Skip to main content

হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগানো বিশুদ্ধ বাস্তব



                                     টমাস ট্রান্সট্রমার এর কবিতা
                হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগানো বিশুদ্ধ বাস্তব
                                            সরওয়ার কামাল
প্রতিবারের মত ২০১১ ইসাঈ সালের ৬ অক্টোবর সুইডিশ একাডেমী সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার ঘোষণা করেছে। এবারে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন সুইডিশ কবি ও সাহিত্যিক টমাস ট্রান্সট্রমার। তাকে পুরস্কার দেয়া হয়েছে কবিতায় এক নতুন নন্দনতাত্ত্বিক শিল্পশৈলী সৃষ্টি করার জন্য। নোবেল কমিটির দৃষ্টিতে তার প্রগাঢ়, আবছা চিত্র-কল্প নতুন এক বিশুদ্ধ বাস্তবতা উন্মোচন করেছে। সুইডেনতো বটেই তামাম দুনিয়ায় তার কবিতা গভীর প্রভাব ফেলেছে। ইতোমধ্যে পঞ্চাশটিরও বেশি ভাষায় তার কবিতা অনুদিত হয়েছে। এর আগে প্রতিবছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার ঘোষণার প্রাক্কালে টমাসের নাম নির্বাচকদের সামনে ভেসে উঠত, কিন্তু তা দেখে নোবেল কমিটি এক গভীর নিঃশ্বাস ফেলতেন; পাছে তাদের বিরুদ্ধে স্বজন প্রীতির অভিযোগ উঠে। কারণ ১৯৭৪ সালে দুইজন সুইডিশ একাডেমীর সদস্যকে পুরস্কার দিতে গিয়ে এই অভিযোগ এড়ানো যায়নি। এছাড়া তার কপাল আরেকটু পোড়া ছিল এই কারণে যে নোবেল পুরস্কার যতটা না সাহিত্য বিবেচনা করে দেয়া হয় তার চেয়ে বেশি দেয়া হয় রাজনৈতিক বিবেচনায়। অথচ টমাস ট্রান্সট্রমার একজন রাজনীতিবিমুখ ও রাজনীতিমুক্ত কবি। যেমনি ধ্যানমগ্ন নিঃসঙ্গতার মতো ধীর, গম্ভীর, প্রগাঢ় তার কাব্যভাষা, তেমনি তার জীবন।
টমাস ১৯৩১ সালের ১৫ এপ্রিল সুইডেনের ষ্টকহোমে জন্ম গ্রহন করেন। ১৯৫৬ সালে স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয় হতে মনোবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর পাস করেন। পরে মনোবিজ্ঞানী হিসেবে কিশোর জেলখানায় প্রতিবন্ধী, দণ্ডপ্রাপ্ত ও মাদকাসক্তদের নিয়ে কাজ করতেন। ১৯৯০ সালে তিনি স্ট্রোকে আক্রান্ত হন এবং বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন। তারপরও তিনি তার লেখা চালিয়ে যাচ্ছেন। মাত্র তের বছর বয়স থেকেই টমাস কবিতা লিখতে শুরু করেন। ১৯৫৪ সালে তার বয়স যখন তেইশ বছর তখন তার প্রথম কবিতার বই ১৭ দিক্তার (সতের কবিতা ) প্রকাশিত হয়। ২০১০ সালে সরো গদলা, ২০১১ সালে নিউ কালেক্টেড পোয়েমস প্রকাশিত হয়। “ বন্ধু, কিছু অন্ধকার খেয়ে নাও” নামে এক গাঁথা লিখার পর থেকে তার পাঠকপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। পাবলো নেরুদার পর আর কোন কবি তার জীবদ্দশায় এত পাঠকপ্রিয়তা পায়নি।তবে তিনি নেরুদা থেকে ভিন্ন মতের পোষক। আধ্যাত্মিকতার প্রতি তার রয়েছে গভীর শ্রদ্ধা। তাদের মধ্যে যতটুকু মিল তা প্রকৃতি থেকে চিত্রকল্প নেয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ। এক্ষেত্রে আমাদের জীবনানন্দকেও তার পূর্বসূরী বলা যেতে পারে। তার বিখ্যাত লেখাগুলো বন ও প্রকৃতির ক্যানভাসে আঁকা এক্সপ্রেশনিসট চিত্রকলার মত যেখানে সব উপাদানই প্রাকৃতিক, মরমি সাধকের মতই নিখাদ মনের নির্মোহ বয়ান। দ্যা গ্রেট এনিগমা তার বিখ্যাত কাব্য গ্রন্থগুলোর মধ্যে অন্যতম।রবার্ট ব্লাই হলেন প্রথম কবি যিনি টমাসের কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। 
