Skip to main content

'অনুসন্ধান'-এর ভূমিকা

হাসান মুরাদ ছিদ্দিকী সর্বমহলে কম পরিচিত হলেও পাঠক মহলে সমাদৃত লেখক। তিনি ইতিপূর্বে দুইটি বই প্রকাশ করেছেন। তার তৃতীয় প্রবন্ধ সংকলন ‘অনুসন্ধান’, তৃতীয় চোখ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হলো। অনুসন্ধানে সন্নিবেশিত প্রবন্ধগুলো মূলতঃ সাহিত্য পর্যালোচনামূলক, যাতে প্রসঙ্গক্রমে স্থান পেয়েছে দশটি টপিক, যার চারটি আহমদ ছফা নিয়ে। সমকালীন বাংলায় বুদ্ধিজীবীতার আদর্শ বলে বিবেচিত আহমদ ছফা ছাড়াও বইটিতে আবদুর রশিদ ছিদ্দিকী, গ্যোয়েটে, লিটলম্যাগ, রোহিঙ্গা সংকট এবং কক্সবাজারের স্থানীয় সাহিত্যিক পরিমণ্ডল নিয়ে লেখকের অনুধ্যানী ভাবনা বিধৃত হয়েছে। এতে তিনি অনুসন্ধান করেছেন, ছফার চিন্তার ব্যাপ্তি, গভীরতা, জ্ঞানতাত্ত্বিক সততা, সামাজিক দায়বদ্ধতা এবং কালোত্তীর্ণতা। বিপরীতে সমকালীন লেখকদের চিন্তার দৈন্য, সাহস ও সততার সংকট এবং সর্বোপরি, দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সমাধান নিয়ে লেখক তার জায়গা থেকে স্বীয় অভিমতও ব্যক্ত করেছেন।

আহমদ ছফার একজন মুগ্ধ পাঠক হিসেবে তিনি ছফাকে দেখেছেন, অন্য অনেকের মতোই, আপসহীন লড়াকু বুদ্ধিজীবী হিসেবে। যে কোন বিচারে আহমদ ছফা বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ট লেখকদের একজন। সলিমুল্লাহ খানের মতে “মীর মশাররফ হোসেনের পর একমাত্র কাজী নজরুল ইসলামকে বাদ দিলে আহমদ ছফাই সম্ভবত মহত্তম মুসলমান লেখক”। কাজেই বাংলাদেশে আহমদ ছফা ভাষা ও চিন্তার একটি উপযুক্ত মানদণ্ডও বটে। বিগত দুই দশক ধরে সলিমুল্লাহ খান কর্তৃক ছফার তাফসির রাষ্ট্র হয়েছে। 'ছফা সঞ্জীবনী' গ্রন্থে সলিমুল্লাহ খান তার নতুন পাঠ হাজির করেছেন। ছফার মহিমা চিহ্নিত করে তিনি ইংরেজি ভাষাতেও লিখেছেন। ডঃ সুদীপ্ত হান্নান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আহমদ ছফার সাহিত্য নিয়ে পিএইচডি করেছেন। ছফার স্নেহভাজন নুরুল আনোয়ার, মোরশেদ শফিউল হাসান, গাজী তানজিয়া ও মোহাম্মদ আলম চৌধুরীও লিখেছেন। ছফার একজন জার্মান বন্ধুও ছফা সম্পর্কে নির্মোহ মূল্যায়ন করেছেন। ইতিপূর্বে হাসান মুরাদ ছিদ্দিকী নিজেও ছফাকে নিয়ে ‘চিন্তাবৃত্তিঃ আহমদ ছফা ও অন্যান্য’ নামে গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। এর বাইরে আরও অনেকে নানা দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ছফাকে দেখেছেন। স্পষ্টত, এভাবে ছফা নিজেই সাংস্কৃতিক আদর্শের জায়গায় পাঠ ও চর্চার বিষয় হয়ে ওঠেছেন। অন্যদিকে, ছফার মুখে ঝাল খেয়ে এতোদিন আমরা, পাঠকরা, অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের মহিমার স্বাদ নিয়েছি। গেলো বছর (২০২২ খ্রি) অধ্যাপক রাজ্জাকের পিএইচডি থিসিসটি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড থেকে প্রকাশিত হওয়ায় রাজ্জাক সম্পর্কে পাঠকদের ভক্তির জায়গাটি জানাশোনার ভিত্তিতে পোক্ত হয়েছে। ফলত, সলিমুল্লাহ খান হয়ে ছফা এবং ছফা হয়ে আব্দুর রাজ্জাক মিলে একটি দীর্ঘ কালব্যাপ্তিতে বাংলাদেশের সাহিত্য ও বুদ্ধিজীবীতার একটি রৈখিক চিন্তাঘরানা তৈরি হয়েছে।

