Skip to main content

তত্ত্ববিদ্যার স্বরূপ

সরওয়ার কামাল

জ্ঞানের স্বরূপ, জ্ঞানের সীমা, জ্ঞানের পদ্ধতি, জ্ঞানের নিশ্চয়তা, জ্ঞানের সাথে সত্য ও বিশ্বাসের সম্পর্ক এবং সর্বোপরি জ্ঞান কী, এই সম্পর্কিত দার্শনিক আলোচনাশাস্ত্রের নাম জ্ঞানবিদ্যা। 

ধরুন, আপনি বিশ্বাস করেন, সূর্য পূর্ব দিকে ওঠে। এটা সত্য; সত্য বলেই আপনার বিশ্বাস। আপনি সকালে ঘুম থেকে ওঠে পুর্বদিকে সূর্য দেখে নিশ্চিত হয়েছেন যে, সূর্য পূর্বদিকে ওঠে। প্রাথমিকভাবে আপনি জানলেন, সূর্য পূর্বদিকে ওঠে। এটাই হলো আপনার জ্ঞান।

এখন আমি যদি প্রশ্ন করি, আপনি কীভাবে নিশ্চিত হলেন, সূর্য পূর্বদিকে ওঠে? প্রথমত, আপনি যাকে সূর্য বলছেন, সেটা কি সূর্য? কে বলেছে, তার নাম সূর্য? হাজার হাজার বছর ধরে পৃথিবীর মানুষ বিশেষ একটি নক্ষত্রকে সূর্য বলে ডাকলেই কি তার নাম সূর্য হয়ে যাবে? সূর্যের জন্ম আগে, নাকি মানুষের জন্ম আগে? সূর্য যদি মানুষের আগে জন্ম নিয়ে থাকে, মানুষ কোন অধিকারে একটি নক্ষত্রের ওপর ' সূর্য' নাম আরোপ করে? ( সীমা থাকা উচিত হয়তো!)। আর তাকেই আপনি বলছেন সূর্য? এছাড়া আপনি যে সূর্যকে দেখছেন, তা আপনার দেখার মুহূর্তে কি একই বাস্তবতা ধারণ করে? 

আপনি যেটাকে পূর্বদিক বলছেন, সেটা কোথাকার পূর্বদিক? আপনার ঘরের, এলাকার বা বড়জোর আপনার দেশের পূর্বদিক, তাই না? সূর্য যেখানে অবস্থান করছে, সেখানে কি কোন পূর্বদিক আছে? মহাকাশে, যেখানে মহাজাগতিক বস্তুসমূহ গতিশীল অবস্থায় আছে, সেখানেতো পূর্ব-পশ্চিম নেই। এমনকি আপনার গ্রহ পৃথিবী প্রতিনিয়ত ঘূর্ণমান অবস্থায় আছে। প্রতি সেকেন্ডেইতো দিক পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। 

এরপর বললেন, সূর্য ওঠে। সূর্য ওঠে, ডুবে, এইসব কি হাস্যকর নয়? সূর্য কোথায় ওঠে, আর কোথায় ডুবে? সূর্যতো তার কক্ষপথে পরিভ্রমণরত। তাহলে কেন আপনি বলছেন সূর্য পূর্বদিকে ওঠে?
এতক্ষণে আপনার বিশ্বাসটা নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। এখন আপনি প্রথমে হারালেন আপনার বিশ্বাসের নিশ্চয়তা, তারপর সত্য, এবং পরিশেষে জ্ঞান। কিন্তু এগুলো জ্ঞানের বহিরাংগ। বাইরের দিক। আপনার ভেতর যখন একটি জ্ঞান তৈরি হয় বা আপনি কোন কিছু জানেন তার কিছু ভেতরের দিকও আছে। এতক্ষণ আপনি সূর্যকে জেনেছেন। কিন্তু সূর্যকে আপনি যে মেকানিজমে জেনেছেন, বিশেষ করে আপনার ইন্দ্রীয়সমূহ, স্নায়ুতন্ত্র, আপনার চেতনা ইত্যাদি কোন পদ্ধতিতে বহির্জগতের একটি জিনিষকে জানে তার নির্ভরযোগ্যতা নিয়েও একইরূপ প্রশ্ন আসতে পারে।

আপনার মস্তিষ্কে সূর্য, পূর্বদিক, ওঠা, এইসব নিয়ে যে সংবেদন তৈরি হচ্ছে তা কীভাবে বাইরের বস্তুকে রিপ্রেজেন্ট করে? এতক্ষণ আপনি 'সূর্য' নামের একটি বস্তু সম্পর্কে জেনেছেন কিন্তু সূর্যকে যেভাবে/পদ্ধতিতে জেনেছেন তা জানেননি। অর্থাৎ কোন কিছুকে জানা এবং জানার প্রক্রিয়াটাকে জানা, দুইটা সম্পর্কেই নিশ্চিত জ্ঞান না থাকলে আপনি কোন কিছু জেনেছেন বলে দাবি দাবি করতে পারবেন না।

