সরওয়ার কামাল
রোমন্থনের সুযোগ না রেখেই স্মৃতিগুলো চলভাষ পর্দার মতো অপসৃত হচ্ছে দ্রুত। ক্ষণকালের শিক্ষক নিয়ে স্মৃতিচারণ তাই দুঃসাধ্য। তবুও যেন এক্সপ্রেশনিষ্ট চিত্রকলার মতো একটি মোটা রেখা স্মৃতির কোটরে রেখাপাত করে আছে, যেখানে স্পষ্ট অবয়বে উঁকি দিচ্ছে আমাদের সময়ের বিখ্যাত বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলাম। তার মহিমা সম্পর্কে প্রীতিবোধ নেই এমন ছাত্র চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বিরল। কারণ যে ক'জন ফ্ল্যাগশিপ স্কলার ও শিক্ষকের সুনাম গেয়ে ছাত্ররা নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্রাণ্ড বিচার করতো, উনি ছিলেন তাদের অন্যতম। আমি নিজে উনার সরাসরি ছাত্র নই। প্রথমদিকে উনি ঠিক কী বিষয় পড়ান তাও জানতাম না। একদিন শুনলাম, আমাদের ডিপার্টমেন্টের শাহীন স্যার ওনার অধীনে গবেষণা করছেন, গণিত ও যুক্তিবিদ্যার সম্পর্কের ওপর। স্যার হিসেবে শাহীন স্যারকে আমরা একজন নিবিড় পাঠমগ্ন শিক্ষক হিসেবে জানতাম। তাই স্যারের গবেষণা এবং তার সুপারভাইজারের মার্গীয় অবস্থা সম্পর্কে আমাদের সমীহ ভাব ছিল। এরইমধ্যে একদিন লাইব্রেরি অডিটরিয়ামে এক সেমিনারে যোগ দিই, যেখানে বক্তা ছিলেন জামাল নজরুল ইসলাম। দেখলাম তিনি মহাবিশ্বের নানা বিষয়আশয়, গ্যালাক্সির ব্যাপকতা, সময়, মহাজগতের উৎপত্তি, বস্তুগুলোর দূরত্ব, সময়ের সাথে সাথে মহাকাশের নানা গ্রহ-নক্ষত্রের পরিণতি ইত্যাদি নিয়ে কথা বলতে বলতে কোরান, গীতা, বাইবেল, গণিত, সাহিত্য, ভাষাতত্ত্ব মিলে জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় পরিভ্রমণ করতে শুরু করলেন। কখনো কোরানের কিছু আয়াতের অনুবাদও করছেন। শ্রোতা হিসেবে তাল মেলাতে না পেরে অনেকে বিরক্ত হচ্ছে, কিন্তু আমি বিস্মিত হচ্ছিলাম তার জানার ব্যাপ্তি এবং জ্ঞানের আন্তঃবিষয়িক সম্পর্ক স্থাপনের সক্ষমতা দেখে।
তার কোন বই পড়া ছিল না আমার। মূলত কী বই লিখেছেন, তাও জানা ছিল না। শুধু জানতাম তিনি বিজ্ঞানী আবদুস সালামের বন্ধু এবং রবীন্দ্রভাবুক আবু সয়ীদ আইয়ুবের ভাগ্নে হন। এরইমধ্যে একদিন মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভৌতবিজ্ঞান গবেষণাগারে প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলাম বক্তব্য রাখবেন বলে খবর পেলাম। এতে অংশ নেওয়ার জন্য আমরা সেমিনার শুরু হওয়ার আগেই সভাস্থলে গিয়ে হাজির হই। সামনের সারির একপাশে প্রফেসরদের সাথেই বসে পড়ি। পরে