বলা বাহুল্য যে, ছফার চিন্তার স্পষ্টতা, বাকবৈভব ও ঋজুতা, এবং ভাষার বলদর্পী পেলবতা তরুণদের যার পর নাই আকৃষ্ট করে। সাংস্কৃতিক বুঝাপড়ার ময়দানে ছফা একজন পরিশীলিত উস্তাদ। ছফা সাংস্কৃতিক এলিটদের অন্তর্ভুক্ত নয়, আবার সর্বহারা নিষ্পেষিত শ্রেণিরও প্রতিনিধি নয়, তিনি আটপৌরে দশপাঁচটা নিম্নমধ্যবিত্ত ব্যক্তির মতোই লিখেছেন, রাজনীতিও করেছেন, অথচ যাপন করেছেন এক বোহেমিয়ান জীবন। সাহিত্যের বাইরেও ছফার অজস্র গুণমুগ্ধ ভক্ত রয়েছে। কাজেই ছফার মহিমা ছফাকেন্দ্রিক আচ্ছন্নতা ও মোহ তৈরি করে। ফলে ছফা সম্পর্কিত নির্মোহ ব্যাখ্যা থাকলেও সেটা দুর্লভ। হাসান মুরাদের মূল্যায়নও এই মুগ্ধতা থেকে মুক্ত নয়।    

গ্রামসি, এডওয়ার্ড সাইদ, একবাল ও চমস্কি দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে অনেকেই প্রতিবাদী বুদ্ধিজীবীতাকে আদর্শ মনে করে। হাসান মুরাদ ছিদ্দিকীর বিচারের মানদণ্ডও কিছুটা এইদিকে ঝুঁকে আছে বলে প্রতীয়মান হয়। ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করে সত্য বলা, সাহসের সাথে অন্যায়ের প্রতিবাদ করা এবং সুবিধা ভোগের দিক থেকে নিরাপস থাকা বুদ্ধিজীবীদের কর্মতৎপরতার অংশ। কিন্তু বুদ্ধিজীবী হলে তাকে অবশ্যই প্রতিবাদ করতে হবে, নয়তো সে বুদ্ধিজীবী হবে না, বিষয়টা তেমন নয়। এনজিওকরণের (NGO-ization) প্রাদুর্ভাবে প্রতিবাদ এখন শুধু নৈতিক ও আদর্শিক অবস্থান নয়, প্রতিবাদ এক ধরনের বেসরকারি চাকরিও বটে। মানুষের দুর্ভোগ, ক্ষোভ এবং অন্যায্যতার অনুভুতি ঘিরে বিশ্বব্যাপী এনজিও প্রকল্প চলমান রয়েছে। একটিভিস্টদের দ্বারা পরিচালিত এইসব এনজিও কার্যক্রম মাঝেমধ্যে সামাজিক আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে। ফলে যুগ ও বিশ্বপরিস্থিতির নিরিখে প্রতিবাদ নির্ভর বুদ্ধিজীবীতার পাল্টা পর্যালোচনাও তৈরি হয়েছে। বিপরীতে, বুদ্ধিজীবীদের অন্যতম কাজ হলো চিন্তা করা ও লিখা। কাজেই চিন্তাটা সঠিকভাবে করতে পারছে কিনা, সেটা আগে দেখা জরুরি। জনপ্রিয় ধারার লেখকদের মধ্যে জনপ্রিয়তার মোহ এবং ভক্তের আকাঙ্ক্ষার প্রতি গোলামি লক্ষ করা যায়। কাজেই বুদ্ধিজীবীর আদর্শ রূপ কী, এটা নিয়ে সর্বজনগ্রাহ্য কোন সংজ্ঞা নেই। গ্রিসে থুসিডিডিস, রোমান সাম্রাজ্যে সিসেরো, মৌর্য সাম্রজ্যে কৌটিল্য, সুলতানি আমলে জিয়াউদ্দিন বারানী, মুঘল আমলে আবুল ফজল, এবং হালে ভ্লাদিমির পুতিনের জমানায় আলেক্সাণ্ডার দুগিন, এরা সবাই ক্ষমতাকেন্দ্রের বুদ্ধিজীবী; অথচ প্রতিবাদি ভূমিকা ব্যতিরেকেই তারা কালোত্তীর্ণ বুদ্ধিজীবী, শুধু তাদের চিন্তা ও লেখার কারণে। বিপরীতে, দার্শনিক সাইমন ক্রিশলি বুদ্ধিজীবীদের দেখেন স্রেফ ক্ষমতাতোষণকারী হিসেবে। ‘অনুসন্ধানে’ হাসান মুরাদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতিবাদি ভূমিকা ও এক্টিভিজমকে প্রাধান্য দিয়েছেন বলে প্রতিভাত হয়। এগুলো বেহতর বৈশিষ্ট্য হলেও বুদ্ধিজীবী হওয়ার একমাত্র শর্ত নয়।  

