উত্তরাধুনিক দর্শন ও সংস্কৃতি
সরওয়ার কামাল
দর্শনের মৃত্যু হয়েছে[1], এ কথাটি নানা জন নানাভাবে
বলতে শুরু করেছেন। বিজ্ঞানীরাতো বলছেনই, খোদ দার্শনিকদের মধ্যে যারা এ ধরনের মত
পোষণ করেন ( যেমন, হাইডেগার )তাদের সংখ্যাও কম নয়। কারণ যেসব প্রশ্নের জবাব খোঁজার
জন্য দর্শনের জন্ম হয়েছে কিংবা চিরকাল ধরে যেসব জিজ্ঞাসা নিয়ে দর্শন ও দর্শনচর্চা বেগবান
হয়েছে, তার উত্তর অনুসন্ধানের নতুন তত্ত্ব ও তথ্যের হাতিয়ার দার্শনিকদের হাতে নেই।
দর্শনের যে রাজপথে দার্শনিকদের অভিযাত্রা চলেছিল তা শেষ পর্যন্ত নানা বিশেষায়িত
চিন্তার অলি গলিতে মিলিয়ে গেছে। সত্তা, সত্তার স্বরূপ, ঈশ্বর, দ্রব্য, প্রকৃতি ও
জগত সংক্রান্ত চিরায়ত দার্শনিক জিজ্ঞাসার
উত্তর খোঁজা এখন দার্শনিকদের আয়ত্ত্বের বাইরে। এসব পুরনো জিজ্ঞাসার বর্ধিষ্ণু
অঞ্চল আজ পদার্থ বিজ্ঞানী ও মহাকাশ বিজ্ঞানীদের দখলে। কোয়ান্টাম মেকানিক্স ও
আধুনিক পদার্থ বিজ্ঞানের নব আবিষ্কার ও তত্ত্বের দ্বারা সরল বাস্তববাদ যেমন
পরিত্যক্ত হয়েছে, তেমনি আধুনিক স্নায়ুবিজ্ঞান , মনোবিজ্ঞান ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা
সংক্রান্ত নতুন চিন্তার বিপরীতে প্রচলিত ভাববাদও অসার প্রমাণিত হয়েছে। মন,
দেহ-মনের সম্পর্ক, আত্মা, চেতনা, এসব এখন এপিজেনেটিক্স , প্রায়োগিক পদার্থ বিজ্ঞান
এবং স্নায়ু বিজ্ঞানের প্রয়োগ ছাড়া ব্যাখ্যা করা অসম্ভব। নৈতিক বিষয়গুলো যত না
নীতিবিদ্যায় আলোচিত হয় তার চেয়ে বেশি আলোচিত হয় আইন, অর্থনীতি ও সমাজ বিজ্ঞানে। নন্দনতত্ত্ব
, নান্দনিক বিষয় ও সৌন্দর্য নিয়ে চর্চা ও নিরীক্ষার জায়গা দর্শনে যতটা সংকুচিত
হয়েছে তার চেয়ে বেশি প্রসার পেয়েছে কবিতা ও শিল্পে। তাই, বলা হয়ে থাকে, এ যুগে
কাউকে দার্শনিক হতে হলে তাকে একই সাথে হতে হবে, একজন প্রথম শ্রেণির বিজ্ঞানী,
দ্বিতীয় শ্রেণির সমাজ বিজ্ঞানী ও কমপক্ষে তৃতীয় শ্রেণির কবি। জীবন ও জগত সংক্রান্ত
জিজ্ঞাসার সর্বাঙ্গীন ও যৌক্তিক ব্যাখ্যা দেয়া দর্শনের কাজ। জ্ঞানের জগতে
সর্বব্যাপী ও সর্বপ্লাবী গমন ছাড়া, মহাবয়ান ছাড়া দার্শনিক ব্যাখ্যা অসম্ভব। কিন্তু
উত্তরাধুনিক সমাজে জ্ঞানের পরিধি এত বিস্তৃতি লাভ করেছে যে ব্যক্তি মানুষের
পক্ষে মহাবয়ান ( Metanarrative ) হাজির
করা দুরূহ। এই দুরূহতা ও অর্থহীন বাহাসের কারণে মহাবয়ান দূরায়ত্ত্ব হয়ে পড়েছে,
কাজে কাজেই মহাবয়ানেরও বিলুপ্তি ঘটেছে। একই কারণে এই ঘরানার ( প্লাতো, আরিস্তোতল,
কান্ট, হেগেল, মার্ক্স ) দর্শনেরও সমাপ্তি ঘটেছে। এখনকার দার্শনিকগণ জ্ঞানের অন্যান্য
শাখা থেকে তথ্য, উপাত্ত ও তত্ত্ব ধার করে এনে যা করছেন তা হলো জ্ঞানতাত্ত্বিক (
Epistemological ) পর্যালোচনা। কার্ল পপারও মনে করেন, দর্শনের মূল কাজ হল জীবন ও
জগত সম্পর্কিত সমস্যার সমাধান দেয়া। তাই বিষয়বস্তুতে আবদ্ধ না থেকে, এসব সমস্যা
সমাধানের লক্ষে জ্ঞান চর্চার স্বার্থে যদি বিষয়সীমা অতিক্রম করতে হয়, তবে তা করাই
বাঞ্ছনীয়[2]। কাজেই অন্যান্য
জ্ঞানকাণ্ডের নব-উৎপাদিত জ্ঞান কতটুকু জ্ঞান, এর সীমা, পরিধি বিবেচনায় রেখে এর
দ্বারা সৃষ্ট প্রত্যয়গুলো নতুন কী সেন্স তৈরি করে তা পরখ করে দেখা সমসাময়িক
দার্শনিকদের কাজ। ফলে Philosophy is the
process of making sense, কথাটি এখন যথেষ্ট গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে।
উল্লেখিত দর্শনহীনতার যুগে পা
দিয়ে জীবন, জগত, সমাজ ও বিশ্ব সংসারের নানা কারবারে লিপ্ত হয়ে মানুষ যেভাবে
বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও সংস্কৃতির ফ্রেমে নিজেদের চিন্তাকে কাঠামোবদ্ধ করে ফেলেছে
তাতে নতুন করে দর্শন বিষয়ক আলোচনার সুযোগ কম। জগতের সবকিছুকে একই চিন্তাসূত্রে
গ্রথিত করে জানার কিংবা সর্বাঙ্গীন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করার ব্যর্থতা থেকে
চিন্তাবিমুখতা জন্ম নিয়েছে যা দর্শনের ক্ষেত্রকে ক্রমাগত সংকুচিত করেছে । এই
সংকোচন ও দর্শন বিরোধিতা দ্বারা চিন্তার বীজতলা বিরাণ ভূমিতে পরিণত হলেও উত্তরাধুনিক
কালে সংস্কৃতি চিন্তার ফলন, ব্যাপ্তি ও পরিসর ক্রমাগত বেড়েছে । উত্তরাধুনিক কালে
সংস্কৃতির যে ধরণ তা নিছক জীবন কৌশল নয়, বরং আধুনিক কালে স্বীকৃতি পায়নি এরকম কিছু
অপ্রচলিত যুক্তি ও জ্ঞানভাষ্যের চর্চা। উত্তরাধুনিক সংস্কৃতি জ্ঞানের এক বিশেষ
ধরন। এই সাংস্কৃতিক যুক্তির উৎসারণ ঘটেছে এক বিশেষ নস্টালজিক আবেগ থেকে। এই দিক
থেকে সংস্কৃতিকে বুঝার জ্ঞানতাত্ত্বিক পর্যালোচনার সাথে সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি ও
মনস্থত্ত্বের বহুমাত্রিক যোগসূত্র রয়েছে। একই সূত্রে সাংস্কৃতিক চিন্তা আমাদের
সামগ্রিক বিষয় ভাবনাকে পরিব্যাপ্ত করে আছে। সে সব সংস্কৃতি বিষয়ক নানা চিন্তা ও
বিশ্লেষণকে দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে পরখ করারও বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। তাই উত্তরাধুনিক
সংস্কৃতি সম্পর্কে আলোকপাত করতে গিয়ে দর্শনের বারান্দায় উঁকিঝুঁকি দিচ্ছি। এছাড়া বাস্তব দুনিয়ার পথে ঘাটে বিচরণের মধ্য
দিয়ে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতাকে তত্ত্বের সাথে মিলিয়ে দেখারও প্রয়োজন মনে করছি। মূল
আলোচনায় প্রবেশ করার আগে উত্তরাধুনিকতাবাদ, উত্তরাধুনিক দর্শন ও সংস্কৃতি সম্পর্কে
সাধারণ ধারণা উপস্থাপন করা যাক।
উত্তরাধুনিকতাবাদ
উত্তরাধুনিকতাবাদ বিংশ শতাব্দির
এক শিল্প আন্দোলন, বিশেষ করে ১৯৬০ এর দশকে পশ্চিম ইয়ুরোপে স্থাপত্য, চিত্রকলা,
ভাস্কর্য ও সংগীতের রূপরীতি নিয়ে ভিন্নতর চিন্তা ভাবনা ও চর্চা থেকে এর উদ্ভব, যা
ক্রমাগত সাহিত্য জ্ঞানতত্ত্ব, দর্শন, বিজ্ঞান, সমাজ বিজ্ঞান, ইতিহাস ও আন্তর্জাতিক
সম্পর্কের ক্ষেত্রে সর্বতোভাবে প্রভাব ফেলেছে। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে সন্দেহবাদ,
দর্শনের ক্ষেত্রে বাস্তবের সমাপ্তি, মহাবয়ানের নিস্কৃতি ও ভাষা কেন্দ্রিকতা,
নৈতিকতার ক্ষেত্রে আপেক্ষিকতাবাদ, আত্মপ্রেম ও ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার উদ্ভব, পরিচয়
সংকটের ক্ষেত্রে নারীবাদের প্রাধান্য, ভোগবাদী সংস্কৃতির প্রাদুর্ভাব ও পন্যায়ণের
মহামারি, কবিতার ক্ষেত্রে লোকজ উপাদান, মোটিফ ও প্রান্তিক শব্দের ব্যবহার,
উপন্যাসের ক্ষেত্রে জাদুবাস্তবতা ও সমাজের ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্নতাবাদের পুনরাবৃত্তি ও