তার কবি মানস গড়ে উঠেছে জন্মভূমি সুইডেনের প্রগাঢ় দীর্ঘ শীতের প্রকৃতিপটে। মৌসুম বদলের সাথে সাথে প্রকৃতির সাথে মানব মনের যে অন্তঃক্রীড়া তিনি লক্ষ্য করেছেন তাকেই যেন তিনি ঘন সন্নিবিষ্ট চিত্রকল্পের সাহায্যে স্কান্ডেনেভিয়ান মোটিফে এঁকেছেন। প্রথম দিকে বিংশ শতাব্দীর আলোচিত পরাবাস্তববাদী ভাষায় লিখতে শুরু করলেও তিনি তার নিত্য দিনের, যাপিত জীবনের সাথে  প্রকৃতির ক্রীড়াময়  সম্পর্ককে মরমি অন্তর্দৃষ্টির লেন্সে ফেলে দেখেন। এভাবে তিনি মানব মনের চিরায়ত দিকগুলোর প্রতি আলোকপাত করেন। কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতায় যেমন শীতের রাত, পেঁচার ডাক, ডাহুকীর কথা এক স্পষ্ট চিত্রকল্পের আঙ্গিকে লোকজ বুননে ফিরে ফিরে আসে তেমনি প্রজাপতি, বিটলস,গাঢ় অন্ধকার টমাসের কবিতার বহুল পরিচিত অনুষঙ্গ। তার কবিতায় একই সাথে দুইটি বয়ান পরিলক্ষিত হয়।একই সময়ে ভেতরের জগত ও বাইরের জগতকে  প্রকাশ করার এক বিরল গতিময়তা তার চিত্রকল্পের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।চিত্রকল্পের গাঢ়-গভীর সন্নিবেশ টমাসের কাব্য ভাষার পরতে পরতে নিহিত। হৃদয়ের গহীন থেকে উৎসারিত মরমী পংক্তি বুননের যে কায়দা তিনি গ্রহণ করলেন তা বুঝতে হলে তার সময়কার জ্ঞানতত্বের জারণ- বিজারণ আমলে নেয়া দরকার। একজন মনোবিজ্ঞানী হিসেবে মনোবিশ্লেষণের সব ঘরানা যেমন তার আয়ত্তে ছিল, তেমনি কিছু দার্শনিক অনুসিদ্ধান্ত সম্পর্কেও তিনি সজাগ ছিলেন। বিশেষ করে ব্রেন্তানু, এদ্মুন্দ হুসারল,হাইদেগার ও জাঁক লাকার দার্শনিক বিবেচনা তার ভাবজগতকে যথেষ্ট পরিশোধন করেছে।     
আমাদের জ্ঞান তৈয়ার হয় দেশ-কালের প্রভাবে,ইতিহাসের আধিপত্যে, ঘটনা পরম্পরার বহুজাত বিকৃতি নিয়ে। তাই আমাদের আপাত বাস্তব জ্ঞান ঐতিহাসিক ও ব্যক্তিগত প্রেক্ষিতের সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে পারেনা।এই সীমাবদ্ধতার দোষে দুষ্ট চেতনা জ্ঞানতাত্বিকভাবে নিষ্কলুষ নয়। দার্শনিক ব্রেন্তানু প্রথম এইদিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তার ছাত্র হুসারল এ থেকে মুক্তির উপায় বাতলে দেন। বলেন, আমদের যে ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা ও দেশ- কালের প্রতি সহজাত মনোভাব, আমাদের জ্ঞানকে কলুষিত করে তা ব্রাকেটে বন্ধি করতে হবে।কারণ আমাদের ব্যক্তিগত মনোভাব বিশুদ্ধ বাস্তবকে জানার পথে প্রধান বাধা। যে অবভাসকে আমরা জানি তা সীমাবদ্ধতার সুত্রে গাঁথা । অভিজ্ঞতার বেদনাময় অভিঘাত বিশুদ্ধ বাস্তবকে আবৃত করে রাখে। তাই ইন্দ্রিয়লব্ধ অভিজ্ঞতাকে দূরে রেখে শ্বাশ্বত অচেতনকে সরাসরি জানতে হবে, জ্ঞানের জন্য যেখানে কোন ইন্দ্রিয়জাত মাধ্যম থাকবেনা। এই ধরণের বিশুদ্ধ জ্ঞানের আরেক পথ হল মরমী পথ। মনের অচেতন আরশিতে দেখা বিশুদ্ধ বাস্তবকেই টমাস ত্রান্সট্রমার তার কবিতায় ধারণ করেছেন। লালনের মত মরমি বোধকে  তিনি জীবনানন্দের মত প্রকৃতি নির্ভর চিত্রকল্পের দ্বারা কবিতার পংক্তিতে উপস্থাপন করেছেন।এখানেই তার বিশেষত্ব। এই বিশেষত্বটা মাটির গুণে আমাদের অতি চেনা। এই চেতনার সাথে আমরা একাত্বতা পোষণ করতে পারি সহজেই।
“যুগল” নামে তার এক পরিচিত কবিতা থেকে (ভুল ছন্দে) অনুবাদ করি,
তারা বাতি নিবে দেয়,তার আভা হারিয়ে যাওয়ার আগে/ অন্ধকারের গ্লাসে একটি ট্যাবলেটের মত জ্বলে/তারা উঠে, হোটেলের দেয়ালগুলো কৃষ্ণ আকাশে উঠে পড়ে/ প্রেমের গতি মীমাংসিত হলে পরে ঘুমায়,কিন্তু/ গোপন ভাবনাগুলো তখনি মিলে,যখন/পাঠশালার আঁকাআঁকির ভেজা কাগজে দুটি রং/একে অপরের সাথে মিলে যায়। 