এরপর আসছে এইসব জিনিসের সত্তাগত দিক, একটি বিশেষ সত্তাসহ অস্তিত্বের দিক। কোন কিছু কেন আছে, না থাকার বদলে? সূর্য কেন অন্যকিছু না হয়ে সূর্য হয়েছে? কিংবা সূর্য নিজেই কেন সূর্যের সত্তা বা অবস্থা প্রাপ্ত হয়েছে? এভাবে কোন কিছু বিশেষ সত্তা নিয়ে অস্তিত্বশীল থাকার বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হলো তত্ত্ববিষয়ক আলোচনা। তত্ত্ববিদ্যা মূলত অধিবিদ্যারই একটি শাখা।

এই ধরনের তত্ত্ববিষয়ক আলোচনায় দুই দিক থেকে আলোচনা করা যায়, নিরেট দার্শনিক ও নিরেট বৈজ্ঞানিক তত্ত্ববিদ্যার আলোচনা। দার্শনিক তত্ত্ববিদ্যায় কোন সত্তার আছেময়তা নিয়ে আলোচনা করা হয়। যেমন, সূর্য আছে। সূর্যের থাকাটা কেমন? সূর্য না থাকার বদলে কেন আছে?


অন্যদিকে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ববিদ্যায় কোন কিছুর থাকা বা অস্তিত্ব সংক্রান্ত তিনটা দিক নিয়ে আলোচনা করা হয়। বস্তু ও বিষয়গত অস্তিত্ব, যেভাবে বা যে অবস্থা নিয়ে থাকে, তা, এবং প্রকৃত জগত। সূর্য নামক কোন নক্ষত্র আছে কিনা, সূর্যের সুর্যাবস্থা বা নক্ষত্রীয় অবস্থাটা কেমন এবং মহাজগতের একটা সত্তা হিসেবে সূর্য কিভাবে অস্তিত্বশীল, এইসব দিক বিবেচনা করা বৈজ্ঞানিক তত্ত্ববিদ্যার আলোচনা। একইসাথে সত্তার স্বরূপ এবং সত্তার বিভিন্ন গুণাবলী এবং অবস্থার সম্পর্ক নিয়ে যেকোন আলোচনা তত্ত্ববিষয়ক আলোচনা। 

খুব মৌলিক পর্যায়ে কোন কিছুর অস্তিত্ব ও আছেময়তা সম্পর্কিত আলোচনা করতে গিয়ে দার্শনিকরা বিশেষ ও সার্বিকের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করেন। যেমন, একটা সূর্য নামক নক্ষত্র এবং মহাজগতের যাবতীয় নক্ষত্রের ধারণা। দুইটার মধ্যে কী সম্পর্ক? এর বাইরে আছে মুর্ত ও বিমূর্ত সত্তার ধারণা। অন্যদিকে সমপরিচয়জ্ঞাপকতা ( আইডেন্টিক্যাল অবস্থা) বা গুণগত অনন্যতা, এবং যে কোন সত্তার ধরনগত সম্ভাব্যতা নিয়েও আলোচনা হতে পারে।   

Comments

Popular posts from this blog

মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার কারণ ও প্রতিকার

সরওয়ার কামাল শিক্ষাক্ষেত্রে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য সাফল্য রয়েছে। সামাজিক উন্নয়ন সূচকেও বাংলাদেশের অবস্থান প্রতিবেশি দেশগুলোর তুলনায় ভালো, যা সম্পর্কে প্রশংসা করে বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন প্রবন্ধ লিখেছেন “ ল্যানসেট ” নামক মেডিক্যাল জার্নালে। কিন্তু এতে আমাদের বগল বাজিয়ে আত্মতৃপ্তিতে ভোগার অবকাশ নেই। কারণ শিক্ষার্থী ঝরে পড়া এবং বিজ্ঞান শিক্ষা সংকুচিত হয়ে পড়া আমাদের সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভুত হয়েছে। শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার কারণে আমাদের শিক্ষার মূল লক্ষ্যগুলো হাসিল হচ্ছে না, যার একটি হলো সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করা, অপরটি হলো শিক্ষাক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় প্রণোদনার ন্যায্য বণ্টন নিশ্চিত করা। অর্থাৎ সব শিশুই যাতে সরকারের সুযোগ ব্যবহার করে উন্নত জীবনের সন্ধান করতে পারে, তার শতভাগ নিশ্চয়তা প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না। শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার বিভিন্ন কারণ রয়েছে, তার মধ্যে বিভিন্ন স্তরের শিক্ষার ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন কারণ রয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার প্রধান কারণ দারিদ্র্য ও অপুষ্টি বা স্বাস্থ্যহীনতা । মাধ্যমিক পর্যায়েও শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার ক্ষেত্রে দারিদ্র্য সমস্যার ...

তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি বিচিত্র ছলনা জালে

তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি বিচিত্র ছলনা জালে ............................................................................... সাম্প্রতিক কালে আমাদের নৈতিক উপলব্ধিতে, সামাজিক উদ্বেগে কিংবা মূল্যবোধে দৃশ্যমান পরিবর্তন এসেছে। প্রযুক্তির নিবিড় ব্যবহার, বিশ্বায়নের প্রভাব, বিশ্বরাজনীতির অভিঘাত, বাজার সংস্কৃতির ধাক্কা ও চরমপন্থী ভাবাদর্শের টানাপড়েনে আমাদের চিরকালীন মূল্যবোধ ভেঙ্গে পড়েছে। নৈতিকতার সীমানা সরে যাচ্ছে প্রথাগত বিশ্বাস ও প্রতিষ্ঠানসংলগ্নতা থেকে। গতিময় জীবনের অভিঘাতে চরম অস্থিরতা ব্যক্তি থেকে ব্যষ্টির ব্যাপ্তিতে বিরাজ করছে। সর্বত্র আহাজারি, শোনার অবসর নিয়ে হাজির নেই কেউ। মানুষ যে নির্বিকার তাও নয়, তারা বিকারগ্রস্থ, পূর্ণমাত্রায় ঘোরগ্রস্থ, কেবল অপ্রত্যাশিত ঘটনাপ্রবাহের সাথে তাল মেলানোতে। তারা এখন এমন সব বিষয়ে আলোড়িত হয়, যে বিষয়ের সাথে তাদের সরাসরি যোগ নেই। থাকলেও তা অনেক ক্ষীণ ও দূরবর্তী কার্যকারণ সম্পর্কে আবদ্ধ। একইভাবে, তারা এমন সব পরিণতি ভোগ করে, যার জন্য তারা নিজেরা দায়ী নয়। আর যারা দায়ী তারা এর পরিণতি ভোগ করেন না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষ বয়সের দিকে এই প্যার...

মহেশখালীর সমাজ ও সংস্কৃতি

সরওয়ার কামাল সাগর কূলে গিরিকুন্তলা মোহিনী মহেশখালী দ্বীপের ৩৮৮ বর্গকিলোমিটার ভূত্বকে প্রায় পাঁচ লক্ষ লোকের বসতি। তাদের বসতি ঘিরে গড়ে উঠেছে উপকূলীয়-দ্বীপাঞ্চলীয় সমাজ। এই সমাজসভ্যদের মানসিক ঐক্য ও জীবনযাপন পদ্ধতি নিয়ে তৈরি হয়েছে শনাক্তযোগ্য বিশেষ স্থানীয় সংস্কৃতি। মানবজাতির চিরকালীন অভিযাত্রার অংশ হিসেবে দেশের নানা জায়গা থেকে হিজরত করে লোকজন এসে বসতি গেড়েছে মহেশখালীতে। তাই তাদের ভাষা ও আচরণে শনাক্ত করা যায় এমন বৈচিত্র্য ও তারতম্য, যা দিয়ে কক্সবাজারের অন্যান্য অঞ্চলের অধিবাসীদের তুলনায় মহেশখালীবাসীকে স্বতন্ত্রভাবে চিহ্নিত করা যায়। যে পার্থক্যসূচক বৈশিষ্ঠ্যাবলী নিয়ে মহেশখালীর সমাজ ও মানুষের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য তৈরি হয়েছে, চাটগাঁইয়া ভাষার উপভাষাতুল্য মহেশখালীর দ্বীপাঞ্চলীয় বুলি তার মধ্যে বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। [1] তবে সমস্যা হলো, লিখিত সাহিত্য ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের অভাবে স্থানীয় ইতিহাসের মতোই কালিক সূচকের নিরিখে এর জনসংস্কৃতি বর্ণনা করা দুরূহ। একেতো সংস্কৃতি স্বয়ং একটি ব্যাপক ধারণা, তদুপরি, এটি সতত পরিবর্তনশীল। ভাষা ও সংস্কৃতি স্রোতস্বী নদীর মতো বহমান। মানুষের কথা, স্মৃতি, পুরা...