিরাজ করছে মহেশখালীতে। অন্যদিকে বাংলামুলুকের অংশ হিসেবে বৃহত্তর অর্থে বাঙালি সংস্কৃতি, বিশেষ করে শবর, নিষাদ এবং কিরাট জাতির সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার এখনো বহন করে যাচ্ছে। মহেশখালীর সবচেয়ে বৃহৎ লোকজ মেলা শিব চতুর্দশী মেলা মূলত প্রাচীন কিরাট জাতির দেবতার মেলা।[2] সাংখ্য ও শৈব ধর্মাবলম্বী থেকে সেটি ক্রমান্বয়ে বৌদ্ধ তান্ত্রিক ও হিন্দু ধর্মে অন্বিত ও সমাদৃত হয়েছে। মুসলিমদের ধর্মীয় উৎসব, বৌদ্ধদের ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব, জাত-পরিচয়ের ভিত্তিতে কিছু লোকজ উৎসব মিলে, অন্যান্য এলাকার মতোই, মহেশখালীর কিছু স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করা যায়। বিদ্যমান নিবন্ধে আমরা মহেশখালীর সমাজ এবং সংস্কৃতির একটি রূপরেখা অঙ্কনের করার প্রয়াস চালাবো।
সতর্কভাবে মহেশখালীর স্থানীয় সংস্কৃতি বিষয়ক আলোচনার পরিপ্রেক্ষিত নির্ধারণ করতে গেলে তা দৃশ্যতঃ চারটি প্রধান তত্ত্বের ভিত্তিতে আলোচনার দাবি রাখে। এক, মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্নতাজাত কারণে উপকূলীয় দ্বীপের স্বতন্ত্র সংস্কৃতি হিসেবে; দুই, মূলধারার সংস্কৃতির উপসংস্কৃতি হিসেবে; তিন, জীববৈচিত্র্য বিবেচনায় নিয়ে জৈব-ভৌগোলিক অঞ্চল (বায়ো-জিওগ্রাফিক রিজিয়ন) হিসেবে এবং চার, ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক প্রতিমা (প্রোটোটাইপ) হিসেবে। তবে এসব ব্যাখ্যায় অগ্রসর হওয়ার পূর্বে সংস্কৃতির ধ্রুপদী সংজ্ঞায়ন সম্পর্কে আমাদের স্পষ্ট ধারণা থাকা চাই। সংস্কৃতির অন্যতম একটি সংজ্ঞা এডওয়ার্ড টেলরের বরাতে পাওয়া, যেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘সংস্কৃতি হলো, সমাজের সদস্য হিসেবে মানুষ জ্ঞান, বিশ্বাস, শিল্প, আইন, নৈতিকতা, প্রথাসহ যে সব সক্ষমতা ও অভ্যাস রপ্ত করে তার জটিল সমবায়'।[3] তাঁর ধারণাটি ব্যাপক, তবে সংস্কৃতি যে এক ধরনের সক্ষমতা নির্দেশ করে, তা এই সংজ্ঞায় স্পষ্ট। তাই, সংস্কৃতি হলো, ব্যাপক অর্থে, টিকে থাকার সক্ষমতা। এক সময় সংস্কৃতি বলতে যে কোন ধরনের পরিচর্যা বোঝাতো। মানুষের শ্রম ও স্বপ্ন দিয়ে সুন্দর কিছু করাকে সংস্কৃতি বলা হতো। সেই নিরিখে এগ্রিকালচার বা কৃষি ছিলো মানুষের আদিম সংস্কৃতি। একইভাবে রোমান দার্শনিক সিসেরো সন্তান পরিচর্যা ও প্রতিপালনকেও সংস্কৃতি বলে গণ্য করেছেন।[4] মানসিক ও বৌদ্ধিক পরিচর্যা দ্বারা সন্তানদের শিক্ষিত করাকেও সংস্কৃতি বলে অভিহিত করা হয়। কিন্তু ইদানীং বিশেষ কোন সাংস্কৃতিক চিহ্ন দ্বারা সংস্কৃতি পৃথক করা যায় না। কারণ সবার মধ্যেই একই ধরনের সাংস্কৃতিক চিহ্ন দেখা যায়। শিল্পকলার যান্ত্রিক পুনরুৎপাদনের সক্ষমতা বাড়ায় একই পেইন্টিং, একই বই, একই আর্ট পিস সবার ঘরে পাওয়া যায়। সবাই একই টুথপেস্ট, একই সাবান, একই জুতো ব্যবহার করে। অথচ কয়েক দশক পূর্বে এসব জীবনোপকরণের শ্রেণিভিত্তিক পার্থক্য ছিলো এবং সেই পার্থক্যকে সাংস্কৃতিক পার্থক্য হিসেবে বিবেচনা করা হতো।[5]
পোলিশ দার্শনিক ও সংস্কৃতি তাত্ত্বিক জিগমুন্ট বাউম্যানের মতে সংস্কৃতি মানুষের মনন ও সৃজনশীলতার ভেতর দিয়ে পরিবর্তনের অনুঘটক হিসেবে থাকার কথা থাকলেও মূলত পরিবর্তনপ্রবণ সমাজে সংস্কৃতি মানবীয় মোয়ামেলার মিশনারি ভূমিকা হারিয়ে ফেলেছে। সংস্কৃতি এখন সজীব ও পরিবর্তনপ্রবণ সমাজে প্রতীকী তথ্যের বিনিময়। ভাষাকাঠামোর মতোই সংস্কৃতি এখন মানুষকে ঘিরে তার পরিপার্শ্বের প্রতীক ও চিহ্নবিন্যাসের ভেতর দিয়ে অপর মানুষের সাথে সম্পর্ক তৈরির ব্যাপার।[6]
উপকূলীয় দ্বীপের স্বতন্ত্র
সংস্কৃতি
মধ্যযুগে মগ শাসন ও বঙ্গ শাসন থেকে প্রাকৃতিক কারণে বিচ্ছিন্ন
থাকার সুবাদে মহেশখালী দ্বীপের স্বতন্ত্র কিছু বৈশিষ্ট্য তৈরি হয়েছে, যেগুলো স্থানীয়
জন ও জনপদের স্বকীয়তা নির্দেশক। তার মধ্যে চাটগাঁইয়া ভাষার মহেশখালীর দ্বীপাঞ্চলীয়
বুলি এবং উচ্চারণে স্বর তারতম্যের কথা উল্লেখ করেছেন ভাষা গবেষক প্রফেসর মনিরুজ্জামান
ও প্রফেসর আফিয়া দিল। তারা চাটগাঁইয়া ভাষার চারটি স্বতন্ত্র ধারা চিহ্নিত করেছেন, যার
মধ্যে মহেশখালী-কুতুবদিয়ার বুলিকে পৃথক বলে দাবি করেছেন ধ্বনি ও শব্দপ্রকরণের জন্য।
কক্সবাজারের অন্যান্য অঞ্চলের মানুষের সাথে মহেশখালীর মানুষের কথোপকথনে সেই পার্থক্য
স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে অর্থনৈতিক লেনদেন, প্রযুক্তি ব্যবহার এবং
যোগাযোগের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় মানুষের ভাষার মধ্যেও স্বাঙ্গীকরণ ঘটেছে। এখানে যা
বিশেষভাবে উল্লেখের দাবি রাখে তা হলো, উনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভকাল থেকে চাটগাঁইয়া
ভাষার যে বাংলায়ন শুরু হয়, তা সাম্প্রতিককালে তার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। হয়তো কোন
এক ভবিষ্যৎ কালপর্বে গিয়ে চাটগাঁইয়া ভাষা বিলুপ্তির মুখে পড়বে।
