Skip to main content

চাটগাঁর ভাষা পরিস্থিতি এবং আবদুর রশিদ সিদ্দিকী

সরওয়ার কামাল

Language is a dialect with an army and a navy

       -Max Weinreich

চাটগাঁর ভাষা পরিস্থিতির (সস্যুর, ২০১১: ১০১)[1] ওপর আলোকপাত করলে যে কয়টি মৌলিক প্রশ্ন ফণা তুলে আসে, তার একটি চাটগাঁইয়া ভাষার স্বাতন্ত্র্য নিয়ে। মাগধী প্রাকৃতের দুহিতা কিংবা মাগধী প্রাকৃতের অপভ্রংশ (মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে গৌড়ি প্রাকৃতের অপভ্রংশ)[2] হিসেবে চাটগাঁইয়া ভাষা বাঙলার উপভাষা কিনা, এই বিষয়ে ভাষাবিদ্যার দিগবলয়ে পাণ্ডিত্যের নিশান উড়ানো মহারথিগণ নির্বিবাদে একমত। তারা অন্তত এই বিষয়ে একমত যে, চাটগাঁইয়া ভাষা বাঙলার উপভাষা। ভাষাতাত্ত্বিকদের মধ্যে জর্জ গ্রিয়ার্সন, জে ডি এন্ডার্সন, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, সুকুমার সেন, পরেশ্চন্দ্র মজুমদার, মুহম্মদ এনামুল হক, ড. মনিরুজ্জামান এবং সলিমুল্লাহ খান প্রমুখের ধারণা, চাটগাঁইয়া ভাষা বাঙলারই উপভাষা। ভাষাতাত্ত্বিক মহাম্মদ দানীউল হকও মনে করেন, যতক্ষণ একটি ভাষার ব্যাকরণগত বৈশিষ্ট্যাবলি কোন জননী ভাষার আশ্রয়ী থাকে, ততক্ষণ সে ভাষাকে স্বতন্ত্র ভাষা বলার সুযোগ নেই।[3] তাদের এই ধারণার প্রধান উৎস জর্জ গ্রিয়ার্সন সংকলিত ‘লিঙ্গুইস্টিক সার্ভে অব ইন্ডিয়া’(১৯০৩) এবং সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের গবেষণাজাত সন্দর্ভ ‘দ্য অরিজিন এন্ড ডেভেলপমেন্ট অব দ্য বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ’ (১৯২৬)। অথচ গ্রিয়ার্সনসহ তার উত্তরসূরীদের গবেষণালব্দ সন্দর্ভের পরিপ্রেক্ষিত, ভাষা ও সাহিত্যের রাজনৈতিক ইতিহাস এবং সর্বোপরি পদ্ধতিতত্ত্বের দিক পর্যালোচনা করলে তাদের এই দাবির পক্ষে জোরালো প্রমাণ মেলে না। মজার বিষয় হলো, তাদের প্রত্যেকেই এই ধারণার সাথে একটি সতর্কতামূলক নোকতা পূর্বেই দিয়ে রেখেছিলেন। রূপ-বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে চাটগাঁইয়া ভাষাকে বাঙলা থেকে ভিন্ন বলে মনে করেছিলেন।[4] অর্থাৎ তারা চাটগাঁইয়া ভাষাকে উপভাষা বলে দাবি করলেও বাঙলার আর দশ পাঁচটা উপভাষার তুলনায় চাটগাঁইয়া ভাষার স্বাতন্ত্র্য স্বীকার করে একে সম্ভাব্য মূল ভাষা হিসেবে গণ্য করার পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন। ঐতিহাসিক তুলনামূলক পদ্ধতি বা কালানুকেন্দ্রিক পদ্ধতিতে অনুসন্ধান করে লেখা তাদের সমূহ সন্দর্ভের উত্তরকালে গুরুভক্তিযোগে যেসব গৌণ পুস্তক লেখা হয়েছে, তাতেও এই সূক্ষ্ম প্রশ্নটি চেপে যাওয়ার প্রয়াস লক্ষ করা যায়। অথচ, বিদ্যায়তনিক তৎপরতার বাইরে থেকেও, চাটগাঁর ভাষা প্রসঙ্গে বলিষ্ঠভাবে ব্যতিক্রম আবদুর রশিদ সিদ্দিকী, যিনি তাবৎ পণ্ডিতের বিপক্ষে গিয়ে ঔপনিবেশিক ভাষানীতির পদ্ধতিগত ত্রুটি উন্মোচন করেছিলেন এবং চাটগাঁইয়া ভাষাকে স্বতন্ত্র ভাষা বলে ঘোষণা করেছিলেন। সমসাময়িক মনীষী আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ ও ড. মুহম্মদ এনামুল হকের সাথে এই নিয়ে তার স্পষ্ট মতভিন্নতা ছিল। উপভাষা নিয়ে অন্যান্যদের তুলনায় সিদ্দিকীর ভাবনা শুধু ভিন্ন নয়, সমাজভাষাবিজ্ঞান, ভাষা দর্শন এবং আধুনিক ভাষাতত্ত্বের দিক থেকেও প্রাগ্রসর।

 আমরা এই নিবন্ধে চাটগাঁইয়া ভাষাতত্ত্বের পথিকৃৎ, পুরোধা সাংবাদিক ও লেখক আবদুর রশিদ সিদ্দিকীর ভাষাভাবনার সূত্র ধরে ভাষাপরিস্থিতি এবং আধুনিক ভাষাতত্ত্বের আলোকে চাটগাঁইয়া ভাষা বাঙলা ভাষার উপভাষা কিনা পর্যালোচনা করে দেখব। এটা করতে গিয়ে চাটগাঁইয়া ভাষা সম্পর্কে পূর্বসূরীদের মতামতসমূহ পরখ করে দেখব; দেখব আসলেই চাটগাঁইয়া ভাষা বাঙলা ভাষার উপভাষা কিনা। এছাড়া চাটগাঁইয়া ভাষা সম্পর্কে এযাবৎ যারা চিন্তাভাবনা করেছেন, তাদের মধ্যে আবদুর রশিদ সিদ্দিকীর গুরুত্ব ও অবস্থান চিহ্নিত করার প্রয়াস নেব। আবদুর রশিদ সিদ্দিকীর চিন্তার ওপর যারা আলোকপাত করেছেন, তাদের লেখাজোঁখার হদিস নেব। সেইক্ষেত্রে, তারা কি জর্জ গ্রিয়ার্সন অথবা সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতো এক ক্ষুরে মাথা কামিয়েছেন, নাকি তাদের প্রভাব থেকে মুক্ত থেকে চাটগাঁইয়া ভাষার অবস্থান বিবেচনা করেছেন তা খতিয়ে দেখব। আধুনিক ভাষাতত্ত্বের জনক ফের্দিনঁ দ্য সস্যুর ভাষা ও উপভাষা নির্ণয়ের ক্ষেত্রে পূর্বসূরীদের অনুসৃত প্রথাগত নীতি ও পদ্ধতিগুলোকে অপর্যাপ্ত মনে করেন[5]। সেই অপর্যাপ্ততার জায়গায় নতুন করে ভাববার অবকাশ আছে। ফলত, আবদুর রশিদ সিদ্দিকীর ভাষাভাবনাকে নতুন চিন্তার সাথে সংযুক্ত করে দেখার সাথে সাথে চাটগাঁইয়া ভাষার নব মূল্যায়নেরও সুযোগ আছে।     