বাঙলা মুলুকে সামাজিক মাধ্যমে আদর্শিক এক্টিভিজমে সম্পৃক্ত থেকে ইত্যবসরে অনেকেই বুদ্ধিজীবীর তকমা পেয়ে গেছে। ফলে দ্রোহী ভাব নিয়ে স্রেফ প্রতিবাদ করাকেই অনেকে বুদ্ধিজীবীতা বলে টাওরে থাকেন। লেখকদের মূল জায়গায় সাংস্কৃতিক-ব্যবসায়িক গোষ্ঠীবাদিতা, চিন্তার স্বাধীনতা, প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে এক ধরনের টানাপড়েন রয়েছে। দেশি লেখকদের চেয়ে ডায়াসপোরার মধ্যে সুযোগ ও স্বাধীনতা বেশি থাকায় মত প্রকাশের জায়গাটাও সমতাসূচক নয়। এই ধরনের সেলফ-সেন্সরিং, চাপ ও পীড়নের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে এক্টিভিজম করে, জনতুষ্টিবিধান করে জনপ্রিয়তা পেয়ে, লেখক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এই বিষয়ে বিস্তারিত বলা সময়, পরিসর ও কাণ্ডজ্ঞান সাপেক্ষ; তাই কথা না বাড়িয়ে পরিপ্রেক্ষিতের পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনা করার দিকে ইঙ্গিত দেওয়া যায়।  

অনুসন্ধানের প্রারম্ভে আহমদ ছফা রচিত ‘একজন আলী কেনানের উত্থান’ সম্পর্কে পর্যালোচনা করেছেন হাসান মুরাদ। এই পর্যালোচনায় ধর্মকে পুঁজি করে মানুষের যে সাংসারিক দোকানদারি মনোবৃত্তির প্রকাশ ঘটে তা চিহ্নিত করে, ডাকু সমাজ থেকে উঠে আসা সুবিধাবাদি আলী কেনানের উত্থানের প্রেক্ষাপট চিত্রিত করে, পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নেওয়া আপসকামী মানুষের স্বার্থতাড়না, এবং সর্বোপরি, তাদের সাথে ক্ষমতা ও পৃষ্ঠপোষকতার সম্পর্ক নিরূপন করে কীভাবে তাদের মোকাবেলা করা যায় তার দিশা ও হিম্মতের জায়গাও অনুসন্ধান করেছেন লেখক।

