সরওয়ার কামাল
Language is a dialect with an army and a navy
-Max Weinreich
চাটগাঁর ভাষা পরিস্থিতির (সস্যুর, ২০১১: ১০১)[1] ওপর আলোকপাত করলে যে কয়টি মৌলিক প্রশ্ন ফণা তুলে আসে, তার একটি চাটগাঁইয়া ভাষার স্বাতন্ত্র্য নিয়ে। মাগধী প্রাকৃতের দুহিতা কিংবা মাগধী প্রাকৃতের অপভ্রংশ (মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে গৌড়ি প্রাকৃতের অপভ্রংশ)[2] হিসেবে চাটগাঁইয়া ভাষা বাঙলার উপভাষা কিনা, এই বিষয়ে ভাষাবিদ্যার দিগবলয়ে পাণ্ডিত্যের নিশান উড়ানো মহারথিগণ নির্বিবাদে একমত। তারা অন্তত এই বিষয়ে একমত যে, চাটগাঁইয়া ভাষা বাঙলার উপভাষা। ভাষাতাত্ত্বিকদের মধ্যে জর্জ গ্রিয়ার্সন, জে ডি এন্ডার্সন, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, সুকুমার সেন, পরেশ্চন্দ্র মজুমদার, মুহম্মদ এনামুল হক, ড. মনিরুজ্জামান এবং সলিমুল্লাহ খান প্রমুখের ধারণা, চাটগাঁইয়া ভাষা বাঙলারই উপভাষা। ভাষাতাত্ত্বিক মহাম্মদ দানীউল হকও মনে করেন, যতক্ষণ একটি ভাষার ব্যাকরণগত বৈশিষ্ট্যাবলি কোন জননী ভাষার আশ্রয়ী থাকে, ততক্ষণ সে ভাষাকে স্বতন্ত্র ভাষা বলার সুযোগ নেই।[3] তাদের এই ধারণার প্রধান উৎস জর্জ গ্রিয়ার্সন সংকলিত ‘লিঙ্গুইস্টিক সার্ভে অব ইন্ডিয়া’(১৯০৩) এবং সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের গবেষণাজাত সন্দর্ভ ‘দ্য অরিজিন এন্ড ডেভেলপমেন্ট অব দ্য বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ’ (১৯২৬)। অথচ গ্রিয়ার্সনসহ তার উত্তরসূরীদের গবেষণালব্দ সন্দর্ভের পরিপ্রেক্ষিত, ভাষা ও সাহিত্যের রাজনৈতিক ইতিহাস এবং সর্বোপরি পদ্ধতিতত্ত্বের দিক পর্যালোচনা করলে তাদের এই দাবির পক্ষে জোরালো প্রমাণ মেলে না। মজার বিষয় হলো, তাদের প্রত্যেকেই এই ধারণার সাথে একটি সতর্কতামূলক নোকতা পূর্বেই দিয়ে রেখেছিলেন। রূপ-বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে চাটগাঁইয়া ভাষাকে বাঙলা থেকে ভিন্ন বলে মনে করেছিলেন।[4] অর্থাৎ তারা চাটগাঁইয়া ভাষাকে উপভাষা বলে দাবি করলেও বাঙলার আর দশ পাঁচটা উপভাষার তুলনায় চাটগাঁইয়া ভাষার স্বাতন্ত্র্য স্বীকার করে একে সম্ভাব্য মূল ভাষা হিসেবে গণ্য করার পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন। ঐতিহাসিক তুলনামূলক পদ্ধতি বা কালানুকেন্দ্রিক পদ্ধতিতে অনুসন্ধান করে লেখা তাদের সমূহ সন্দর্ভের উত্তরকালে গুরুভক্তিযোগে যেসব গৌণ পুস্তক লেখা হয়েছে, তাতেও এই সূক্ষ্ম প্রশ্নটি চেপে যাওয়ার প্রয়াস লক্ষ করা যায়। অথচ, বিদ্যায়তনিক তৎপরতার বাইরে থেকেও, চাটগাঁর ভাষা প্রসঙ্গে বলিষ্ঠভাবে ব্যতিক্রম আবদুর রশিদ সিদ্দিকী, যিনি তাবৎ পণ্ডিতের বিপক্ষে গিয়ে ঔপনিবেশিক ভাষানীতির পদ্ধতিগত ত্রুটি উন্মোচন করেছিলেন এবং চাটগাঁইয়া ভাষাকে স্বতন্ত্র ভাষা বলে ঘোষণা করেছিলেন। সমসাময়িক মনীষী আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ ও ড. মুহম্মদ এনামুল হকের সাথে এই নিয়ে তার স্পষ্ট মতভিন্নতা ছিল। উপভাষা নিয়ে অন্যান্যদের তুলনায় সিদ্দিকীর ভাবনা শুধু ভিন্ন নয়, সমাজভাষাবিজ্ঞান, ভাষা দর্শন এবং আধুনিক ভাষাতত্ত্বের দিক থেকেও প্রাগ্রসর।