কেন্দ্রবিমুখতার উৎসারণ, সব কিছু মিলে উত্তরাধুনিকতাবাদকে কতগুলো শর্ত ও
বৈশিষ্ট্যের নিরিখে বিচার করতে হয়। অর্থাৎ মানবিক বোঝাপড়ার একটা স্থায়ী মুড হিসেবে
সংস্কৃতি ও সমাজের নানা স্তরে এর জাগৃতি চিহ্নিত করা যায়। উত্তরাধুনিকতাবাদ
শব্দটি দার্শনিক শব্দভাণ্ডারে সংযোজিত হয় ১৯৭৯ সালে যখন জাঁ ফ্রাসোঁয়া লিওতার
বিখ্যাত “ দ্য পোস্ট মডার্ন কন্ডিশন [3]” বইটি প্রকাশ করেন। তবে
ফেদেরিকো ওনিস ১৯৩৪ সালে প্রকাশিত কবিতা সংকলনে আধুনিকতাবাদের প্রতিক্রিয়া হিসেবে
উত্তরাধুনিকতা শব্দটি প্রয়োগ করেন[4]। প্যারিসে উত্তরাধুনিকতার
বীজ রোপিত হয়েছিলো কাঠামোবাদিদের দ্বারা সেই পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে। কাঠামোবাদিরা
আবার মার্ক্স ও ফ্রয়েড দ্বারা প্রভাবিত। মনোবিশ্লেষণ, ভাষা বিশ্লেষণ, ভাষা কাঠামো
এবং সমাজ কাঠামোর নিরিখে মানুষ ও সমাজের বিদ্যমান প্রপঞ্চকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে
লাঁকা, ফুঁকো ও দেরিদা ইমেজতত্ত্ব, ক্ষমতাতত্ত্ব ও বিনির্মাণবাদ নামক নতুন প্রত্যয়
সৃষ্টি করেছেন। এদিকে শিল্পের মূল চর্চা ও বিকাশ পরিলক্ষিত হয়েছে ইতালি ও
ফ্রান্সে। উত্তরাধুনিক ইতালিয়ান শিল্প চেতনা ভিকো ও ক্রোচের নন্দনতত্ত্ব দ্বারা
প্রভাবিত। শিল্পের মধ্যে বিমূর্ত প্রকাশবাদের আবির্ভাব ও চর্চা, নাটক-সিনেমায়
এবসার্ডিটি কিংবা পরোক্ষ দৃশ্যের অবতারণা সব কিছুই উত্তরাধুনিক চিন্তাজাত। এ ধরণের
খন্ড খণ্ড দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা তাড়িত উত্তরাধুনিকতাবাদিদের মধ্যে জার্মান দার্শনিক
য়ুর্গেন হ্যাবারমাসই একমাত্র চিন্তক যিনি উত্তরাধুনিকতাবাদকে সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ
থেকে উপস্থাপন করেছেন। তার মতে আধুনিক সমাজের সাধারণ সংকটের মূলে রয়েছে সমাজের
সাথে সংস্কৃতির বিচ্ছেদ, বিশেষ করে জীবন কৌশলের দিক থেকে। আটপৌরে জীবনের সর্বত্র মূল্য
আরোপ করা এবং সুখবাদি চেতনা প্রবিষ্ট করা উদ্দেশ্যপূর্ণ চিন্তাশীল জীবনের নৈতিক
ভিত্তির সাথে খাপ খায় না[5]। তিনি আধুনিক চিন্তার
বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিপ্রবণতা ও ধর্মনিরপেক্ষতার পাল্টা সন্দেহবাদ ও উত্তর
ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের ওপর জোর দেন।
উত্তরাধুনিক দর্শন
উত্তরাধুনিকতাবাদিদের মূল উদ্বেগ
ও মত্ততা হলো সংস্কৃতি নিয়ে কিংবা শিল্প নিয়ে। তারপরও মানুষের সমসাময়িক কালের নানা
চিন্তার অভিঘাত দর্শনের মূল জায়াগায় না পড়ে থাকে নি। শিল্পের দার্শনিক ও আদর্শিক
মানদণ্ড কিংবা আকার বা কাঠামো নিয়ে যেমন নতুন তত্ত্ব হাজির হয়েছে তেমনি সংস্কৃতির
রূপ, চর্চা, উপস্থাপনা ও পরিচয়ের রাজনীতি নিয়েও মত-মতান্তর রয়েছে। কান্টের
“কোপার্নিকান বিপ্লব” থেকেই দর্শনের ক্ষেত্রে উত্তরাধুনিকতার সৃজনমূলক ও বিচারমূলক
চিন্তার সুত্রপাত ঘটে । কোপার্নিকান বিপ্লবের মূল কথা হল, স্বয়ংসত্তাকে[6] ( Thing in itself ) জানা যায় না, ব্যক্তি অভিজ্ঞতার কাঠামো ও ক্যাটাগরিতে তৈরি হওয়া বোধ
দ্বারা নির্মিত হয় সত্তার জ্ঞান। তাই অধিবিদ্যার ধারনাসমূহ ( আত্মা, ঈশ্বর,
স্বাধীনতা, অমরত্ব ইত্যাদি ) অভিজ্ঞতার মাধ্যমে জানা যায় না। হেগেল মনে করেন,
বিশ্বসত্তার সাথে মানবসত্তার যোগ ছাড়া বিষয় ও বিষয়ীর সম্পর্ক তৈরি হবে না। এ
সম্পর্ক না হলে জ্ঞানের সম্ভাবনাও থাকে না, কারণ জ্ঞানের একটি প্রক্রিয়া হল বিষয়ের
সাথে বিষয়ীর যোগ। মানুষ যদি তার নিজের সত্তাগত আকারে
বা এসেন্সিয়াল ফর্মে না থাকে তাহলে পরমসত্তার সাথে সংশ্লেষের অবকাশ থাকে না। কান্টও মনে
করেন মানুষ নিজের এসেন্সিয়াল ফর্ম হারিয়ে নিজসত্তাকে খুঁজছে। মানুষের মূল স্বভাবের
ওপর সামাজিক ও ধর্মীয় নৈতিকতা আরোপের কারণে মানুষের সত্তাগত আকারের বিকৃতি ঘটেছে। হেগেল
মনে করেন যুক্তির মাধ্যমে মানুষ সেই ফর্ম ফিরে পেতে পারে। তাই
হেগেল যদিও
বিষয় এবং বিষয়ীর সম্পর্ককে কাল্পনিক হিসেবে দেখেন, তিনি সত্তাকে যৌক্তিক চেতনা
হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন, যা বিষয়ীর সাথে বিষয়কে যুক্ত করার একটি অভিন্ন মাধ্যম। তাত্ত্বিক
তরিকা হিসেবে যৌক্তিক কাঠামোর পরিসীমায় চেতনা বা আত্মার সাথে বিশ্বচেতনার বা
বিশ্বাত্মার সম্পর্ক রচনায় আধুনিক দর্শনের আপাত উপযোগিতা রয়েছে। চেতনা যখন যৌক্তিক
আকার পায় তখন তার বিমূর্ততা লোপ পেতে থাকে এবং এক পর্যায়ে তার মূর্তায়ন ঘটে। চেতনার
মূর্ততা লাভের একটি প্রধান মাধ্যম হচ্ছে প্রতীক ও ভাষা। ভাষার পর্যায়ে এসে
চেতনা চিন্তায় পরিণত হয়। এ কারণেই বিশ্লেষণী দর্শনে ভাষা কেন্দ্রিক চিন্তার সূত্র
ধরে জ্ঞান চর্চার ও অধিবিদ্যক জিজ্ঞাসার উত্তর খুঁজতে গিয়ে ভিটগেনস্টাইন সত্তার
শেষ সীমা ভাষায় বলে মন্তব্য করেন। ফলে দর্শনের মূল চিন্তা বাঁক বদল করে ভাব থেকে
ভাষার দিকে ধাবিত হয়। ভিয়েনা সার্কেল ও
ভিটগেনস্টাইনগণ মনে করেন, সমস্ত দার্শনিক সমস্যার বাস্তব ভিত্তি নাই। সমস্যা হচ্ছে
অধিবিদ্যক আলোচনার বিষয়গুলো দ্বারা আসলে আমরা কি বুঝাতে চাই তা নিয়ে। তো সেই সমস্যা
সংজ্ঞায়ন ও ভাষা বিশ্লেষণের সমস্যা ছাড়া কিছু নয়। তাই
দার্শনিকরা যা বলেন এবং বুঝাতে চান তা যদি স্পষ্ট করে বলতে পারেন তাহলে সব সমস্যার সমাধান হয়
। কাজেই দার্শনিক সমস্যার সমাধান যদি খোঁজতে হয় তাহলে তা ভাষার মধ্যে খোঁজতে হবে।
বিশ্লেষণী দর্শন বলি আর হারমেনিউটিক্স বলি সর্বক্ষেত্রে চেতনা ভিত্তিক
প্যারাডাইমের স্থান নিয়েছে ভাষা ভিত্তিক প্যারাডাইম[7]।
হেগেলিয়ান যুক্তিবাদের বিরুদ্ধে
মার্ক্সিয়ান প্রতিক্রিয়া বিবেচনা না নিলে উত্তরাধুনিকতাবাদি দার্শনিক ঘরানা
চিহ্নিত করা কিছুটা জটিল হয়ে পড়ে। হেগেল যেখানে যৌক্তিক কাঠামোতে
বিষয় ও বিষয়ীর সমন্বয় ও সংশ্লেষের কথা
বলেন, মার্ক্স সেখানে প্রতিটি সমন্বয়কে একটি নতুন “নয়” হিসেবে দেখেন, যা
নয়-প্রতিনয়-সমন্বয়ের মাধ্যমে ক্রমাগত ঐতিহাসিক পরিণতির দিকে অগ্রসরমান হবে। তার মতে মানুষের
মুক্তির জন্য যুক্তি নয় বরং মানুষের সচেতন প্রচেষ্টা দ্বারা বিপ্লব দরকার,
বিপ্লবের মাধ্যমে সামাজিক ও ঐতিহাসিক শর্তের দ্বান্দ্বিক বিবর্তনের পরিণতি হিসেবে
মানুষের মুক্তির পথ তৈরি হবে। উত্তরাধুনিকতাবাদিরা মনে করেন,
যুক্তি শুধু মানুষের যুক্তিবাদি সত্তাকে তৃপ্ত করে, মানুষের পরম লক্ষ্য ও
অভীপ্সাকে নয়। উত্তরাধুনিক কালে আপাতভাবে অযৌক্তিক প্রতীয়মান হয় এ রকম অনেক