বর্তমান ভারতের বিহারস্থ মগধ থেকে এসে ১৪৬ খীষ্টাব্দে রাজা চন্দ্র-সূর্য কর্তৃক আরাকান রাজ্য প্রতিষ্ঠা করার পর বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চল ও ধান্যবতীতে মগ এবং নিম্নবর্ণের হিন্দুদের সহাবস্থান শুরু হয়।[7] তার সাথে অষ্টম শতক থেকে যুক্ত হয় আরব্য বণিকগণ, যারা সওদা করতে এসে এখানে দীর্ঘদিনব্যাপী থেকে যেতো।[8] তারা স্থানীয়দের বিয়েশাদি করে সওদাগরি বসতি পত্তন করে বসতেন। সর্বোপরি, ১৩৪০ সালে ফখরুদ্দিন মোবারক শাহ কর্তৃক চিটাগাঙ বিজয়ের পর কক্সবাজার অঞ্চলে গৌড়ীয় মুসলমানদের বসবাস শুরু হয়।[9] ফলতঃ চাটগাঁইয়া ভাষার মতোই নানান জায়গা থেকে আসা নানা ভাষা ও জাত-বর্ণ প্রসূত সংস্কৃতির মেল্টিং পটে পরিণত হয় কক্সবাজার, যার তৎকালীন নাম ছিলো বুলিতে ‘পামাজা’ এবং লিখনে ‘প্যাঁওয়া-সা’।[10] প্যাঁওয়া-সা ইংরেজিতে লিখতে গেলে চন্দ্রবিন্দুর জন্য ‘এন’ দিয়ে লিখতে হয় বলে প্যাঁওয়া-সা ইংরেজিতে ‘প্যানোয়া’ নামে প্রচার পেয়েছে। যাইহোক, হিন্দু, বৌদ্ধ, পর্তুগীজ, আরব্য, ব্রিটিশ নানা সংস্কৃতির যোগসূত্রে চিটাগাঙ ও কক্সবাজারের উপকূলীয় অঞ্চলে মিশ্রসংস্কৃতির প্রভাব পড়েছে। কাজেই মগি প্রশাসন, পর্তুগীজ খাবার ও ফার্নিচার এবং আরবদের ভাষা ও ধর্ম বৃহত্তর চট্টগ্রামের মতো মহেশখালীতেও ব্যাপক প্রভাব রেখেছে।
আরাকান ব্রিটিশদের দখলে আসে ১৮২৬ সালে। তার আগের ৪২ বছর, মানে ১৭৮৪ থেকে ১৮২৬ পর্যন্ত আরাকান ছিলো বার্মার দখলে। ১৭৮৪ সালে বার্মার রাজা বোধপায়া কর্তৃক অধিকৃত হওয়ার পূর্বে প্রায় ৫০০ বছর এটা ছিল স্বাধীন রাজ্য। মধ্যযুগের শেষের দিকে পর্তুগিজদের প্রভাবে বৃহত্তর চট্টগ্রামে বড় ধরনের সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ঘটে। খাবারে, কৃষিতে, জীবনউপকরণে, অভ্যাসে পর্তুগিজদের উল্লেখযোগ্য প্রভাব রয়েছে। সেই প্রভাব ব্রিটিশদের আগমনের পরও অব্যাহত থাকে। একই কারণে মহেশখালীও বিদেশি সংস্কৃতির প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। এছাড়া এই দ্বীপে মুঘলদের আগমনের পূর্বে পর্তুগিজ জলদস্যুদের যাতায়াত ছিল বলে ধারণা করা হয়। সুলতান সুলেমানের অনুমতি নিয়ে তুর্কি নাবিক সীদী আলী রঈস প্রকাশ সীদী আলী সালেবি ১৫৫৪ সালের ডিসেম্বর মাসে চাটগাঁ উপকূল ভ্রমণ করে ‘কিতাব উল মুহিত’ লিখেন, যেখানে মহেশখালী দ্বীপের পূর্বনাম হিসেবে তিনি বাকাল বা বাকোলী উল্লেখ করছেন। তবে তিনি এই দ্বীপে অবতরণ করেন নি। ফ্রান্সিস বুকাননের বর্ণনা থেকে জানা যায় মহেশখালীতে তার ভ্রমণের পুর্ব থেকেই মানুষের বসতি ছিলো। কেবল দুর্গম দ্বীপ হওয়ার কারণে অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় মহেশখালীতে জীবনাচার ও সংস্কৃতির স্থবিরতা ছিল। উপকূলীয় দ্বীপসত্তাই এই দ্বীপের সাংস্কৃতিক স্বকীয়তা যুগিয়েছে। ডিমকে আরবি ‘বয়জা’ বলা, তরকারির পেয়ালাকে আরবি ‘কদ্দা’ বলা কক্সবাজারের অন্যান্য অঞ্চলেও প্রচলিত, কিন্তু মহেশখালীতে সেটা কিছুটা স্থায়িত্ব পেয়েছিল। স্থানীয় ভাষায় আরবি শব্দবাহুল্য এবং ব্যাকরণের প্রভাব আরবীয়দের কাছ থেকে আগত বলে ধারণা করা হয়।
যে কোন দ্বীপের বিচ্ছিন্ন পরিবেশ, মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্নতা, একাকীত্ব, সম্পর্ক ও যোগাযোগের অভাব, ভূপ্রকৃতি ইত্যাদি মিলে সেখানে স্থানীয় সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্য দেখা দেওয়া অত্যন্ত স্বাভাবিক। অন্যদিকে, মানবীয় সম্পর্কের ওপরও যদি আলোকপাত করা হয়, তাহলে দেখা যাবে, ওই অঞ্চলের সাথে অন্য যে অঞ্চলের মানুষের সম্পর্ক পূর্বে ঘটেছে তার প্রভাবও পূর্বে পড়বে। কাজেই উপকূলবর্তী দ্বীপ হিসেবে নৌ-যোগাযোগের সূত্রে বিভিন্ন দেশের পরিভ্রাজক, ব্যবসায়ী, নাবিক এবং জেলেদের পদার্পন ঘটা অত্যন্ত স্বাভাবিক। আরবি ও বিদেশি শব্দবাহুল্যতার কারণেই চাটগাঁইয়া ভাষার যে চারটি প্রকরণের কথা গবেষকগণ উল্লেখ করেছেন, তার একটি মহেশখালী-কুতুবদিয়া অঞ্চলের। অর্থাৎ মহেশখালীর একটি ভাষাগত স্বাতন্ত্র্য রয়েছে, যে স্বাতন্ত্র্য চাটগাঁইয়া ভাষাকে বিবেচনায় নিলেও স্পষ্টভাবে দুসরা বলে প্রতিভাত হতে পারে।
উপসংস্কৃতি হিসেবে মহেশখালী
উপসংস্কৃতি বলতে একটি বৃহৎ সংস্কৃতির অধীনে থাকা সত্ত্বেও কিছু
বিরোধ এবং বৈপরীত্য নিয়ে সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখা। উপসংস্কৃতি দ্বারা সর্বদা
অধীন, প্রান্তিক, বৈপরীত্য, বিকল্প এবং কিছুটা বিচ্ছিন্ন সংস্কৃতি নির্দেশ করে। যদিও
এটি পুরো একটি জনগোষ্ঠীকে না বুঝিয়ে সমাজের একটি বিশেষ গোষ্ঠীকে বোঝায়, যাদের এইসব
বৈশিষ্ঠ্য ও বিচ্ছিন্নতা আছে। তবুও এটা বিশেষ ধরনের সাংস্কৃতিক ও তত্ত্ববিষয়ক জায়গা।
মহেশখালী এক সময় সুরতন, আরাকান এবং পরে চাটগাঁর অধীন বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হিসেবে উভয় অঞ্চলের
সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার পেয়েছে। একইসাথে উপকূলীয় দুর্গম দ্বীপ হিসেবে এতে
মগ ও ফিরিঙ্গি জলদস্যু, নাবিক এবং নাথপন্থী যোগীদের দ্বারা সমাজপত্তনের সম্ভাবনা রয়েছে।
যদিও রেকর্ডপত্রের অভাবে কারা এই দ্বীপে প্রথম এসেছে তা নিশ্চিত করে বলা যায় না, তবুও
এটা সহজেই অনুমেয় যে, বর্ণিত তিন দলের যে কোন একটি দল এখানে সর্বপ্রথম এসে থাকতে পারে।
সমাজপত্তনের পৃথক ধরণই এখানকার এক্সক্লুসিভ সংস্কৃতির সূতিকাগার।