প্রাসঙ্গিকভাবেই, জর্জ গ্রিয়ার্সন কর্তৃক পরিচালিত ভাষা জরিপের নীতি, পদ্ধতি ও ফলাফল সম্পর্কে আলোচনা করা প্রয়োজন। জর্জ গ্রিয়ার্সনের ‘লিঙ্গুইস্টিক সার্ভে অব ইন্ডিয়া’ হলো ২১ খণ্ডে রচিত বিপুলায়তন ভাষা সংকলন।[6] এটি ভারতীয় অঞ্চলে অন্যতম গবেষণা সূত্রপাতকারী রেফারেন্স, যার প্রভাব উত্তরকালের সমস্ত ভাষাতাত্ত্বিক গবেষণার ওপর পড়েছে। এতে ভারতীয় অঞ্চলের ৭২৩টি ভাষা-উপভাষার ভিন্নতা ও ব্যাকরণগত দিক আলোচিত হয়েছে। গ্রিয়ার্সনের জীবৎকালে তিন ধাপে এই জরিপটি সম্পাদিত হয়। প্রথম ধাপের প্রারম্ভে সমস্ত ভাষার একটি তালিকা দেওয়া হয়েছে। প্রত্যেকটি ভাষা থেকে তিনটি করে নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। নমুনা সংগ্রহ করেন তৎকালীন জেলা পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তারা। চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে ভাষাজরিপের তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন চট্টগ্রামের তৎকালীন ডিসি জেমস ড্রামন্ড এন্ডার্সন (এরপর থেকে জে ডি এন্ডার্সন)। চাটগাঁইয়া ভাষার প্রবাদ প্রবচন নিয়ে রচিত প্রথম বইটিও জে ডি এন্ডার্সনের। রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ বন্ধু এন্ডার্সন আমলাজীবন সমাপন করে কিছুদিন ক্যাম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে বাঙলা পড়িয়েছিলেন। যাইহোক, তাদের সংগৃহীত নমুনার প্রথমটি হলো বাইবেলের একটি অনুচ্ছেদ, যা প্রত্যেক টার্গেট ভাষায় অনুদিত ছিল। দ্বিতীয় নমুনা হলো, স্ব স্ব ভাষার একটি কবিতা বা লোককথার অংশ বিশেষ এবং তৃতীয়টি জর্জ ক্যাম্পবেল কর্তৃক ১৮৬৬ সালে সংকলিত কিছু প্রচলিত ও মানশব্দের নমুনা। সংগৃহীত নমুনা বিশ্লেষণ শেষে, উইলিয়াম জোন্সের অনুসরণে, গ্রিয়ার্সন ভাষার তুলনা-প্রতিতুলনা করে মিল-অমিলের ভিত্তিতে ঠিক করেছিলেন, কোনটি মূল ভাষা এবং কোনটি উপভাষা। নমুনা পর্যবেক্ষণের পয়লা নীতি ছিল, সাহিত্যের ভাষাকে মূল ভাষা এবং মৌখিক বুলিকে উপভাষা বলে সাব্যস্ত করা। দ্বিতীয় নীতি ছিল, প্রশাসনিক ক্রমসোপানের আদলে ভাষা ও সংস্কৃতির ক্রমসোপান বজায় রাখা। তৃতীয় নীতি ছিল, রাজনৈতিক কেন্দ্র বা ভিত্তিভাষার কেন্দ্র থেকে প্রান্তিক ভাষার স্থানিক বৈচিত্র্য বিবেচনা করা। স্মরণ রাখা দরকার, জরিপের শুরুতে গ্রিয়ার্সন ও জে ডি এন্ডার্সন যে কয়টি পূর্বতসিদ্ধ নীতি ঠিক করে রেখেছিলেন, সেগুলো স্পষ্টতই ঔপনিবেশিক দৃষ্টিকোণ থেকে উৎসারিত। ধ্বনিতত্ত্ব ও রূপতত্ত্বের দিক থেকে সমধর্মী নমুনা পর্যালোচনা করে পরবর্তীতে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এবং মুহম্মদ এনামূল হকও চাটগাঁইয়া ভাষাকে বাঙলার উপভাষা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। বাঙলা ও চাটগাঁইয়া ভাষা অতীতে কোন না কোন কালিক পর্যায়ে একই ছিল কিংবা তারা একই ভাষাজাত, কেবল আঞ্চলিক ভিন্নতার কারণে তাদের রূপভিন্নতা দেখা দিয়েছে, এই হলো তাদের সুচিন্তিত অভিমত। রবীন্দ্রনাথ শব্দের প্রাদেশিক প্রয়োগের দিকে নির্দেশ করতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন, ‘সকল দেশেই প্রাদেশিক প্রয়োগের বৈচিত্র্য আছে, তথাপি এক-একটি বিশেষ প্রদেশ ভাষা সম্বন্ধে অন্যান্য প্রদেশের ওপর কর্তৃত্ব করিয়া থাকে’।[7] এই পরিপ্রেক্ষিতে গবেষক মোঃ আবুল কাসেমের অভিমতও প্রণিধানযোগ্য। তার মতে, চাটগাঁইয়া ভাষায় তদ্ভব শব্দের হার শতকরা সত্তর ভাগ; এই ভাষার কোন লিখিত ও প্রত্ন-ইতিহাস নেই।[8] বাঙলাভাষী ভাষাবিদদের জোরালো মত হলো, বাক্যতত্ত্বের দিক থেকে চাটগাঁইয়া ভাষা বাঙলার অনুগামি। এই ভাষার নিজস্ব শব্দভাণ্ডারও অপর্যাপ্ত।   

যাইহোক, ভাষাচিন্তকদের ব্যক্তিগত ঝোঁকের দিকে নজর না দিয়ে আমরা তাদের অনুসৃত পদ্ধতিতত্ত্বের দিকে নজর দিতে চাই। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে, চাটগাঁইয়া ভাষার প্রতি জে ডি এন্ডার্সনের আগ্রহের কমতি ছিল না; ভাষাগত সমত্বের প্রতি উপেক্ষাও ছিল না। তা সত্ত্বেও, ভাষাজরিপের ক্ষেত্রে চাটগাঁইয়া ভাষাকে বাঙলার আঞ্চলিক বুলি বলার যে ভাষাতাত্ত্বিক পদ্ধতি তিনি অবলম্বন করেছেন, যে বৃক্ষ মডেল অনুসরণ করেছেন, তা সহজ কথায় ভাষার আমলাতন্ত্র। প্রশাসনিক ক্রমসোপানের আদলে ভাষা ও সংস্কৃতির ক্রমসোপান নির্ধারণ করতে গিয়ে গ্রিয়ার্সন ও জে ডি এন্ডার্সন উভয়েই ভাষার ওপর পূর্বতঃসিদ্ধ ক্ষমতাকাঠামো চাপিয়ে দিয়েছেন। ভাষা ও সংস্কৃতির প্রকৃত উৎস ও উৎপত্তি বিবেচনা না করে, সমকালীন রাজনীতি প্রভাবিত ভাষা পরিস্থিতির আলোকে চাটগাঁইয়া বুলিকে বিবেচনা করেছেন। ফলে ভাষা এবং, সেই অর্থে, শব্দের ব্যুৎপত্তি, রূপান্তর এবং উচ্চারণ সংক্রান্ত বিবেচনা, তাদের ক্ষেত্রে, একটি বৈকল্পিক বিবেচনা; চূড়ান্ত বিবেচনা নয়। যে ক্ষমতার দুর্গ থেকে প্রাচ্যবাদি তাকানি দিয়ে তারা চাটগাঁইয়া ভাষাকে অবলোকন করেছেন, তা প্রান্তিক ভাষাকে প্রান্তিক প্রতিষ্ঠানের মতোই অধস্তন ভাবার জায়গা। ভাষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে কেন্দ্র ও প্রান্ত উৎপাদনের এই ক্রমসোপানতন্ত্র জন্ম নিয়েছিলো খোদ উপনিবেশিক সরকারের দাপ্তরিক প্রয়োজনে। দাপ্তরিক শৃঙ্খলা[9] রক্ষা করে পরিচালিত এই জরিপ, রমিলা থাপারের ভাষায় ইতিহাসের একটি দাপ্তরিক ভাষ্য।[10] রণজিৎ গুহও তার সাব অল্টার্ণ স্টাডিজ সংকলনের ভূমিকাতে এই বক্তব্যের প্রতিধ্বনি করেছেন।[11]

অতীতে রাজনৈতিক ভূগোল এবং সাংস্কৃতিক বলয়ের ভিন্নতার কারণে চাটগাঁইয়া ভাষা যেমন বাঙলা থেকে ভিন্ন ছিল, কালিক বিবর্তনের ভিন্ন ভিন্ন পর্যায়েও চাটগাঁইয়া ভাষার বিভিন্ন রূপ দেখা দিয়েছিল।[12] তাই, স্মরণ রাখা দরকার, গ্রিয়ার্সন যখন ভাষা জরিপ করছেন, তখন চট্টগ্রাম সার্বিক অর্থেই কলকাতাকেন্দ্রিক ক্ষমতাবলয়ের অধীন। যেহেতু চারটি প্রধান শক্তি, রাজশক্তি, ধর্মশক্তি, সাহিত্যশক্তি এবং বাণিজ্যশক্তি থেকে ভাষার প্রভাব তৈরি হয়, বাঙলার প্রভাবও এসব কারণজাত।[13] তাই, স্বাভাবিকভাবেই বাঙলাকে কেন্দ্র ধরে অপরাপর ভাষার ক্রমঅবস্থান হিসেব করা হয়েছে। অথচ আমির খসরু, যিনি জাতিতে তুর্কী, ভাষার অঞ্চলভেদে স্বাতন্ত্র্য স্বীকার করেছিলেন। স্থানের ভিত্তিতে সিন্ধি, গুজরাটি, তামিল, লাহোরি, বাঙলা, ইত্যাদি ভাষাকে তার স্ব স্ব অঞ্চল ভেদে স্বতন্ত্র বলে চিহ্নিত করেছিলেন। ইতিপূর্বে আলবেরুণী (১০৩০ খ্রিস্টাব্দ) এবং আমির খসরু (১৩১৭ খ্রিস্টাব্দ) কর্তৃক ভারতীয় ভাষা জরিপের ক্ষেত্রে এই ধরনের কেন্দ্র-প্রান্তের ধারণা গ্রাহ্যতা পায় নি। গ্রিয়ার্সন কর্তৃক চালানো জরিপের পাঁচশো বছর পূর্বে যে ভাষা (চাটগাঁইয়া) স্বতন্ত্র ভাষাপরিচয়ে সংজ্ঞায়িত, পাঁচশো বছর পরে তাকে বাঙলার উপভাষা গণ্য করার অনুমানগত ছাঁচ ঔপনিবেশিক, পূর্বতসিদ্ধ এবং আরোপিত। এই জায়গায় আমির খসরু এবং গ্রিয়ার্সনের পদ্ধতিগত ভিন্নতা বিবেচনায় নিলে চাটগাঁইয়া ভাষা প্রশ্নের একটি প্রাথমিক মীমাংসা হয়। আমির খসরু ও গ্রিয়ার্সনের মতো প্রবল ভিন্নতা আবদুর রশিদ সিদ্দিকীও বজায় রেখেছিলেন তার সুচিন্তিত মত ও মন্তব্যে।[14]

 প্রাচ্যবিদ্যায় ভাষাচর্চা যখন এক ধরনের ভাষাবিজ্ঞানের রূপ লাভ করছিল, তখন ওই কাজের অন্যতম সূত্রধার ছিলেন উইলিয়াম জোন্স ও ম্যাক্স মুলার। জোন্সই প্রথম সংস্কৃত ও য়ুরোপীয় ভাষার মধ্যে মিল খুঁজে পান।[15] ম্যাক্স মুলার তার 'সায়েন্স অব ল্যাংগুয়েজ' বইতে ভারতীয় ভাষা সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভেন্টদের উদ্দেশ্যে ভারতীয় ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য নিয়ে ভাষণ দিতে গিয়ে তিনি ভারতীয় ভাষার কিছু রূপ ব্যাখ্যা করেছেন।[16]