ব্যক্তিগত ও সামাজিক আচরণের পেছনে রয়েছে নস্টালজিক আবেগ ও বিকল্পযুক্তি ।
হেগেলিয়ান চিন্তার সাথে এডমুন্ড
হুসার্লের চিন্তার একটা যোগসূত্র আছে। হেগেল তাঁর “ফেনোমেনলজি অব স্পিরিট” নামক
গ্রন্থে বিষয় এবং বিষয়ীর সম্পর্ক, বিষয়ীসত্তা কীভাবে বিষয় হয়ে ওঠে তা নিয়ে আলাপ
সেরেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, বিষয়কে জানার পূর্বশর্ত হচ্ছে, বিষয়ীসত্তা কীভাবে বিষয়
হয়ে ওঠে তা জানা। কিন্তু বিষয়ের বা অবভাসের একটি পারিপার্শ্বিক প্রেক্ষিত আছে, তাই
বিশুদ্ধ সত্তাকে জানতে হলে বিষয়ীসত্তা নিজেই নিজের কাছে কীভাবে ধরা দেয় তা জানতে
হবে। তবে তিনি সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন এই বলে যে, যৌক্তিক আকারের বা কাঠামোর ভেতরে
বিষয়ীসত্তা নিজের কাছে নিজে ধরা দেয়। এই বিষয়ীসত্তার অপর নাম, চেতন। তাই ব্যাপারটি
এভাবে বলা যায়, চেতন, চেতনকে চিনে যুক্তির আকার দ্বারা। এদিকে হুসার্ল এই চেতনকে
বিশুদ্ধরূপে জানতে চান। তাই তিনি বিষয় থেকে বিষয়ীকে বা অবভাস থেকে চেতনকে আলাদা
রাখতে চান। শেষ পর্যন্ত সত্তার বিশুদ্ধ স্বরূপ অথবা ভ্রান্তিমুক্ত বিষয়ীসত্তাকে
জানতে অবভাসকে ব্র্যাকেটে বন্ধী রেখে, সত্তার জ্ঞানকে বিশুদ্ধ চেতনে পর্যবেসিত
করার প্রয়াস নেন। তাঁর এই প্রয়াসের অপর নাম, ফেনোমেনলজিক্যাল রিডাকশান।
বিষয়ীসত্তার স্বরূপ বা চেতনকে যুক্তির আকার বা ফর্ম থেকে যদি মুক্তি দিতে হয় ,তবে
ভাষার আবশ্যকতা দেখা দেয়। কিন্তু ভাষা তো শব্দের সমাহার মাত্র আর শব্দতো প্রতীক,
চিহ্ন ও মোটিফের রূপক মাত্র। ফলে শব্দ কীভাবে চেতনকে ধারণ করে কিংবা চেতন কীভাবে
ভাষায় রূপান্তরিত হয় তা জানার প্রয়োজন পড়ে। এই জায়গায় গাডেমার হার্মেনেউটিক্সের
অবতারণা করেন। অর্থাৎ দার্শনিক সমস্যা শব্দতাত্ত্বিক ও ভাষাতাত্ত্বিক পর্যালোচনার
মোড়ে এসে দাঁড়ায়। সুইস ভাষা দার্শনিক সস্যুর, সংস্কৃতি ও ফ্যাশন তাত্ত্বিক রঁলা বার্থ,
কাঠামোবাদি নৃবিজ্ঞানী লেভি স্ত্রস, ভাষা, সংস্কৃতি ও মিথের কাঠামোবাদি ব্যাখ্যা
দেন। তাদের মতে, ভাষা, সংস্কৃতি ও মিথের সুনির্দিষ্ট কাঠামো আছে, আর ভাষার কাঠামো
মানুষের চিন্তার কাঠামোকে নিয়ন্ত্রণ করে। চেতনের হেগেলীয় যৌক্তিক কাঠামো আর
সস্যুরীয় ভাষা কাঠামোর সেতুবন্ধনে চলেছে আধুনিক ও উত্তরাধুনিক দর্শনের ঘটকালি।
উত্তরাধুনিক দর্শনের ফোকাস
দর্শন বিষয়ে উত্তরাধুনিক অভিঘাত অত্যন্ত
স্পষ্ট পড়েছে সত্য ও সত্তা বিষয়ক চিন্তাতে। উত্তরাধুনিকতাবাদিরা মনে করেন
পরম সত্য বলতে কিছু নেই। সব সত্য আপেক্ষিক। ব্যক্তিনিরপেক্ষ
নৈর্ব্যক্তিক সত্য নেই। সব সত্যই
ব্যক্তিক সত্য । তাই সত্য এক নয়, একাধিক। আবার একই
সত্যের রয়েছে নানা দ্যোতকতা। উত্তরাধুনিকতাবাদিরা অধিবিদ্যার সমাপ্তি ঘোষণা
করেছেন। তাদের মতে “ জ্ঞান বিজ্ঞানের সকল শাখায় মানব জাতি এত উন্নতি লাভ করেছে এবং
প্রকৃতিও এখন এতটাই বিকশিত হয়েছে যে, সব কিছুর দিকে সব দিক দিয়ে তাকাবার- সার্বিক
দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বনের- কোন সুযোগ আর মানুষের নেই”[8] । তাই
মহাবয়ানেরও দিন শেষ। ফলে অনুধ্যানমূলক দর্শন ,ধর্ম ও ভাবাদর্শের দিন শেষ। অথচ তাদের অধিবিদ্যা বিরোধী চিন্তা
সমূহ শেষ পর্যন্ত অধিবিদ্যা ও মূল্যবিদ্যায় স্থিত হয়। কারণ উত্তরাধুনিক চিন্তার
বৈকল্পিক আবেগ, যুক্তি ও জ্ঞানভাষ্যের জ্ঞানতাত্ত্বিক নিশ্চয়তা প্রতিপাদনের জন্য যে
তৎপরতা চলছে, তা ঘুরে ফিরে একই জায়গায় প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষায় আছে। ফলে উত্তরাধুনিকতাবাদিদের
দর্শন বিমুখতা শেষ পর্যন্ত দর্শন অভিমুখি হয়ে পড়ে।
দার্শনিক নিৎসের নিরীশ্বরবাদি
দর্শনের গোড়ায় রয়েছে “ প্রকৃত বাস্তবের” ( real world ) অসত্যতা সংক্রান্ত বিশ্বাস।
নীৎসিয়ান ভাবনাবীজ দ্বারা প্রভাবিত হন জাঁ
বদ্রিলার। তাই বদ্রিলার মনে করেন বাস্তব বলতে কিছু নাই, সব নির্মিতি। এই কৃত্রিম
নির্মিতির প্রক্রিয়া সম্পাদিত হয় উপস্থাপনার কলা কৌশল দ্বারা। অর্থাৎ কে, কিভাবে,
কাকে, কীসের মাধ্যমে উপস্থাপন করে তার ভিত্তিতে তৈরি হয় বাস্তবের এক মেকি বাস্তব।
এই মেকি বাস্তবের অপর নাম অতিবাস্তব[9]। অতিবাস্তব
তৈরি হয় হাইব্রিড আকারে। বাস্তব ও অবাস্তবের বাইনারিতে হাইব্রিডিটির স্থান, যা
সত্ত্বাগতভাবে পরম না আবার নতুনও না, বরং এ দুয়ের মাঝামাঝি । উত্তরাধুনিক
সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এর ব্যাপক উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়। বিশেষ করে হোমি ভাবা
হাইব্রিডিটির বহুপ্রজ নির্মিতির মাঝে সংস্কৃতির অবস্থা বিচার করেছেন । এদিকে জাঁক
দেরিদা তত্ত্বের, টেক্সটের ও বাস্তবের বিনির্মানের ধারণা উপস্থাপন করেন। তার মতে
টেক্সটের কন্টেক্সট বা প্রেক্ষিত আছে , আর আছে সাব টেক্সট। তাই টেক্সটের এক এক
পাঠে একেক অর্থ নির্মিত হবে। যেমন, “বল” কে “লব” আকারে বিনির্মাণ করলে এর অর্থ
পাল্টে যায়, তেমনি “কলম” ( লিখনী )কে “কমল” ( পদ্মফুল ) হিসেবে বিনির্মাণ করলে
অর্থ বিচ্যুতি ঘটে। প্রতিটি টেক্সট এ ধরণের শব্দ ও ভাষা নির্ভর বলে টেক্সটকে
বিনির্মাণ করে এর অর্থ ও বোধকে বদলে দেয়া যায়। বোধকে বদলে দিলে মূল্যবোধ বদলে যায়,
হোক তা সামাজিক, ধর্মীয় বা নৈতিক। এভাবে যেকোন আখ্যানকে বিনির্মাণ করা যায়। আখ্যান
যদি বিনির্মাণ করা সম্ভব হয় তাহলে পুরো বিশ্বব্যবস্থা বিনির্মাণ করা সম্ভব। আত্মপরিচয়ের
ক্ষেত্রে পুরুষকেন্দ্রিকতার সমাপ্তি ও নারীবাদের উদ্ভব উত্তরাধুনিকতাবাদের উল্লেখযোগ্য
লক্ষণ। বিশেষ করে লুস ইরিগারে এবং জুডিত বাটলার পশ্চিমা অধিবিদ্যার পুরুষতান্ত্রিক
জ্ঞানকেন্দ্রিকতার স্বরূপ উম্মোচন করেন। লিঙ্গভিত্তিক চিহ্নের মাধ্যমে ব্যক্তির আত্মপরিচয়
নির্মাণের তরিকা ভ্রান্তিপুর্ণ। ইরিগারে নারীকে মানুষ নয় নারী হিসেবে বিচার করেন,
অন্য দিকে বাটলার নারীকে লৈঙ্গিক আত্মপরিচয়ের দ্বারা নয় বরং চর্চা ও স্বভাবগত দিক
থেকে বিচার করেন।
উত্তরাধুনিক সংস্কৃতি
উত্তরাধুনিক সংস্কৃতি নিয়ে আলোকপাত করার আগে
সংস্কৃতির সংজ্ঞা পাড়ি। ব্রিটিশ নৃবিজ্ঞানী টেলরের মতে, সংস্কৃতি হল “ সমাজের
সদস্য হিসেবে মানুষ জ্ঞান, বিশ্বাস,
শিল্প, আইন, নৈতিকতা, প্রথাসহ যে সক্ষমতা ও অভ্যাস রপ্ত করে তার জটিল সমাহার”[10]। মানুষ দৈনন্দিন জীবনে
সক্ষমতা দেখানোর জন্য এবং টিকে থাকার জন্য সংস্কৃতির অনিবার্যতা রয়েছে। সে দিক