প্রাসঙ্গিকভাবেই, জর্জ গ্রিয়ার্সন কর্তৃক পরিচালিত ভাষা জরিপের নীতি, পদ্ধতি ও ফলাফল সম্পর্কে আলোচনা করা প্রয়োজন। জর্জ গ্রিয়ার্সনের ‘লিঙ্গুইস্টিক সার্ভে অব ইন্ডিয়া’ হলো ২১ খণ্ডে রচিত বিপুলায়তন ভাষা সংকলন।[6] এটি ভারতীয় অঞ্চলে অন্যতম গবেষণা সূত্রপাতকারী রেফারেন্স, যার প্রভাব উত্তরকালের সমস্ত ভাষাতাত্ত্বিক গবেষণার ওপর পড়েছে। এতে ভারতীয় অঞ্চলের ৭২৩টি ভাষা-উপভাষার ভিন্নতা ও ব্যাকরণগত দিক আলোচিত হয়েছে। গ্রিয়ার্সনের জীবৎকালে তিন ধাপে এই জরিপটি সম্পাদিত হয়। প্রথম ধাপের প্রারম্ভে সমস্ত ভাষার একটি তালিকা দেওয়া হয়েছে। প্রত্যেকটি ভাষা থেকে তিনটি করে নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। নমুনা সংগ্রহ করেন তৎকালীন জেলা পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তারা। চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে ভাষাজরিপের তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন চট্টগ্রামের তৎকালীন ডিসি জেমস ড্রামন্ড এন্ডার্সন (এরপর থেকে জে ডি এন্ডার্সন)। চাটগাঁইয়া ভাষার প্রবাদ প্রবচন নিয়ে রচিত প্রথম বইটিও জে ডি এন্ডার্সনের। রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ বন্ধু এন্ডার্সন আমলাজীবন সমাপন করে কিছুদিন ক্যাম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে বাঙলা পড়িয়েছিলেন। যাইহোক, তাদের সংগৃহীত নমুনার প্রথমটি হলো বাইবেলের একটি অনুচ্ছেদ, যা প্রত্যেক টার্গেট ভাষায় অনুদিত ছিল। দ্বিতীয় নমুনা হলো, স্ব স্ব ভাষার একটি কবিতা বা লোককথার অংশ বিশেষ এবং তৃতীয়টি জর্জ ক্যাম্পবেল কর্তৃক ১৮৬৬ সালে সংকলিত কিছু প্রচলিত ও মানশব্দের নমুনা। সংগৃহীত নমুনা বিশ্লেষণ শেষে, উইলিয়াম জোন্সের অনুসরণে, গ্রিয়ার্সন ভাষার তুলনা-প্রতিতুলনা করে মিল-অমিলের ভিত্তিতে ঠিক করেছিলেন, কোনটি মূল ভাষা এবং কোনটি উপভাষা। নমুনা পর্যবেক্ষণের পয়লা নীতি ছিল, সাহিত্যের ভাষাকে মূল ভাষা এবং মৌখিক বুলিকে উপভাষা বলে সাব্যস্ত করা। দ্বিতীয় নীতি ছিল, প্রশাসনিক ক্রমসোপানের আদলে ভাষা ও সংস্কৃতির ক্রমসোপান বজায় রাখা। তৃতীয় নীতি ছিল, রাজনৈতিক কেন্দ্র বা ভিত্তিভাষার কেন্দ্র থেকে প্রান্তিক ভাষার স্থানিক বৈচিত্র্য বিবেচনা করা। স্মরণ রাখা দরকার, জরিপের শুরুতে গ্রিয়ার্সন ও জে ডি এন্ডার্সন যে কয়টি পূর্বতসিদ্ধ নীতি ঠিক করে রেখেছিলেন, সেগুলো স্পষ্টতই ঔপনিবেশিক দৃষ্টিকোণ থেকে উৎসারিত। ধ্বনিতত্ত্ব ও রূপতত্ত্বের দিক থেকে সমধর্মী নমুনা পর্যালোচনা করে পরবর্তীতে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এবং মুহম্মদ এনামূল হকও চাটগাঁইয়া ভাষাকে বাঙলার উপভাষা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। বাঙলা ও চাটগাঁইয়া ভাষা অতীতে কোন না কোন কালিক পর্যায়ে একই ছিল কিংবা তারা একই ভাষাজাত, কেবল আঞ্চলিক ভিন্নতার কারণে তাদের রূপভিন্নতা দেখা দিয়েছে, এই হলো তাদের সুচিন্তিত অভিমত। রবীন্দ্রনাথ শব্দের প্রাদেশিক প্রয়োগের দিকে নির্দেশ করতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন, ‘সকল দেশেই প্রাদেশিক প্রয়োগের বৈচিত্র্য আছে, তথাপি এক-একটি বিশেষ প্রদেশ ভাষা সম্বন্ধে অন্যান্য প্রদেশের ওপর কর্তৃত্ব করিয়া থাকে’।[7] এই পরিপ্রেক্ষিতে গবেষক মোঃ আবুল কাসেমের অভিমতও প্রণিধানযোগ্য। তার মতে, চাটগাঁইয়া ভাষায় তদ্ভব শব্দের হার শতকরা সত্তর ভাগ; এই ভাষার কোন লিখিত ও প্রত্ন-ইতিহাস নেই।[8] বাঙলাভাষী ভাষাবিদদের জোরালো মত হলো, বাক্যতত্ত্বের দিক থেকে চাটগাঁইয়া ভাষা বাঙলার অনুগামি। এই ভাষার নিজস্ব শব্দভাণ্ডারও অপর্যাপ্ত।