জানলাম, পাশের জনের নাম প্রফেসর কামরুল ইসলাম। শ্রোতা কম, তাই আসনের সংকট ছিলো না। এছাড়া আমরা ছাড়া উপস্থিত সবাই জামাল নজরুল ইসলামের অনুরাগী ও অনুসারী গবেষক। আমাদের মতো ছোকরা ছাত্রদের পাশে বসা নিয়ে তাদের মধ্যে কোন বিরক্তি ছিলো না। মূল বক্তা জামাল স্যার স্যূট-টাই পরা অবস্থায় হাতে একটি চক নিয়ে কথা শুরু করলেন। কথা বলতে বলতে চকটি নিয়ে কখনো কখনো ব্ল্যাকবোর্ডে ছুটে যাচ্ছিলেন। গাণিতিক সংকেত, সংখ্যা ও সমীকরণ ইত্যাদি লিখে বোঝাতে চাচ্ছিলেন কেন একই গ্যালাক্সির অন্তর্গত গ্রহ নক্ষত্রগুলো ভিন্ন ভিন্ন। এক পর্যায়ে তাদের পারষ্পরিক দূরত্ব, সম্প্রসারণ ও পরিণতির তুলনামূলক বিশ্লেষণ করতে গিয়ে পাশে রাখা একটি চেয়ারে বসে পড়লেন। কয়েক সেকেন্ডের মতো গম্ভীর মৌনতা শেষে হঠাৎ একটা অভিব্যক্তি দিলেন। এই অভিব্যক্তির দিকে নজর দিয়ে উপলব্ধি করলাম, নীরবতারও অর্থ থাকে। বিষ্ময়কর বৈজ্ঞানিক তথ্য উপস্থাপনের ক্ষেত্রে নীরবতার ব্যবহার লক্ষ্য করলাম।তিনি হয়তো এর ভেতর কোন অংক কষছিলেন। অথবা হতে পারে, গ্রহ নক্ষত্রের দূরত্বের ব্যাপ্তি বোঝাতে গিয়ে খেই হারানোর বিষয়টি নীরবতা আকারে প্রকাশ পেয়েছিল।
সেমিনার শেষে আমরা চাকসুর পেছনে ঝুপড়িতে এসে আড্ডা জমালাম। আর তাতে সদ্য সমাপ্ত হওয়া সেমিনারের রেশ। আমাদের মধ্যে এক বন্ধু বলে ওঠলো, কিছুই বুঝিনি। একেবারে বিরক্তিকর বক্তা। জামাল নজরুল বিরক্তিকর বক্তা! এই মন্তব্য করার যোগ্যতা আছে আমাদের? হয়তো এই কারণে বিরক্তিকর লাগতে পারে যে, তার বক্তব্যে উল্লেখিত ফ্যাক্ট এন্ড ফিগার ছিলো মহাজাগতিক পর্যায়ের। এইসব বক্তব্য শোনার জন্য জ্যোতির্বিজ্ঞান সংক্রান্ত কিছু প্রাথমিক ধারণা থাকা আবশ্যক। এছাড়া, বিষয়ের ওপর নির্ভর করে মানুষের ভাষা ও ভাষাভঙ্গি ভিন্ন হয়, সেইসাথে ডিপথং ও ফিলোলজির ভিন্নতাতো আছেই।
যাইহোক, তার কিছুদিন না যেতেই আমরা বিবর্ত পাঠচক্রের আয়োজনে "মহাবিশ্বের উৎপত্তি এবং তারপর" শিরোনামে একটি সেমিনার করি, শরীফ ভাইয়ের সহযোগিতায় সেখানে প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলামকে প্রধান বক্তা এবং প্রফেসর কামরুল ইসলামকে ছিলেন বিশেষ বক্তা হিসেবে দাওয়াত করি। সেই সময় আমাদের বিবর্ত পাঠচক্রের সমন্বয়ক রাহমান নাসির উদ্দিন স্যার কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি গবেষণারত। তা সত্ত্বেও, আমরা অনলাইনভিত্তিক ওয়েবপোর্টাল নিয়ে একটি প্লাটফর্ম দাঁড় করাই, যাতে আমাদের আলোচ্য বিষয় সম্পর্কে