সরওয়ার
কামাল
শিক্ষাক্ষেত্রে
বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য সাফল্য রয়েছে। সামাজিক উন্নয়ন সূচকেও বাংলাদেশের অবস্থান
প্রতিবেশি দেশগুলোর তুলনায় ভালো, যা সম্পর্কে প্রশংসা করে বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন
প্রবন্ধ লিখেছেন “ল্যানসেট” নামক মেডিক্যাল জার্নালে। কিন্তু এতে আমাদের বগল বাজিয়ে
আত্মতৃপ্তিতে ভোগার অবকাশ নেই। কারণ শিক্ষার্থী ঝরে পড়া এবং বিজ্ঞান শিক্ষা
সংকুচিত হয়ে পড়া আমাদের সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভুত হয়েছে। শিক্ষার্থী
ঝরে পড়ার কারণে আমাদের শিক্ষার মূল লক্ষ্যগুলো হাসিল হচ্ছে না, যার একটি হলো সবার
জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করা, অপরটি হলো শিক্ষাক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় প্রণোদনার ন্যায্য
বণ্টন নিশ্চিত করা। অর্থাৎ সব শিশুই যাতে সরকারের সুযোগ ব্যবহার করে উন্নত জীবনের
সন্ধান করতে পারে, তার শতভাগ নিশ্চয়তা প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না। শিক্ষার্থী ঝরে
পড়ার বিভিন্ন কারণ রয়েছে, তার মধ্যে বিভিন্ন স্তরের শিক্ষার ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন
কারণ রয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার প্রধান কারণ দারিদ্র্য ও
অপুষ্টি বা স্বাস্থ্যহীনতা। মাধ্যমিক পর্যায়েও শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার ক্ষেত্রে
দারিদ্র্য সমস্যার অভিঘাত রয়েছে, তবে দারিদ্র্য একমাত্র কারণ নয়। এ ক্ষেত্রে
লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য, যৌন হয়রানি, বাসা থেকে স্কুলের দূরত্ব, অনাকর্ষনীয় পাঠ্যবই,
ক্লাসে শিক্ষকের উপস্থিতি ও আন্তরিকতার অভাব, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের মোটিভেশনের
অভাব, ভোগ ও চাহিদা তাড়িত মনোবৃত্তির চাপ, শিশুশ্রম, বাল্য বিয়ে, শিক্ষাব্যয়ের
উর্ধ্বগতি এবং লক্ষ্যহীনতা অন্যতম। মেধা ও দক্ষতাভিত্তিক পেশা নির্বাচনের নিশ্চয়তা
না থাকা এবং চাকুরিক্ষেত্রে মেধার অবমূল্যায়ন, দুর্নীতি ইত্যাদি শিক্ষার্থী ও
অভিভাবকের মনস্তত্ত্বে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এর বাইরেও কিছু সামাজিক-সাংস্কৃতিক
মনস্তত্ত্ব কাজ করে যা শিক্ষার্থীদের আত্মপ্রত্যয়কে ভেঙ্গে চুরমার করে দেয়। ফলে মাধ্যমিক
পর্যায়ে শিক্ষার্থী ঝরে পড়া মোকাবেলা করা অন্যান্য স্তরের তুলনায় চ্যালেঞ্জিং। দারিদ্র্য
সমস্যা একটি ব্যাপক ধারণাগত বিষয়। এর প্রভাবও নানা মাত্রিক। শিক্ষা অর্জনের নানা
স্তরে দারিদ্র্যজনিত প্রতিবন্ধকতা দেখা যায়। পরিবারের অর্থনৈতিক সক্ষমতা থাকলে
শিশুশ্রমের ওপর নির্ভরতা কমে, ফলে শিক্ষার্থীর ওপর উপার্জনের চাপ থাকে না। সেই ক্ষেত্রে শিক্ষার্থী নির্বিঘ্নে পড়াশুনা
চালিয়ে যেতে পারে, কিন্তু দরিদ্র হলে শিক্ষার্থীর ঘাড়ে পারিবারিক উপার্জনের বাড়তি
চাপ পড়ে, ফলে শিশুশ্রমে নিযুক্ত হওয়ার মাধ্যমে স্কুল হতে ঝরে পড়ে। শিক্ষাব্যয়
নির্বাহ করার সক্ষমতা না থাকার কারণেও শিশুর শিক্ষা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। বিশেষ