যাইহোক, ভাষাচিন্তকদের ব্যক্তিগত ঝোঁকের দিকে নজর না দিয়ে আমরা তাদের অনুসৃত পদ্ধতিতত্ত্বের দিকে নজর দিতে চাই। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে, চাটগাঁইয়া ভাষার প্রতি জে ডি এন্ডার্সনের আগ্রহের কমতি ছিল না; ভাষাগত সমত্বের প্রতি উপেক্ষাও ছিল না। তা সত্ত্বেও, ভাষাজরিপের ক্ষেত্রে চাটগাঁইয়া ভাষাকে বাঙলার আঞ্চলিক বুলি বলার যে ভাষাতাত্ত্বিক পদ্ধতি তিনি অবলম্বন করেছেন, যে বৃক্ষ মডেল অনুসরণ করেছেন, তা সহজ কথায় ভাষার আমলাতন্ত্র। প্রশাসনিক ক্রমসোপানের আদলে ভাষা ও সংস্কৃতির ক্রমসোপান নির্ধারণ করতে গিয়ে গ্রিয়ার্সন ও জে ডি এন্ডার্সন উভয়েই ভাষার ওপর পূর্বতঃসিদ্ধ ক্ষমতাকাঠামো চাপিয়ে দিয়েছেন। ভাষা ও সংস্কৃতির প্রকৃত উৎস ও উৎপত্তি বিবেচনা না করে, সমকালীন রাজনীতি প্রভাবিত ভাষা পরিস্থিতির আলোকে চাটগাঁইয়া বুলিকে বিবেচনা করেছেন। ফলে ভাষা এবং, সেই অর্থে, শব্দের ব্যুৎপত্তি, রূপান্তর এবং উচ্চারণ সংক্রান্ত বিবেচনা, তাদের ক্ষেত্রে, একটি বৈকল্পিক বিবেচনা; চূড়ান্ত বিবেচনা নয়। যে ক্ষমতার দুর্গ থেকে প্রাচ্যবাদি তাকানি দিয়ে তারা চাটগাঁইয়া ভাষাকে অবলোকন করেছেন, তা প্রান্তিক ভাষাকে প্রান্তিক প্রতিষ্ঠানের মতোই অধস্তন ভাবার জায়গা। ভাষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে কেন্দ্র ও প্রান্ত উৎপাদনের এই ক্রমসোপানতন্ত্র জন্ম নিয়েছিলো খোদ উপনিবেশিক সরকারের দাপ্তরিক প্রয়োজনে। দাপ্তরিক শৃঙ্খলা[9] রক্ষা করে পরিচালিত এই জরিপ, রমিলা থাপারের ভাষায় ইতিহাসের একটি দাপ্তরিক ভাষ্য।[10] রণজিৎ গুহও তার সাব অল্টার্ণ স্টাডিজ সংকলনের ভূমিকাতে এই বক্তব্যের প্রতিধ্বনি করেছেন।[11]
অতীতে রাজনৈতিক ভূগোল এবং সাংস্কৃতিক বলয়ের ভিন্নতার কারণে চাটগাঁইয়া ভাষা যেমন বাঙলা থেকে ভিন্ন ছিল, কালিক বিবর্তনের ভিন্ন ভিন্ন পর্যায়েও চাটগাঁইয়া ভাষার বিভিন্ন রূপ দেখা দিয়েছিল।[12] তাই, স্মরণ রাখা দরকার, গ্রিয়ার্সন যখন ভাষা জরিপ করছেন, তখন চট্টগ্রাম সার্বিক অর্থেই কলকাতাকেন্দ্রিক ক্ষমতাবলয়ের অধীন। যেহেতু চারটি প্রধান শক্তি, রাজশক্তি, ধর্মশক্তি, সাহিত্যশক্তি এবং বাণিজ্যশক্তি থেকে ভাষার প্রভাব তৈরি হয়, বাঙলার প্রভাবও এসব কারণজাত।[13] তাই, স্বাভাবিকভাবেই বাঙলাকে কেন্দ্র ধরে অপরাপর ভাষার ক্রমঅবস্থান হিসেব করা হয়েছে। অথচ আমির খসরু, যিনি জাতিতে তুর্কী, ভাষার অঞ্চলভেদে স্বাতন্ত্র্য স্বীকার করেছিলেন। স্থানের ভিত্তিতে সিন্ধি, গুজরাটি, তামিল, লাহোরি, বাঙলা, ইত্যাদি ভাষাকে তার স্ব স্ব অঞ্চল ভেদে স্বতন্ত্র বলে চিহ্নিত করেছিলেন। ইতিপূর্বে আলবেরুণী (১০৩০ খ্রিস্টাব্দ) এবং আমির খসরু (১৩১৭ খ্রিস্টাব্দ) কর্তৃক ভারতীয় ভাষা জরিপের ক্ষেত্রে এই ধরনের কেন্দ্র-প্রান্তের ধারণা গ্রাহ্যতা পায় নি। গ্রিয়ার্সন কর্তৃক চালানো জরিপের পাঁচশো বছর পূর্বে যে ভাষা (চাটগাঁইয়া) স্বতন্ত্র ভাষাপরিচয়ে সংজ্ঞায়িত, পাঁচশো বছর পরে তাকে বাঙলার উপভাষা গণ্য করার অনুমানগত ছাঁচ ঔপনিবেশিক, পূর্বতসিদ্ধ এবং আরোপিত। এই জায়গায় আমির খসরু এবং গ্রিয়ার্সনের পদ্ধতিগত ভিন্নতা বিবেচনায় নিলে চাটগাঁইয়া ভাষা প্রশ্নের একটি প্রাথমিক মীমাংসা হয়। আমির খসরু ও গ্রিয়ার্সনের মতো প্রবল ভিন্নতা আবদুর রশিদ সিদ্দিকীও বজায় রেখেছিলেন তার সুচিন্তিত মত ও মন্তব্যে।[14]
সুনীতিকুমার নিজেও তার গবেষণায় বাঙলা ভাষাকে ভিত্তিভাষা বা মূলভাষা ধরে অন্যান্য ভাষার তুলনা ও প্রতিতুলনা করেছেন। তিনি উল্লেখ করতে ভুলেন নি, যে অশোকের রাজত্বকালে মাগধী প্রাকৃত ছিল দাপ্তরিক ভাষা বা প্রধান ভাষা।[17] পরে রাজনৈতিক কেন্দ্র পরিবর্তনের কারণে গুরুত্ব হ্রাস পেলে পাশাপাশি অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষাই লিখিত ও কথ্য ভাষায় উন্নীত হয়। বাঙলা, উড়িয়া, বিহারি, আসামি ইত্যাদি মাগধী প্রাকৃতের পরবর্তী ভাষা। শুরুর দিকে যেসব বাঙলা ব্যাকরণ লেখা হয়েছে, সেগুলোতে ভাষার ইতিহাস উল্লেখিত নেই। ফলে, বাঙলা কীভাবে তার লিখিত আদল বা রূপ পেল, সেই কারণ বিশেষ তখনো উদ্ঘাটিত হয় নি। বস্তুতঃ মাগধী প্রাকৃতের অপভ্রংশের মধ্যে চাটগাঁইয়াকে মূলভাষা ধরলে ফলাফল ঠিক উল্টো হতো। চাটগাঁইয়া ভাষার সাথে মূল তুলনাটা সরাসরি মাগধী প্রাকৃতের সাথে হলেও বাঙলার সাথে চাটগাঁইয়ার সম্পর্কটি ভাষা-উপভাষার হতো না। যেহেতু কালের পরিক্রমায় মাগধী তার স্বীয় গৌরব সমর্পন করেছে, তার জায়গায় বাঙলাকেন্দ্রিকতা য়ুরোকেন্দ্রিকতার মতোই একটি রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আধিপত্যের ধরন হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, সেহেতু বাঙলা বনাম চাটগাঁইয়ার সম্পর্ক ভাষা-উপভাষার স্তরে বিবেচিত হলো।
সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় মনে করেন, ভারতের ভাষাগুলো চারটি মুখ্য ও স্বতন্ত্র ভাষাশ্রেণিতে পড়ে; যেমন, ১) আর্যগোষ্ঠী ২) দ্রাবিড় গোষ্ঠী ৩) অস্ট্রিক গোষ্ঠী বা কোল এবং ৪) ভোট-চীন গোষ্ঠী বা তিব্বতী-চীনা গোষ্ঠী।[18] তার মধ্যে বাঙলা হলো আর্যভাষাগোষ্ঠীর ভাষা। একটি জাত বা গোষ্ঠীকে অবলম্বন করে একটি ভাষা বহতা নদীর মতো কাল থেকে কালান্তরে বাহিত হয়। বঙ্গে ভাষাসমৃদ্ধির অন্যতম লক্ষণ বাঙলা সাহিত্য; তাই সাহিত্য নিয়ে বাঙলার যথার্থ লোকনেতাগণ গৌরব বোধ করেন।[19] বাঙলার পূর্বসূত্রে আর্যভাষার আদিতম ভাষারূপ পাওয়া যায় ঋগবেদে।[20] চাটগাঁইয়া ভাষা আর্যভাষাগোষ্ঠীরই অংশ, কেবল এর ইতিহাস সুরক্ষিত নেই কিংবা কোন নিদর্শন নেই বলে এই ভাষাকে তুলনামূলক আলোচনায় আনা যাচ্ছে না।[21]
চাটগাঁইয়া ভাষা বাঙলার উপভাষা কিনা, এই বিতর্কের বিপক্ষে অবস্থান নিলে আমাদের বাঘাবাঘা ভাষাবিশারদের প্রদর্শিত যুক্তি পরখ করে দেখতে হবে। তাদের যুক্তির বিপক্ষে যুক্তিপ্রমাণ উপস্থাপন করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, সর্বাগ্রে মূলভাষা ও উপভাষার সংজ্ঞা দিতে হবে। উভয়ের পার্থক্য নিরূপণকারী বৈশিষ্ট্যগুলো স্পষ্ট করতে হবে। ভাষাতত্ত্বের দিক থেকে যে যে পদ্ধতি অনুসরণ করলে নতুন জ্ঞানের আলোকে ভাষা-উপভাষার সংজ্ঞা ও পার্থক্য নির্ণয় করা যাবে, তার ভিত্তিতে প্রমাণ করতে হবে, চাটগাঁইয়া ভাষা বাঙলার উপভাষা নয়, বরং স্বতন্ত্র ভাষা।
গ্রীয়ার্সন থেকে পরেশচন্দ্র মজুমদারের গবেষণা পর্যন্ত যে তুলনামূলক পদ্ধতি বা কালানুকেন্দ্রিক পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়েছে তা ভাষা ও উপভাষা নির্ণয়ের আধুনিক পদ্ধতি নয়। পুরনো পদ্ধতি হিসেবেও তার কিছু মৌলিক ত্রুটি রয়েছে। পৃথিবীর নব্বইভাগ ভাষার মধ্যে ‘মা’ শব্দটির উচ্চারণগত মিল আছে। যেমনটা স্যার উইলিয়াম জোনস বলেছেন, যে ভাষার মধ্যে কমন সোর্স বা অভিন্ন উৎস আছে।[22] এখন কেউ যদি ‘মা’ শব্দটিকে নমুনা হিসেবে তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে তাহলে পৃথিবীর নব্বই ভাগ ভাষাই একটি আরেকটির উপভাষা বলে মনে হবে। এটা ভাষা-উপভাষার প্রশ্ন নয়, সমস্ত ভাষার অন্তর্নিহিত কিছু ধ্বণিগত ঐক্যের প্রশ্ন, মনুষ্যজাতি হিসেবে শারীরমনোবৃত্তীয় অভিন্নতার প্রশ্ন, ভাষার ইউনিভার্সাল গ্রামারের প্রশ্ন। অথচ গ্রীয়ার্সনের তুলনামূলক ভাষা বিশ্লেষণ পদ্ধতিতে এমন কিছু নির্বাচিত শব্দ, বাক্য ও বাগবিধি নিয়ে তুলনা করা হয়েছে, যা নমুনা হিসেবে সংকীর্ণ। এছাড়া তারা চাটগাঁইয়া ভাষার যে নমুনাগুলো তুলনা করেছেন সেগুলোও খাস চাটগাঁইয়া ভাষার নয়, বরং বাংলায়নকৃত চাটগাঁইয়ার। অনেকটা চাটগাঁইয়া ভাষাকে পিটিয়ে বাঙলার কাছাকাছি নিয়ে বসানো হয়েছে বলা যায়। বস্তুতঃ চাটগাঁইয়া ভাষার নিজেরই দু’টি স্পষ্ট উপভাষা শনাক্ত করা যায়, যার চারটি বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন অঞ্চল রয়েছে; যেমন, উত্তর চট্টগ্রাম, দক্ষিণ চট্টগ্রাম, মহেশখালী-কুতুবদিয়া দ্বীপাঞ্চল এবং পার্বত্য অঞ্চল প্রভাবিত ভাষা।