যে কোন বিচ্ছিন্ন দ্বীপে লোকদের বসতি ঘটে সাধারণত শাস্তিপ্রাপ্ত মানুষের নির্বাসন দেওয়ার মাধ্যমে। মহেশখালীতে যারা বসতি গেড়েছে তারা যে সেই শাস্তির অংশ হিসেবে দ্বীপান্তরিত হয়েছে, ইতিহাসে এমন নজির পাওয়া যায় নি। তবে ১৭৮৫ খ্রিস্টাব্দে আরাকান থেকে আসা শরণার্থীদের সেলফ সেটেলড ক্যাম্প করতে দেওয়া হয়, যারা সেখানে না থেকে পুনরায় বার্মার সীমান্তে ফিরে যায় বলে জানা যায়[11]। অন্যদিকে, প্রফেসর মুহিবউল্যাহ ছিদ্দিকীর দেওয়া তথ্য অনুসারে, মহেশখালীতে জনবসতির পত্তন ঘটে ১৭৬০ সালে সরফরাজ চৌধুরীদের মাধ্যমে।[12] ১৭৬২ সালের ২রা এপ্রিল চিটাগাঙ্গে মারাত্মক ভূমিকম্পে চট্টগ্রামের বেশ কিছু উপকূলীয় অঞ্চল চিরদিনের জন্য সমুদ্রে নিমজ্জিত হয়।[13] এর প্রভাবে মহেশখালী, অন্যান্য দ্বীপের মতোই, ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের শিকার হওয়ার এবং মূল ভূখন্ড থেকে অধিকতর বিচ্ছিন্নতায় আপতিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
একটি এলাকার সাংস্কৃতিক উপাদান, ঐতিহ্য, অতীত এবং তার ধারাবাহিক পরম্পরা নিয়েই এর সাংস্কৃতিক ইতিহাস তৈরি হয়। কিন্তু অতীত রেকর্ড ও স্মারকচিহ্নের অভাবে কিছু শনাক্ত করা কঠিন। মহেশখালীতে যে কয়টি সাংস্কৃতিক স্মারকচিহ্ন আছে, সেগুলোর অধিকাংশই পুনঃনির্মিত। এতে ইতিহাসের কিছু বিক্ষেপ ঘটে গেছে। যেমন, সর্বপ্রথম স্থাপিত আদিনাথ মন্দিরের চিহ্ন আর অবশিষ্ট নেই। কোম্পানি আমলে যে মন্দিরটি ছিল, তারও লেশমাত্র নেই। অন্যদিকে পাহাড় চূড়ায় বৌদ্ধ জাদির সময়কাল সম্পর্কেও নির্ভরযোগ্য কোন তথ্য নেই। তবে, অনুমান করা সম্ভব; যেহেতু একটি পুরনো স্থাপনা আছে, তার কার্বন রিডিং উদ্ধার করা গেলে এটা সম্ভব হবে। কক্সবাজার ও আরাকান অঞ্চলের পাহাড়ে এই রকম অসংখ্য বৌদ্ধ জাদি রয়েছে। বিশিষ্ট অস্ট্রেলিয়ান গবেষক পামেলা গুটম্যান আরাকানের বৌদ্ধ জাদিগুলোর ইতিহাস লিখতে গিয়ে এই ধারণা পোষণ করেছেন, যে এগুলো বেশ পুরনো।[14]
স্থাপত্য ও মনুমেন্ট বিবেচনায় মহেশখালী ইতিহাস একেবারেই অপর্যাপ্ত। কিন্তু প্রাকৃতিক পরিবেশ, ভূতাত্ত্বিক গঠন, পরিবেশ-প্রতিবেশগত উপাদান এবং মানুষের জীবিকার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে ব্যাপক অর্থে অনেকগুলো সাংস্কৃতিক উপাদান পাওয়া যায়। যেমন, লবণ চাষ, মাছ ধরা, কৃষি এবং পান চাষকে কেন্দ্র করে কিছু পেশাগত ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য লক্ষ করা যায়।
বায়োজিওগ্রাফিক রিজিয়ন
একসময় মহেশখালীতে গাঙ্গেয় সুন্দরবনের অনুরূপ ঝোপজঙ্গল ছিল।[15] সোনাদিয়ায় সামুদ্রিক কচ্ছপের
প্রাচুর্যও সর্বজনবিদিত।[16] মহেশখালী দ্বীপে দুর্লভ উদ্ভিদ,
প্রাণী, কাঁকড়া, জুয়োপ্লাংটন, ফাইটোপ্লাংটন, সামুদ্রিক পাখি ও পরিযায়ী পাখির এক্সক্লুসিভ
উপস্থিতির জন্য একে একটি বায়োজিওগ্রাফিক রিজিওন হিসেবে বিবেচনা করা যায়। ভৌগোলিকভাবে
মূল দ্বীপ ঘেঁষে আছে সোনাদিয়া ও মাতারবাড়ি নামে দুইটি ক্ষুদ্র দ্বীপ। এসব ক্ষুদ্রদ্বীপ
জীববৈচিত্র্যে অত্যন্ত সমৃদ্ধ। উদ্ভিদ, প্রাণী, প্রাকৃতিক উপাদান এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ
নিয়ে মহেশখালীতে স্বতন্ত্র জীবনোপকরণ ও সাংস্কৃতিক অবস্থা বিরাজ করছে। মহেশখালীর জীববৈচিত্র্যের
অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হলো সোনাদিয়া, যদিও ইতিমধ্যে সোনাদিয়ার জীববৈচিত্র্যের জন্য
হুমকি তৈরি করে মাছের ঘের তৈরি করা হয়েছে। তবুও, অদ্যাবধি এটি বাংলাদেশের অন্যতম মৎস্য
প্রজনন অঞ্চল। সোনাদিয়ায় কিছু বিরল পাখি ও
পরিযায়ী পাখির দেখা মিলে, যা সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের স্বাতন্ত্র্য
নির্দেশক। সোনাদিয়ায় দেখা গেছে এমন উল্লেখযোগ্য পাখির মধ্যে বদর বা খোঁয়াজকৈতর
(Brown-headed gull), ছোট পানকৌড়ি (Little Cormorant), কানি বক (Pond Heron), ছোট
সাদা বা কোরচে বক (Little Egret), গুলিন্দা (Eurasian Curlew), ছোট টিটি জিরিয়া
(Lesser Sandoplover), ছোট গুলিন্দা (Whimbrel), যাঠুয়া বক (Great White Egret), চা
পাখি (Common Sandpiper), মটরি (Common Redshank), মধুবাজ (Oriental Honey
Buzzard), তিলা সবুজ চা পাখি (Nordmann's Greenshank), বড় পানকৌড়ি (Great
Cormorant), লেজ নাচুনে (White-throated Fantail), কালোটুপি মাছরাঙ্গা
(Black-capped Kingfisher), প্রজাপতি বাজ বা ইঁদুরমারা চিল (Long-legged Buzzard),
পান্তামুখী বা কোদাইল্লা হাঁস (Northern Shoveler), বড় বদরকৈতর (Pallas's gull), বৃহৎ
গাঙচিল (Great Crested Tern), কালি কাক বা ধূপনি বক (Grey Heron), বড় চা পাখি বা
আদাকাইচে (Great Knot), টিটি জিরিয়া বা বালু বাটান (Greater Sandplover), ডোরালেজ
জৌরালি (Bar-tailed godwit), মাঝারি গাঙচিল (Common tern), বাবুই বাটান (Little
Pratincole), বামন চা পাখি বা চড়ুই চা (Little Stint), ছোট টিটি জিরিয়া ও জিরিয়া
(Kentish Plover), গুলিন্দাঠোঁটি চা পাখি (Curlew Sandpiper), কালোমাথা কাস্তেচরা
(Black-headed Ibis), সাদা বা বড়ঠোঁটি গাংচিল (Common gull-billed Tern), বড়
বাটান (Grey Plover), সবুজ চা পাখি (Green Sandpiper) এবং গঙ্গাকৈতর
(Slender-billed gull) উল্লেখযোগ্য।
একসময়
উপকূলীয় বনাঞ্চলে বিচিত্র প্রজাতির উদ্ভিদ জন্মাতো। আধুনিক বনায়ন নীতির কারণে
বিশেষ ধরনের প্রজাতি নির্বাচনের কারণে বনগুলো হয়ে পড়েছে এক্সক্লুসিভলি গেওয়া ও
কেওড়া বন। তারপরও বিশেষ কিছু উদ্ভিদের দেখা মিলে মহেশখালীতে, যা এর বিশেষায়িত