আহমদ ছফা ছাত্রাবস্থায় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের তত্ত্বাবধানে গবেষণা শুরু করার পূর্বেই লেখক হিসেবে খ্যাতিমান। গবেষণা করতে গিয়ে গুরু রাজ্জাকের উপদেশ অনুযায়ী বইয়ের জগতে যে অবগাহন শুরু করলেন, তা তাকে ডিগ্রি না যোগালেও জ্ঞান ও বীক্ষা যুগিয়েছিল সন্দেহ নেই। সমাসাময়িক অন্যান্যদের তুলনায় ছফার জ্ঞানগত অবস্থানের উৎকর্ষতা অনুসন্ধান করা হয়েছে জ্ঞানভিক্ষু আহমদ ছফা শিরোনামের প্রবন্ধে। এই প্রবন্ধে ছফার সামগ্রিক বুদ্ধিবৃত্তিক ভূমিকার ওপর আলোকপাত করা হয়েছে। প্রাসঙ্গিকভাবে, বুদ্ধিজীবীর সংজ্ঞাও অনুসন্ধানের প্রয়াস নেওয়া হয়েছে। এই প্রবন্ধে প্রত্যয়গত বিশ্লেষণের কিছু উনতা ও সমস্যা রয়েছে, যা নিয়ে ইতোমধ্যে আলোকপাত করা হয়েছে। লেখালেখির জায়গায় প্রত্যয় ও ধারণাগত স্পষ্টতা থাকা যেমন জরুরি, তেমনি সার্বিকীকরণজনিত অনুপপত্তি এড়ানো প্রয়োজন।

সাহিত্যিক আহমদ ছফা একইসাথে গল্পকার, উপন্যাসিক, কবি, প্রাবন্ধিক, শিল্পবোদ্ধা, ঐতিহাসিক, অনুবাদক, সম্পাদক, কলামিস্ট, সংগঠক ও রাজনীতিক। তার বিচিত্র ঝোঁক, খেয়াল ও প্রতিভার কোনটাই গড়পড়তা নয়, বরং উৎকৃষ্টতর। তার আত্মজীবনীর সাথে মিল রেখে রচিত হয়েছে পুষ্প, বৃক্ষ ও বিহঙ্গ পুরাণ উপন্যাসটি, সেই সাথে খণ্ডিত উপন্যাস ‘অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী’ও। পুষ্প, বৃক্ষ ও বিহঙ্গ পুরাণকে প্রতিপাদ্য করে মোহাম্মদ আলম চৌধুরী লিখেছেন “আহমদ ছফার সংসার”। ঠিক একই বইকে ঘিরে হাসান মুরাদ ছিদ্দিকীও তার তৃতীয় প্রবন্ধটি সাজিয়েছেন। মুরাদের এই প্রবন্ধটি ভাষার গাঁথুনি, আবেগের যুক্তিযুক্ততা এবং চিন্তাগত সঙ্গতির দিক থেকে উৎকৃষ্টতর।  

ছফার পরার্থপরতা প্রবন্ধে মুরাদের মুগ্ধতার প্রকাশ স্পষ্ট। কিন্তু ছফা সম্পর্কে তিনি যে বিষয়গুলো উত্থাপন করেছেন তার কোনটিই মিথ্যা নয়। মূলত মুরাদের ছফা বিষয়ক প্রবন্ধগুলোতে তার ছফামুগ্ধতা, আচ্ছন্নতা এবং ছফা অনুধাবনের আন্তরিকতা স্পষ্ট। এসব পর্যালোচনা পড়ে সাধারণ পাঠক ছফা সম্পর্কে একটি মহান ধারণা পাবে। কিন্তু ছফা বিষয়ক গবেষকদেরকে কিছুটা ক্রিটিক্যাল দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখতে হবে। মুরাদের প্রবন্ধে ছফার লেখার সুন্দর রিভিউ ফুটে উঠেছে। এতে মূল লেখার সংক্ষিপ্তসার এবং অতিশায়ন বাদ দিলে সুন্দর মূল্যায়নও ধরা পড়েছে। মুরাদের ভাষা সমৃদ্ধ, তবে ভাষার ব্যাকরণের সাথে সাথে চিন্তার ব্যাকরণে সঙ্গতি বিধান করলে লেখার মান আরও উৎকৃষ্ট হতো। অনুচ্ছেদগুলোর সঙ্গতিপূর্ণ ক্রমপরম্পরা নিশ্চিত করাও আবশ্যক।   