[23] এর সাথে চাটগাঁইয়া ও রোয়াইঙ্গা ভাষার বাচিক পার্থক্যতো আছেই। কাজেই, তুলনামূলক পদ্ধতিতে বিচ্যুতি প্রকাশক নমুনা নিয়ে, ভাষা-উপভাষা সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত পৌঁছা মানে যুক্তিগতভাবে অবৈধ সার্বিকীকরণজনিত অনুপপত্তিকে মেনে নেওয়া। বাঙলা ও চাটগাঁইয়া ভাষার রূপ কালেকালে পরিবর্তিত ও বিবর্তিত হয়েছে। রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও আঞ্চলিক সংহতির কারণে এবং ব্যবসাকেন্দ্রের প্রভাবে ঔপনিবেশিক কালে চাটগাঁইয়া ভাষার উপর বাঙলার প্রভাব বেড়েছিল। বাঙলার কিছু শব্দ ও ভাষাভঙ্গি চাটগাঁইয়া ভাষার ওপর চেপেছিল। কাজেই, ভিন্ন ভাষার লোক যে ভিন্নভাবে চিন্তা করে, ভিন্ন ভঙ্গিতে অভিব্যক্তি প্রকাশ করে, তা পরখ করেও বাঙলা ও চাটগাঁইয়া ভাষার স্বাতন্ত্র্য চিহ্নিত করা সম্ভব।
দূর অতীতে আর্য-অনার্যের যে দ্বন্ধ, তা শুধু ধর্ম ও রাজনীতির দ্বন্ধ ছিল না, তা একইসাথে ভাষা ও আত্মপরিচয়ের দ্বন্ধ ছিল। কারণ ভাষা নিজেই আত্মপরিচয়ের একটি প্রধান সূত্র। সংস্কৃতি ভাষাকে প্রভাবিত করে, ভাষা জাতিকে।[24] যদিও মৌর্যদের আগমনের পুর্বে বাঙলায় স্থানীয় কেউ আর্য ভাষায় কথা বলতো না; কালের পরিক্রমায় আর্যভাষা অনার্যগৃহে প্রবেশ করেছে এবং অনার্যেরই ভাষা হয়ে উঠেছে।[25] এভাবে অনার্যের হাতে পড়ে আর্যভাষা ব্যাপক রূপান্তরের ভেতর দিয়ে গিয়েছে। অঞ্চলের দিক থেকে প্রান্তিক ভাষাগুলো নানা কারণেই কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ধারণ করে আছে। ব্রিটিশপূর্ব পর্যায়ে, মুঘল কিংবা সুলতানি আমলে চাটগাঁইয়া ভাষা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় ভিন্ন ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। মধ্যযুগে আরাকানি রাজসভায় চর্চিত বাঙলাও বঙ্গে চর্চিত বাঙলার চেয়ে কিছুটা ভিন্ন। গ্রীয়ার্সন ভাষা জরিপের জন্য যেসব নমুনা নিয়েছেন, সেগুলো কাকতালীয়ভাবে বাঙলার কাছাকাছি, যদিও পরিমাণ হিসেবে একেবারেই অপর্যাপ্ত। হয়তো ব্যাপক পরিসরে তুলনামূলক জরিপ করায় নমুনাগুলোকে কেজো রাখার জন্য তিনি এই কাজ করেছেন। অন্যদিকে গ্রীয়ার্সন নিজে এসে, ভাষা পরিস্থিতি ও ভাষা অঞ্চলে থেকে এই জরিপ করেন নি। তিনি একটি চিঠির মারফত ডিস্ট্রিক্ট অফিসারদের কাছে থেকে নমুনা চেয়ে সংগ্রহ করেছেন। ভাষা জরিপের শেষে এগুলোকে সূত্রবদ্ধ করার প্রাক্কালে গ্রিয়ার্সনের দৃষ্টিশক্তিও লোপ পেয়েছিল। ফলে কাজের জন্য তিনি মিসেস গ্রিয়ার্সনের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন। এতে গ্রিয়ার্সনের দক্ষতা ও সতর্কতার মাত্রা ব্যাহত হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
পরবর্তীকালে সুনীতিকুমার থেকে পরেশ্চন্দ্র পর্যন্ত সবাই গ্রীয়ার্সনকে ভক্তিযোগে অনুসরণ করেছেন। এমনকি তারা চাটগাঁইয়া ও সিলটি ভাষাকে স্বতন্ত্র ভাষা হওয়ার যোগ্য বিবেচনা করা সত্ত্বেও ভৌগোলিক নৈকট্য ও রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ঐক্যের লক্ষে এগুলোকে বাঙলার উপভাষা গণ্য করে গিয়েছেন। ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক ফ্রন্টিয়ার হিসেবে চট্টগ্রামে শুধু বাঙলা নয়, আরবি, ফার্সি, পালি, বার্মিজ, ইংরেজি, উর্দু, চাকমা প্রভৃতি ভাষার প্রভাব পড়েছে। এছাড়া অনাদিকাল থেকেই চট্টগ্রাম একটি জাতি ও সভ্যতার মেল্টিংপট বলে বিবেচিত। সেইসাথে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের জন্য বাংলা, ত্রিপুরা এবং বার্মার লড়াই জারি ছিল। এর ফলে বাঙলার সাথে চাটাগাঁইয়া ভাষার মৌলিক কিছু পার্থক্য তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে, ধর্ম, প্রার্থনালয়, বিদ্যালয়সহ যাবতীয় প্রতিষ্ঠানের প্রভাবে চাটগাঁইয়া ভাষা বাঙলার নৈকট্য লাভ করেছে। কেবল লিখিত সাহিত্যের অভাবে চাটগাঁইয়া ভাষা বাঙলা থেকে স্বতন্ত্র হওয়া সত্ত্বেও পৃথক ভাষার স্বীকৃতি পাচ্ছে না। ফরাসি দার্শনিক জাক লাকাঁর মতে, দুইটি ভাষাভাষী গোষ্ঠী ভিন্নভাবে চিন্তা করে[26]। সেইদিক থেকে বিবেচনা করলে, সন্দেহের অবকাশ নেই যে বাঙলা ভাষী ও চাটগাঁ ভাষী পৃথকভাবে চিন্তা করে। তাদের সিগ্নিফায়ার (বস্তু) এক হলেও সিগ্নিফাইড (ধারণা) ভিন্ন।