উপকূলীয় পরিবেশের পরিচয় বহন করে।
ল্যান্ডস্কেপ ও সীস্কেপ বিবেচনায় দ্বীপের জীবনযাপন পদ্ধতি ও জীবনোপকরণের প্রতুলতা নিয়ে মহেশখালীকে সংস্কৃতি বিষয়ক গবেষণার একটি ল্যাবরেটরি হিসেবেও বিবেচনা করা যায়। মহেশখালী দ্বীপের মধ্যে কয়েকটি স্বতন্ত্র জনগোষ্ঠীও আছে। বিশেষ করে রাখাইন ও জলদাস, এই দুই ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী তাদের সংখ্যাগত লঘুতা নিয়েই স্বতন্ত্র জীবনযাপন পদ্ধতি অটুট রেখেছে। সংস্কৃতি অধ্যয়নের ক্ষেত্রে এই ধরনের জনগোষ্ঠীর জীবনযাপন পর্যবেক্ষণ করা এবং অন্যদের সাথে তাদের সম্পর্ক বিশ্লেষণের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের মডেল ও তত্ত্ব বিশ্লেষণ করা সহজ।
সমাজ ও মানবউন্নয়নের মডেল হিসেবে মহেশখালীর মতো দ্বীপগুলো পরিকল্পিতভাবে নিয়ন্ত্রণযোগ্য; উন্নয়নের প্রক্ষেপও আগাম অনুমানযোগ্য। দ্বীপের সাংস্কৃতিক ভূগোল বিবেচনায় সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি পরখ করা যায়। প্রাচীন সভ্যতা, সামুদ্রিক পরিবেশ এবং লবণ, মৎস্য ও পানের মতো অতি প্রাচীন ও প্রান্তিক পেশাগুলো নিজেই সাংস্কৃতিক সংযোগের ভূমিকা পালন করে।
ক্ষুদ্র পরিসরে মহেশখালীর মানুষের ভাষা, ভাষা
ব্যবহারের ধরণ, সমাজভাষাতত্ত্ব, মূল্যবোধ, অভ্যাস, আচরণ, সামাজিক নৈতিকতা, অপরিচিতের
প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি, মনস্তাত্ত্বিক সংহতি এবং সাংস্কৃতিক অনুশীলন মিলে বিশেষ ধরনের গোষ্ঠীপরিচয়
লক্ষ করা যায়। এটা কক্সবাজার জেলার অন্যান্য উপজেলার মানুষের সাথে কিংবা বৃহত্তর চাটগাঁ
অঞ্চলের মানুষের সাথে তুলনা করলে সহজে পৃথক করা যায়। উপকূলীয়-দ্বীপাঞ্চলীয় ভূগোল, সমাজ
ও অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক বাস্তবতা এখানকার মানুষের সাংস্কৃতিক দল হয়ে ওঠার পেছনে ভূমিকা
রাখে। মহেশখালীবাসীর প্রাত্যহিক জীবনের লড়াই ও সংগ্রাম, প্রতিরোধ ও টিকে থাকার সম্বল
অভিন্ন বলেই এক ধরনের সংহতি তৈরি হয়েছে। সার্বিকভাবে মহেশখালীর সমাজ ও সংস্কৃতির একটি
উপকূলীয়-দ্বীপাঞ্চলীয় রূপ আমাদের মনোযোগ দাবি করে। কাজেই এই সমাজ ও সংস্কৃতিকে তার
নিজস্ব প্রতিমার আকারে বুঝা এবং ব্যাখ্যা করা অনুসন্ধানের তাগিদেই গুরুত্বপূর্ণ।
মহেশখালীতে বিভিন্ন পেশার মানুষ আছে। তার মধ্যে জেলে ও পানচাষীদের
আছে পৃথক স্থানবোধ। এই বোধ থেকেই তাদের আচার-আচরণ ও স্থানীয় জীবন উপকরণের ব্যবহারে
আছে স্বাতন্ত্র্য। জেলেদের আছে সাগরমুখি দৃষ্টিভঙ্গি, অন্যদিকে পানচাষীদের আছে পাহাড়মুখি
দৃষ্টিভঙ্গি। ফলে তাদের মনোভঙ্গি ও জীবনবোধ ভিন্ন ধরনের। জেলেদের জীবনঝুঁকি বেশি, ফলে
তাদের মৌসুমি আধ্যাত্মিকতার চর্চাও পানচাষীদের তুলনায় ভিন্ন। জেলেদের মধ্যে মিলাদ ও
ওয়াজ মাহফিল আয়োজনের প্রবণতা বেশি, হয়তো এই কারণে যে সাগরে তাদের অনিশ্চয়তা, ভয় ও আতংক
বেশি থাকে। এছাড়া তাদের সাফল্যের হারও অনেকটা দৈবী বিষয়। অন্যদিকে পানচাষীদের ক্ষেত্রে
লাভ-লোকসানের প্রভাব ঘটে ধীরে, কিছুটা সময় নিয়ে, যা আগাম আঁচ করা যায়। ফলে এখানে জীবনের
অনিশ্চয়তা কম; ভীতি ও আতংক কম। তাই তাদের মধ্যে ধার্মিকতা ও রক্ষণশীলতা দেখা গেলেও
আধ্যাত্মিক অনুষ্ঠানের প্রবণতা তুলনামূলকভাবে কম।
জেলে অঞ্চলে আছে নৌকা, গলুই, জাল, মাঝি, মাছ, বয়া, মাছ ও তেলের ঘ্রাণ। অন্যদিকে চাষীদের অঞ্চলে আছে পান, শণ, বাঁশ খৈল, গোবর, সার ও তৃণলতার ঘ্রাণ। কেবল জেলেরা পান খায় এবং পানচাষীরা মাছ খায়, এই দুই বাস্তবতা বাদ দিলে তাদের মধ্যে পরস্পর নির্ভরশীলতা খুব বেশি নেই । তবে উভয়ের নির্ভরশীলতা আছে রাখাইনপাড়ায় স্বর্ণালঙ্কার বন্ধক দেওয়ার ক্ষেত্রে। পূর্বে পান পরিবহনের জন্য কার্গো নৌকা ব্যবহার করা হতো। এখন সড়ক পরিবহন চালু থাকায় নৌকার চল নেই।
লবণ উৎপাদনকে কেন্দ্র করে এক বিশাল জনগোষ্ঠীর জীবিকানির্ভরতা তৈরি হয়েছে। তবে তাদের মধ্যে স্থানবোধ এতো স্পষ্ট নয়, যতোটা বর্ণিত দুই পেশাদার অঞ্চলে পরিলক্ষিত হয়। যাইহোক, মানুষের এই ধরনের স্থানবোধ সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
খাদ্যাভ্যাসের ক্ষেত্রে মহেশখালীর মানুষের ঝাল খাওয়ার প্রবণতা
বাদ দিলে কক্সবাজার জেলার অন্যান্য অঞ্চলের সাথে বড় ব্যবধান নেই। বিয়ে প্রথার ক্ষেত্রেও
মহেশখালীর পৃথক কোন সাংস্কৃতিক চিহ্ন নেই। বাংলাদেশের অন্য যে কোন এলাকার মতোই এখানে
বিয়ে-সংস্কৃতি ধর্মনির্ভর প্রথা ও রসম অনুযায়ী চর্চিত হয়ে আসছে। তার একটা উল্লেখযোগ্য
হলো বৈরাত যাওয়া। মানে বরকে নিয়ে সদলবলে কনের বাড়িতে যাওয়া। সাথে পানের বিরা, দইয়ের
হাড়ি ও গুড়-কলা ইত্যাদি নেওয়া। এখন অবশ্য সেসবের অনেককিছুই বদলে গেছে। দইয়ের প্রচলন
একেবারেই উঠে গেছে। এখন জনপ্রিয়তা পেয়েছে ডেজার্ট। বিয়ে অনুষ্ঠানও এখন ক্লাব কিংবা
কমিউনিটি সেন্টারে অনুষ্ঠিত হয়।
খাবারে ঝালের প্রতি ঝোঁক সর্বজনবিদিত। এক সময় পাহাড়ে বিচিত্র ধরনের পাহাড়ি মরিচ পাওয়া যেত। পাড়ামরিচ (অতি ঝালজাতীয় ক্যাপসিকাম), ধাউন্ন মরিচ, বরই মরিচ, স্থানীয় মরিচ ইত্যাদির জনপ্রিয়তা ছিল। শাকের সাথে এইসব মরিচ স্বাদ অনুপাতে ব্যবহার করা হতো। এছাড়া মরিচ ভর্তা, ভেট বায়ন ভর্তা, হলুদপাতার ভর্তা, মামুনি শাক, টমেটোর চাটনি, আলুভর্তা, শিম ভর্তা ইত্যাদিতে কাঁচামরিচ পুড়িয়ে ব্যবহার করা হতো। কখনো কখনো স্রেফ পেঁয়াজ দিয়ে মরিচের ভর্তা দিয়েই গরীব লোকজন ভাত খেত। অনেক সময় রোগীরা মুখের স্বাদ বদলানোর জন্যও মরিচ ভর্তা খেত।