আবদুর রশিদ ছিদ্দিকী বাঙলা ভাষার কীর্তিমান পুরুষ, বাঙলা ভাষায় সাংবাদিকতার গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোক্তা, সর্বোপরি চাটাগাঁইয়া ভাষার পুরোধা ব্যক্তিত্ব, যিনি একইসাথে হাসান মুরাদ ছিদ্দিকীর পিতামহ। এই লেখক পরিবারে বেশ কয়েকজন গুণী লেখক আছেন। ভাষা ও সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে রশিদ ছিদ্দিকীর অবিস্মরণীয় ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু তার সাহিত্যিক তৎপরতা এবং উপনিবেশ বিরোধী রাজনৈতিক ভূমিকাকে বি-উপনিবেশবাদ তত্ত্ব দ্বারা ব্যাখ্যা করা কিছুটা সমস্যাজনক। কারণ খোদ বি-উপনিবেশবাদ তত্ত্বটি রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক বিশ্লেষণের জায়গায় কাম্য তত্ত্ব নয়। রাজনৈতিক তৎপরতার দিক থেকে উপনিবেশবিরোধী হলেও বি-উপনিবেশবাদ তত্ত্বে ঘটনার ঐতিহাসিক যোগসূত্র, ঐতিহ্যের পরম্পরা এবং প্রাতিষ্ঠানিক ধারাবাহিকতাকে অস্বীকার করার কিছু রাজনৈতিক এজেন্ডাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। কালের পরিক্রমায় বি-উপনিবেশবাদেরই নবউন্মোচন দরকার পড়ে। তারপরও আবদুর রশিদ ছিদ্দিকীর ভূমিকা স্মরণ করতে মুরাদের প্রবন্ধের চেয়ে নির্ভরযোগ্য বর্ণনা নেই। এই লেখা নতুন পাঠকদের ঐতিহ্যের পাটাতন যোগাবে।

লেখকের দায়বোধ প্রবন্ধে বিদ্যমান সমাজ-বাস্তবতার আলোকে লেখালেখির জায়গা থেকে কিছু সমালোচনা  যেমন চোখে পড়ে তেমনি লেখকদের কেমন হওয়া উচিত, এমন কিছু ঔচিত্যবোধের প্রতি ইঙ্গিতও পাওয়া যায়। মহাকবি গ্যোয়েটে সম্পর্কে প্রশংসা করে লেখা প্রবন্ধে একজন বিশ্বসাহিত্যিকের মোটামুটি সামগ্রিক দিক উঠে এসেছে। গ্যোয়েটে বিশ্বসাহিত্যের ব্যতিক্রমধর্মী ব্যক্তিত্ব যার প্রতিভা ও কীর্তির অবধি নেই। শেক্সপীয়র, গ্যোয়েটে এবং রবীন্দ্রনাথের মধ্যে কে বড় এই তর্ক এখনো অমীমাংসিত। মুরাদ তার প্রবন্ধে এই মহান ব্যক্তিত্বের সামগ্রিক দিক চিত্রায়িত করার প্রয়াস পেয়েছেন। লিটল ম্যাগাজিনের গুরুত্ব নিয়ে লেখক এখানে পূর্বাপর প্রেক্ষাপট তুলে ধরেছেন, সৃষ্টিশীলতা ও সাহিত্য চর্চার প্রকৃত জায়গা অনুসন্ধান করতে গিয়ে লিটল ম্যাগাজিনের তুলনামূলক শ্রেষ্ঠত্ব কবুল করেছেন। লিটল ম্যাগাজিনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে একে উৎসাহব্যঞ্জক অভিধায় বিভূষিত করে লেখক এর শক্তি ও বৈপ্লবিক ভূমিকার স্বপ্ন দেখেছেন।

রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশের সমকালীন সংকটগুলোর অন্যতম। এটি মূলত আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সংকট, যার পশ্চাতে ভূমিকা রেখেছে ঐতিহাসিক, জাতিগত, ভূ-রাজনৈতিক, ধর্মীয়, জনতত্ত্বগত এবং নিরাপত্তা কৌশলগত উত্তরাধিকার। লেখক স্থানীয় অধিবাসী হিসেবে এবং একজন সচেতন পাঠক হিসেবে নিজের জায়গা থেকে সমস্যাটিকে পাঠ করার প্রয়াস পেয়েছেন। তিনি এটাকে ব্যাখ্যা করার জন্য ষোড়শ শতকে শাহ সুজার ট্র্যাজিক ঘটনার উল্লেখ করেছেন। কিন্তু একটি ফ্রন্টিয়ার এলাকা হিসেবে আরাকানের সংকটটি ঐতিহাসিকভাবে আরও পুরনো। বলতে গেলে ৩০০০ বছর পূর্বে ধান্যবতী রাজ্য পত্তন থেকে শুরু করে, ৭২০ খ্রিষ্টাব্দে চন্দ্র রাজপরিবারের উত্থান, মহা থাইং সান্দার রাজত্বকালে আরব্য জাহাজ ঢুবি, দশম শতকে পিউ রাজ্যের পত্তন, চতুর্দশ শতকে ম্রোক-উ রাজ্য পত্তন হয়ে, ষোড়শ শতকে শাহ সুজার ঘটনা এবং সর্বশেষ ব্রিটিশ কর্তৃক বার্মা দখলের মাধ্যমে ইতিহাসের একটি ধারাবাহিক পরম্পরা আছে, যার প্রত্যেকটি ঘটনাগত পরিবর্তন পরবর্তী ঘটনাকে প্রভাবিত করেছে। ফলে রোহিঙ্গা সংকটের একটি ঐতিহাসিক দিক আছে, যা সংকটটিকে বুঝার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। লেখক বিচ্ছিন্ন তথ্যের ভিত্তিতে সংকটটিকে যেভাবে দেখেছেন এবং যেভাবে সংকটের সমাধান বাতলে দেওয়ার প্রয়াস নিয়েছেন তা, যদিও বিপ্লবাত্মক, কিছুটা বাস্তবতা বিবর্জিত। তবে তার লেখায় স্বদেশপ্রেম ও রোহিঙ্গা জাতির প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ পেয়েছে।