সুনীতিকুমার নিজেও তার গবেষণায় বাঙলা ভাষাকে ভিত্তিভাষা বা মূলভাষা ধরে অন্যান্য ভাষার তুলনা ও প্রতিতুলনা করেছেন। তিনি উল্লেখ করতে ভুলেন নি, যে অশোকের রাজত্বকালে মাগধী প্রাকৃত ছিল দাপ্তরিক ভাষা বা প্রধান ভাষা।[17] পরে রাজনৈতিক কেন্দ্র পরিবর্তনের কারণে গুরুত্ব হ্রাস পেলে পাশাপাশি অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষাই লিখিত ও কথ্য ভাষায় উন্নীত হয়। বাঙলা, উড়িয়া, বিহারি, আসামি ইত্যাদি মাগধী প্রাকৃতের পরবর্তী ভাষা। শুরুর দিকে যেসব বাঙলা ব্যাকরণ লেখা হয়েছে, সেগুলোতে ভাষার ইতিহাস উল্লেখিত নেই। ফলে, বাঙলা কীভাবে তার লিখিত আদল বা রূপ পেল, সেই কারণ বিশেষ তখনো উদ্ঘাটিত হয় নি। বস্তুতঃ মাগধী প্রাকৃতের অপভ্রংশের মধ্যে চাটগাঁইয়াকে মূলভাষা ধরলে ফলাফল ঠিক উল্টো হতো। চাটগাঁইয়া ভাষার সাথে মূল তুলনাটা সরাসরি মাগধী প্রাকৃতের সাথে হলেও বাঙলার সাথে চাটগাঁইয়ার সম্পর্কটি ভাষা-উপভাষার হতো না। যেহেতু কালের পরিক্রমায় মাগধী তার স্বীয় গৌরব সমর্পন করেছে, তার জায়গায় বাঙলাকেন্দ্রিকতা য়ুরোকেন্দ্রিকতার মতোই একটি রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আধিপত্যের ধরন হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, সেহেতু বাঙলা বনাম চাটগাঁইয়ার সম্পর্ক ভাষা-উপভাষার স্তরে বিবেচিত হলো।   

সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় মনে করেন, ভারতের ভাষাগুলো চারটি মুখ্য ও স্বতন্ত্র ভাষাশ্রেণিতে পড়ে; যেমন, ১) আর্যগোষ্ঠী ২) দ্রাবিড় গোষ্ঠী ৩) অস্ট্রিক গোষ্ঠী বা কোল এবং ৪) ভোট-চীন গোষ্ঠী বা তিব্বতী-চীনা গোষ্ঠী।[18] তার মধ্যে বাঙলা হলো আর্যভাষাগোষ্ঠীর ভাষা। একটি জাত বা গোষ্ঠীকে অবলম্বন করে একটি ভাষা বহতা নদীর মতো কাল থেকে কালান্তরে বাহিত হয়। বঙ্গে ভাষাসমৃদ্ধির অন্যতম লক্ষণ বাঙলা সাহিত্য; তাই সাহিত্য নিয়ে বাঙলার যথার্থ লোকনেতাগণ গৌরব বোধ করেন।[19] বাঙলার পূর্বসূত্রে আর্যভাষার আদিতম ভাষারূপ পাওয়া যায় ঋগবেদে।[20] চাটগাঁইয়া ভাষা আর্যভাষাগোষ্ঠীরই অংশ, কেবল এর ইতিহাস সুরক্ষিত নেই কিংবা কোন নিদর্শন নেই বলে এই ভাষাকে তুলনামূলক আলোচনায় আনা যাচ্ছে না।[21]

চাটগাঁইয়া ভাষা বাঙলার উপভাষা কিনা, এই বিতর্কের বিপক্ষে অবস্থান নিলে আমাদের বাঘাবাঘা ভাষাবিশারদের প্রদর্শিত যুক্তি পরখ করে দেখতে হবে। তাদের যুক্তির বিপক্ষে যুক্তিপ্রমাণ উপস্থাপন করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, সর্বাগ্রে মূলভাষা ও উপভাষার সংজ্ঞা দিতে হবে। উভয়ের পার্থক্য নিরূপণকারী বৈশিষ্ট্যগুলো স্পষ্ট করতে হবে। ভাষাতত্ত্বের দিক থেকে যে যে পদ্ধতি অনুসরণ করলে নতুন জ্ঞানের আলোকে ভাষা-উপভাষার সংজ্ঞা ও পার্থক্য নির্ণয় করা যাবে, তার ভিত্তিতে প্রমাণ করতে হবে, চাটগাঁইয়া ভাষা বাঙলার উপভাষা নয়, বরং স্বতন্ত্র ভাষা।

গ্রীয়ার্সন থেকে পরেশচন্দ্র মজুমদারের গবেষণা পর্যন্ত যে তুলনামূলক পদ্ধতি বা কালানুকেন্দ্রিক পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়েছে তা ভাষা ও উপভাষা নির্ণয়ের আধুনিক পদ্ধতি নয়। পুরনো পদ্ধতি হিসেবেও তার কিছু মৌলিক ত্রুটি রয়েছে। পৃথিবীর নব্বইভাগ ভাষার মধ্যে ‘মা’ শব্দটির উচ্চারণগত মিল আছে। যেমনটা স্যার উইলিয়াম জোনস বলেছেন, যে ভাষার মধ্যে কমন সোর্স বা অভিন্ন উৎস আছে।[22] এখন কেউ যদি ‘মা’ শব্দটিকে নমুনা হিসেবে তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে তাহলে পৃথিবীর নব্বই ভাগ ভাষাই একটি আরেকটির উপভাষা বলে মনে হবে। এটা ভাষা-উপভাষার প্রশ্ন নয়, সমস্ত ভাষার অন্তর্নিহিত কিছু ধ্বণিগত ঐক্যের প্রশ্ন, মনুষ্যজাতি হিসেবে শারীরমনোবৃত্তীয় অভিন্নতার প্রশ্ন, ভাষার ইউনিভার্সাল গ্রামারের প্রশ্ন। অথচ গ্রীয়ার্সনের তুলনামূলক ভাষা বিশ্লেষণ পদ্ধতিতে এমন কিছু নির্বাচিত শব্দ, বাক্য ও বাগবিধি নিয়ে তুলনা করা হয়েছে, যা নমুনা হিসেবে সংকীর্ণ। এছাড়া তারা চাটগাঁইয়া ভাষার যে নমুনাগুলো তুলনা করেছেন সেগুলোও খাস চাটগাঁইয়া ভাষার নয়, বরং বাংলায়নকৃত চাটগাঁইয়ার। অনেকটা চাটগাঁইয়া ভাষাকে পিটিয়ে বাঙলার কাছাকাছি নিয়ে বসানো হয়েছে বলা যায়। বস্তুতঃ চাটগাঁইয়া ভাষার নিজেরই দু’টি স্পষ্ট উপভাষা শনাক্ত করা যায়, যার চারটি বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন অঞ্চল রয়েছে; যেমন, উত্তর চট্টগ্রাম, দক্ষিণ চট্টগ্রাম, মহেশখালী-কুতুবদিয়া দ্বীপাঞ্চল এবং পার্বত্য অঞ্চল প্রভাবিত ভাষা।[23] এর সাথে চাটগাঁইয়া ও রোয়াইঙ্গা ভাষার বাচিক পার্থক্যতো আছেই। কাজেই, তুলনামূলক পদ্ধতিতে বিচ্যুতি প্রকাশক নমুনা নিয়ে, ভাষা-উপভাষা সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত পৌঁছা মানে যুক্তিগতভাবে অবৈধ সার্বিকীকরণজনিত অনুপপত্তিকে মেনে নেওয়া। বাঙলা ও চাটগাঁইয়া ভাষার রূপ কালেকালে পরিবর্তিত ও বিবর্তিত হয়েছে। রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও আঞ্চলিক সংহতির কারণে এবং ব্যবসাকেন্দ্রের প্রভাবে ঔপনিবেশিক কালে চাটগাঁইয়া ভাষার উপর বাঙলার প্রভাব বেড়েছিল। বাঙলার কিছু শব্দ ও ভাষাভঙ্গি চাটগাঁইয়া ভাষার ওপর চেপেছিল। কাজেই, ভিন্ন ভাষার লোক যে ভিন্নভাবে চিন্তা করে, ভিন্ন ভঙ্গিতে অভিব্যক্তি প্রকাশ করে, তা পরখ করেও বাঙলা ও চাটগাঁইয়া ভাষার স্বাতন্ত্র্য চিহ্নিত করা সম্ভব।