থেকে সংস্কৃতি মূলত মানুষের বেঁচে থাকার কৌশল। আমরা যে উত্তরাধুনিক সংস্কৃতির কথা
বলছি তাকে কতগুলো লক্ষণ দ্বারা চিহ্নিত
করতে পারি। তবে আধুনিক সংস্কৃতির সাথে তার মূল পার্থক্য চিন্তাগত ও দার্শনিক
ভাবনাগত বিশ্বাসের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আধুনিক সংস্কৃতির মূল লক্ষণ হল,
যুক্তিবাদ, বিজ্ঞানমনস্কতা, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, কেন্দ্রিকতাবাদ, যূথবদ্ধতা
ইত্যাদি। উত্তরাধুনিক সংস্কৃতির মূল লক্ষণ ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা,
উত্তর-ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, বিজ্ঞানের প্রতি সন্দেহবাদ, বিচ্ছিন্নতাবাদ,
বিকেন্দ্রিকতাবাদ, লোকজ ও প্রান্তিকতার উত্থান, হাইব্রিডিটি, কর্পোরেটসংস্কৃতি,
পণ্যায়ন ও ভোগবাদিতা ইত্যাদি। উত্তরাধুনিক সংস্কৃতির বিচিত্র অনুষঙ্গ ব্যাপক
পরিসরে আলোচনার দাবি রাখে। তাই কম বাক্য ব্যয়ে স্পষ্টতর ধারণা উপস্থাপনার দিকে
মনোযোগ দেয়ার লক্ষে উত্তরাধুনিক সংস্কৃতির প্রপঞ্চগুলো সম্পর্কে আলোকপাত করতে চাই।
অতিবাস্তবতা ও নির্মিতি
উত্তরাধুনিক সংস্কৃতির
উল্লেখযোগ্য লক্ষণ হল বাস্তবতার বিলুপ্তি ও অতিবাস্তবতার নির্মিতি। বাস্তবতার
বিলুপ্তির অন্যতম কারণ হল, কোয়ান্টাম মেকানিক্সের আবিষ্কার এবং আধুনিক পদার্থ
বিজ্ঞানের নতুন তত্ত্বের বিকাশ। আমরা বাস্তবকে যেভাবে দেখি বা জানি, বাস্তব সে রকম
নয়। হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা নীতি জানার পর পদার্থকে স্থির বলে মনে করারও কোন কারণ
নাই। তাই সরল বাস্তববাদের বিলুপ্তি ঘটেছে, অর্থাৎ সরল চোখে, পঞ্চইন্দ্রিয় দ্বারা
বস্তুকে জানার, বাস্তব অভিজ্ঞতাকে জানার দিন শেষ । তবে বাস্তবকে জানা
অসম্ভব হলেও বাস্তবের আপাত নির্মিতি চলছে। বাস্তবকে, সত্যকে, ঘটনাকে বিশেষ
উপস্থাপনার মাধ্যমে নির্মাণ করা হয়। আমাদের নিজেদের প্রয়োজন ও উদ্দেশ্য হাসিলের
জন্য এই নির্মিতি চলছে । এ সময়ে বাস্তবতা নির্মানের অন্যতম হাতিয়ার হল মিড়িয়া এবং
ক্ষমতা। ক্ষমতার কথা পাড়লে ক্ষমতাকেন্দ্র এবং নিয়ন্ত্রণের কথা আসে । ক্ষমতা দ্বারা
জ্ঞানকে, জ্ঞান উৎপাদনের হাতিয়ারকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। বর্তমান উত্তরাধুনিক যুগে
তাই জ্ঞান যা ক্ষমতা দ্বারা নিয়ন্ত্রিতভাবে উৎপাদন করা হয়। কাজেই হবসের “ জ্ঞানই
শক্তি” উত্তরাধুনিক সমাজে ফুকোর হাতে বিনির্মিত হয়ে “শক্তিই জ্ঞান” এ রূপান্তরিত
হয়েছে । ফলে মিড়িয়া আমাদের সামনে যা / যাকে,
যেভাবে, উপস্থাপন করে তা আমরা বিনা বিচারে হুঁশ জ্ঞান হারিয়ে গিলি। আর সেই
মিড়িয়া নির্ভর কৃত্রিমভাবে নির্মিত সত্যকে
প্রকৃত সত্য বলে কবুল করে বসি। কৃত্রিমভাবে সত্য নির্মাণের জন্য ক্ষমতাবানদের
বিশেষ কৌশল রয়েছে। যেমন, উত্তর ঔপনিবেশিক যুগে বিশ্বের নানা প্রান্তে জ্ঞান
উৎপাদনের মুদির দোকান খোলা হয়েছে যার ভদ্র নাম এরিয়া স্টাডিজ সেন্টার। এসব জ্ঞান
চর্চা ও উৎপাদন কেন্দ্রে কাড়ি কাড়ি টাকা ঢেলে সম্মান, স্বীকৃতি ও অর্থের জালে ফেলে
গরিব দেশের মেধাবি ছাত্রদের টানা হয়, আর তাদের মগজ খরচ করে পশ্চিমা ছাঁচে নতুন
জ্ঞান তৈরি করা হয়। এই উদ্দেশ্যপূর্নভাবে নির্মিত
সত্য সেসব গরিব ও অশিক্ষিত মানুষের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়, যেখান থেকে এর তরুণ
নির্মাতারা উঠে এসেছেন। বিনির্মানের মাধ্যমে তথাকথিত নির্বাক ও বোবা [11]মানুষের পক্ষ হয়ে যারা কথা
বলা শুরু করেছেন তারাও প্রকারান্তরে জ্ঞানের ঠিকাদারি ব্যবসা করেন মাত্র । কারণ
তাঁদের জ্ঞান চর্চা, উৎপাদন, বিতরণের সাথে পশ্চিমা ক্ষমতা কেন্দ্রের পোষক –পোষিত (
Patron- client ) সম্পর্ক বিদ্যমান, যা তাদের এজেন্টদারি কারবারের নানা ছুতোয় প্রকাশ
পেয়ে যায়।
হাইব্রিডিটি
উত্তরাধুনিক সংস্কৃতির একটি
প্রধান লক্ষণ হল হাইব্রিডিটি। হাইব্রিডিটি শব্দবন্ধটি জীববিজ্ঞানে উৎপাদন ও
প্রজননের ধরণ হিসেবে আলোচিত হয়। দুটি ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির সংকরায়নের মাধ্যমে মূল
জেনেটিক বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করে নতুন সারসত্তা সম্পন্ন বহুপ্রজ সংকর প্রজাতি তৈরির
ধরণকে বলা হয় হাইব্রিডিটি। তবে এর প্রাসঙ্গিকতা ও প্রয়োগ উত্তর ঔপনিবেশিক অধ্যয়নের
ক্ষেত্রে উপনিবেশি ও উপনিবেশিত নামক বাইনারি থেকে উৎসারিত হয়ে সাংস্কৃতিক ও
রাজনৈতিক বিচ্যুতির প্রতীতি আকারে চর্চা ও ব্যবহৃত হয়। সাংস্কৃতিক হাইব্রিডিটির
বহুবিদ প্রকাশ রয়েছে। গানের ফিউশন, বিশেষ করে লোক সঙ্গীতের সাথে পশ্চিমা জ্যাজ
মিউজিকের ফিউশন, একই ব্যক্তির একই সময়ে নানা সংস্কৃতির পোশাক পরিধান, না পড়ে
পণ্ডিত, না জেনে জ্ঞানী হওয়ার শুনা কথার জ্ঞান, এক পেশার প্রশিক্ষণ নিয়ে আরেক
পেশার দক্ষ বিশেষজ্ঞ বনে যাওয়া, কপি এন্ড পেস্ট কৌশলে রাতারাতি বনে যাওয়া
সাংবাদিক, গবেষক, উকিল, পেশাদার শ্রেণির উদ্ভব ইত্যাদির মাধ্যমে হাইব্রিডিটির বহুমুখী
ও বহুপ্রজ চর্চা দেখা যায়। বর্তমান বিশ্বগ্রাম ধারণার সাথেও
হাইব্রিড সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক রয়েছে। মূল কথা হলো একাধিক ভিন্ন সংস্কৃতি
ও চর্চার যোগসাজসে সংকরায়িত নতুন সংস্কৃতি ও চর্চার উদ্ভব যা মূলকে এবং প্রকৃত
সত্ত্বাকে বিকৃত করে ফেলে, তার চর্চাই হাইব্রিডিটি[12]।
মিমিক্রাই
হোমি ভাবা তার “দ্য লোকেশন অব
কালচার” নামক বইয়ে হাইব্রিডিটির সাথে মিমিক্রাইয়ের ধারণা উপস্থাপন করেছেন[13]। দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিশ্বব্যবস্থায় উপনিবেশিত ও উপনিবেশি শক্তির দ্বি-অক্ষীয় সম্পর্ক থেকে
জন্ম নেয়া হাইব্রিড সংস্কৃতিতে মিমিক্রাই বা অনুকৃতি আকারে ছদ্মবেশি পশ্চিমা
তত্ত্বের, জ্ঞানের, সংস্কৃতির, প্রশাসনিক প্রতিষ্টানের নকল রূপ পরিদৃশ্যমান হচ্ছে।
নকল অনুকৃতির প্রাকৃতিক চর্চা আছে ভিন্ন প্রজাতির সম্পর্কের মধ্যে যেখানে ভিন্নতর
প্রজাতির মধ্যে তথ্য যোগাযোগ বা নির্ভরশীল জীবনের স্বার্থে অঙ্গগত ছদ্মবেশ বা
আঙ্গিক সাদৃশ্য তৈরি হয়। একটি মূল গাছের ওপর জন্ম নেয়া পরগাছা নিজের অঙ্গগত
সাদৃশ্য দ্বারা হোস্ট গাছের সাথে নিজের জীবন ও নিয়িতিকে মানিয়ে নেয়। বাইরে থেকে
আপাতভাবে একই শেকড়ের রস পান করলেও তারা ভিন্নতর প্রজাতি। মূলগাছের অনুকৃতি করতে গিয়ে
পরগাছা যেমন নিজের স্বকীয় উৎপাদন ও জীবন প্রণালি ভুলে যায়, তেমনি ঔপনিবেশিক শক্তির