করে পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে স্বল্প বেতন নিয়ে শিক্ষকরা চলতে পারেন না, তাই কিছু
বাড়তি আয়ের জন্য তারা প্রাইভেট ও কোচিং ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। কোচিং ব্যবসার কিছু
ব্যবসায়িক ও বিপণন নীতি রয়েছে, তার মধ্যে একটি হলো শিক্ষার্থীদেরকে প্রাইভেট পড়তে
বাধ্য করা। এর জন্য কোচিং ব্যবসায়ী শিক্ষকরা ক্লাসে কম পড়ান, অর্ধেক পড়ান কিংবা
খণ্ডিতপাঠ পড়ান। যার ফলে শিক্ষার্থীরা পাঠ অনুধাবনের জন্য কোচিং নির্ভর হয়ে পড়ে।
ফলে যেসব শিক্ষার্থীর প্রাইভেট পড়ার মতো আর্থিক সঙ্গতি নেই তাদের মনে ক্লাস ও শিখন
পদ্ধতির প্রতি বিরূপ প্রতিক্রিয়া জন্ম নেয়। কালক্রমে হতাশ হয়ে পরীক্ষায় খারাপ করে
এবং এক পর্যায়ে ঝরে পড়ে।
লিঙ্গবৈষম্য আমাদের
সমাজে ব্যাপক পরিসরে, নানা মাত্রায় বিরাজমান। ছেলে ও মেয়ের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিগত
পার্থক্য, তাদের পুষ্টি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও নিরাপত্তা প্রাপ্তির মধ্যে ব্যবধান
রচনা করে। এখনো সমাজে ছেলেকে সম্পদ আর মেয়েকে আপদ মনে করা হয়। তাই শিক্ষার
ক্ষেত্রে পারিবারিকভাবে মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের বেশি পৃষ্টপোষকতা দেয়া হয়। ধর্মীয়
জ্ঞানের ভুলব্যাখ্যা দ্বারা প্রভাবিত হয়েও অনেকে নারী শিক্ষাকে অপ্রয়োজনীয় মনে
করে। তাই মেয়েদের বাল্যবিয়ে দিয়ে দেয়। এভাবে বাল্যবিয়েজনিত কারণে শিক্ষার্থীরা ঝরে
পড়ে।
শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার পেছনে
যৌন হয়রানি অন্যতম ভূমিকা রাখছে। বিশেষ করে মাধ্যমিক পর্যায়ে মেয়ে শিক্ষার্থীদের
জন্য এটা জীবন ঝুঁকিও তৈরি করছে। মেয়েরা পথেঘাটে, বিদ্যালয়ে, মোবাইল ও ফেসবুকে,
সর্বোপরি ভার্সুয়াল জগতে যৌননিগ্রহ ও নিপীড়নের শিকার হয়। বখাটেদের ইভ টিজিং,
টেক্সটিং, সেক্সটিং, ভিডিও আপলোডিং ইত্যাদির মাধ্যমে মেয়েরা পদে পদে হয়রানির শিকার
হচ্ছে। এর ফলে তারা স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিচ্ছে। কেউ কেউ আত্মহত্যার পথ বেছে
নিচ্ছে, আবার কেউ দুঃসহ সামাজিক ট্রমাতে ভুগছে। অভিভাবকরাও অনন্যোপায় হয়ে অল্প
বয়সে মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে কিংবা পড়ানো বন্ধ করে দিচ্ছে।
বাসা থেকে স্কুলে
দূরত্ব বেশি হলেও শিক্ষার্থীরা নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার শিকার হয়। যাতায়াতের
ব্যয়, নিরাপত্তা, সময়, শারীরিক কষ্ট সব কিছু মিলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক ধরনের বিতৃষ্ণার জন্ম নেয়, যা শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার জন্য অনুঘটক হিসেবে ভূমিকা রাখে। প্রত্যন্ত
অঞ্চলে নাগালের মধ্যে স্কুল না থাকায় কিংবা স্কুলের অবস্থান অতি দূরে থাকায়
শিক্ষার্থীরা যোগাযোগের সমস্যায় পড়ে।
স্কুলের পাঠ্যবইগুলো
আকর্ষণীয় নয়। বিশেষ করে, ভাষা, গণিত ও বিজ্ঞানের বইগুলো ছাত্রদের কাছে কঠিন ঠেকে। বছরের
পর বছর ধরে একই নিয়মে ইংরেজি শেখার “কমিউনিকেটিভ মেথড” ব্যর্থতায় পর্যবসিত
হয়েছে। ভাষা শিক্ষার সাথে শিক্ষার্থীর কল্পনাশক্তির যোগ না থাকায়, সাহিত্যিক চর্চা