দূর অতীতে আর্য-অনার্যের যে দ্বন্ধ, তা শুধু ধর্ম ও রাজনীতির দ্বন্ধ ছিল না, তা একইসাথে ভাষা ও আত্মপরিচয়ের দ্বন্ধ ছিল। কারণ ভাষা নিজেই আত্মপরিচয়ের একটি প্রধান সূত্র। সংস্কৃতি ভাষাকে প্রভাবিত করে, ভাষা জাতিকে।[24] যদিও মৌর্যদের আগমনের পুর্বে বাঙলায় স্থানীয় কেউ আর্য ভাষায় কথা বলতো না; কালের পরিক্রমায় আর্যভাষা অনার্যগৃহে প্রবেশ করেছে এবং অনার্যেরই ভাষা হয়ে উঠেছে।[25] এভাবে অনার্যের হাতে পড়ে আর্যভাষা ব্যাপক রূপান্তরের ভেতর দিয়ে গিয়েছে। অঞ্চলের দিক থেকে প্রান্তিক ভাষাগুলো নানা কারণেই কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ধারণ করে আছে। ব্রিটিশপূর্ব পর্যায়ে, মুঘল কিংবা সুলতানি আমলে চাটগাঁইয়া ভাষা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় ভিন্ন ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। মধ্যযুগে আরাকানি রাজসভায় চর্চিত বাঙলাও বঙ্গে চর্চিত বাঙলার চেয়ে কিছুটা ভিন্ন। গ্রীয়ার্সন ভাষা জরিপের জন্য যেসব নমুনা নিয়েছেন, সেগুলো কাকতালীয়ভাবে বাঙলার কাছাকাছি, যদিও পরিমাণ হিসেবে একেবারেই অপর্যাপ্ত। হয়তো ব্যাপক পরিসরে তুলনামূলক জরিপ করায় নমুনাগুলোকে কেজো রাখার জন্য তিনি এই কাজ করেছেন। অন্যদিকে গ্রীয়ার্সন নিজে এসে, ভাষা পরিস্থিতি ও ভাষা অঞ্চলে থেকে এই জরিপ করেন নি। তিনি একটি চিঠির মারফত ডিস্ট্রিক্ট অফিসারদের কাছে থেকে নমুনা চেয়ে সংগ্রহ করেছেন। ভাষা জরিপের শেষে এগুলোকে সূত্রবদ্ধ করার প্রাক্কালে গ্রিয়ার্সনের দৃষ্টিশক্তিও লোপ পেয়েছিল। ফলে কাজের জন্য তিনি মিসেস গ্রিয়ার্সনের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন। এতে গ্রিয়ার্সনের দক্ষতা ও সতর্কতার মাত্রা ব্যাহত হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

পরবর্তীকালে সুনীতিকুমার থেকে পরেশ্চন্দ্র পর্যন্ত সবাই গ্রীয়ার্সনকে ভক্তিযোগে অনুসরণ করেছেন। এমনকি তারা চাটগাঁইয়া ও সিলটি ভাষাকে স্বতন্ত্র ভাষা হওয়ার যোগ্য বিবেচনা করা সত্ত্বেও ভৌগোলিক নৈকট্য ও রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ঐক্যের লক্ষে এগুলোকে বাঙলার উপভাষা গণ্য করে গিয়েছেন। ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক ফ্রন্টিয়ার হিসেবে চট্টগ্রামে শুধু বাঙলা নয়, আরবি, ফার্সি, পালি, বার্মিজ, ইংরেজি, উর্দু, চাকমা প্রভৃতি ভাষার প্রভাব পড়েছে। এছাড়া অনাদিকাল থেকেই চট্টগ্রাম একটি জাতি ও সভ্যতার মেল্টিংপট বলে বিবেচিত। সেইসাথে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের জন্য বাংলা, ত্রিপুরা এবং বার্মার লড়াই জারি ছিল। এর ফলে বাঙলার সাথে চাটাগাঁইয়া ভাষার মৌলিক কিছু পার্থক্য তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে, ধর্ম, প্রার্থনালয়, বিদ্যালয়সহ যাবতীয় প্রতিষ্ঠানের প্রভাবে চাটগাঁইয়া ভাষা বাঙলার নৈকট্য লাভ করেছে। কেবল লিখিত সাহিত্যের অভাবে চাটগাঁইয়া ভাষা বাঙলা থেকে স্বতন্ত্র হওয়া সত্ত্বেও পৃথক ভাষার স্বীকৃতি পাচ্ছে না। ফরাসি দার্শনিক জাক লাকাঁর মতে, দুইটি ভাষাভাষী গোষ্ঠী ভিন্নভাবে চিন্তা করে[26]। সেইদিক থেকে বিবেচনা করলে, সন্দেহের অবকাশ নেই যে বাঙলা ভাষী ও চাটগাঁ ভাষী পৃথকভাবে চিন্তা করে। তাদের সিগ্নিফায়ার (বস্তু) এক হলেও সিগ্নিফাইড (ধারণা) ভিন্ন।

ভাষাগোষ্ঠীর দিক থেকে চাটগাঁর অধিবাসীরা সংখ্যায় বিপুল, অন্তত এক কোটি ত্রিশ লাখ; বিশ্বে ৭,১১১টি জীবন্ত ভাষার মধ্যে চাটগাঁইয়া ভাষার অবস্থান ৮৮তম।[27] চাটগাঁইয়ারা একাধিক ভাষায় কথা বলতে অভ্যস্ত। এতদাঞ্চলে আরব্য বণিকদের আগমন, তুর্কিদের আগমন, ওলন্দাজদের আগমন, ব্রিটিশদের আগমন, ত্রিপুরা প্রভাব এবং বার্মার প্রভাব, পাকিস্তানের প্রভাব ইত্যাদি কারণে ভাষার মধ্যেও কালেকালে নানা পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। প্রত্যেক কালপর্বে চাটগাঁইয়া ভাষায় নতুন শব্দ, বাগবিধি ও সংস্কৃতি আত্মীকৃত হয়েছে, পুরনো শব্দ নতুন উচ্চারণে ধ্বনিত হয়েছে এবং কিছুকিছু শব্দ একেবারে পরিত্যক্ত হয়েছে। ব্যবসা ও বাণিজ্যসম্পর্ক ভাষা পরিবর্তনের অন্যতম হাতিয়ার। চট্টগ্রাম একটি বন্দরনগরী এবং সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চল হওয়ায় এই অঞ্চলে অন্য ভাষাভাষী মানুষের আগমন ঘটেছে, যা ভাষার মধ্যে বৈচিত্র্য নিয়ে এসেছে। পাল যুগে বৌদ্ধ এবং সেনযুগে শৈব মতাবলম্বীদের[28] ধর্ম, সংস্কৃতি ও ভাষাগত পরিবর্তনের ইতিহাস আছে। রাজনৈতিক ভূখণ্ডের দ্বান্ধিক মোহনায় থেকেও চাটগাঁইয়া ভাষা যে বাঙলা, ত্রিপুরা ও আরাকানের প্রভাব থেকে স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে পারছে, তার পেছনে আছে এই অঞ্চলের একটি শক্তিশালী সাংস্কৃতিক সত্তার ভূমিকা। এই সাংস্কৃতিক সত্তা একটি স্বতন্ত্র চাটগাঁইয়া ভাষার ভিত্তিতে নির্মিত, যার লিখিত কিংবা প্রত্নতাত্ত্বিক ইতিহাস নেই, কিন্তু মৌখিক ও শ্রুতিনির্ভর সমৃদ্ধ উত্তরাধিকার আছে।      

হাল জমানায় ফের্দিনঁ দ্য সস্যুর ঐতিহাসিক বা কালানুকেন্দ্রিক (ডায়াক্রোনিক) ভাষাবিজ্ঞানের পরিবর্তে যে বর্ণনামূলক বা কালকেন্দ্রিক (সিনক্রোনিক) ভাষাবিজ্ঞানের প্রস্তাব করেছেন, তা অনুসরণ করলে অর্থাৎ কালেকালে ভাষা যে স্থান বিশেষে বিশেষ অবস্থা প্রাপ্ত হয় এবং কালের নিরিখে যে ভাষার পরিবর্তন ঘটে তা বিবেচনায় নিলে আমরা এই ভাষাবিজ্ঞানীদের দাবিকে খন্ডন করতে পারি।[29] সস্যুরের মতে, ভাষা চিহ্ন দিয়ে তৈরি। ভাষা যেসব চিহ্ন দ্বারা গঠিত তা বিমূর্ত নয়, বাস্তব। চিহ্ন এবং চিহ্নের সম্পর্কই মূলত ভাষাবিজ্ঞান।[30] চিহ্ন ও চিহ্নের সম্পর্ক দিয়ে, বিশেষ করে সাইন, সিগ্নিফায়ার ও সিগ্নিফাইড দিয়ে যদি ভাষা বিশ্লেষণ করা যায়, তাহলে বাঙলা ও চাটগাঁইয়া ভাষার বিস্তর পার্থক্য শনাক্ত করা সম্ভব। চিহ্নের মধ্যে ভাষাচিহ্ন ও দৃশ্যচিহ্ন দুইভাগে ভাগ করা যেতে পারে। [31] কারণ ভাষাচিহ্নের সাথে শব্দ, ধ্বনি এবং বস্তুর সম্পর্ক রয়েছে। চিহ্ন ব্যতীত দুইটি ধারণার মধ্যে পার্থক্য করা যায় না। ভাষাতো মূলত ধ্বনিবিশিষ্ট সুশৃঙ্খল চিন্তা। অন্যদিকে শব্দ ছাড়া আমাদের মানসিক চিন্তাগুলো অবয়বহীন।[32] সস্যুর প্রবর্তিত কালকেন্দ্রিক ভাষাবিজ্ঞান পরপর ক্রমপদের (টার্মের) সম্পর্ক বিচার করে। যা কালেকালে একটি আরেকটির জন্য ব্যবহৃত হয়। চূড়ান্ত স্থবির কোন কিছু নেই। ভাষার প্রতিটি অংশই পরিবর্তনশীল।[33] ভাষাতাত্ত্বিক অবস্থার সাথে ভৌগোলিক অবস্থানের সম্পর্ক আছে, তাই এক জায়গা থেকে আরেক জায়গার ভাষাগত পার্থক্য আছে।[34] দুইটি জনগোষ্ঠী যখন সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের দিক থেকে পৃথক হয়, তখন তাদের আঞ্চলিক ভাষাও স্বতন্ত্র ভাষার মর্যাদা পায়। বোধগম্যতার প্রশ্নে ভৌগোলিকভাবে আঞ্চলিক মনে হলেও ভাষাগুলো আসলে স্বতন্ত্র। সাধারণত সিগ্নিফায়ার ও সিগ্নিফায়েডের সহ-সম্পর্ককেই চিহ্ন বলে বিবেচনা করা হয়।[35] এই চিহ্নের ভিত্তিতেই ভাষা তৈরি করে অর্থ। চিহ্ন উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় বাঙলা ও চাটগাঁইয়া ভাষার কিছু পার্থক্য আছে। তাই একই শব্দ বাঙলা ও চাটগাঁইয়া ভাষায় ভিন্ন অর্থ জ্ঞাপন করে। যেমন, উদাহরণ হিসেবে আমরা যদি বলি, ‘পোন ফাড়ি আইক্কাপ যার’, যেখানে আইক্কাপ (সিগ্নিফায়ার) হলো মায়ানমারের একটি শহর, যা তীব্র কষ্টজ্ঞাপক (সিগ্নিফায়েড), তা বাঙলা হতে একেবারে ভিন্ন ধরনের চিহ্ন তৈরি করে। আরও বলা যেতে পারে, ‘বউয়ে খানা বাছের’, যেখানে খানা বাছা মানে পোয়াতি হওয়া বুঝাচ্ছে।[36]      