ভাষাগোষ্ঠীর দিক থেকে চাটগাঁর অধিবাসীরা সংখ্যায় বিপুল, অন্তত এক কোটি ত্রিশ লাখ; বিশ্বে ৭,১১১টি জীবন্ত ভাষার মধ্যে চাটগাঁইয়া ভাষার অবস্থান ৮৮তম।[27] চাটগাঁইয়ারা একাধিক ভাষায় কথা বলতে অভ্যস্ত। এতদাঞ্চলে আরব্য বণিকদের আগমন, তুর্কিদের আগমন, ওলন্দাজদের আগমন, ব্রিটিশদের আগমন, ত্রিপুরা প্রভাব এবং বার্মার প্রভাব, পাকিস্তানের প্রভাব ইত্যাদি কারণে ভাষার মধ্যেও কালেকালে নানা পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। প্রত্যেক কালপর্বে চাটগাঁইয়া ভাষায় নতুন শব্দ, বাগবিধি ও সংস্কৃতি আত্মীকৃত হয়েছে, পুরনো শব্দ নতুন উচ্চারণে ধ্বনিত হয়েছে এবং কিছুকিছু শব্দ একেবারে পরিত্যক্ত হয়েছে। ব্যবসা ও বাণিজ্যসম্পর্ক ভাষা পরিবর্তনের অন্যতম হাতিয়ার। চট্টগ্রাম একটি বন্দরনগরী এবং সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চল হওয়ায় এই অঞ্চলে অন্য ভাষাভাষী মানুষের আগমন ঘটেছে, যা ভাষার মধ্যে বৈচিত্র্য নিয়ে এসেছে। পাল যুগে বৌদ্ধ এবং সেনযুগে শৈব মতাবলম্বীদের[28] ধর্ম, সংস্কৃতি ও ভাষাগত পরিবর্তনের ইতিহাস আছে। রাজনৈতিক ভূখণ্ডের দ্বান্ধিক মোহনায় থেকেও চাটগাঁইয়া ভাষা যে বাঙলা, ত্রিপুরা ও আরাকানের প্রভাব থেকে স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে পারছে, তার পেছনে আছে এই অঞ্চলের একটি শক্তিশালী সাংস্কৃতিক সত্তার ভূমিকা। এই সাংস্কৃতিক সত্তা একটি স্বতন্ত্র চাটগাঁইয়া ভাষার ভিত্তিতে নির্মিত, যার লিখিত কিংবা প্রত্নতাত্ত্বিক ইতিহাস নেই, কিন্তু মৌখিক ও শ্রুতিনির্ভর সমৃদ্ধ উত্তরাধিকার আছে।
হাল জমানায় ফের্দিনঁ দ্য সস্যুর ঐতিহাসিক বা কালানুকেন্দ্রিক (ডায়াক্রোনিক) ভাষাবিজ্ঞানের পরিবর্তে যে বর্ণনামূলক বা কালকেন্দ্রিক (সিনক্রোনিক) ভাষাবিজ্ঞানের প্রস্তাব করেছেন, তা অনুসরণ করলে অর্থাৎ কালেকালে ভাষা যে স্থান বিশেষে বিশেষ অবস্থা প্রাপ্ত হয় এবং কালের নিরিখে যে ভাষার পরিবর্তন ঘটে তা বিবেচনায় নিলে আমরা এই ভাষাবিজ্ঞানীদের দাবিকে খন্ডন করতে পারি।[29] সস্যুরের মতে, ভাষা চিহ্ন দিয়ে তৈরি। ভাষা যেসব চিহ্ন দ্বারা গঠিত তা বিমূর্ত নয়, বাস্তব। চিহ্ন এবং চিহ্নের সম্পর্কই মূলত ভাষাবিজ্ঞান।[30] চিহ্ন ও চিহ্নের সম্পর্ক দিয়ে, বিশেষ করে সাইন, সিগ্নিফায়ার ও সিগ্নিফাইড দিয়ে যদি ভাষা বিশ্লেষণ করা যায়, তাহলে বাঙলা ও চাটগাঁইয়া ভাষার বিস্তর পার্থক্য শনাক্ত করা সম্ভব। চিহ্নের মধ্যে ভাষাচিহ্ন ও দৃশ্যচিহ্ন দুইভাগে ভাগ করা যেতে পারে। [31] কারণ ভাষাচিহ্নের সাথে শব্দ, ধ্বনি এবং বস্তুর সম্পর্ক রয়েছে। চিহ্ন ব্যতীত দুইটি ধারণার মধ্যে পার্থক্য করা যায় না। ভাষাতো মূলত ধ্বনিবিশিষ্ট সুশৃঙ্খল চিন্তা। অন্যদিকে শব্দ ছাড়া আমাদের মানসিক চিন্তাগুলো অবয়বহীন।[32] সস্যুর প্রবর্তিত কালকেন্দ্রিক ভাষাবিজ্ঞান পরপর ক্রমপদের (টার্মের) সম্পর্ক বিচার করে। যা কালেকালে একটি আরেকটির জন্য ব্যবহৃত হয়। চূড়ান্ত স্থবির কোন কিছু নেই। ভাষার প্রতিটি অংশই পরিবর্তনশীল।[33] ভাষাতাত্ত্বিক অবস্থার সাথে ভৌগোলিক অবস্থানের সম্পর্ক আছে, তাই এক জায়গা থেকে আরেক জায়গার ভাষাগত পার্থক্য আছে।