বিভিন্ন ধরনের আচার ও আমশি তৈরির ক্ষেত্রেও পোড়া মরিচের ব্যবহার দেখা যেত। স্থানীয় ভাষায় কাঁজি নামে এক ধরনের ঝাল-টকের ঝোল তৈরি করা হয়। মরিচ ভর্তা দিয়ে কাঁজির স্বাদও উপভোগ্য।
মহেশখালীতে জনপ্রিয় মাছের মধ্যে অন্যতম দুইটি হলো কালাবাটা বা হরুল মাছ ও ফইল্যা মাছ বা রূপালি রূপচাঁদা মাছ। তবে কিছু সাধারণ জনপ্রিয় মাছ আছে, যেমনঃ ইলিশ, বাগদা, য়ুন্দরা, দাতিনা কোরাল, পাঁচকাটা বা পাঁচমিশালি মাছ ইত্যাদি। এক সময় দেশি মাগুর ও কৈ মাছের জনপ্রিয়তা ছিল। সেসব এখন খুব একটা পাওয়া যায় না। ১৯৯১ এর ঘুর্ণিঝড়, মারিএনের আঘাতের পর মহেশখালীর জীববৈচিত্র্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তার অন্যতম হচ্ছে মিঠাপানির মাছের অপ্রতুলতা।
গৃহস্থালি জিনিসের মধ্যে ঢেঁকি ছিল একটা সাধারণ উপকরণ। মাটির চুলা, কাঠের ঢেঁকি, লাকড়ি রাখার কোম্বালা, গরুর বিষ্ঠা থেকে তৈরি লাকড়ি, যাকে স্থানীয় ভাষায় বলে গোন্ডার লাঠি, বেড়ার তৈরি মাচা, ডেকসি রাখার সেইক্যা, উইত্ত্যা, মুরগির ঘর, মুরগির ঝুড়ি, গরুর হওঁর, ধান বানার হাইরগ্যাসহ নানা লোকজ উপকরণ এখনো গ্রামাঞ্চলে পাওয়া যায়।
উদ্ভিদের মধ্যেও কিছু উদ্ভিদ এখন বিলুপ্ত প্রায়। তার মধ্যে অন্যতম হলো পুকুরের শাপলা, কেঁয়ুর, হেলেঞ্চা শাক, মানকচু, আন্ডাগোলা গাছ, ভেরেন্ডা গাছ, গিল গাছ, তিতা শাক, বাউত্তা শাক, ক্ষ্যাতাপাড়া শাক, নেয়ান্দা শাক, মলিচি শাক ইত্যাদি।
খেলাধুলা
খেলাধূলার ক্ষেত্রে একসময় গ্রামীণ লোকজ খেলার প্রচলন ছিল। পুকুরে
ভা'ত খেলা, ভুটভাট খেলা, ডুব খেলা, লম্ফঝম্ফ ছাড়াও বিভিন্ন জলক্রীড়া প্রচলিত ছিল। পুকুর
ছাড়াও আগেকার দিনে বিলে বিলে ছোটখাটো জলাশয় দেখা যেত। সেখানে বাচ্চারা খেলতো। এখন এই
ধরনের জলাশয় বিরল। গরু মহিষকে পানি খাওয়াতে গিয়েও অনেকে জলক্রীড়ায় মেতে উঠতো।
শীতকালে কাবাড়ি খেলা, হাড়ুড়ু, পরঅ খেলা, ফুটবল খেলা ইত্যাদি বেশ জনপ্রিয় ছিল। ডাংগুলি খেলা, মার্বেল খেলা, পয়সা খেলা, জোর জোর খেলা, একের কেড়ি খেলা, বৌচি খেলা, ক্ষুত খেলা, আংটা খেলা, ইত্যাদি ছিল।
বাচ্চারা কাদামাটি দিয়ে রেডিও, টিভি, হাতি ঘোড়া তৈরি করতো। ফলটুশ নিয়ে আছার গুলা, চিল হান্ডা দিয়ে পাখি শিকার করা, রাবার খেলা, আন্ডা গুলা দিয়ে খেলা ইত্যাদি নানাবিধ খেলাধূলার প্রচলন ছিল। শীতকালে ধানকাটা শেষ হলে লুকোচুরি খেলাও হতো।
ফুটবল এক সময় বেশ জনপ্রিয় খেলা ছিল। বিশেষ করে ১৯৮২ তে আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ জয় করলে ম্যারাডোনা খুব জনপ্রিয় নাম হয়ে উঠ। দেশে জাতীয় পর্যায়ে মোহামেডান ও আবাহনী দলের অনুকরণে মহেশখালীতেও এলাকাভিত্তিক ক্রীড়াচক্র ও ক্লাব গঠিত হতে থাকে। নতুন বাজার এবং গোরকঘাটা মাঠে খেলা অনুষ্ঠিত হতো। কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকা থেকে ভালো খেলোয়াড়দের হায়ার করে আনা হতো। এক সময় মহেশখালীর মকবুল আহমদ, মাসুদ আহমেদ, চেংসা, ফরিদ মিয়া আরমান নামকরা খেলোয়াড় ছিলো। সাম্প্রতিককালে তৌহিদুল ইসলাম সবুজ ফুটবলার হিসেবে নাম কামিয়েছেন। এইসব খেলার মধ্যে সেই সময়কার সহজিয়া জীবনবোধের পরিচয় পাওয়া যায়। শরীর চর্চা ও নির্মল বিনোদনের মাধ্যম হিসেবেও খেলাধুলার অভ্যাস দেখা যায়। তবে গ্রামীণ পর্যায়ে বাচ্চাদের বিচিত্র খেলাগুলো একান্তই সাংস্কৃতিক গুরুত্ব ও ঐতিহ্যের দিক থেকে অত্যন্ত বিচিত্র ও মূল্যবান। বলি খেলা ও ষাঁড়ের লড়াই অন্যতম জনপ্রিয় দুইটি বিনোদন কার্যক্রমের অংশ। মূলত লবণ চাষ শেষ হলে বৈশাখের শেষের দিকে এই দুইটি খেলার আয়োজন করা হয়। মহেশখালীর কামাল বলি এক সময় চাটগাঁ অঞ্চলের বিখ্যাত বলি ছিলেন।
যে কোন অঞ্চলের সংস্কৃতি পর্যালোচনার অন্যতম বিষয় হলো ভাষা
এবং ভাষাভিত্তিক সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ও অভিব্যক্তি পর্যালোচনা। কাজেই স্থানীয় গান,
প্রবাদ প্রবচন, ভাষাভঙ্গি, উচ্চারণ, গীতিকা, হঁলা, আইল্যাগীত, জারিগান ইত্যাদি শণাক্ত
করে তাতে স্থানীয় রূপ আবিষ্কার করা এবং স্থানীয়দের অবদান চিহ্নিত করা জরুরি।
নব্বইয়ের দশকের আব্দুল আলী গারুলির জারিসহ স্থানীয় শিল্পী ও গায়েনদের গাওয়া গান দিয়ে আমরা মহেশখালীর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য পর্যালোচনা করতে পারি। আর এসব ঐতিহ্যের ভেতর দিয়ে কোন ধরনের সাংস্কৃতিক চেতনা, অভ্যাস ও জীবনবোধের প্রকাশ ঘটছে, জীবনদক্ষতার চর্চা সমাদৃত হচ্ছে তা অনুভব করতে পারি। এক সময় পুঁথি পাঠের আসর বসতো গ্রামীন পরিবেশে। ব্যক্তিগতভাবে পারিবারিক পরিবেশেই সবচেয়ে বেশি পুঁথি পাঠের আসর বসতো।
মহেশখালীতে আদিনাথের শিব চতুর্দশী মেলা, বলি খেলা, ওয়াজমাহফিল এবং স্থানীয় নির্বাচন ঘিরে লোকজ গানের উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা যায়। ভিন্ন ভিন্ন মওসুমে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক আয়োজন ঘিরে পরিবেশ সরগরম হয়ে ওঠে। আদিনাথের মেলায় কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের খ্যাতিসম্পন্ন শিল্পীরা অংশ নিতো। এছাড়া চাটগাঁইয়া গানের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গান মহেশখালী ও সোনাদিয়ার আবহে লিখিত ও গীত হয়েছে।