অনুকৃতি করে, তাদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে বিলেতি গণতন্ত্র, সংবিধান, সিভিল সোসাইটি
ইত্যাদি আমদানি করে উপনিবেশিত জনসমাজ নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে নিজের ক্ষমতা, সৃজনশীলতা
ও টিকে থাকার সক্ষমতা ভুলে যায়। উত্তর-ঔপনিবেশিক দেশ হিসেবে বাংলাদেশও শয়ে শয়ে
পশ্চিমা অনুকৃতি আঁকড়ে আছে। এসব নকল ইমিটেশন মূল দেশে যেভাবে কাজ করে বা যে
তাৎপর্য নিয়ে বিরাজ করে তার মতো নাম থাকলেও এই দেশে সেভাবে কাজ করে না। তাই এ ধরনের অনুকৃতি
শেষ পর্যন্ত আমাদের অক্ষমতার ও অযোগ্যতার স্বাক্ষর বহন করে। এসব অনুকৃতি শুধুমাত্র
ঔপনিবেশিক শক্তির সাথে সম্পর্ক রচনার এজেন্ট হিসেবে কাজ করে। ফলে পশ্চিমের অনেক
ভাল প্রতিষ্টানের দেশি অনুকৃতি প্রহসনের বিষয়ে পরিণত হয়। উত্তরাধুনিক সংস্কৃতিতে
নতুন প্রতিষ্ঠানের, জ্ঞানের, প্রকল্পের উদ্ভাবন না থাকলেও অনুকৃতির অভাব নেই।
প্রযুক্তিগত পণ্য থেকে শুরু করে ধারণা, উপস্থাপনা, চর্চা সব কিছুতেই আমরা সীমাহীন
অনুকৃতির মাঝে দিনাতিপাত করছি। অনুকৃতির মাধ্যমে আসলের নকল কপি বৃদ্ধি করা গেলেও
নকল কখনও আসলের মর্যাদা পায় না। ফ্রানয ফানোঁ তাঁর “ ব্ল্যাক স্কিন, হোয়াইট মাস্ক”
গ্রন্থে কালো লোকের সাদা মুখোশ পরাকে এক ধরনের অনুকৃতি হিসেবে বিবেচনা করেন[14]। কৃষ্ণাঙ্গ
পপ শিল্পী প্রয়াত মাইকেল জ্যাকসনের কসমেটিক সার্জারির মাধ্যমে সাদা বনার প্রচেষ্টাও
অনুকৃতির প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
ভোগবাদিতা ও পণ্যায়ন
ভোগবাদিতা ও পণ্যায়ন হলো
উত্তরাধুনিক সংস্কৃতির অন্যতম লক্ষণ। ভোগবাদিতার মূল কথা হলো মানুষ মূলত ভোক্তা,
আমরা যত ভোগ করতে পারি তত বাজার চাঙ্গা হবে, বাজার চাঙ্গা হলে অর্থনীতি চাঙ্গা
হবে, অর্থনীতি চাঙ্গা হলে পণ্যের চাহিদা ও যোগান বাড়বে। ভোগবাদিতার আরেকটি দিক
হলো, ভোগেই প্রকৃত সুখ, ত্যাগে নয়। ভোগের সাথে বর্তমানের ও বস্তুবাদিতার সম্পর্ক
রয়েছে। ব্যক্তির আয় থাকুক না থাকুক তাকে ভোগের দিকে প্রলুব্ধ করতে ক্রেডিট কার্ড,
কনজুমার লোন দেয়া হচ্ছে, ফলে প্রচ্ছন্ন ভোক্তাও নগদ ভোক্তায় পরিণত হয়। এই ধরণের
ভোক্তার চাহিদা মেটাতে পর্যাপ্ত যোগানের দরকার। চাহিদার চাপ সামলাতে গিয়ে মানুষের
চিরায়ত সেবা, প্রেম, আত্মীয়তা, মানবতা থেকে শুরু করে খড়কুটো পর্যন্ত সব কিছুই
পণ্যে পরিণত হয়েছে। মানুষের, রূপ, যৌনতা, বিবেক, আধ্যাত্মিকতা, সতীত্ব, দেশপ্রেম
সব কিছুই এখন টাকার বিনিময়ে বিক্রি হয়। রূপের ব্যবসার একটি প্রধান লক্ষণ হিসেবে
রাস্তার মোড়ে মোড়ে বিউটি পার্লার, জেন্টস পার্লার আর জিমের ছড়াছড়ি পরিলক্ষিত হচ্ছে। জাতীয় প্রতীক, ঐতিহ্য,
পুরাণ ও মিথ, জাতীয় আবেগ সবকিছুই আজ ব্যবসায়িক পণ্য। বহুজাতিক কোম্পানির
পণ্যের বিজ্ঞাপনে জাতীয় আবেগ ও ঐতিহ্যকে জিঙ্গেল ও শ্লোগানরূপে উপস্থাপন করা হয়।
মানবিক সম্পর্কের আবেগিক দিকগুলোর উদ্দেশ্যপূর্ণ দৃশ্যায়ন এবং বিজ্ঞাপনের বাজারে
সেই সম্পর্কের ফর্মকে উচ্চ মূল্যে বিক্রি করে পুঁজিবাদীরা মূর্ত থেকে বিমূর্ত
বিষয়েও মূল্য সংযোজন করছে। এভাবে, সব কিছুতেই পুঁজিবাদী গ্রাসের ছোবল পড়েছে। ভোগবাদিতা
ও পণ্যায়নের উদাহরণ দিতে গেলে শেষ করা যাবে না। কিছুদিন আগে আমেরিকাতে এক তরুণী
তার সতীত্ব নিলামে তুলেছেন। সতীত্ব ব্যাপারটি চিরকালই এক অনুপম পবিত্র, গোপন ও
ঐশ্বরিক মর্যাদার বিষয় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে এসেছে, কিন্তু উত্তরাধুনিক কালে এই
পর্যায়ের একটি মানবিক মর্যাদাকে বাজারি পণ্যে রূপান্তর করা সাধারণ মানুষের অভ্যস্ত
আবেগ-অনুভূতিতে তীব্র ধাক্কা দিয়েছে। মানুষের শরীর ও মন সব কিছু নিয়েই
ব্যবসা হচ্ছে। মানুষের অঙ্গ বিক্রি, বিশেষ
করে কিডনি, চোখ, লিভার, চুল, দাঁত থেকে শুরু করে হালে বীর্য বিক্রি পর্যন্ত কোন কিছুই বাদ যাচ্ছে না। বীর্য
বিক্রিকে কেন্দ্র করে ভারতে হাসপাতাল ব্যবসা জমজমাট হয়েছে। একে ভদ্রভাবে চিকিৎসা
পর্যটন বলে অভিহিত করা হচ্ছে। সন্তান জন্মদানে অক্ষম পিতা/মাতার জন্য সারোগ্যাট মা
( ভাড়াটে পোয়াতি ) জোগাড় ও শুক্রাণু উৎপাদনের হিড়িক পড়ে গেছে। সম্প্রতি
নাইজেরিয়াতে মানব শিশু উৎপাদনের ব্যবসায়িক খামারের খবরও পাওয়া গেছে যেখানে
নারীদেরকে জোর পূর্বক গর্ভ ধারণে বাধ্য করা হয় সন্তান উৎপাদনের জন্য, আর সে
সন্তান, সন্তানহীন বাবা-মাদের কাছে ব্যবসায়িকভাবে বিক্রি করা হয়।
আত্মপরিচয়ের সংকট
উত্তরাধুনিক সমাজে পুরুষতান্ত্রিকতার
অবসান হচ্ছে, সে সাথে পুরুষের ক্ষমতা চর্চার সমস্ত উপকরণ ও ক্ষমতা কাঠামো বদলে
যাচ্ছে। জ্ঞানের সমস্ত ক্যাটাগরির ব্যবধানের দেয়াল পাতলা হচ্ছে, আর পুরুষ ও নারীর
লৈঙ্গিক ভেদ মুছে যাচ্ছে। পুরুষবাদি আদর্শে নির্মিত নারীর বিষয়ীকে ( subject ) নিনির্মাণ
করার মাধ্যমে গড়ে উঠছে আরেক নতুন বিষয়ীসত্তা, যা পুরুষের দ্বারা নির্মিত পুরনো
নারীসত্তাকে এবং তার উপস্থাপনা ও জ্ঞানকে চ্যালেঞ্জ করতে সক্ষম। নারীকে চিরকালই
গৌণ ও পুরুষের অধীন বলে ভাবা হয়েছে, ফলে পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতা চর্চার ক্ষেত্র
হিসেবে নারীর সমাজ, মন, শরীর থেকে শুরু করে নারীর বিমূর্ত ভাবনাকেও বিশেষ জায়গা বা
স্পেস হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে, কিন্তু আজ সেই রৈখিক চিন্তার ও একতরফা নির্মিতির
দিন শেষ হয়েছে। নারীকে কীভাবে, কী রকম হয়ে
ওঠতে হবে তার বিপরীত অনুপাতে নির্ধারিত হয় পুরুষের পরিচয়। নারী পুরুষের জায়গায় চলে
আসলে পুরুষ আর আগের জায়গায় থাকে না। বিশেষ করে পুরুষের পরিচয় ও সত্তারও রূপান্তর
ঘটে যায়। পুরুষ ও নারীর তরল পরিচয়ের কারণে এক ধরনের লৈঙ্গিক সমতার অবকাশ দেখা দেয়।
পুরুষের মধ্যে নারীভাব আর নারীর মধ্যে পুরুষভাবের উপস্থিতি দেখা দেয়, যা নারীর
পোশাকে পুরুষ আর পুরুষের পোশাকে নারীর উপস্থাপনের ভেতর দিয়ে দৃশ্যমান হচ্ছে। পুরুষের
কানে দোল, হাতে ব্রেসলেট কিংবা নারীর গায়ে হাওয়াই শার্ট আর হাফ প্যান্ট; পুরুষের
মেট্রোসেক্সুয়ালিটির চর্চা সব কিছুই উত্তরাধুনিক সংস্কৃতির লক্ষণ।
মনস্থাত্ত্বিকভাবেও নারী পুরুষের অভিন্ন সত্ত্বার জায়গা অনুভূত হচ্ছে। তাই সমাজ ও
বাস্তবতাকে এক ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার প্রচেষ্টা চলছে। আমরা ফরহাদ মজহারের
কবিতায় এ রকম উত্তরাধুনিক ভাবনার প্রকাশ দেখি...