না থাকায় বাংলাদেশে শিক্ষার্থীদের ইংরেজিতে দক্ষতা অর্জন করতে পারছে না। তাই তাদের
কাছে ইংরেজি হয়ে উঠেছে যমের মতো ভয়ংকর এক বিষয়। তারা দিনের পর দিন ঐ বিষয়ে ফেল করার
সম্ভাবনায় আতঙ্কিত হয়ে দিন কাটায়। একদিন সত্যি সত্যি তারা ফেল করে এবং ফেল করতে
করতে ঝরে পড়ে।
শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার
জন্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের মনোভঙ্গি দায়ী। তারা মনে করে
যথেষ্ট হয়েছে, এত বেশি পড়ার দরকার নেই। অযথা টাকা খরচ করে অনিশ্চিত লক্ষে সন্তানকে
ধাবিত করার মানে নেই। আমাদের দেশে একটু পড়াশুনা করলেই ছেলেরা কায়িকশ্রম বিমূখী
হয়ে পড়ে। তাই অভিভাবকরা চান না তার সন্তান অর্ধশিক্ষিত হয়ে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে
একূল ওকূল, দু’কূল
হারাক। কাজেই অদৃশ্যভাবেই অনেক শিক্ষার্থী শিক্ষার মূলধারা থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ছে।
সাধারণ সামাজিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ক্লাসে তাদের অনুপস্থিতি বাড়ছে,
দক্ষতা অর্জন বিঘ্নিত হচ্ছে, পরিণতিতে ঝরে পড়ছে। বর্তমান সময়ে ভোগবাদী প্রবণতা মারাত্মক রূপ
নিয়েছে। সমাজের সব কিছুই পণ্যায়িত হয়ে পড়েছে। ফলে চাহিদা মেটাতে মানুষ হিমশিম
খাচ্ছে। মানুষ এখন নগদ উপার্জন ও উৎপাদনের এক অসাধু প্রতিযোগিতার সম্মূখীন। এর চাপ
পড়ছে পরিবারের শিশু সন্তানটির ওপর। তাকেও নিজের চাহিদা মেটানোর জন্য উপার্জনমূখী
হতে হয়। শিক্ষার্থীরা অল্প বয়সে উপার্জনের পথ খোঁজতে বাধ্য হচ্ছে। জীবনযাপনের
ব্যয় ও চাহিদা মেটাতে গিয়ে অনেক শিক্ষার্থী স্কুলে অনুপস্থিত থাকছে এবং এক পর্যায়ে
ঝরে পড়ছে। কাজেই স্কুলে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার নানা কারণ আছে, যা ব্যক্তি, সমাজ,
অঞ্চল, বয়স, লিংগ, সংস্কার ইত্যাদির ভিত্তিতে ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। শিক্ষার
লক্ষ্য অর্জনে আমাদের যেটা করা দরকার তা হলো, শিক্ষার্থী ঝরে পড়া রোধ করার উপায় বের
করা এবং সেগুলো বাস্তবায়ন করা।
শিক্ষার্থী ঝরে পড়া
রোধ করার জন্য ইতোমধ্যে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, যার সুফল পাওয়া যাচ্ছে।
বিশেষ করে অবৈতনিক শিক্ষা, বিনামূল্যে বই বিতরণ, উপবৃত্তি, স্কুল ফিডিং ইত্যাদির
মাধ্যমে ঝরে পড়া রোধের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু নতুন নতুন সামাজিক বাস্তবতার
সাথে সঙ্গতি রক্ষা করে আরও লাগসই ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়জনীয়তা দেখা দিয়েছে।
শিক্ষার্থী ঝরে পড়া কমানোর জন্য আরও কী কী ব্যবস্থা নেওয়া যায়,
তা অনুসন্ধানের জন্য বেশ কিছু গবেষণা করা হয়েছে। তাদের কিছু সাধারণ সুপারিশ আছে,
যা এখানে প্রণিধানযোগ্য।
১। ক্লাসে তাদের
অনুপস্থিতি দেখে ঝরেপড়া শিক্ষার্থীদেরকে আগেভাগেই চিহ্নিত করতে হবে এবং তাদের
ব্যাপারে খোঁজ খবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে এবং মোটিভেশন দিতে হবে। তাদের
ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সমস্যাগুলো কাটিয়ে তারা কীভাবে পড়াশুনা চালাতে পারে সেই ব্যাপারে পরামর্শ দিতে হবে। এই ক্ষেত্রে তারা যে ধরনের সরকারি-বেসরকারি প্রণোদনা