চাটগাঁইয়া গানের বেশ কয়েকজন বিখ্যাত শিল্পী মহেশখালীর বংশোদ্ভূত। বুলবুল আক্তার, মহিউদ্দিন আজাদ, দীপংকর দে এবং সুমন বেশ জনপ্রিয়। সাথে মহেশখালী নিয়ে যারা গান পরিবেশন করেছেন তাদের মধ্যে শেফালী ঘোষ, কল্যাণী ঘোষ, রবী চৌধুরী, তপন চৌধুরী, ও সিরাজুল ইসলাম আজাদের নাম উল্লেখ করতে হয়। মহেশখালী নিয়ে লেখা গানের মধ্যে কিছু উল্লেখযোগ্য হলো-
১) আঁই যাইয়ুম সোনাদিয়া বন্ধু মাছ মারিবার লাই...,২) বাঁশখালী
মইশখালী...,৩) যদি একখান সুন্দর মুখ পাইতাম, মইশখালীর পানর খিলি তারে বানাই খাওয়াইতাম...,৪)
বাঁকখালীর মাঝি ও ভাই সোনাদিয়া বাসা/মুখখান কালা গইহ্য কীল্লাই হনে দিল আশারে,
৫) শ্যামলা রঙের সেই মেয়েটি ভালো লেগেছে/আদিনাথের মেলা থেকে
কথা দিয়েছে, ৬) টেকনাইফ্যা ফোয়ানা সুয়ারী/ মইশখালীর পান রে/ আদর গরি খাবাই দিয়ে /ছোড
তালতো ভইন রে, ৭) তরমুজ ভালা পতেঙ্গার/ গয়াম ভালা পটিয়ার/ লাইল্ল্যার হাডড় বঅরখানি/
কী মজার জিনিস/ খাইলে বুঝিবা ন খাইলে পচতাইবা/ চাক্তাইর শুটকি মজা/ মইশখালীর পান, 8)
মইশখালী মুড়ার আগাত চিঅন চিঅন লতা/ আঁর ভাইয়রে রেডু দিবার কথা রে/ মোর হায় হায় রে--(হঁওলা),
৯) দিবা নি দিবা নি দু'য়া টেঁইয়া দুলা ভাই/ আদিনাথর মেলা বইস্যে/ আঁই একখান জিনিস কিইনতাম
চাই, ১০) ওরে ও সখিনা বু একখান কথা হুন/ আঁর বিয়ার উকিল আইস্যে মইশখালীত্তুন, ১১) আঁর
আদরইয্যা ভাবী/ আঁর সোয়াইগ্যা ভাবী/ আঁর বদ্দায় তোঁয়ারে মাইজ্যে কননানদি/ মইশখালী মেলাত
গেইলে আইন্যম তোঁয়াল্লাই লালশাড়ি/ বদ্দায় তোঁয়ারে মাইজ্যে কননানদি… ইত্যাদি।
সমাজচিত্র
মানুষের মধ্যে ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সামাজিক
সৌহার্দ্য ছিলো মহেশখালীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। যদিও আইনশৃঙ্খলার রেকর্ডের দিক থেকে অন্য
অঞ্চলের লোকদের চোখে মহেশখালী বেশ ভীতিজাগানিয়া একটি অঞ্চল। এই নেতিবাচকতার অন্যতম
কারণ ও প্রভাবকের মধ্যে মহেশখালীর যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা, দুর্গম এলাকার ব্যাপকতা, থানার
অবস্থান মহেশখালীর একটি বিশেষ প্রান্তে হওয়া, খাসজমি ও জলমহাল নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে
মতমতান্তর, জমির রেকর্ড ও দখল নিয়ে বিরোধের কথা উল্লেখ করতে হয়। এখানকার মানুষ তুলনামূলকভাবে
রাগী কিন্তু উদার ও অতিথিপরায়ণ। ভাষা ও বাচনিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে কিছুটা কর্কশ, সম্বোধনের
ক্ষেত্রে সংস্কৃত, কর্ষিত ও পরিশীলিত ভঙ্গির অভাব। ডাকার ক্ষেত্রে উচ্চস্বর অন্যতম।
এছাড়া মহেশখালী সম্পর্কে অন্যদের ধারণাগুলো তৈরি হয়, মহেশখালী ঘাটে তারা কী ব্যবহার
পেয়েছে, রিক্সাওয়ালা কত টাকা দাবি করেছে, ডাবের স্বাদ কেমন, পানের স্বাদ কেমন এগুলোর
ওপর। সলিমুল্লাহ খান জন্ম না নিলে মহেশখালীতে যে শিক্ষিত বিদ্বান মানুষও জন্ম নেয় এটা
অন্যদের বিশ্বাস করাতে বেগ পেতে হতো। মহেশখালীতে পুরনো রসম ও সম্পর্ক ক্রমে রূপান্তরিত
হয়ে আধুনিক সমাজ-সম্পর্কে রূপ নিচ্ছে। তা সার্বিকভাবে সামাজিক বুনন পালটে দিচ্ছে। মানুষ
এখন তুলনামূলকভাবে অভিবাসনমুখি। মানুষের গতিময়তা ব্যাপক মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। তা
সমাজের শ্রেণিভিত্তিক পরিচয়কেও প্রভাবিত করেছে। মূলত বর্তমানে মানুষের শ্রেণিভিত্তিক
পরিচয় অনেকটা উঠে গেছে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের প্রভাবে গ্রামীণ সর্দার ও মোড়লদের
ভূমিকাও গৌণ হয়ে পড়েছে। শিক্ষার হার পূর্বের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। অবকাঠামোও কলেবরে
বেড়েছে। তবুও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি না হওয়ায় যুবসমাজের মধ্যে হতাশা, লক্ষ্যহীনতা
এবং অস্থিরতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। কর্মহীন বিপুল সংখ্যক তরুণের প্রভাব সমাজ-সংস্কৃতির
ওপর প্রত্যক্ষভাবে পড়েছে।
স্থাপত্য
স্থাপত্যের দিক থেকে মহেশখালীর
দারিত্র্য অপরিসীম। কারণ, শুরু থেকেই এবসেন্টি জমিদারের কারণে মহেশখালীতে
কাঙ্ক্ষিত স্থাপনা হয় নি। স্থানীয়রাও নিজের মতো করে তৈরি করার অবকাশ পায় নি।
আদিনাথ মন্দির ও বৌদ্ধ জাদি এই অভাব কিছুটা পূরণ করেছে। তবে, মহেশখালীর বৌদ্ধ
জাদির সুনির্দিষ্ট ইতিহাস জানা নেই। এই ধরনের যে কোন স্থাপনার ইতিহাস অন্বেষণের
কিছু প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতি আছে। তার একটি হলো স্থাপনাগুলোর প্রত্নতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ,
অপরটি হলো ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক রূপান্তরের ইতিহাস, এবং প্রসঙ্গিকভাবেই ভাষার
প্রবাহ বিবেচনায় নিয়ে নৃগোষ্ঠির দেশান্তরের ইতিহাস বিশ্লেষণ। মহেশখালীর মৈনাকচূড়ায়
স্থাপিত জাদি দেখে মনে হতে পারে, এটি একটি বিহারকেন্দ্রিক 'মাগধি' ঘরানার বৌদ্ধ
স্থাপনা। এই স্থাপনায় অষ্টম শতকের ব্রাহ্মণ্যপ্রভাবিত স্থাপত্যের নিদর্শন রয়েছে।
নালন্দার শিক্ষার্থীরা দক্ষিণ চিটাগাং এবং আরাকানে ছড়িয়ে পরার মধ্যে দিয়ে এই