লক্ষ্য কর এ
কবিতার মধ্যে নারী নেই,
পুরুষ নেইআমার যে নারী সে পুরুষ
এবং যে পুরুষ সে একই সঙ্গে নারী
লক্ষ্য কর কবিতা পুরুষের মতো ভালবাসে
এবং নারীর মতো ভালবাসা গ্রহণ করে
এবং একই সঙ্গে এ কবিতা নারীর মতো ভালবাসে
এবং পুরুষের মতো ভালবাসা গ্রহণ করে।
আমার ভালবাসা একই সঙ্গে নারী
এবং একই সঙ্গে পুরুষ
লক্ষ্য কর, মেহেরজান
এ কবিতা অন্যসব কবিতার মতো নয়।
ফরহাদ মজহার ( আমাদের ভালবাসা মেহেরজান )/ অকস্মাৎ রপ্তানীমুখী নারীমেশিন[15]।
সমকামিতা
আত্মপরিচয়ের সংকট ও লৈঙ্গিক সমতার
একটি বহুল চর্চিত কিন্তু বিতর্কিত সামাজিক প্রপঞ্চ হলো সমকামিতা। ভিন্ন লিঙ্গের
ব্যক্তির মধ্যে যৌন সম্পর্ক হবে এটা একটি আধুনিক সভ্য ধারণা। যৌনতাকে আদিপাপ
হিসেবে চিহ্নিত করার ক্রিশ্চিয়ান জ্ঞানভাষ্যকে চ্যালেঞ্জ করে সমকামিতার পক্ষে কথা
বলছেন উত্তরাধুনিকতাবাদিরা। কারণ আধুনিকতার ক্রিশ্চিয়ান প্রকল্পে সমলৈঙ্গিক যৌনতা
চর্চার কারণে স্বাভাবিক যৌনতা চর্চার বেশ কিছু ধরণ প্রান্তবর্তী হয়ে পড়ে। দ্বিলৈঙ্গিক
যৌনতার কারণে প্রাকৃতিকভাবেই কিছু মানুষ, সামাজিক বর্গ, প্রচলিত বাইনারির বাইরে
পড়ে যায়। এ ধরনের লিঙ্গীয় পরিচয় ও যৌনতা চর্চার কারণে ব্যক্তির মানবাধিকার, নাগরিক
অধিকার, স্বাধীনতা ও সামাজিক মর্যাদার হানি ঘটে। বর্তমান পুঁজিবাদি সমাজের মূল
শর্ত পূরণের সাথে সমকামিতার অধিকারের লাগসই সহ-সম্পর্ক রয়েছে। তবে সমকামিতা নিয়ে
শুধু ইউরোপে নয় আমাদের উপমহাদেশেও বিতর্ক শুরু হয়েছে। সম্প্রতি ভারতের হাইকোর্ট
সমকামিতাকে অবৈধ ঘোষণা করার সাথে সাথে “দেশ” পত্রিকায়
সম্পাদকীয় লেখা হয়েছে। সমকামিতার পক্ষে যুক্তি দাঁড় করাতে পুঁজিবাদি সমাজের
সাংস্কৃতিক শর্তগুলোর, ব্যক্তি স্বাধীনতার ও মানবাধিকারের
প্রসঙ্গ এসেছে। এছাড়া সম্প্রতি সমকামিতাকে বেআইনি ঘোষণা করার বিপক্ষে কলম ধরেছেন
লায়লা শেঠ, যিনি সাবেক বিচারপতি ও বিখ্যাত লেখক বিক্রম
শেঠের মা। তিনি সমাজতত্ত্ব, মনস্তত্ত্ব ও মানব প্রকৃতির
দোহাই দিয়ে সমকামিতার পক্ষে তার অবস্থান ব্যক্ত করেছেন। তবে লায়লাজির অবস্থানের
একটি দৃশ্যত দূর্বলতা আছে। তাহলো, তাঁর বড় ছেলে, লেখক বিক্রম শেঠ নিজেই একজন সমকামি, এবং
আদালতের রায়ের কারণে বিক্রমের যৌনতা চর্চার ধরণকে অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হবে। ফলে
নিজের ছেলেকে আইনি অপরাধের বৃত্ত থেকে বের করতে গিয়ে তিনি খোদ ঐ বৃত্ত ভাঙ্গার
পক্ষেই অবস্থান নিয়েছেন। বর্তমান সমাজে সমকামিতা চর্চাকারী নানা বর্গ বাস্তবিক
জীবনে যে সমস্ত সংকট ও অস্তিত্ব বিষয়ক হুমকির সম্মুখীন হয়, এবং তাদের সে ঝুঁকি মোকাবেলা করার সামর্থ্য যে সমকামিতা চর্চার অধিকার
থাকা না থাকার ওপর নির্ভর করে, তার দিকে দৃষ্টিপাত করেই
তিনি তার সমর্থনের যৌক্তিক পট নির্মাণ করেছেন।
পশ্চিমা তাত্ত্বিক জুডিত বাটলার
মনে করেন, পুঁজিবাদি পুরুষ, পুরুষ নয়। সে নারীময় পুরুষ
অথবা নারীপ্রবণ। পুঁজিবাদি পুরুষের সত্ত্বা নানা বিকারে বিকৃত হয়ে পুরুষত্বহীন হয়ে
ওঠে। টাকার জন্য যে নিজের বউয়ের যৌনতাকে অপরের কাছে বর্গাদান করে, সমকামিতা, মর্ষকামিতা, আত্মরতির মাধ্যমে যে নিজের যৌন লেনদেন সারে; সে
মানসপ্রকৃতি, জৈব প্রবৃত্তি, হরমোনাল
গতিবিধি কিংবা সমাজ-মানস গঠনের দিক থেকে পুরুষ হিসেবে হাজির থাকে না। সে বদলে যায়।
একজন সমকামি পুরুষ যেমন নিজেকে পুরুষ ভাবতে পারে না, তেমনি
একজন সমকামি নারী নিজেকে নারী ভাবতে পারে না। যৌনতার সাংস্কৃতিক প্রকাশভঙ্গি নানা
ছলনা ও প্রতারণার অবয়বে হাজির হচ্ছে। পুঁজিবাদি পুরুষ বা নারীর পরিচিতি নিয়ে যে
প্রতারণাময় লুকোচুরি চলছে তাও একধরণের নারী প্রবণ সত্ত্বার ( বেগম রোকেয়ার মতে)
প্রকাশ বৈ নয়[16]। পুঁজিবাদী পুরুষ সত্যকে ভয় পায়, কারণ সত্য
বিপ্লবী। তাই সে মিথ্যেকে আশ্রয় করে, ছলনার অবলম্বন করে
নিজেকে আড়ালে রেখে চলতে চায়। উত্তরাধুনিক প্রবণতা হিসেবে পুরুষের নারীময়তা বা
নারীর পুরুষময়তা অনিবার্য সামাজিক-সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি ছাড়া কিছু নয়। সামাজিক
ও নৈতিক মূল্যবোধকে ভেঙ্গেচুরে স্বভাব বিকৃতির যে নতুন মূল্যবোধ হাজির করার বিশ্ব
রাজনীতির উত্তাপ অনুভূত হচ্ছে, তাকে সামাল দেয়ার কিংবা মোকাবেলা করার কোন সাংস্কৃতিক
প্রস্তুতি আমাদের নেই। কারণ পুঁজিবাদী যৌনতার নানা
ব্যবসায় ইতোমধ্যে অনেকে জেনে বা না জেনে শরিক হয়েছে। পূর্বে উল্লেখিত বীর্য বিক্রি
করা, গর্ভাশয় ভাড়া দেয়া, গর্ভপাত করা, লিভটুগেদার করা, যৌন বিনোদন করা ইত্যাদি নানা
ব্যবসায় মানুষ পুঁজি খাটাচ্ছে বা উপার্জন করছে। ফলে সমকালীন পুঁজিবাদি সমাজে
লিঙ্গীয় রাজনীতির যে বাহাস চলছে, তাতে এ ধরণের না-পুরুষ
বা না-নারী বাচক নতুন বর্গের পক্ষে যত না আওয়াজ শুনা যাচ্ছে, এর একটি ন্যায্য যৌক্তিকতা ও বৈধতা বিচারের জ্ঞানতাত্ত্বিক উদ্যোগ দেখা
যাচ্ছে না।
সমকামিতার জনপ্রিয়তা বাড়লেও সামাজিক, নৈতিক ও ধর্মীয়
মানদণ্ডের নিরিখে এর গ্রহনযোগ্যতা নেই। অনেকে
সমকামিতার গোপন
চর্চাকে
ঐতিহাসিক মানদণ্ড দ্বারা বিচার করেন। ইতিহাসে থাকলেই কোন বিষয় বর্তমান এবং
ভবিষ্যতের নির্ণায়ক আকারে ফিরে আসে না যদি এর সমকালীন প্রাসঙ্গিকতা না থাকে।
ঐতিহাসিকভাবে যা গোপন ছিলো,
তা কেন গোপন ছিলো তারও হদিস নেয়া দরকার। এই গোপন থাকার পেছনেও
একটি না বাচক শর্ত ছিল এবং সামাজিক বিকারের শর্ত ছিল। ধর্মীয় অবস্থান থেকে
সমকামিতার বিপক্ষে নানা মত আছে। তবে নিছক বিশ্বাসের জোরে কোন কাজের ও অভ্যাসের
মূল্য নিরূপণ করা যায় না। এখানেও নৈতিক যুক্তি ও বৃহত্তর
মানব কল্যাণের আকাঙ্ক্ষা দ্বারা ধর্মীয় বিধি-বিধানের বাস্তবিক প্রয়োগযোগ্যতা আছে
কি না দেখতে হবে। লিঙ্গীয় পরিচিতির সামাজিক নির্মিতি যতটা
তরল আকারে উৎপাদন করা যায়,
যৌনতার চর্চা ও বিকার ততটা তরল নয়, নারী-পুরুষকেন্দ্রিক
ব্যবধানের দেয়ালও তেমন পাতলা নয়। মানুষ চাইলেই কেঁচো বা তেলাপিয়া মাছের মত
উভয়লৈঙ্গিক যৌনতা ও প্রজনন সংস্কৃতির চর্চা করতে পারে না। পুঁজিবাদ তাড়িত
জ্ঞানতত্ত্ব দ্বারা নির্মিত, আমাদের সমকালীন নৈতিকতার বোধ
কালের পরিক্রমায় আদৌ কোন আশার জায়গা তৈরি করে কি না দেখার বিষয়।
মানবতাবাদের বিপরীতে নারীবাদ
জ্ঞানভাষ্য পুরুষকেন্দ্রিকতা থেকে
মুক্ত হলে পুরুষের পরিচয় আর পুরুষ থাকে না। তবে পুরুষকেন্দ্রিকতা নির্মূল করেও মানবকেন্দ্রিকতার,
বিশেষ করে মানুষের স্বকীয় বিষয়ীর অনুভবে জাগতিক বিষয় ভাবনাগুলো চর্চা চলতে পারে। সে
দিক থেকে পুরুষ “পুরুষ” হিসেবে না থাকলেও মানব হিসেবে থাকার কথা, কিন্তু
উত্তরাধুনিকতাবাদিরা এই ধরনের মানবতাবাদের বিপরীতে নারিবাদককে
প্রতিষ্টিত করতে চান। নারীকে মানুষ নয় নারী হিসেবে বিচার করে ----হলেন নারী। অর্থাৎ নারীকে মানুষ