একই ভাষা অঞ্চলভেদে তার উচ্চারণগত ও রীতিগত পার্থক্য ধারণ করে। উচ্চারণ ও ভাষারীতির দিক থেকে অঞ্চলভেদে যে পার্থক্য তাই হলো আঞ্চলিক উপভাষা। যেমন, বাঙলার সাথে ঢাকাইয়া কিংবা নোয়াখালির ভাষা তুলনা করলে আঞ্চলিক রূপ বুঝা যায়। কিন্তু চাটগাঁইয়া ভাষা ব্যাকরণগত সাদৃশ্য ধারণ করলেও বোধগম্যতার দিক থেকে বাঙলার সাথে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ পার্থক্য ধারণ করে। কাজেই চাটগাঁইয়া ভাষাকে বাঙলার উপভাষা দাবি করা রাজনৈতিক সংহতির লক্ষে সঠিক হলেও আধুনিক ভাষাতত্ত্বের নিরিখে কঠিন। উপভাষার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, “উপভাষা হলো একটি ভাষার অন্তর্গত এমন একটি বিশেষ রূপ, যা একেকটি বিশেষ অঞ্চলে প্রচলিত, যার সঙ্গে আদর্শ ভাষা বা সাহিত্যিক ভাষার ধ্বনিগত, রূপগত এবং বিশিষ্ট বাগধারাগত পার্থক্য আছে। এই পার্থক্য এমন সুস্পষ্ট যে ঐসব বিশেষ বিশেষ অঞ্চলের রূপগুলোকে স্বতন্ত্র বলে ধরা যাবে, অথচ পার্থক্যটা এত বেশি নয় যাতে আঞ্চলিক রূপগুলিই এক একটি সম্পূর্ণ পৃথক ভাষা হয়ে উঠে’।

(A specific form of a given language, spoken in a certain locality or geographic area, showing sufficient differences from the standard or literary form of that language, as to pronunciation, grammatical construction and idiomatic usage of words, to be considered a distinct entity, yet not sufficiently distinct from other dialects of the language to be regarded as a different language.)”[37]

যেকোন ভাষার একটি আদর্শ রূপ থাকে কিন্তু তার একাধিক কথ্য রূপ থাকতে পারে। আদর্শ রূপটি সর্বজনগ্রাহ্য। কথ্যরূপগুলো একেকটা অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষারূপ। এই আঞ্চলিক ভাষা রূপকেই অভিহিত করা হয়, উপভাষা বলে। উপভাষা মূলত- ১) একটি বিশেষ অঞ্চলে প্রচলিত কথ্যভাষা, ২) একটি ভাষার বিশিষ্ট আঞ্চলিক ও সামাজিক রূপ, যার মধ্যে বিশেষ ধরনের শব্দ ও ব্যাকরণগত গঠনবৈশিষ্ট্য নিহিত থাকে, ৪) মূল ভাষার সাথে পার্থক্য বিশেষভাবে লক্ষণীয়, ৫) এটি হচ্ছে একটি ভাষার রূপ বৈচিত্র্য। কাজেই চাটগাঁইয়া ভাষাকে বাঙলার উপভাষা দাবি করা একেবারে অনায্য নয়, যদি না কেউ বাঙলার সাথে এর পার্থক্য, বোধগম্যতা, সংস্কৃতি ইত্যাদি বিবেচনার বাইরে রাখে। তবে, ভাষা ও উপভাষার পার্থক্য নিরূপন করা দুঃসাধ্য। এইজন্যই হয়তো, নোম চমস্কি তার ‘নলেজ অব ল্যাঙ্গুয়েজ’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ভাষা ও উপভাষার পার্থক্য নিরূপন করা অসম্ভব। কারণ ভাষার ইউনির্সাল গ্রামার একই। তাদের যুক্তিবিন্যাস একই। তবে তিনি ভাষা বৈচিত্র্যের মাত্রা ও ব্যাপকতার ওপর নির্ভর করে একটি ভাষা থেকে আরেকটি ভাষার স্বাতন্ত্র্য বিবেচনা করা যায় বলে মনে করেন। কাজেই, কোন একটি ভাষার বিশেষ একটি উপভাষা যদি বৈচিত্র্যের দিক থেকে বেশি ভিন্ন হয়, তাহলে সেটিকে উপভাষা না বলে ভাষা বলাই শ্রেয়।[38]

 ব্রিটিশ আমলে বিশাল বঙ্গ-প্রেসিডেন্সির একটা জেলা চট্টগ্রাম কীভাবে বুলির স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করে এসেছে, তা নিয়ে গভীরভাবে ভেবেছেন কক্সবাজারে সাংবাদিকতার পথিকৃৎ, লেখক ও লোকগবেষক আবদুর রশিদ সিদ্দিকী।[39] তিনি চাটগাঁইয়া ভাষার স্বাতন্ত্র্য নিয়ে অনেকের সাথেই ভিন্নমত পোষণ করেছিলেন। গোঁড়া ও সংকীর্ণ আঞ্চলিকতার টানে নয়, তিনি এটা করেছিলেন মূলত গভীর সাংস্কৃতিক বোঝাপড়া এবং মত প্রকাশের সাহস থেকে। আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের সাথে সাহিত্য পত্রিকা ছাড়াও ভাষার স্বাতন্ত্র্য নিয়ে তার মতান্তর ঘটেছিল। আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ চাটগাঁইয়া ভাষার স্বাতন্ত্র্য স্বীকার করতেন না, তা নয়; তিনি এটাকে বাঙলার উপভাষা মনে করতেন, যেমনটা আর দশ-পাঁচজন প্রাচ্যবাদ প্রভাবিত জাত্যাভিমানি বাঙালি লেখক মনে করতেন। মধ্যযুগে চট্টগ্রাম ও আরাকান অঞ্চলে বাঙলা সাহিত্যের তুঙ্গীয় বিকাশ ও চর্চা, এই ধরনের ধারণাকে আরও বেশি পোক্ত করেছিল। বাঙলা সাহিত্যে সৈয়দ সুলতান, শাহ মুহাম্মদ সগীর, আলাওল, আলী রজা, নসরুল্লাহ খান খন্দকার, প্রমুখ সাহিত্যিকের গৌরবজনক ভূমিকা ছিল। সাহিত্যের এই ঐতিহাসিক পর্বের গৌরব ও ঐতিহ্য স্মরণ রেখে, এমনকি বাঙলার প্রতি তার অপরিসীম দরদ সত্ত্বেও, আবদুর রশিদ সিদ্দিকী চাটগাঁইয়া ভাষার স্বাতন্ত্র্যের কথা বলতে দ্বিধা করেন নি। চট্টগ্রামী ভাষাতত্ত্বে (১৯৩৫) তিনি দৃঢ়ভাবে উল্লেখ করেছেন,“চট্টগ্রাম বঙ্গদেশের সীমান্ত জেলা এবং এতদাঞ্চলের অধিবাসীরাও বাঙালি, তত্রাচ এ জেলার কথ্য ভাষা বা বুলি বাঙলা ভাষা হইতে স্বতন্ত্র”। তিনি এটাও মনে করেন, যে চট্টগ্রামী (চাটগাঁইয়া) ভাষা উর্দু ক্রিয়াপদের ওপর প্রতিষ্ঠিত। “উর্দুই চট্টগ্রামী ভাষার বাহন, আরবি ইহার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, পার্শি ইহার অঙ্গরাগ এবং বাঙ্গালা ইহার নয়নাঞ্জন”।[40]

 ভাষা ও সংস্কৃতির পারস্পরিক প্রভাব এবং নির্ভরশীলতা বিবেচনায় নিলে বাঙলা ও চাটগাঁইয়া ভাষার মধ্যে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য চোখে পড়ে। রাজনীতি ও আঞ্চলিক সংহতির পূর্বাপর ইতিহাস বিবেচনায় নিলে চাটগাঁইয়া ভাষার সাথে বাঙলার নৈকট্যের কারণ এবং স্বাতন্ত্র্যের কারণ উভয়ই চিহ্নিত করা যায়। যে সময়কালে গ্রীয়ার্সন ভাষা জরিপ করছিলেন, সেই সময়কাল হচ্ছে বাঙলার সাথে চাটগাঁইয়া ভাষার নৈকট্যের কাল। তাই তাদের কাছে চাটগাঁইয়া ভাষাকে বাঙলার উপভাষা বা আঞ্চলিক রূপ বলে মনে হয়েছে। চাটগাঁইয়া ভাষা বাঙলার অন্যান্য উপভাষার তুলনায় ধ্বনিতত্ত্ব ও রূপতত্ত্বের দিক থেকে আলাদা। [41] সাধারণত প্রত্যেক ভাষা পৃথক হিসেবেই বিবেচিত, একটি অপরটির কাছে বোধগম্য নয়, যেমনটা ফ্রেন্সভাষী লোকজন জার্মান বুঝে না। [42] কাজেই, স্বতন্ত্র ভাষাভাষী লোকেরা সাধারণত অপর ভাষা বুঝে না। উপভাষা হলে মূলভাষা ও উপভাষার লোকজন পারষ্পরিক ভাষা বোধগম্য হওয়ার কথা। একই যুক্তি যদি আমরা বিবেচনায় নিই এবং চাটগাঁইয়া ভাষা ও বাঙলার পারষ্পরিক বোধগম্যতার বিষয় আমলে নিই, তাহলে দেখা যায়, চাটগাঁইয়া ভাষা বাঙলার উপভাষা নয়, স্বতন্ত্র ভাষা। কারণ চাটগাঁইয়া ভাষা বাঙলাভাষীরা বুঝে না, যতক্ষণ না অনুবাদ করে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। এমনকি বাঙলার অন্যান্য উপভাষা চর্চাকারীদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। ফলে সমসাময়িক কালে যারা ভাষাবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করছেন তারাও এই বিষয়ে সদর্থক মত ব্যক্ত করেছেন যে, চাটগাঁইয়া ভাষা বাঙলা থেকে আলাদা একটি ভাষা হিসেবে বিবেচিত হওয়ার মতো যথেষ্ট ভিন্ন।[43]