স্থাপত্যের নকশা এতদাঞ্চলে এসেছে বলে মত ব্যক্ত করেছেন পামেলা গুটম্যান।
প্রাচীন ধান্যবতী রাজ্যসহ আমাদের এই অঞ্চলে প্রথমে সাংখ্য ও শৈব মতাবলম্বীদের প্রভাব ছিল। তখনো সনাতন ধর্ম বিশেষ গ্রন্থকেন্দ্রিক ধর্ম হিসেবে বিস্তার লাভ করে নি। বাঙালি জাতির পূর্বসূরি দুইটি জাতিগোষ্ঠী, নিষাদ ও কিরাট জাতির মধ্যে 'কিরাট' জাতি শৈব মতাবলম্বী ছিল। অর্থাৎ কিরাট জাতিরাই প্রথম শিবের পূজা চালু করে।
কিরাট জাতির কাছ থেকে এই দেবতা "শিব" অন্যান্য প্রাকৃত ধর্ম ও সনাতন ধর্মে অঙ্গীভূত হয়। এরা ইন্দো-ইয়োরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হয়। নবম শতকে চন্দ্রবংশের শাসনকালের সমাপ্তি ঘটলে দেবনাগরির পরিবর্তে তিব্বতি প্রভাবিত 'মো'-বর্ণমালা সমাদর লাভ করে। ইতিমধ্যে সনাতন ধর্ম ও বৌদ্ধধর্ম এবং স্থানগত নৈকট্যের সুবাদে সাংস্কৃতিক মিশ্রণে দেবতা শিবকে মান্য করে তান্ত্রিক নাথপন্থীদের উদ্ভব ঘটলে এবং তান্ত্রিকরা পরবর্তীতে পুনরায় হিন্দু ধর্মে প্রত্যাবর্তন করলে উভয় ধর্মের মধ্যে সাংস্কৃতিক ও আচারগত বিভেদ কিছুটা মুছে যায়।
বিহার থেকে আগত মাগধি বুদ্ধরা পালি ভাষা সংরক্ষণ এবং বৌদ্ধমন্দির স্থাপনের চেষ্টা করে। কিন্তু তাতে হিন্দুদের প্রভাবে দুর্গাদেবির বাহন সিংহকে ধর্মরক্ষক বোধিসত্ত্বের মোটিফ হিসেবে মেনে নেয়। একই ধর্মীয় মোটিফ "সিংহ" প্রথমে হিন্দু, এবং পরে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের প্রভাবিত করে (এই বিষয়ে গবেষণামূলক তথ্য আছে, Jinah Kim এর লেখা প্রবন্ধে এবং য়ুনিভার্সিটি অব মিশিগানে দাখিলকৃত মাইকেল চার্নির পিএইচডি গবেষণায়)।
বৌদ্ধ মন্দিরে সিংহমূর্তির প্রচলন শুরু হয় মৌর্য সাম্রাজ্যের সময়ে। অবশ্য সেই সময় চট্টগ্রাম অঞ্চল মৌর্য সাম্রাজ্যের অংশ ছিল না। কিন্তু তিব্বতি ও সিংহলি বৌদ্ধদের প্রভাব আরাকান পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। বৌদ্ধধর্মীয় মোটিফগুলো যেহেতু কিছুটা হিন্দুধর্মীয় মোটিফ দ্বারা প্রভাবিত, সেহেতু দূর্গার বাহন সিংহ, বৌদ্ধমন্দিরে বোধিসত্ত্ব হিসেবে গৃহীত হয়েছে বলে মনে করা হয়।
বৌদ্ধদের মধ্যে মাগধি বৌদ্ধ এবং তিব্বতি-সিংহলি প্রভাবিত থেরবাদি বৌদ্ধ উভয়ই আছে। অন্যদিকে গামবাসী ও নির্জনবাসী বুদ্ধমুণি আছে। নির্জনবাসীরা পাহাড়চূড়া এবং নির্জন দ্বীপেও বৌদ্ধমন্দির স্থাপন করেছে। কাজেই এটা অসম্ভব নয় যে, লোকবসতি শুরু হওয়ার পূর্বেই নির্জনবাসী বৌদ্ধভিক্ষুরা এই জাদি স্থাপন করেছে। একই স্থাপত্যের একাধিক পুনঃনির্মান হওয়ার ঘটনাও অসম্ভব নয়। এই জাদি ফ্রান্সিস বুকাননের ভ্রমণের পূর্বে স্থাপিত হলে নিশ্চয়ই তার বিবরণে উল্লেখিত হতো। সেই বিবেচনায় এটি উনবিংশ শতকেরই কোন এক সময় স্থাপিত হয়ে থাকতে পারে। তবে এটির স্থাপত্য শৈলী পুরনো দিনের।
সেন আমল বাদ দিয়ে নবম শতক থেকে চতুর্দশ শতকের নরমিখলার শাসন এবং ষোড়শ শতক থেকে মুঘল প্রভাবিত শাসনকালে বৌদ্ধদের মন্দির স্থাপনে অবাধ স্বাধীনতা ছিল। কিন্তু ধর্মদর্শন ও সাংস্কৃতিক রূপান্তরের কারণে সিংহকে মোটিফ হিসেবে নেওয়া, শিবকে দেবতা হিসেবে মানা এবং ধান্যবতী রাজ্যে বৃষ্টির দেবতা ইন্দ্রের প্রভাবে 'পানিখেলা' চর্চা ইত্যাদি বিষয়ে সনাতন ধর্মাবলম্বী ও বৌদ্ধদের মধ্যে মিল রয়েছে।
অতএব, তান্ত্রিক নাথপন্থীরা আদিনাথ মন্দিরের সাথেও বৌদ্ধ জাদি স্থাপন করতে পারে। এছাড়া চতুর্দশ শতকে কিংবা ব্রিটিশদের আরাকান দখলের পূর্বে আদিনাথ পাহাড়ে এই জাদি স্থাপিত হতে পারে। তবে, তুলনামূলক ইতিহাসের নিরিখে ব্যাখ্যা করে যা পাওয়া যায়, তাও অনুমান মাত্র। প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান ব্যতীত প্রকৃত ইতিহাস জানা যাবে না।
মহেশখালী অন্য যেকোন প্রান্তিক অঞ্চলের মতোই শিল্পকলায় কিছুটা পিছিয়ে
রয়েছে। তা সত্ত্বেও কয়েজন গুণী শিল্পীর চিত্রকলার খ্যাতি ইতিমধ্যে জাতীয় অঙ্গনে
ছড়িয়ে পড়েছে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন কামাল উদ্দিন, মং মং শো, আর করিম,
আনিসুজ্জামান ফারুক, এ এছেন এবং মং হ্লা ওয়ান। মহেশখালীর শিল্পীদের চিত্রকলায়
স্থানবোধের প্রভাব স্পষ্ট। তাতে উপকূলীয় জীবন, ধীবর, মৎস্য, পাহাড় এবং তরঙ্গায়িত
জলের ঊর্মি পরিস্ফুট হয়। স্থানীয় মানুষের জীবনকে গভীর থেকে দেখা এবং তার সাথে
সমকালীন শিল্পকলার আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যে ছবি আঁকা হচ্ছে, তা মানুষের
জীবন ও সংস্কৃতির নন্দনতাত্ত্বিক বিকাশ ও উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে। শিল্পচর্চার
মাধ্যমে মানুষ ও জীবনোপকরণের শ্রী বৃদ্ধি ঘটে। মানুষের চিন্তায় শিল্পকলা ও শিল্প
আন্দোলনের প্রভাব পড়ে। এক পর্যায়ে তা মানুষের পরিচয়, জীবনবোধ, ইতিহাস ও
গোষ্ঠী-সংহতি তৈরিতে ভূমিকা রাখে। রাজনৈতিক স্থানবোধের জন্ম দেয়। শিল্প জন্মভূমির
প্রতি নস্টালজিয়া জাগ্রত করে।
ইতিমধ্যে আলোকপাত করেছি যে, ভাষা গবেষকগণ চাটগাঁইয়া
ভাষার চারটি ধরন শনাক্ত করেছেন, যার মধ্যে মহেশখালী-কুতুবদিয়ার ভাষা, একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন
উপকূলীয়-দ্বীপাঞ্চলীয় চাটগাঁইয়া ভাষা। মহেশখালীর ভাষার মধ্যে আবার তিন ধরনের ভাষাভঙ্গি
দেখা যায়; কুতুবজোম, শাপলাপুর এবং মহেশখালীর অন্যান্য অঞ্চল। সাহিত্যিক না বললেও নাট্যকার