হিসেবে বিবেচনা না করে তারা পুরুষের বিপরীতে নারীকে বিপরীত শক্তি চর্চার এজেন্ট হিসেবে
অভিষিক্ত করতে চান। মানবতাবাদের
একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মানবকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি, যা মানুষের
অভিজ্ঞতাভিত্তিক জ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে মানব-ইন্দ্রিয় ও মানব-মস্তিষ্কের যৌক্তিক
ক্ষমতার নির্ভরযোগ্যতাকে স্বীকার করে। কিন্তু উত্তরাধুনিক কালে নারীর বিশেষ
দৃষ্টিভঙ্গি জ্ঞানচর্চার প্রচলিত কাঠামো ও জ্ঞানভাষ্যকে প্রতিস্থাপন করে নারীর
চোখে দেখা অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে। এদিকে মানবতাবাদের যে সমতল জায়গায় নারী ও পুরুষ
উভয়ের কল্যাণের জন্য সাধারণ প্লাটফর্ম আছে
বলে মনে করা হয়, সেখানে উত্তরাধুনিকতাবাদিরা নারীর প্রতি বৈষম্য, লাঞ্ছনা ও
অবমাননা খুঁজে পেয়েছেন। ফলে মানবতাবাদের বিপক্ষে কথা বলার আপাত যুক্তিও তৈরি
হয়েছে। কারণ নারীকে পুরুষের সমান মানব মনে করা হয় না। নারীকে সর্বদা পুরুষের
অর্ধেক হিসেবে ভাবা হয়। “অর্ধেক নারী তুমি, অর্ধেক ঈশ্বরী[17]” কিংবা “মৎস্যপরী” সবই
নারীকে অর্ধেক হিসেবে ভাবার আধুনিক প্রয়াস। এসবের প্রতিক্রিয়ায় উত্তরাধুনিক
নারীবাদের উত্থান ঘটেছে।
প্রযুক্তির সাথে শিল্পকলা ও
মানুষের নিবিড় সম্পর্ক/ ভার্চুয়াল রিয়েলিটিঃ
প্রযুক্তির সাথে শিল্পকলার,
মানুষের গতিময় জীবনের এক নিবিড় সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে। প্রযুক্তি মানুষের জীবনে এমন
গতি ও বৈচিত্র্য এনে দিয়েছে যে তাকে আর এক জায়গায় ও এক ফর্মে আবদ্ধ করে রাখা
যাচ্ছে না। মানুষ এখন নিজেই নিজের ফর্ম ও বৃত্ত ভাঙছে। মানুষের প্রকৃত শৈল্পিক
ক্ষমতার সাথে প্রযুক্তিগত ক্ষমতা যুক্ত হয়ে শৈল্পিক অনুলিপি বা প্রতিলিপি উৎপাদনের
সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ছায়ালিপি ও ছাপলিপির উদ্ভাবনের কারণে লেখা ও চিত্র কর্মের বিকল্প
কপি তৈরি করা অনেক সহজ হয়েছে। ওয়াল্টার বেনিয়ামিন তাঁর “দ্য ওয়ার্ক অব আর্ট ইন দ্য
এজ অব মেকানিক্যাল রিপ্রোডাকশন” নামক প্রবন্ধে খেটে খাওয়া মেহনতি শিল্পীর শৈল্পিক
কর্ম যান্ত্রিক উৎপাদন প্রক্রিয়ার
পুনরুৎপাদনের কারণে এর মৌলিক স্বত্ত্ব কীভাবে গৌণ হয়ে পড়ে তা দেখিয়েছেন[18]। সে সাথে পুঁজিবাদি
উৎপাদনের ধরণের সাথে শিল্পীর নতুন সংকট চিহ্নিত করেছেন। যে কোন শিল্পীর কাজকে অন্য
কারও দ্বারা অনুকরণ করা স্বাভাবিক, কিন্তু যান্ত্রিকভাবে বহুসংখ্যক প্রতিলিপি তৈরি
করা ভিন্ন বিষয়। যত নিখুঁতভাবেই ডুপ্লিকেট কপি করা হোক না কেন এ ধরণের অনুলিপিতে দেশ-কাল
ধরা দেয় না। উত্তরাধুনিক যুগে যান্ত্রিক নিবিড়তার জন্য মানুষের জীবন পুরোপুরি মানবিক নাই, অর্ধেক যান্ত্রিক আর অর্ধেক মানবিক
হয়ে পড়েছে। চোখে লেন্স লাগানো, কানে এমপ্লিপায়ার, হাতে ট্যাব সব কিছু মিলে মানুষ
দিনের বিশেষ অংশই কাটায় ভার্চুয়াল জগতে, তাও আবার যন্ত্র-মানবের এক যৌগিক মেশিন
হিসেবে। এই যে উত্তরাধুনিক মানুষের যান্ত্রিক সংস্কৃতি, এর পেছনে কাজ করে এক বিশেষ
পুঁজিবাদি লজিক[19]। আধুনিকতার
প্রতিক্রিয়ায় বিকল্প লজিক হিসেবে এর উদ্বোধন ঘটেছে। এ কারণে সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র
ও কল্যাণরাষ্ট্র, লেনিনবাদ, শিল্প ও ভাবাদর্শ সবকিছুই হুমকিতে পড়েছে। শিল্পচৈতন্য
ও ভাবাদর্শ লোকপ্রিয়তার কাছে হার মানছে। শিল্প এখন গুণের বিচারে নয় লোকপ্রিয়তার
বিচারে স্বীকৃতি লাভ করে। সব কিছুর বাজারিকরণের সাথে সাথে পুঁজিবাদি অধঃপতনও
ঘটেছে।
বিরাজনীতিকরণ
আধুনিক চেতনার সংকট থেকে
গণতান্ত্রিক সংকট তীব্র হয়েছে। গণতন্ত্র হুমকিতে পড়ার অন্যতম কারণ বিরাজনীতিকরণ।
ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের বৃত্তাবদ্ধ রাজনৈতিক ও আমলা গোষ্টী কর্পোরেটস্বার্থ রক্ষার
জন্য গণস্বার্থকে জলাঞ্জলি দিতে চায়। এ কারণে সাধারণ নাগরিককে রাজনীতি থেকে দূরে
রাখতে চায়। ফলে গুরুত্বপুর্ণ রাজনৈতিক বিষয়গুলোতে এবং সিদ্ধান্তে জনমতের প্রতিফলন
ঘটানোর জন্য জনগণকে রাজনৈতিকভাবে যুক্ত না করে গ্রিনরুমে নেয়া সিদ্ধান্ত তাদের ওপর
চাপিয়ে দেয়। জনগণের সাথে শাসক গোষ্টীর দূরত্ব তৈরি হতে হতে জনরোষ বাড়ে। জনরোষ থেকে
গণবিক্ষোভ দানা বাধে। ফলে রাজনীতির মাঠ একটু পিচ্ছিল ও তরল হয়ে পড়ে। এ ধরণের ঘোলা
পানিতে পুঁজির নিয়মেই পুঁজিবাদিরা নতুন করে তাদের শিকার সারে, নিজেদের স্বার্থ
পুনর্বার প্রতিষ্টিত করে।
রাজনৈতিক সমাজের ( Political society) পরিবর্তে জনসমাজের ( Civil society ) উত্থান
বিরাজনীতিকরণের কারণে রাজনৈতিক
সমাজ দূর্বল হয়ে পড়ে, এক পর্যায়ে রাজনৈতিক সমাজের বিলুপ্তিও ঘটে। কিন্তু পুঁজিবাদি
নীতি ও ব্যবস্থার রাজনৈতিক বৈধতার বিষয়টি অমীমাংসিত রয়ে যায়। এই জায়গায় বৈধতা
দানের জন্য এক বিশেষ মধ্যস্থতাকারী শ্রেণির উদ্ভব ঘটে যার নাম জনসমাজ। শাসকগোষ্টী ও জনগণের মাঝে
দরকষাকষির এজেন্ট হিসেবে সিভিল সোসাইটি বা জনসমাজকে পুঁজিবাদিদের পক্ষ থেকে বিশেষ
পোষকতা দেয়া হয়। উত্তরাধুনিক সমাজে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হলেও জনসমাজের
প্রাধান্য লক্ষণীয়।
নিম্নবর্গের ইতিহাস
পৃথিবীর ইতিহাস উচ্চ বর্গের
ইতিহাস। অর্থাৎ শাসকের ইতিহাস। শোষিত বা শাসিত নিম্নবর্গের ইতিহাস লিখা হয় নি। শাসকগণ
এ যাবত যা লিখেছেন, তার ভিত্তিতে তৈরি হয়েছে নিম্ন বর্গের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও
পরিচিতির বৃত্তান্ত। আধুনিকতাবাদি প্রকল্পের বিপরীতে উত্তরাধুনিকতাবাদিরা নতুন করে
সেই হারিয়ে যাওয়া অতল থেকে নিম্নবর্গকে পুনরুদ্ধার করতে চান। তাই তারা নিম্নবর্গের
ইতিহাস চর্চার দিকে নজর দিয়েছেন।
সামাজিক বিখন্ডায়ন
উত্তরাধুনিক সমাজে সামাজিক ঐক্যের
জায়গায় বিচ্ছিন্নতাবাদ ও বিচ্ছেদ দেখা যায়। সমাজ নানা ইস্যুতে ক্রমাগত বিভাজিত হতে
হতে সামাজিক নৈরাজ্যের শর্ত পূরণ করেছে। সাংগঠনিকভাবে মানুষ চরম অস্থিরতার পরিচয়
দিচ্ছে। তাই নতুন নামে নতুন নতুন সংগঠন তৈরি হচ্ছে। সামাজিক আন্দোলনের ক্ষেত্রেও
মানুষ পরস্পর থেকে ব্যাপকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। একই নাগরিক ফোরামে সামগ্রিক
সামাজিক চিন্তা ও প্রচেষ্টা চালানোর অবকাশ নেই, সেই লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। এ
ধরনের সামাজিক বিখন্ডায়নের অন্যতম কারণ হল নাগরিক অস্থিরতা ও আস্থার অভাব। আস্থার
অভাব থেকে সৃষ্টি হয় ভাঙন। এই অনাস্থা শুধু সামাজিক বলয়ে আবদ্ধ নাই, তা ব্যক্তি
জীবনে ছড়িয়ে পড়েছে। সমাজ ভাঙতে না ভাঙতেই পারিবারিক ভাঙ্ন দেখা দিয়েছে। তাই স্বামী