 ধ্বনিতত্ত্ব ও রূপতত্ত্বের ভিত্তিতে চাটগাঁইয়া ভাষা বাঙলা থেকে পৃথক কিনা বিচারের জন্য আমরা ভাষা দুইটির ধ্বনিতাত্ত্বিক ও রূপতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করতে পারি। ধ্বনিতাত্ত্বিকভাবে চাটগাঁইয়া ভাষার একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য আছে, এবং তা ধ্বনির ক্ষেত্রে, ব্যাকরণে এবং শব্দের ভেতরে, এমনকি বাক্যে বা শব্দের বিশিষ্ঠার্থক ব্যবহারেও পরিলক্ষিত হয়। চট্টগ্রামের ভাষা ঠিক বাঙলার ভাষা নয়, অর্থাৎ ধ্বনি প্রকরণ ও ব্যাকরণে চাটগাঁইয়া ভাষা বাঙলা ভাষার উপভাষা সমূহের সমশ্রেণীর নয়। চন্দ্রবিন্দু ও অনুনাসিক উচ্চারণে বাঙলা ও চাটগাঁইয়া ভিন্ন। বাংলায় এটার উচ্চারণ একেবারে অভাব, অথচ চাটগাঁইয়াতে তার বাহুল্য পরিলক্ষিত হয়। আবার চাটগাঁইয়া ভাষায় য-ফলার ‘য’ স্পষ্ট উচ্চারিত হয়, এবং তার পুর্বে ই-কার এসে পড়ে। যথা- লক্ষ্য= লৈক্ষ্য ল-ই-ক্ষ্য; শূন্য=সৈন্য স-ই-ন্য, অন্য=ঐন্য অ-ই-ন্য ইত্যাদি। চাটগাঁইয়া ভাষায় শব্দের মধ্যস্থিত ‘ব’ লোপ পায়। আবদুর রশিদ সিদ্দিকী নিজেও দেখিয়েছেন, কীভাবে রবিবার=রইবার, উপবাস= উপাস হয়।[44] বাঙলা খাইছি, চাটগাঁইয়াতে খাইয়ি; মানে বাঙলার ‘ছি’=চাটগাঁইয়া ‘ই’। বাঙলায় ‘এটা’= চাটগাঁইয়া ‘ইয়ান’; বাঙলা ‘ওটা’=চাটগাঁইয়া ‘এইয়ান’। বাঙলার ‘ট’ চাটাগাঁইয়াতে ‘ড়’ হিসেবে উচ্চারিত হয়, যেমন- ঘটি=ঘড়ি; বাটি=বাড়ি, মাটি=মেড়ি। এভাবে খেয়াল করলে দেখা যায়, চাটগাঁইয়া ভাষা ও বাঙলা ভাষার ধ্বনিতাত্ত্বিক পার্থক্য ব্যাপক।

 রূপতাত্ত্বিক বা ব্যাকরণগত বৈশিষ্ট্য পর্যালোচনা করেও বাঙলা ভাষা ও চাটগাঁইয়া ভাষার পার্থক্য নিরূপন করা সম্ভব। বলা হয়ে থাকে, বাঙলার প্রধান বিভাষা চাটগাঁইয়া। এতে উচ্চারণ বিষয়ে, পদের ব্যবহারে, শব্দরূপে এবং ধাতুরূপে বাঙলার সাথে ব্যাপক পার্থক্য আছে। চাটগাঁতে কারকে বিভক্তির ব্যবহারে বাঙলা হতে ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়; যেমন- বাবু স্কুলে যায়, যেখানে এ বিভক্তি আছে, তা চাটগাঁইয়াতে হবে, বাবু স্কুলত যায়, মানে স্কুল+ৎ বিভক্তি। একইভাবে, কর্তায় ‘এ’ অপদানে ‘অত’ ‘তুন’, সম্মন্ধে ‘অর’, বহুবচনে গুন উন, যথা- কুঁ উরগুন। বর্তমানকালে প্রথমপুরুষে ‘ব’ তৃতীয় পুরুষে ‘বে’ হয়। কাল বুঝাতে অতীতকালে প্রথম পুরুষে (গ) ইয়ম, ‘গে’, যথা- গরগিয়ম, গরিয়ম, গরগি অথবা গরজিয়ম ইত্যাদি ব্যবহৃত হয়। একটি মজার বাক্য দিয়ে দক্ষিণ চট্টগ্রামের চাটগাঁইয়া ভাষার একটি বাক্য বলা যেতে পারে, ‘বুইজ্জ্যা কুইজ্জ্যারতুন গইজ্জ্যাই গইজ্জ্যাই দইজ্জ্যাত পরি মইজ্জ্যে’, মানে বুড়ো খড়ের গাদা থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে সাগরে পড়ে মারা গেছে। এই বাক্য বাঙলার সাথে চাটগাঁইয়া ভাষার পার্থক্যটা ধ্বনিতত্ত্ব ও রূপতত্ত্ব উভয় দিক থেকেই ব্যাপক। কাজেই এটা স্পষ্ট যে, বাঙলা ও চাটগাঁইয়া ভাষার ধ্বনিতাত্ত্বিক ও রূপতাত্ত্বিক পার্থক্য বাঙলার অপরাপর উপভাষাগুলোর তুলনায় ব্যাপক এবং মৌলিক। যে অর্থে নোয়াখালির ভাষা বাঙলার উপভাষা, সেই অর্থে চাটগাঁইয়া ভাষা বাঙলার উপভাষা, ব্যাপারটা তেমন নয়। এইক্ষেত্রে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ কর্তৃক উল্লেখিত চারটি শক্তিই মূলত কাজ করেছে; বাঙলার রাজনৈতিক, ধর্মীয়, সাহিত্যিক ও অর্থনৈতিক শক্তিই চাটগাঁইয়া ভাষার ওপর প্রভাব ও আধিপত্য যুগিয়েছে। যে কোন ভাষার বাঁচা-মরা ভাষাতাত্ত্বিক কারণে নয়, রাজনৈতিক কারণে ঘটে। তাই তুরীয়ভাবেই উপভাষা একটি রাজনৈতিক ধারণা। ভাষা ও উপভাষার পার্থক্যটা যত না ভাষাতাত্ত্বিক, তার চেয়ে বেশি ক্ষমতা ও রাজনীতির।     

 ভাষা হিসেবে বাঙলা নিজেও একটি নির্দিষ্ট বুলি থেকে উৎপত্তি লাভ করে নি, বরং মাগধী অপভ্রংশের বিভিন্ন প্রকরণ থেকে উৎপন্ন হয়েছে।[45] তাই এই ভাষার বিভিন্ন উপভাষা থাকা সম্ভব। কিন্তু উপভাষা হচ্ছে একটি স্টেট অব ল্যাঙ্গুয়েজ, একটি ভাষা পরিস্থিতি, ভাষার একটি স্থান-কালিক অবস্থা, যা যে কোন সময় একটি স্বতন্ত্র ভাষা হিসেবে আবির্ভুত হওয়ার সম্ভাবনা ধারণ করে।

 বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে ভাষাগত স্বাতন্ত্র্য নিয়ে চাটগাঁইয়া ভাষাতত্ত্ব সম্পর্কে আবদুর রশিদ সিদ্দিকীর লেখা বইটি একাডেমিক অর্থে খুব মানসম্মত কোন গবেষণা গ্রন্থ নয়, কিন্তু তিনি যে প্রশ্নগুলো তুলেছেন এবং চাটগাঁইয়া ভাষার ধ্বনিগত ও রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করেছেন, তা অত্যন্ত মৌলিক ও মূল্যবান। তার চিহ্নিত বৈশিষ্ট্যগুলোই বরং অন্যরা, বুঝে হোক কিংবা না বুঝে, এড়িয়ে গেছেন। অন্যদের প্রদত্ত যুক্তিতে ফ্যালাসি অব এক্সক্লুডেড মিডল ঘটেছে। ব্যাপারটা অনেকটা এমন; আমাদের দেশে কুকুরে কামড়ালে একটা ঔষধ খাওয়ানোর রসম আছে। এটা কলায় পুরে খাওয়ানো হয়। বাচ্চারা অনেক সময় কলাটা খায় কিন্তু বিচি বা ঔষধটা ফেলে দেয়। তো গ্রীয়ার্সন থেকে শুরু করে পরেশ বাবুরা কলা ঠিকই খেয়েছেন, শুধু ঔষধটা ফেলে দিয়েছেন। অর্থাৎ যে জায়গায় চাটগাঁইয়া ভাষার স্বাতন্ত্র্যের ভিত্তি প্রবল, সে জায়গাগুলো তারা এড়িয়ে গেছেন। ধ্বনিগত পরিবর্তনের মাধ্যমে চাটগাঁইয়া ভাষাকে বাঙলার কাছাকাছি নিয়ে তারা ভাষার রুপ তুলনা করেছেন। এছাড়া বঙ্গ দেশের অতিথিরা যে উচ্চারণে চাটগাঁইয়া বুলি আওড়ায়, সেরকম একটা ভাষা-আকারকে আদর্শ ধরে তারা চাটগাঁইয়া ভাষাকে বিবেচনা করেছেন। তার সাথে শিক্ষিত মানুষের মুখের ভাষা বিবেচনায় নেওয়ার প্রভাবও কম নয়। কারণ শিক্ষিত মানুষ শুদ্ধ উচ্চারণে ভাষা বলতে গিয়ে ভাষার প্রচলিত এবং প্রকৃত রুপ বদলে ফেলে। শিক্ষিত মানুষের আঞ্চলিক ভাষা, বাংলায়নকৃত ভাষা। বাংলায়নকৃত ভাষা নিজেই একটি স্বতন্ত্র উপভাষা, যার সাথে প্রকৃত চাটগাঁইয়া ভাষার মিল থাকলেও দু’টো অভিন্ন নয়। আবদুর রশিদ সিদ্দিকীর ভাষা গবেষণা এই জায়গায় কিছুটা নিরপেক্ষতা বজায় রেখেছে। তিনি আশাতীতভাবে সমাদৃত না হওয়ার, আমার মনে হয়, অন্যতম কারণ, বাংলা ভাষার লেখকগণ বাঙলার বাইরে অন্যকোন ক্ষুদ্র ভাষার ক্ষীণ কণ্ঠ বরদাশত করতে চান নি। না হলে, আবদুর রশিদ সিদ্দিকীর পথ ধরে চাটগাঁইয়া ভাষার বিশুদ্ধ রূপ নিয়ে বাঙলা ভাষার তুলনামূলক বিশ্লেষণ করতে অনেকে এগিয়ে আসতেন। সর্বোপরি ভাষাকে ভাষার রাজনীতি থেকে দূরে রেখে অনপেক্ষভাবে বিচার করতে না পারলে প্রান্তিকভাষাগুলোর সমৃদ্ধ শব্দ ও চিহ্নগুলো টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। ভাষা, জাতীয়তা ও পরিচয়ের রাজনীতি নিয়ে ফেনোমেনলজিক্যাল পদ্ধতিতে এগোতে না পারলে, অর্থাৎ মনকে পুর্বতসিদ্ধ ধারণা থেকে দূরে রেখে বিষয় ও বিষয়ীর সম্পর্ক বিচার করতে না পারলে, আমাদের ভাষাভাবনা জ্ঞানতাত্ত্বিকভাবে নিরপেক্ষতা পাবে না। জ্ঞানতাত্ত্বিক ন্যায় নিশ্চিত করতে পারবে না।   

 ষাটের দশকে আবদুর রশিদ সিদ্দিকী চাটগাঁইয়া ভাষা নিয়ে, এমনকি রোয়াইঙ্গা ভাষা নিয়ে ভেবেছেন। চাটগাঁইয়া ও রোয়াইঙ্গা ভাষার পার্থক্য নিয়েও আলোকপাত করেছেন। যার সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক তাৎপর্য বুঝার জন্য শুধু ভাষাজ্ঞান থাকাই যথেষ্ট নয়, বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতি নিয়ে ভাবার হিম্মত থাকাও বাঞ্ছনীয়। আবদুর রশিদ সিদ্দিকী সাংবাদিকতা, রাজনীতি ও সাহিত্য চর্চার সাথে সাথে যে ভাষাতত্ত্ব চর্চায় ব্রতী হয়েছিলেন, সেটি তার রাজনীতি সচেতনতার অংশ। পৃথিবীতে মানবজাতির এমন কোন সম্পদ নেই, এমন উদ্ভাবিত কীর্তি নেই, যা ভাষার চেয়ে শ্রেয়। ভাষাকে আশ্রয় করেই মানুষের যাবতীয় প্রয়াস চলে; কীর্তি সাধিত হয়। কাজেই ভাষা, উপভাষা কিংবা মূল ভাষা, মানুষের প্রধান সাংস্কৃতিক সম্পদ। মানুষের মানুষ হিসেবে টিকে থাকার অন্যতম অবলম্বন। চাটগাঁইয়া ভাষা চাটগাঁবাসির সাংস্কৃতিক সম্পদ; চিন্তা ও স্বপ্নের মাধ্যম। চাটগাঁর ভাষা, সংগীত, প্রবাদ-প্রবচন, দাচ্ছান, কেচ্ছা-কাহিনী মিলে সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক উপাদান আছে, যা চাটগাঁইয়া ভাষাকে একটি স্বতন্ত্র ভাষার উপযুক্ত ভিত্তি যোগাতে নিরবধি কাজ করে চলছে। কাজেই, এই ভাষাকে সমৃদ্ধ করা এবং লিপি উদ্ভাবনের মাধ্যমে স্বতন্ত্র ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা ভাষাপ্রেমিদের দায়। এই দায় বহন করেই আবদুর রশিদ সিদ্দিকী চট্টগ্রামের ভাষাতত্ত্ব লিখেছেন। তাই চাটগাঁইয়া ভাষা, এবং সেই সূত্রে, আবদুর রশিদ সিদ্দিকীকে স্মরণ ও মূল্যায়ন করতে হবে একটি বিশেষ পরিপ্রেক্ষিত থেকে।  

 আবদুর রশিদ সিদ্দিকী কেবল চাটগাঁইয়া ভাষাতত্ত্বের পথিকৃৎ হিসেবে নয়, সাংবাদিকতার পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসেবে নয়, বরং চাটগাঁইয়া সংস্কৃতির একজন প্রবল প্রতিভু হিসেবে স্মরণীয়। চাটগাঁইয়া ভাষার যে কোন আলোচনা আবদুর রশিদ সিদ্দিকীকে পাশ কাটিয়ে চলতে পারে না। লিপির ব্যবহার চালু হলে ভাষা, সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের যোগসূত্রে চাটগাঁইয়া ভাষা কাল নিরিবধি টিকে থাকবে। তাতে আবদুর রশিদ সিদ্দিকীও আলোকবর্তিকার মতো প্রোজ্জ্বল হয়ে থাকবে।

 সরওয়ার কামাল ।। লেখক ও গবেষক



[1] Saussure, Ferdinand De (2011) Course in General Linguistics (Tr. Wade Baskin). New York: Columbia University Press. Pp-101 (সস্যুর ভাষা পরিস্থিতি বা ল্যাঙ্গুয়েজ স্টেট বলতে ভাষা যে একেক জায়গায় একেক সময় স্পষ্ট ভিন্নতা প্রদর্শন করে তা বুঝিয়েছেন। ভাষা স্থান ও কাল ভেদে সদা পরিবর্তনশীল। পরিবর্তনশীলতার ভেতরে ভাষার শনাক্তযোগ্য অবস্থাই হলো ভাষা পরিস্থিতি।)

[2] দীন মুহম্মদ, কাজী (২০১৯), বাঙলা ভাষা ও লিপির ইতিহাস, আনিসুজ্জামান সম্পাদিত বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, ১ম খণ্ড, ঢাকাঃ বাংলা একাডেমি। পৃ-২৯৭

[3] হক, মহাম্মদ দানীউল (২০১২) চাটগাঁ ভাষার রূপ-পরিচয় (ডঃ মাহবুবুল হক ও শিমুল বড়ুয়া সম্পাদিত). চট্টগ্রাম: চাটগাঁ ভাষা পরিষদ। পৃ-৩০

[4] চট্টোপাধ্যায়, সুনীতিকুমার (১৯৬৪) বাঙ্গালা ভাষা প্রসঙ্গে, কলকাতা: জিজ্ঞাসা. পৃ-৭২

[5] Id. Pp-L1V

[6] Majeed, Javed. (2019) Colonialism and Knowledge in Grierson’s Linguistic Survey of India.  Abington, Oxon: Routledge. pp-1

[7] ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ, (১৯৯৮) বাংলা শব্দতত্ত্ব, ঢাকাঃ অনন্যা। পৃ-৯১

[8] কাসেম, মোঃ আবুল (২০১২) চাটগাঁ ভাষার ইতিহাস অন্বেষা, চাটগাঁ ভাষার রূপ-পরিচয় (ডঃ মাহবুবুল হক ও শিমুল বড়ুয়া সম্পাদিত), চট্টগ্রাম: চাটগাঁ ভাষা পরিষদ। পৃ-২৫

[9] Majeed, Javed. (2019) Colonialism and Knowledge in Grierson’s Linguistic Survey of India. Abington, Oxon: Routledge. pp-50

[10] Thapar, Romila. (2002) The Penguin History of Early India. London: Penguin Books. Pp-2

[11] Guha, Ranajit. (1997) A Subaltern Studies Reader (1986-1995). Minneapolis: University of Minnesota Press. Pp- xv1

[12] Ali, Syed Murtaza. (1964), History of Chittagong, Dacca: Standard Publishers Ltd. Pp-164

[13] শহীদুল্লাহ, ডক্টর মুহম্মদ (২০১৫) ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ স্মারক গ্রন্থ, ঢাকা: বাংলা একাডেমি। পৃ-১৯৬

[14] Majeed, Javed. (2019) Colonialism and Knowledge in Grierson’s Linguistic Survey of India.  Abington, Oxon:  Routledge. pp

[15] Thapar, Romila (2003) The Penguin History of early India From the origin to AD 1300. London: Penguin Books. P-3

[16] Muller, Max F. (2015) India-What can It Teach us? New Delhi: Munshiram Manoharlal Publishers Pvt. Ltd. P-51