ও চলচ্চিত্র নির্মাতা কাওসার চৌধুরী সম্প্রতি স্বাধীনতা পুরস্কারে পেয়ে মহেশখালীবাসীকে
গর্বিত করেছেন। বুদ্ধিজীবী সলিমুল্লাহ খান ২০২৪ সালের জন্য বাংলা একাডেমী পুরস্কারের
জন্য নির্বাচিত হয়েছেন, যদিও তা সলিমুল্লাহ খানের চেয়ে বাংলা একাডেমীর সম্মানিত হওয়ার
ব্যাপার। কারণ কীর্তিতে তিনি ইতিমধ্যে জাতীয় পুরস্কারের গণ্ডি অতিক্রম করেছেন। সাহিত্যে
বড়ত্বের ছাপ রেখেছেন।
দুঃখের মধ্যে বলতে হয়, মহেশখালীর কোন জেলে, লবনণচাষী অথবা পানচাষী অদ্যাবধি কোন উপন্যাস, নাটক অথবা গীতি কবিতার চরিত্র হিসেবে উঠে আসে নি। জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে যারা সাহিত্য চর্চা করে তারাও মহেশখালীকে প্রতিপাদ্য ধরে কোন চরিত্র সৃষ্টি করে নি; এমনকি কোন ইস্যুর ওপর আলোকপাত করে নি। মহেশখালীর লবণ, পান এবং তুফানজয়ী জীবনের কাহিনী উঠে আসেনি কোন জাতীয় সাহিত্যে। প্রবন্ধ সাহিত্যের ক্ষেত্রে কেবল জনদুর্ভোগ, ইতিহাস এবং স্মৃতিচারণের ছিটেফোঁটা দেখা যায়। কাজেই সংস্কৃতির গুরুত্বপুর্ণ উপাদান যে সাহিত্য, তাতেও মহেশখালীকে প্রতিনিধিত্ব করে এমন কিছু সৃষ্টি হয় নি। উত্তরাধুনিক সমাজে আঞ্চলিকতা, প্রান্তিকতা এবং ক্ষুদ্র পরিসরের বিষয় আশয় নিয়ে লেখকগণ তৎপর থাকেন। সেদিক থেকেও মহেশখালীর সাহিত্যিকগণ নিজেদের দিকে তাকানোর সাহস পাচ্ছে না, পাছে তারা জাতীয় সাহিত্যিকদের অনুকম্পা থেকে বঞ্চিত হন।
মহেশখালী ইতিমধ্যে বেশ কিছু প্রতিনিধিত্বশীল সাহিত্যিক ও চিন্তক জন্ম দিয়েছে, তার মধ্যে সলিমুল্লাহ খানের নাম বলাই বাহুল্য। খ্যাতিতে কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও উল্লেখযোগ্য কিছু সাহিত্যিক ও লেখক আছেন, যেমন, মুফতি মোহাম্মদ ফোরকান, মোস্তাক আহমদ মাস্টার, মওলানা সুলতান জওক নদভী, এস এ এম রফিক উল্লাহ, আহমদ হোছাইন, মকবুল আহমেদ, ডাঃ সিরাজুল হক, রুহুল কাদের বাবুল, ড. মাহফুজুর রহমান, জাহেদ সরওয়ার, সাদাত উল্লাহ খান, শাওয়াল খান, মুহাম্মদ আমানুল্লাহ, মেহেদী হাসান, মোহাম্মদ শাহ আলম, জহির সিদ্দিকী, মাহবুব রোকন, সাইয়্যিদ মঞ্জু, আলম ছৈয়দ, য়ানসার হক, নিলয় রফিক, মোক্তার আমদ রাশেদ, মাসুম হোসাইন, মুহাম্মদ হেলাল উদ্দীন, রুদ্র শাহাদৎ, হামিদুল ইসলাম আরাফাত, মোঃ হামিদুল হক, ওহিদুল হক খোকা, সোহেল তানভীর নিহাল, সুব্রত আপনসহ অনেকে।
গবেষণার জায়গায় উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলেছেন এমন কিছু গবেষক আছেন মহেশখালীতে, যার মধ্যে পরিবেশ বিজ্ঞানী ড. আনসারুল করিম, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. বদিউল আলম, ইতিহাসবিদ ড. মুহিবউল্ল্যাহ সিদ্দিকী, প্রাণিবিজ্ঞানী ড. হারুনুর রশিদ, ডাঃ ফাহমিদা রশিদ স্বাতী, রিদোয়ান মোস্তফা টিপু, মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন, আওলাদ হোসেন সাগর, গোলাম কিবরিয়া, মুহাম্মদ ইসহাক, আজিজ মুনির, তৌহিদুল মোস্তফা রাইয়্যান, মোহাম্মদ হোসেনসহ অনেকের নাম উল্লেখযোগ্য।
সার্বিকভাবে মহেশখালীর সমাজ ও সংস্কৃতি সজীব, গতিময় এবং ক্রমাগত রূপান্তরশীল। সংস্কৃতির ভিত্তিতেই সমাজের পরিচয়, সংস্কৃতির মধ্য দিয়েই সমাজের সক্ষমতা ও বিকাশ নির্ধারিত হয়। মহেশখালী এই দিক থেকে পিছিয়ে থাকলেও স্বতন্ত্র সক্ষমতার অধিকারী।
সরওয়ার
কামাল ।। গবেষক ও লেখক
[1] Dil, Afia (2014). Bengli
Language and Culture, Intercultural Forum, California, USA and Adorn
Publication, Dhaka. pp-211
[2] শরীফ, আহমদ (১৯৮৭) বাঙ্গালীর চিন্তা-চেতনার বিবর্তনধারা,
ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ঢাকা। পৃ-১৬-২২
[3]Tylor, Edward B.
(1871). Primitive Culture: Researches into the development of mythology,
philosophy, religion, art and custom (vol.2.). J Murray. pp-1
[4] Bauman, Zygmunt. (2011) Culture
in a Liquid Modern World (translated by Lydia Bauman), Polity Press, Cambridge,
UK. pp-7
[5] Bauman, Zygmunt. (2011) Culture
in a Liquid Modern World (translated by Lydia Bauman), Polity Press, Cambridge,
UK. pp-3
[6]
Bauman, Zygmunt.(2016). Sketches in the Theory of Culture, Polity Press. UK.
Pp-36
[7]
Ahmad, Mushtaque. (1995) Glimpses of Cox’s Bazar, Cox’s Bazar Foundation. Cox’s
Bazar. Pp-19
[8] Ibid. pp-26
[9]
Ibid. pp-19
[10] Manrique,
Fray Sebastien. (1926). Travels of Fray Sebastien Manrique (1629-1643), Vol. 1.
Arakan. Oxford University Press. Pp-94
[11] মিস্টার ক্রফটস, কালেকটর, Collector to the Governor General, 25 June, 1787, B.S.R., C.D.,
Vol, 443, Page-27
[12] সিদ্দিকী, মোহাম্মদ মুহিবউল্ল্যাহ (২০২৪) সমসাময়িক
উৎসে মহেশখালীর ইতিহাস, কক্সবাজার সাহিত্য একাডেমী, কক্সবাজার। পৃ-৩৩
[13]
O’Malley, L.S.S.(1908) Eastern Bengal District Gazetteer, The Bengal
Secretariat Book Depot. Calcutta. Pp-10
[14] Gutman,
Pamela. (2001) Burma’s Lost Kingdoms: Splendours of Arakan, Orchid Press,
Bangkok. Pp-26
[15]
O’Malley, L.S.S. (1908) Eastern BengalDistrict Gazetteers, The Bengal
Secretariat Book Depot. Calcutta. pp-3
[16]
Ibid. Pp-15
Comments