হাসান মুরাদের সর্বশেষ প্রবন্ধ কক্সবাজারের কবিতা প্রসঙ্গে। এটি আঞ্চলিক সাহিত্যের পরিপ্রেক্ষিতে লেখা হলেও বর্তমান যুগে আঞ্চলিক বলে কিছু নেই, তাই আঞ্চলিক বলা যায় না। যোগাযোগের দিক থেকে প্রত্যেক অঞ্চলই বাদবাকি বিশ্বের সাথে নিবিষ্ঠভাবে অন্বিত। এতে তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা জহিরুল ইসলাম ছিদ্দিকীর লেখা ‘একাত্তর ও আমি’ ও ‘আমার যত গান’ নিয়ে আলোচনা করেছেন। কবি মোহাম্মদ আলী চৌধুরী, অধ্যাপক পদ্মলোচন বড়ুয়া, চাটগাঁইয়া গণশিল্পী সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, গবেষক ফরিদুদ্দীন ফারুক, কবি রুহুল কাদের, আনম রফিকুর রশীদের উপন্যাস ‘শূন্যবৈভব’, কবি জামাল সাকিবের ‘হৃৎচাদরের গোপন সুতো’, মুহাম্মদ ইয়াকুব, কবি সাইফুল মোস্তফা, কবি সাদ্দাম হোসেনের ‘যাচ্ছে উড়ে অনেক দূরে’ ইত্যাদি লেখক ও তাদের লেখা নিয়ে সংক্ষিপ্ত মন্তব্যবাচক বর্ণনা দিয়ে সাহিত্যিক তৎপরতার ভূমিকা টেনেছেন। কবিদের আছে নিজস্ব জগত, অনুভূতি, সংবেদন ও ভাষা। তাদের সমাজও ব্যতিক্রমধর্মী বলা যায়। স্থানীয় পরিবেশে বাস করেও বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা অর্জন এখন অসম্ভব নয়, তাই সাহিত্যের বিশ্বপরিমণ্ডলে স্থানীয় সাহিত্যও প্রকারান্তরে জাতীয় ও বিশ্ব সাহিত্যই। লেখক সংক্ষিপ্ত পরিসরে তাদের কীর্তি ও সম্ভাবনা মূল্যায়ন করেছেন, হয়তো অনুল্লেখিত আরও কবি সাহিত্যিক লেখকের চারপাশে রয়েছেন। পাঠক ভবিষ্যতে তাদের সম্পর্কেও অবহিত হবেন বলে আশা করা যায়।

সামগ্রিকভাবে হাসান মুরাদের ‘অনুসন্ধান’ গ্রন্থটি আহমদ ছফা সম্পর্কে আন্তরিক বয়ানের উন্মোচন ঘটায়। আঞ্চলিক, জাতীয় ও বিশ্ব সাহিত্য সম্পর্কেও বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি হাজির করে। এটি ভাষার দিক থেকে সুখাপাঠ্য, এবং প্রবন্ধগ্রন্থ হিসেবে সংগ্রহযোগ্য।

 

সরওয়ার কামাল

লেখক ও গবেষক             

 

     

Comments

Popular posts from this blog

মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার কারণ ও প্রতিকার

সরওয়ার কামাল শিক্ষাক্ষেত্রে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য সাফল্য রয়েছে। সামাজিক উন্নয়ন সূচকেও বাংলাদেশের অবস্থান প্রতিবেশি দেশগুলোর তুলনায় ভালো, যা সম্পর্কে প্রশংসা করে বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন প্রবন্ধ লিখেছেন “ ল্যানসেট ” নামক মেডিক্যাল জার্নালে। কিন্তু এতে আমাদের বগল বাজিয়ে আত্মতৃপ্তিতে ভোগার অবকাশ নেই। কারণ শিক্ষার্থী ঝরে পড়া এবং বিজ্ঞান শিক্ষা সংকুচিত হয়ে পড়া আমাদের সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভুত হয়েছে। শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার কারণে আমাদের শিক্ষার মূল লক্ষ্যগুলো হাসিল হচ্ছে না, যার একটি হলো সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করা, অপরটি হলো শিক্ষাক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় প্রণোদনার ন্যায্য বণ্টন নিশ্চিত করা। অর্থাৎ সব শিশুই যাতে সরকারের সুযোগ ব্যবহার করে উন্নত জীবনের সন্ধান করতে পারে, তার শতভাগ নিশ্চয়তা প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না। শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার বিভিন্ন কারণ রয়েছে, তার মধ্যে বিভিন্ন স্তরের শিক্ষার ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন কারণ রয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার প্রধান কারণ দারিদ্র্য ও অপুষ্টি বা স্বাস্থ্যহীনতা । মাধ্যমিক পর্যায়েও শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার ক্ষেত্রে দারিদ্র্য সমস্যার ...

তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি বিচিত্র ছলনা জালে

তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি বিচিত্র ছলনা জালে ............................................................................... সাম্প্রতিক কালে আমাদের নৈতিক উপলব্ধিতে, সামাজিক উদ্বেগে কিংবা মূল্যবোধে দৃশ্যমান পরিবর্তন এসেছে। প্রযুক্তির নিবিড় ব্যবহার, বিশ্বায়নের প্রভাব, বিশ্বরাজনীতির অভিঘাত, বাজার সংস্কৃতির ধাক্কা ও চরমপন্থী ভাবাদর্শের টানাপড়েনে আমাদের চিরকালীন মূল্যবোধ ভেঙ্গে পড়েছে। নৈতিকতার সীমানা সরে যাচ্ছে প্রথাগত বিশ্বাস ও প্রতিষ্ঠানসংলগ্নতা থেকে। গতিময় জীবনের অভিঘাতে চরম অস্থিরতা ব্যক্তি থেকে ব্যষ্টির ব্যাপ্তিতে বিরাজ করছে। সর্বত্র আহাজারি, শোনার অবসর নিয়ে হাজির নেই কেউ। মানুষ যে নির্বিকার তাও নয়, তারা বিকারগ্রস্থ, পূর্ণমাত্রায় ঘোরগ্রস্থ, কেবল অপ্রত্যাশিত ঘটনাপ্রবাহের সাথে তাল মেলানোতে। তারা এখন এমন সব বিষয়ে আলোড়িত হয়, যে বিষয়ের সাথে তাদের সরাসরি যোগ নেই। থাকলেও তা অনেক ক্ষীণ ও দূরবর্তী কার্যকারণ সম্পর্কে আবদ্ধ। একইভাবে, তারা এমন সব পরিণতি ভোগ করে, যার জন্য তারা নিজেরা দায়ী নয়। আর যারা দায়ী তারা এর পরিণতি ভোগ করেন না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষ বয়সের দিকে এই প্যার...

মহেশখালীর সমাজ ও সংস্কৃতি

সরওয়ার কামাল সাগর কূলে গিরিকুন্তলা মোহিনী মহেশখালী দ্বীপের ৩৮৮ বর্গকিলোমিটার ভূত্বকে প্রায় পাঁচ লক্ষ লোকের বসতি। তাদের বসতি ঘিরে গড়ে উঠেছে উপকূলীয়-দ্বীপাঞ্চলীয় সমাজ। এই সমাজসভ্যদের মানসিক ঐক্য ও জীবনযাপন পদ্ধতি নিয়ে তৈরি হয়েছে শনাক্তযোগ্য বিশেষ স্থানীয় সংস্কৃতি। মানবজাতির চিরকালীন অভিযাত্রার অংশ হিসেবে দেশের নানা জায়গা থেকে হিজরত করে লোকজন এসে বসতি গেড়েছে মহেশখালীতে। তাই তাদের ভাষা ও আচরণে শনাক্ত করা যায় এমন বৈচিত্র্য ও তারতম্য, যা দিয়ে কক্সবাজারের অন্যান্য অঞ্চলের অধিবাসীদের তুলনায় মহেশখালীবাসীকে স্বতন্ত্রভাবে চিহ্নিত করা যায়। যে পার্থক্যসূচক বৈশিষ্ঠ্যাবলী নিয়ে মহেশখালীর সমাজ ও মানুষের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য তৈরি হয়েছে, চাটগাঁইয়া ভাষার উপভাষাতুল্য মহেশখালীর দ্বীপাঞ্চলীয় বুলি তার মধ্যে বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। [1] তবে সমস্যা হলো, লিখিত সাহিত্য ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের অভাবে স্থানীয় ইতিহাসের মতোই কালিক সূচকের নিরিখে এর জনসংস্কৃতি বর্ণনা করা দুরূহ। একেতো সংস্কৃতি স্বয়ং একটি ব্যাপক ধারণা, তদুপরি, এটি সতত পরিবর্তনশীল। ভাষা ও সংস্কৃতি স্রোতস্বী নদীর মতো বহমান। মানুষের কথা, স্মৃতি, পুরা...