[17] Id.p-51

[18] চট্টোপাধ্যায়, সুনীতিকুমার।(১৯৯৬) বাঙলা ভাষাতত্ত্বের ভূমিকা, ৯ম সংস্করণ, কলিকাতা: কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়. পৃ-২

[19] প্রাগুক্ত, পৃ-৭

[20] প্রাগুক্ত, পৃ-১০

[21] কাসেম, মোঃ আবুল (২০১২) চাটগাঁ ভাষার ইতিহাস অন্বেষা, চাটগাঁ ভাষার রূপ-পরিচয় ( ডঃ মাহবুবুল হক ও শিমুল বড়ুয়া সম্পাদিত), চট্টগ্রাম: চাটগাঁ ভাষা পরিষদ। পৃ-২৫

[22] Garland Cannon(1992) Sir William Jones, language families, and Indo-European, Word, 43:1, p-50

[23] Dil, Afia. (2014) Bengali Language and Culture. Dhaka: Adorn Books. pp- 211

[24] Saussure, Ferdinand De (2011) Course in General Linguistics (Tr. Wade Baskin), New York: Columbia University Press. Pp-21

[25] চট্টোপাধ্যায়, সুনীতিকুমার (১৯৯৬) বাঙ্গালা ভাষাতত্ত্বের ভূমিকা, নবম সংস্করণ, কলকাতা: কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। পৃ-৩১

[26] Id-pp-21

[27] Barua, Amit. (2020) A Comparative Study of Phonological Bengali Language and Chittagonian dialect spoken in Bangladesh, Unpublished masters thesis. Thailand: Mahachulalongkornrajavidyalaya University. Pp-8

[28] চট্টোপাধ্যায়, সুনীতিকুমার (১৯৯৬) বাঙ্গালা ভাষাতত্ত্বের ভূমিকা, নবম সংস্করণ, কলকাতা: কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। পৃ-১০২

[29] আজাদ, হুমায়ুন (২০২১) তুলনামূলক ও ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞান, (৭ম মুদ্রণ), ঢাকা: আগামী প্রকাশনী. পৃ-১৮-১৯

[30] Saussure, Ferdinand De (2011) Course in General Linguistics (Tr. Wade Baskin). New York: Columbia University Press. Pp-102

[31] Id. p-103

[32] Id. p-111

[33] Id. P- 140

[34] Id. P-191

[35] Eco, Umberto. (1986) Semiotics and The Philosophy of Language. Bloomington: Indiana University Press. Pp-1

[36] ইসলাম, মুহম্মদ নুরূল (২০২০) বাঙলা ভাষার আঞ্চলিক শব্দ বৈচিত্র্যঃ কক্সবাজার, কক্সবাজার: কক্সবাজার সাহিত্য একাডেমি, পৃ- ২৭

[37] Pei, Merio A. and Gaynor, Frank (1970) A Dictionary of linguistics. London: Peter Owen. p.56

[38]  Chomsky, Noam. (1977) On Language. New York: The New Press, Pp-169

[39] সিদ্দিকী, এম আবদুররশিদ (১৩৫৩ বাঙলা) চট্টগ্রামী-ভাষাতত্ত্ব, চট্টগ্রাম: পৃ-৩

[40] সিদ্দিকী, আবদুররশিদ (১৩৪২ বাংলা) চট্টগ্রামী-ভাষাতত্ত্ব, চট্টগ্রাম: পৃ-৭

[41] Chatterjee, Suniti Kumar. (1970) The Origin and Development of the Bengali Language. London: pp-136-137

[42] Edwards, John. (2009) Language and Identity. New York: Cambridge University Press. P-57

[43] Masica, Colin P. (1991) The Indo-Aryan Languages. New York: Cambridge University Press. P-16

[44] সিদ্দিকী, আবদুররশিদ (১৩৫৪ বাংলা) চট্টগ্রামী ভাষাতত্ত্ব, চট্টগ্রাম: পৃ-২০

[45] Chatterjee, Suniti Kumar. (1970), …vol- v, part-1, p-139-141

Comments

Mehedi Hasan said…
Wonderful. I've been benefited immensely.

Popular posts from this blog

মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার কারণ ও প্রতিকার

সরওয়ার কামাল শিক্ষাক্ষেত্রে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য সাফল্য রয়েছে। সামাজিক উন্নয়ন সূচকেও বাংলাদেশের অবস্থান প্রতিবেশি দেশগুলোর তুলনায় ভালো, যা সম্পর্কে প্রশংসা করে বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন প্রবন্ধ লিখেছেন “ ল্যানসেট ” নামক মেডিক্যাল জার্নালে। কিন্তু এতে আমাদের বগল বাজিয়ে আত্মতৃপ্তিতে ভোগার অবকাশ নেই। কারণ শিক্ষার্থী ঝরে পড়া এবং বিজ্ঞান শিক্ষা সংকুচিত হয়ে পড়া আমাদের সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভুত হয়েছে। শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার কারণে আমাদের শিক্ষার মূল লক্ষ্যগুলো হাসিল হচ্ছে না, যার একটি হলো সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করা, অপরটি হলো শিক্ষাক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় প্রণোদনার ন্যায্য বণ্টন নিশ্চিত করা। অর্থাৎ সব শিশুই যাতে সরকারের সুযোগ ব্যবহার করে উন্নত জীবনের সন্ধান করতে পারে, তার শতভাগ নিশ্চয়তা প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না। শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার বিভিন্ন কারণ রয়েছে, তার মধ্যে বিভিন্ন স্তরের শিক্ষার ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন কারণ রয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার প্রধান কারণ দারিদ্র্য ও অপুষ্টি বা স্বাস্থ্যহীনতা । মাধ্যমিক পর্যায়েও শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার ক্ষেত্রে দারিদ্র্য সমস্যার ...

তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি বিচিত্র ছলনা জালে

তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি বিচিত্র ছলনা জালে ............................................................................... সাম্প্রতিক কালে আমাদের নৈতিক উপলব্ধিতে, সামাজিক উদ্বেগে কিংবা মূল্যবোধে দৃশ্যমান পরিবর্তন এসেছে। প্রযুক্তির নিবিড় ব্যবহার, বিশ্বায়নের প্রভাব, বিশ্বরাজনীতির অভিঘাত, বাজার সংস্কৃতির ধাক্কা ও চরমপন্থী ভাবাদর্শের টানাপড়েনে আমাদের চিরকালীন মূল্যবোধ ভেঙ্গে পড়েছে। নৈতিকতার সীমানা সরে যাচ্ছে প্রথাগত বিশ্বাস ও প্রতিষ্ঠানসংলগ্নতা থেকে। গতিময় জীবনের অভিঘাতে চরম অস্থিরতা ব্যক্তি থেকে ব্যষ্টির ব্যাপ্তিতে বিরাজ করছে। সর্বত্র আহাজারি, শোনার অবসর নিয়ে হাজির নেই কেউ। মানুষ যে নির্বিকার তাও নয়, তারা বিকারগ্রস্থ, পূর্ণমাত্রায় ঘোরগ্রস্থ, কেবল অপ্রত্যাশিত ঘটনাপ্রবাহের সাথে তাল মেলানোতে। তারা এখন এমন সব বিষয়ে আলোড়িত হয়, যে বিষয়ের সাথে তাদের সরাসরি যোগ নেই। থাকলেও তা অনেক ক্ষীণ ও দূরবর্তী কার্যকারণ সম্পর্কে আবদ্ধ। একইভাবে, তারা এমন সব পরিণতি ভোগ করে, যার জন্য তারা নিজেরা দায়ী নয়। আর যারা দায়ী তারা এর পরিণতি ভোগ করেন না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষ বয়সের দিকে এই প্যার...

মহেশখালীর সমাজ ও সংস্কৃতি

সরওয়ার কামাল সাগর কূলে গিরিকুন্তলা মোহিনী মহেশখালী দ্বীপের ৩৮৮ বর্গকিলোমিটার ভূত্বকে প্রায় পাঁচ লক্ষ লোকের বসতি। তাদের বসতি ঘিরে গড়ে উঠেছে উপকূলীয়-দ্বীপাঞ্চলীয় সমাজ। এই সমাজসভ্যদের মানসিক ঐক্য ও জীবনযাপন পদ্ধতি নিয়ে তৈরি হয়েছে শনাক্তযোগ্য বিশেষ স্থানীয় সংস্কৃতি। মানবজাতির চিরকালীন অভিযাত্রার অংশ হিসেবে দেশের নানা জায়গা থেকে হিজরত করে লোকজন এসে বসতি গেড়েছে মহেশখালীতে। তাই তাদের ভাষা ও আচরণে শনাক্ত করা যায় এমন বৈচিত্র্য ও তারতম্য, যা দিয়ে কক্সবাজারের অন্যান্য অঞ্চলের অধিবাসীদের তুলনায় মহেশখালীবাসীকে স্বতন্ত্রভাবে চিহ্নিত করা যায়। যে পার্থক্যসূচক বৈশিষ্ঠ্যাবলী নিয়ে মহেশখালীর সমাজ ও মানুষের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য তৈরি হয়েছে, চাটগাঁইয়া ভাষার উপভাষাতুল্য মহেশখালীর দ্বীপাঞ্চলীয় বুলি তার মধ্যে বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। [1] তবে সমস্যা হলো, লিখিত সাহিত্য ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের অভাবে স্থানীয় ইতিহাসের মতোই কালিক সূচকের নিরিখে এর জনসংস্কৃতি বর্ণনা করা দুরূহ। একেতো সংস্কৃতি স্বয়ং একটি ব্যাপক ধারণা, তদুপরি, এটি সতত পরিবর্তনশীল। ভাষা ও সংস্কৃতি স্রোতস্বী নদীর মতো বহমান। মানুষের কথা, স্মৃতি, পুরা...