পেতে পারে তা পাওয়ার পথ বাতলে দিতে হবে। এভাবে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার আগেই
প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। রোগ-বালাই ও স্বাস্থ্য সমস্যার কারণেও
শিক্ষার্থীরা স্কুল হতে ঝরে পড়ছে। বিশেষ করে চিকিৎসা ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণে একটু
জ্বরের চিকিৎসা করতে গিয়েই গরীব লোকজন সর্বস্ব হারিয়ে পথে বসছে। তাই গরীব
শিক্ষার্থীর সরকারি চিকিৎসা সেবা প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। এই জন্য সরকারি
হাসপাতালের পাশাপাশি বেসরকারি হাসপাতালেও গরীব শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা
প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে, যার জন্য নীতিগতভাবে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। সরকারি
হাসপাতাল থাকা সত্ত্বেও এই ধরনের দাবি উঠছে, কারণ, বেসরকারি পুঁজিবাদী স্বাস্থ্য
ব্যবসার কারসাজিতে সরকারি হাসপাতালকে পঙ্গু করে রাখা হচ্ছে, যাতে জনগণ বেসরকারি
সেবা নিতে বাধ্য হয়। এই ব্যবসায়িক নীতির করুণ শিকার গরীব শিক্ষার্থীরা।
২। শিক্ষক ও
শিক্ষার্থীর নিয়মিত ক্লাসে উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে, শিক্ষার্থীর পাঠ অনুধাবন
ক্ষমতার দিকে নজর দিয়ে শ্রেনীশিক্ষক কর্তৃক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। ক্লাসে শিক্ষকের আন্তরিক পাঠদান নিশ্চিত করতে
হবে।
৩। পাঠ্যক্রম ও
পাঠ্যসূচি সুপরিকল্পিত হতে হবে। যোগ্য ও মেধাবি শিক্ষক দ্বারা পাঠ্যবই রচনা করতে
হবে, পাঠ্যপুস্তকের লেখক নির্বাচনের ক্ষেত্রে দলীয় বিবেচনা, স্বজনপ্রীতি ও হঠকারি
ব্যবস্থা নেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। পাঠ্যবই মানসম্মত ও আকর্ষনীয় হচ্ছে কি না
দেখতে হবে। এ ব্যাপারে এনসিটিবি’র গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা রয়েছে। সাহিত্যভিত্তিক ইংরেজি
শিক্ষা চালু করতে হবে, যা শিক্ষার্থীকে ছক বাধা অনুচ্ছেদ পাঠের বিরস অভিজ্ঞতার
বিপরীতে সাহিত্যরসের সঞ্জীবনী প্রণোদনা যোগাবে। বিজ্ঞানের বইগুলো আরও সুখপাঠ্য ও
সহজবোধ্যভাবে রচনা করতে হবে।
৪। যৌন হয়রানি রোধ
করতে হবে। ইভ টিজিং এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মেয়েদের উত্যক্ত করার বিরুদ্ধে
কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। বিদ্যমান আইনি কাঠামোয় মেয়েদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে
হবে এবং প্রয়োজনে নতুন আইন প্রণয়ন করতে হবে। সামাজিকভাবে মেয়েবান্ধব পরিবেশ তৈরি
করতে সচেতনতা বাড়াতে হবে, মানবিক মূল্যবোধ তৈরির দিকে নজর দিতে হবে এবং সমাজে
যৌনতাকেন্দ্রিক অস্থিরতা মোকাবেলার জন্য সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে, যা মেয়েদের
যাতায়াত ও বিচরণকে নির্বিঘ্ন করবে।
৫। শিক্ষা উপকরণের
দাম কমাতে হবে। শিক্ষাকে ব্যবসায়ে রূপান্তরিত করার মানসিকতা কমাতে হবে। বেসরকারি
স্কুলের গলাকাটা ফি কমাতে হবে। গরীব শিক্ষার্থীদের জন্য বেসরকারি স্কুলে বিশেষ ছাড়
ও বৃত্তির ব্যবস্থা নিতে হবে।
৬। যোগাযোগ ব্যবস্থা
উন্নত করতে হবে। অন্যথায় প্রান্তিক অঞ্চলে স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বেসরকারি