[34] দুইটি জনগোষ্ঠী যখন সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের দিক থেকে পৃথক হয়, তখন তাদের আঞ্চলিক ভাষাও স্বতন্ত্র ভাষার মর্যাদা পায়। বোধগম্যতার প্রশ্নে ভৌগোলিকভাবে আঞ্চলিক মনে হলেও ভাষাগুলো আসলে স্বতন্ত্র। সাধারণত সিগ্নিফায়ার ও সিগ্নিফায়েডের সহ-সম্পর্ককেই চিহ্ন বলে বিবেচনা করা হয়।[35] এই চিহ্নের ভিত্তিতেই ভাষা তৈরি করে অর্থ। চিহ্ন উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় বাঙলা ও চাটগাঁইয়া ভাষার কিছু পার্থক্য আছে। তাই একই শব্দ বাঙলা ও চাটগাঁইয়া ভাষায় ভিন্ন অর্থ জ্ঞাপন করে। যেমন, উদাহরণ হিসেবে আমরা যদি বলি, ‘পোন ফাড়ি আইক্কাপ যার’, যেখানে আইক্কাপ (সিগ্নিফায়ার) হলো মায়ানমারের একটি শহর, যা তীব্র কষ্টজ্ঞাপক (সিগ্নিফায়েড), তা বাঙলা হতে একেবারে ভিন্ন ধরনের চিহ্ন তৈরি করে। আরও বলা যেতে পারে, ‘বউয়ে খানা বাছের’, যেখানে খানা বাছা মানে পোয়াতি হওয়া বুঝাচ্ছে।[36]
একই ভাষা অঞ্চলভেদে তার উচ্চারণগত ও রীতিগত পার্থক্য ধারণ করে। উচ্চারণ ও ভাষারীতির দিক থেকে অঞ্চলভেদে যে পার্থক্য তাই হলো আঞ্চলিক উপভাষা। যেমন, বাঙলার সাথে ঢাকাইয়া কিংবা নোয়াখালির ভাষা তুলনা করলে আঞ্চলিক রূপ বুঝা যায়। কিন্তু চাটগাঁইয়া ভাষা ব্যাকরণগত সাদৃশ্য ধারণ করলেও বোধগম্যতার দিক থেকে বাঙলার সাথে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ পার্থক্য ধারণ করে। কাজেই চাটগাঁইয়া ভাষাকে বাঙলার উপভাষা দাবি করা রাজনৈতিক সংহতির লক্ষে সঠিক হলেও আধুনিক ভাষাতত্ত্বের নিরিখে কঠিন। উপভাষার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, “উপভাষা হলো একটি ভাষার অন্তর্গত এমন একটি বিশেষ রূপ, যা একেকটি বিশেষ অঞ্চলে প্রচলিত, যার সঙ্গে আদর্শ ভাষা বা সাহিত্যিক ভাষার ধ্বনিগত, রূপগত এবং বিশিষ্ট বাগধারাগত পার্থক্য আছে। এই পার্থক্য এমন সুস্পষ্ট যে ঐসব বিশেষ বিশেষ অঞ্চলের রূপগুলোকে স্বতন্ত্র বলে ধরা যাবে, অথচ পার্থক্যটা এত বেশি নয় যাতে আঞ্চলিক রূপগুলিই এক একটি সম্পূর্ণ পৃথক ভাষা হয়ে উঠে’।
(A specific form of a given language, spoken in a certain locality or geographic area, showing sufficient differences from the standard or literary form of that language, as to pronunciation, grammatical construction and idiomatic usage of words, to be considered a distinct entity, yet not sufficiently distinct from other dialects of the language to be regarded as a different language.)”[37]
যেকোন ভাষার একটি আদর্শ রূপ থাকে কিন্তু তার একাধিক কথ্য রূপ থাকতে পারে। আদর্শ রূপটি সর্বজনগ্রাহ্য। কথ্যরূপগুলো একেকটা অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষারূপ। এই আঞ্চলিক ভাষা রূপকেই অভিহিত করা হয়, উপভাষা বলে। উপভাষা মূলত- ১) একটি বিশেষ অঞ্চলে প্রচলিত কথ্যভাষা, ২) একটি ভাষার বিশিষ্ট আঞ্চলিক ও সামাজিক রূপ, যার মধ্যে বিশেষ ধরনের শব্দ ও ব্যাকরণগত গঠনবৈশিষ্ট্য নিহিত থাকে, ৪) মূল ভাষার সাথে পার্থক্য বিশেষভাবে লক্ষণীয়, ৫) এটি হচ্ছে একটি ভাষার রূপ বৈচিত্র্য। কাজেই চাটগাঁইয়া ভাষাকে বাঙলার উপভাষা দাবি করা একেবারে অনায্য নয়, যদি না কেউ বাঙলার সাথে এর পার্থক্য, বোধগম্যতা, সংস্কৃতি ইত্যাদি বিবেচনার বাইরে রাখে। তবে, ভাষা ও উপভাষার পার্থক্য নিরূপন করা দুঃসাধ্য। এইজন্যই হয়তো, নোম চমস্কি তার ‘নলেজ অব ল্যাঙ্গুয়েজ’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ভাষা ও উপভাষার পার্থক্য নিরূপন করা অসম্ভব। কারণ ভাষার ইউনির্সাল গ্রামার একই। তাদের যুক্তিবিন্যাস একই। তবে তিনি ভাষা বৈচিত্র্যের মাত্রা ও ব্যাপকতার ওপর নির্ভর করে একটি ভাষা থেকে আরেকটি ভাষার স্বাতন্ত্র্য বিবেচনা করা যায় বলে মনে করেন। কাজেই, কোন একটি ভাষার বিশেষ একটি উপভাষা যদি বৈচিত্র্যের দিক থেকে বেশি ভিন্ন হয়, তাহলে সেটিকে উপভাষা না বলে ভাষা বলাই শ্রেয়।[38]