সরওয়ার কামাল, প্রভাষক- দর্শন বিভাগ, কক্সবাজার সরকারি মহিলা কলেজ।
       
       

Comments

Popular posts from this blog

মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার কারণ ও প্রতিকার

সরওয়ার কামাল শিক্ষাক্ষেত্রে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য সাফল্য রয়েছে। সামাজিক উন্নয়ন সূচকেও বাংলাদেশের অবস্থান প্রতিবেশি দেশগুলোর তুলনায় ভালো, যা সম্পর্কে প্রশংসা করে বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন প্রবন্ধ লিখেছেন “ ল্যানসেট ” নামক মেডিক্যাল জার্নালে। কিন্তু এতে আমাদের বগল বাজিয়ে আত্মতৃপ্তিতে ভোগার অবকাশ নেই। কারণ শিক্ষার্থী ঝরে পড়া এবং বিজ্ঞান শিক্ষা সংকুচিত হয়ে পড়া আমাদের সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভুত হয়েছে। শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার কারণে আমাদের শিক্ষার মূল লক্ষ্যগুলো হাসিল হচ্ছে না, যার একটি হলো সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করা, অপরটি হলো শিক্ষাক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় প্রণোদনার ন্যায্য বণ্টন নিশ্চিত করা। অর্থাৎ সব শিশুই যাতে সরকারের সুযোগ ব্যবহার করে উন্নত জীবনের সন্ধান করতে পারে, তার শতভাগ নিশ্চয়তা প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না। শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার বিভিন্ন কারণ রয়েছে, তার মধ্যে বিভিন্ন স্তরের শিক্ষার ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন কারণ রয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার প্রধান কারণ দারিদ্র্য ও অপুষ্টি বা স্বাস্থ্যহীনতা । মাধ্যমিক পর্যায়েও শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার ক্ষেত্রে দারিদ্র্য সমস্যার ...

তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি বিচিত্র ছলনা জালে

তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি বিচিত্র ছলনা জালে ............................................................................... সাম্প্রতিক কালে আমাদের নৈতিক উপলব্ধিতে, সামাজিক উদ্বেগে কিংবা মূল্যবোধে দৃশ্যমান পরিবর্তন এসেছে। প্রযুক্তির নিবিড় ব্যবহার, বিশ্বায়নের প্রভাব, বিশ্বরাজনীতির অভিঘাত, বাজার সংস্কৃতির ধাক্কা ও চরমপন্থী ভাবাদর্শের টানাপড়েনে আমাদের চিরকালীন মূল্যবোধ ভেঙ্গে পড়েছে। নৈতিকতার সীমানা সরে যাচ্ছে প্রথাগত বিশ্বাস ও প্রতিষ্ঠানসংলগ্নতা থেকে। গতিময় জীবনের অভিঘাতে চরম অস্থিরতা ব্যক্তি থেকে ব্যষ্টির ব্যাপ্তিতে বিরাজ করছে। সর্বত্র আহাজারি, শোনার অবসর নিয়ে হাজির নেই কেউ। মানুষ যে নির্বিকার তাও নয়, তারা বিকারগ্রস্থ, পূর্ণমাত্রায় ঘোরগ্রস্থ, কেবল অপ্রত্যাশিত ঘটনাপ্রবাহের সাথে তাল মেলানোতে। তারা এখন এমন সব বিষয়ে আলোড়িত হয়, যে বিষয়ের সাথে তাদের সরাসরি যোগ নেই। থাকলেও তা অনেক ক্ষীণ ও দূরবর্তী কার্যকারণ সম্পর্কে আবদ্ধ। একইভাবে, তারা এমন সব পরিণতি ভোগ করে, যার জন্য তারা নিজেরা দায়ী নয়। আর যারা দায়ী তারা এর পরিণতি ভোগ করেন না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষ বয়সের দিকে এই প্যার...

মহেশখালীর সমাজ ও সংস্কৃতি

সরওয়ার কামাল সাগর কূলে গিরিকুন্তলা মোহিনী মহেশখালী দ্বীপের ৩৮৮ বর্গকিলোমিটার ভূত্বকে প্রায় পাঁচ লক্ষ লোকের বসতি। তাদের বসতি ঘিরে গড়ে উঠেছে উপকূলীয়-দ্বীপাঞ্চলীয় সমাজ। এই সমাজসভ্যদের মানসিক ঐক্য ও জীবনযাপন পদ্ধতি নিয়ে তৈরি হয়েছে শনাক্তযোগ্য বিশেষ স্থানীয় সংস্কৃতি। মানবজাতির চিরকালীন অভিযাত্রার অংশ হিসেবে দেশের নানা জায়গা থেকে হিজরত করে লোকজন এসে বসতি গেড়েছে মহেশখালীতে। তাই তাদের ভাষা ও আচরণে শনাক্ত করা যায় এমন বৈচিত্র্য ও তারতম্য, যা দিয়ে কক্সবাজারের অন্যান্য অঞ্চলের অধিবাসীদের তুলনায় মহেশখালীবাসীকে স্বতন্ত্রভাবে চিহ্নিত করা যায়। যে পার্থক্যসূচক বৈশিষ্ঠ্যাবলী নিয়ে মহেশখালীর সমাজ ও মানুষের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য তৈরি হয়েছে, চাটগাঁইয়া ভাষার উপভাষাতুল্য মহেশখালীর দ্বীপাঞ্চলীয় বুলি তার মধ্যে বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। [1] তবে সমস্যা হলো, লিখিত সাহিত্য ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের অভাবে স্থানীয় ইতিহাসের মতোই কালিক সূচকের নিরিখে এর জনসংস্কৃতি বর্ণনা করা দুরূহ। একেতো সংস্কৃতি স্বয়ং একটি ব্যাপক ধারণা, তদুপরি, এটি সতত পরিবর্তনশীল। ভাষা ও সংস্কৃতি স্রোতস্বী নদীর মতো বহমান। মানুষের কথা, স্মৃতি, পুরা...