সংস্থাগুলো এই ক্ষেত্রে হাত বাড়িয়ে দিতে পারে। সবার কাছে শিক্ষার সুযোগ পৌঁছানো
উচিত। সবার সাধ্যের মধ্যে স্কুল শিক্ষাকে নিয়ে যেতে হবে। অন্যথায় ঝরে পড়া রোধ করা
সম্ভব হবে না।
৭। উপার্জনের
ক্ষেত্রে ধনী-গরিবের ব্যবধান কমাতে হবে। জিডিপি প্রবৃদ্ধির সুফল যাতে সবাই পায় সে
ধরনের সামাজিক নিরাপত্তামূলক পদক্ষেপ নিতে হবে। এতে করে গরীব জনগণ উপকৃত হবে এবং
গরীব শিক্ষার্থীরা শিক্ষার সুযোগ পাবে।
৮। শিক্ষক এবং
অভিভাবকের মধ্যে যোগাযোগ বাড়াতে হবে। শিক্ষার্থীর পড়াশুনা নির্বিঘ্নে চলার জন্য
এবং প্রয়োজনীয় নজরদারি ও যত্নপ্রাপ্তি নিশ্চিত করার জন্য শিক্ষার্থী সম্পর্কে
পর্যাপ্ত তথ্য বিনিময়ের মাধ্যমে পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়ানো দরকার।
৯। শিক্ষাক্ষেত্রে
জাতীয় বাজেট ও বরাদ্ধ বাড়াতে হবে। শিক্ষাকে পণ্য বা বোঝা হিসেবে নয়, একে সেবা এবং
শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্যয়কে বিনিয়োগ হিসেবে দেখতে হবে। শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্যয় বাড়ালে
শুধু শিক্ষার হারই বাড়বে না, আমাদের অনেক সামাজিক সমস্যার সমাধান হবে, যা প্রতিরোধ
করার জন্য আমরা বিভিন্ন খাতে প্রতিনিয়ত অনেক টাকা ব্যয় করি।
১০। প্রাইভেট ও কোচিং
ব্যবসা বন্ধ করতে হবে এবং সেই লক্ষে শিক্ষকের বেতন ও মর্যাদা বাড়াতে হবে, যাতে করে
শিক্ষকরা প্রাইভেট পড়ানো হতে বিরত থাকতে পারে। শিক্ষকদেরকে নৈতিক প্রশিক্ষণ দিয়ে
তাদের মনোভঙ্গি ইতিবাচক করতে হবে। প্রাইভেট এবং কোচিং ব্যবসা যে সামাজিক অবিচারের
পথ খুলে দিচ্ছে, শিক্ষার্থীর মধ্যে মেধা ও
দক্ষতার অন্যায্য বৈষম্য সৃষ্টি করছে, সামাজিকভাবে মেধার তুলনায় অর্থনৈতিক
সক্ষমতার স্বীকৃতি ও পুরষ্কার বৃদ্ধি করছে, তার পেছনে ব্যবসায়ী মনোভাবসম্পন্ন
শিক্ষকগণ দায়ী। এই ধরনের অন্যায্য বৈষম্য উৎপাদনের কর্মে সম্পৃক্ত হওয়া অনৈতিক,
বেআইনি ও মানবাধিকার পরিপন্থী। গরীব শিক্ষার্থীদের মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য
এ ব্যাপারে সমন্বিত ও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।
শিক্ষা জাতীয়
পরিকল্পনার একটি গুরুত্বপুর্ণ দিক। সবার জন্য মানসম্মত ও পরিকল্পিত শিক্ষা নিশ্চিত
করা বড় চ্যালেঞ্জ। তার মধ্যে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, শিক্ষার সমান সুযোগ নিশ্চিত
করা এবং সমাজে শিক্ষার সুফল বয়ে আনা নিশ্চিত করা। তাই শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার
কারণগুলোকে উদ্বেগের সাথে বিবেচনা করে তা প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। এ
ছাড়া যে কোন পরিকল্পনাই কালে কালে সংশোধন, পরিবর্তন ও পরিমার্জনযোগ্য। সামনে এগোতে
হলে নতুন নতুন সমস্যাকে নতুন পরিপ্রেক্ষিত থেকে বিবেচনা করে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।
তাহলে যে কোন সমস্যাই আমরা সফল্ভাবে মোকাবেলা করতে পারব। একইভাবে বিদ্যালয়ে
শিক্ষার্থী ঝরে পড়া রোধের জন্যও আমরা যেক্ষেত্রে যে রকম প্রযোজ্য সে রকম ব্যবস্থা
নিতে পারি। এ ধরনের একটি কম্প্রিহেন্সিভ পথেই আমাদের সফলতা আসবে বলে আশা রাখি।
Comments