আমাদের ভাবনাচিন্তার সংক্ষিপ্ত বিবরণী আপলোড করা থাকে। সংক্ষিপ্ত বিবরণীগুলো সাধারণত আমিই লিখতাম। তখন অনলাইনে ইয়াহু চ্যাট চেম্বারে নাসির স্যারের সাথে নিয়মিত চ্যাট হয়, কখনো কখনো দীর্ঘ মেইলে দিকনির্দেশনা পাই। একবার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের প্রফেসর ক্রিস্টিনা কোর্সগার্ডকেও অনলাইনভিত্তিক প্রোগ্রামে আমন্ত্রণ জানাই। তখন জুম মিটিংয়ের ধারণা তৈরি হয় নি, সবে ভিডিও চ্যাট শুরু হয়েছে।
জামাল স্যার তার বক্তব্যের একটি সারানুবাদ ফটোকপি করে দিলেন। তাতেও ক্লোজ ইউনিভার্স ও ওপেন ইউনিভার্স এবং স্ট্যান্ডার্ড মডেল দিয়ে মহাবিশ্বের সম্ভাব্য পরিণতি ব্যাখ্যার গাণিতিক রেখাগুলো দুর্বোধ্য ঠেকছে। বলা যায়, সাধারণ শ্রোতার জন্য অগম্য। সেমিনারটি শুরু হয়েছিল প্রবল কৌতুহল ও উৎসুক্য থেকে, এটা জানার জন্য যে, এই বিস্ময়কর মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ কী, পৃথিবী এবং পৃথিবীবাসী মানুষেরই বা ভবিষ্যৎ কী?
সুদূর ভবিষ্যতে মহাবিশ্বের কী পরিণতি হতে পারে, তা অনুধাবনের জন্য মহাবিশ্বের বর্তমান কাঠামো সম্পর্কে বুঝাপড়া লাগবে। জানা লাগবে কীভাবে মহাবিশ্ব এই পর্যায়ে এসেছে? তাঁর জনপ্রিয় বই The Ultimate Fate of the Universe লেখা হয়েছিল ১৯৭৭-১৯৮২ সালে। ইতোমধ্যে, যখন সেমিনার হয়, মহাকাশবিজ্ঞানের বেশকিছু তথ্য নতুন তথ্যের ভিত্তিতে পরিবর্তিত হয়ে গেছে, কিছু ধারণা বাতিলও হয়ে গেছে। তা সত্ত্বেও স্যারের প্রবন্ধের সাথে মিলিয়ে সহজভাবে লেখা The Ultimate Fate of the Universe পড়লাম। সেইসময় আমাদের পল্লবগ্রাহিতায় পেয়ে বসেছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ে যতো সাবজেক্ট পড়ানো হয়, সব সাবজেক্ট নিয়ে মোটামুটি একটা ধারণা রাখার প্রয়াস ছিলো। ফলে বিভিন্ন বিষয়ের ওপর আমরা সেমিনার আয়োজন করতাম।
জামাল স্যার উর্দু গজল গাইতেন। চাটগাঁর নাগরিকসমাজে তার সবাক উপস্থিতি নতুন দিকনির্দেশনা দিতো। স্যারকে যে কয়েকবার কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি, ততোবার মনে হয়েছে তিনি ধ্যানমগ্ন মানুষ, আচার ব্যবহারের ধরন টাফনেস ছাড়িয়ে সরলতায় উত্তীর্ণ। আমার বন্ধু হাদির উসিলায় স্যার আমাদের সম্পাদিত লিটলম্যাগ 'মূলধারা'র কপিও দেখেছেন। আমাদের লেখাগুলোতে চোখ বুলিয়েছেন। আমাদের এমন বড় বড় ব্যক্তিত্ব দরকার, যারা টিকটকার পর্যায়ের ব্যক্তিত্বের নাগরিক উপদ্রব থেকে আমাদের রেহাই দেবে।



Comments