হারা মা আর স্ত্রী হারা বাবার সংখ্যা বাড়ছে। সামাজিক ও ব্যক্তিগত সম্পর্কগুলো এত
তরল ও পিচ্ছিল হয়ে পড়েছে যে কে কখন কার সাথে সম্পর্ক পাতে আর কী কারণে কখন কার
সাথে সম্পর্ক ভাঙে তার হদিস নাই।
তরল প্রেম
সামাজিক ভাঙ্ন ও অবিশ্বাসের জের
ব্যক্তি জীবনে প্রকটভাবে দেখা দিয়েছে। উত্তরাধুনিকতাবাদ অনুযায়ী সত্য নাই,
সত্ত্বাও নাই। যেহেতু সত্য বলতে কিছু নাই, সেহেতু বিশ্বাসের প্রয়োজন নাই। তাই অমর
প্রেমের স্বর্গীয় মিথে মানুষের বিশ্বাস নাই। চিরায়ত নান্দনিকতায়, আবেগের প্রশান্ত
অলৌকিকতায় উত্তরাধুনিক চিন্তার প্রভাব পড়েছে, তাই প্রেমের ক্ষেত্রেও ক্রমাগত ভাঙ্ন
ও অবিশ্বাস দেখা দিয়েছে। এখন উত্তরাধুনিক প্রেমিক/ প্রেমিকাগণ একজনের সাথে প্রেম
করে, আরেকজনকে বিয়ে করে আর তৃতীয় একজনের সাথে পরকিয়া করে। ক্রমাগত মিথ্যা আর অস্থির
ভোগের সংস্কৃতি প্রেমিক- প্রেমিকার মনকে গ্রাস করেছে সুনামির মত।
আধ্যত্মিকতার পুনরুত্থান
কোয়ান্টাম মেকানিক্স আবিষ্কারের
পরে, বিজ্ঞানের প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তিত হয়েছে। বিজ্ঞান মানে শতভাগ
সত্য নয়, বরং প্রায়
( Approximate ) সত্য।
বিজ্ঞান আজ যা প্রমাণ করে দুদিন না হতেই তার বিপরীত কিছুকে প্রমাণ করে। তাই
বিজ্ঞানে স্থির কোন সত্য নাই। এ থেকে বিজ্ঞানের প্রতি সন্দেহবাদ জন্ম নিয়েছে।
অন্যদিকে পুঁজিবাদের খপ্পরে পড়ে বিজ্ঞান নিজেই এক ধরনের ভায়োলেন্স ঘটায়। তাই
বিজ্ঞান নিছক আশির্বাদ নয়, সম্ভাবনাময় অভিশাপও। এদিকে ধর্মনিরপেক্ষতার আবরণে মানুষ
অপরিসীম ধর্মীয় স্বাধীনতা যেমন পায়, তেমনি ধর্মকে ব্যক্তিগত পরিসরে ঠেলে দেয়ার
কারণে মানুষের ধর্মীয় চেতনায় নতুন নৈতিক দ্বন্ধ ও আধ্যাত্মিক অন্বেষার আকাঙ্ক্ষা
তৈরি হয়েছে। আধুনিক চেতনার ধর্মনিরপেক্ষতা মানুষের চিরন্তন আধ্যাত্মিক আবেগকে
অস্বীকার করার কারণে এর প্রতি মানুষের নতুন মনোযোগ সৃষ্টি হয়েছে। তবে সত্ত্বার
অস্তিত্বকে অস্বীকার করার কারণে উত্তরাধুনিক মানুষের আধ্যাত্মিকতার কোন
সুনির্দিস্ট লক্ষ্য নেই।
উপসংহার
উত্তরাধুনিক দর্শনের মূলে রয়েছে
এক বিশেষ ধরনের চিন্তা, যা প্রথাগত চিন্তাকে নতুন করে চ্যালেঞ্জ করতে চায়। আবার এই
নতুন চিন্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে সংস্কৃতিতে। উত্তরাধুনিক মানুষ ও সমাজের পরিচয় ফুটে
ওঠে সংস্কৃতিতে। আলোচিত উত্তরাধুনিক সংস্কৃতি ভালো না মন্দ তা বিচার করার
সুনির্দিষ্ট কোন মানদণ্ড নাই। কিন্তু মানুষের জীবন, সমাজ ও প্রকৃতিতে এর প্রভাব
শেষ পর্যন্ত কোন গন্তব্যে পৌঁছে তার ভিত্তিতে এর মাপঝোঁক চলবে। মানুষ কি আসলেই
ইতিহাসের শেষ গন্তব্যে পৌঁছে গেছে না কি নতুন কোন রূপে মানবিকশক্তির উদ্বোধন ঘটবে,
এ আশা ও সন্দেহ রয়েই যায়। উত্তরাধুনিক সংস্কৃতির সব কিছু আমাদের কাছে যেমন
গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হয় না, তেমনি এর সব কিছু বাতিলযোগ্যও নয়। যা আমাদের দরকার তা
হল, বৃহত্তর কল্যাণের স্বার্থে, অধিকতর গ্রহণযোগ্য জীবন পদ্ধতি বেছে নেয়া। বিচ্ছিন্নতার
হাল টেনে ধরে, অবিশ্বাসের অনুঘটক দূরীভূত করে, প্রযুক্তিকে বিবেচনাপ্রসূতভাবে
ব্যবহার করে জীবনে প্রশান্তি ও বিশ্বাসের জায়গা সৃষ্টি করতে পারলে হয়তো আমরা
উত্তরাধুনিক অভিঘাত মোকাবেলা করতে পারব।
[1] Hawking,
Stephen and Mlodinow, Leonard, The Grand Design, Bantam Press, London,2010, pp-
5
[2]
Popper,
Karl,Conjectures and refutations, 5th edition: Rutledge and kegan paul,London,
1974, pp-66.
[3]
Lyotard, Jean-Francois, The Postmodern condition: A report on knowledge,
[4]
আইয়ুব, সালাহউদ্দীন, আধুনিকতা ও উত্তরাধুনিকতা, মাওলা ব্রাদার্স,
ঢাকা-১৯৯৮,পৃ-১২
[5]
Habermas, Jurgen, Modernity
versus Postmodernity, in New German Critique, 1981, pp-6
[6] আধুনিক জ্ঞানের দুইটি
দিক, একটা হলো অবভাসের ও উপস্থাপনের দিক, আরেকটি হলো সারসত্তা বা স্বয়ংসত্ত্বার
দিক। Friedrich
Nietzsche, "The Genealogy of Morals," The Birth of
Tragedy and the Genealogy of Morals, trans.
by F. Golffing (New York: Doubleday, 1958), pp. 289 ff.
[7]
Benhabib, Seyla, Epistemologies of postmodernism: A rejoinder to Jean-
Fracois-Leyotard, in Modernity and Post modernity, New German Critique, 1984 ,
Pp-110
[8]
হক, আবুল কাশেম ফজলুল, জাতীয়তাবাদ, আন্তর্জাতিকতাবাদ, বিশ্বায়ন ও
ভবিষ্যৎ, জাগৃতি প্রকাশনী, ঢাকা-২০১৪, পৃ- ১১৪
[9]
Baudrillard, Jean, In the
shadow of silent majorities...or the End of the Social (New York: Semiotext(e),
1983. Pp 85
[11]
Spivak, Gayotri Chakravorty, Can subaltern speak? , in Toward a History
of the vanishing Present, Cambridge, Mass: Harvard University Press, 1999
[13]
Ibid.
[14]
Fanon, Franz, Black Skin,
White Masks, Pluto Press, London, 2008
[15] মজহার, ফরহাদ, আমাদের ভালবাসা মেহেরজান, অকস্মাৎ
রপ্তানীমুখী নারীমেশিন, শ্রেষ্ঠ কবিতা, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা, ২০১০, পৃ-৯৫
[16] কুসুমের সৌকুমার্য্য, চন্দ্রের
চন্দ্রিকা, মধুর মাধুরী, যূথিকার
সৌরভ, সুপ্তির নীরবতা, ভূধরের
অচলতা, নবনীর কোমলতা, সলিলে
তরলতা- এক কথায় বিশ্ব জগতের সমুদয় সৌন্দর্য এবং স্নিগ্ধতা লইয়া বাঙ্গালী গঠিত
হইয়াছে! আমাদের নামটি যেমন শ্রুতিমধুর তদ্রূপ আমাদের সমুদয় ক্রিয়াকলাপও সহজ ও সরল।
আমরা মূর্তিমতি কবিতা- যদি ভারতবর্ষকে ইংরাজি ধরণের একটি অট্টালিকা মনে করেন, তবে বঙ্গদেশ তাহার বৈঠকখানা এবং বাঙ্গালী তাহাতে সাজসজ্জা! যদি ভারতবর্ষকে একখানা উপন্যাস মনে করেন, তবে বাঙ্গালী তাহার নায়িকা! ভারতের পুরুষ সমাজে বাঙ্গালী পুরুষিকা!!
বেগম রোকেয়া, নিরীহ বাঙ্গালী/ মতিচূর ( প্রথম খণ্ড), রোকেয়া রচনাবলী, উত্তরণ, ধাকা,২০০৬, পৃ- ৪০
আমরা মূর্তিমতি কবিতা- যদি ভারতবর্ষকে ইংরাজি ধরণের একটি অট্টালিকা মনে করেন, তবে বঙ্গদেশ তাহার বৈঠকখানা এবং বাঙ্গালী তাহাতে সাজসজ্জা! যদি ভারতবর্ষকে একখানা উপন্যাস মনে করেন, তবে বাঙ্গালী তাহার নায়িকা! ভারতের পুরুষ সমাজে বাঙ্গালী পুরুষিকা!!
বেগম রোকেয়া, নিরীহ বাঙ্গালী/ মতিচূর ( প্রথম খণ্ড), রোকেয়া রচনাবলী, উত্তরণ, ধাকা,২০০৬, পৃ- ৪০
[17] ছফা, আহমদ,
অর্ধেক নারী তুমি, অর্ধেক ইশ্বরী,
[18]
Benjamin, Walter, The
Work of Art in the Age of Mechanical Reproduction, in Illuminations, Schocken
Books, New York, 2007, pp- 218
[19] Jameson,Fredric, Postmodernism,
or, The Cultural Logic of Late Capitalism, Duke University Press, Durhum,
NC,1991, PP
Comments