আবদুর রশিদ সিদ্দিকী কেবল চাটগাঁইয়া ভাষাতত্ত্বের পথিকৃৎ হিসেবে নয়, সাংবাদিকতার পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসেবে নয়, বরং চাটগাঁইয়া সংস্কৃতির একজন প্রবল প্রতিভু হিসেবে স্মরণীয়। চাটগাঁইয়া ভাষার যে কোন আলোচনা আবদুর রশিদ সিদ্দিকীকে পাশ কাটিয়ে চলতে পারে না। লিপির ব্যবহার চালু হলে ভাষা, সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের যোগসূত্রে চাটগাঁইয়া ভাষা কাল নিরিবধি টিকে থাকবে। তাতে আবদুর রশিদ সিদ্দিকীও আলোকবর্তিকার মতো প্রোজ্জ্বল হয়ে থাকবে।
[1] Saussure, Ferdinand De (2011) Course in General Linguistics (Tr. Wade
Baskin). New York: Columbia University Press. Pp-101 (সস্যুর ভাষা পরিস্থিতি বা ল্যাঙ্গুয়েজ স্টেট বলতে ভাষা
যে একেক জায়গায় একেক সময় স্পষ্ট ভিন্নতা প্রদর্শন করে তা বুঝিয়েছেন। ভাষা স্থান ও কাল
ভেদে সদা পরিবর্তনশীল। পরিবর্তনশীলতার ভেতরে ভাষার শনাক্তযোগ্য অবস্থাই হলো ভাষা পরিস্থিতি।)
[2] দীন মুহম্মদ, কাজী (২০১৯), বাঙলা ভাষা ও লিপির ইতিহাস, আনিসুজ্জামান সম্পাদিত বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস,
১ম খণ্ড, ঢাকাঃ বাংলা একাডেমি। পৃ-২৯৭
[3] হক, মহাম্মদ দানীউল (২০১২) চাটগাঁ ভাষার রূপ-পরিচয় (ডঃ মাহবুবুল হক ও শিমুল বড়ুয়া সম্পাদিত). চট্টগ্রাম:
চাটগাঁ ভাষা পরিষদ। পৃ-৩০
[4] চট্টোপাধ্যায়, সুনীতিকুমার (১৯৬৪) বাঙ্গালা ভাষা প্রসঙ্গে, কলকাতা: জিজ্ঞাসা.
পৃ-৭২
[5]
Id. Pp-L1V
[6] Majeed,
Javed. (2019) Colonialism and Knowledge
in Grierson’s Linguistic Survey of India. Abington, Oxon: Routledge. pp-1
[7] ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ, (১৯৯৮) বাংলা শব্দতত্ত্ব, ঢাকাঃ অনন্যা। পৃ-৯১
[8] কাসেম, মোঃ আবুল (২০১২) চাটগাঁ ভাষার ইতিহাস অন্বেষা, চাটগাঁ ভাষার রূপ-পরিচয় (ডঃ মাহবুবুল হক
ও শিমুল বড়ুয়া সম্পাদিত), চট্টগ্রাম: চাটগাঁ ভাষা পরিষদ। পৃ-২৫
[9]
Majeed, Javed. (2019) Colonialism and
Knowledge in Grierson’s Linguistic Survey of India. Abington, Oxon:
Routledge. pp-50
[10]
Thapar, Romila. (2002) The Penguin
History of Early India. London: Penguin Books. Pp-2
[11]
Guha, Ranajit. (1997) A Subaltern Studies
Reader (1986-1995). Minneapolis: University of Minnesota Press. Pp- xv1
[12] Ali, Syed Murtaza. (1964), History of Chittagong, Dacca: Standard
Publishers Ltd. Pp-164
[13] শহীদুল্লাহ, ডক্টর মুহম্মদ (২০১৫) ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ স্মারক গ্রন্থ, ঢাকা:
বাংলা একাডেমি। পৃ-১৯৬
[14]
Majeed, Javed. (2019) Colonialism and
Knowledge in Grierson’s Linguistic Survey of India. Abington, Oxon: Routledge. pp
[15]
Thapar, Romila (2003) The Penguin History
of early India From the origin to AD 1300. London: Penguin Books. P-3
[16]
Muller, Max F. (2015) India-What can It
Teach us? New Delhi: Munshiram Manoharlal Publishers Pvt. Ltd. P-51
[17]
Id.p-51
[18] চট্টোপাধ্যায়, সুনীতিকুমার।(১৯৯৬) বাঙলা ভাষাতত্ত্বের ভূমিকা, ৯ম সংস্করণ, কলিকাতা:
কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়. পৃ-২
[19] প্রাগুক্ত, পৃ-৭
[20] প্রাগুক্ত, পৃ-১০
[21] কাসেম, মোঃ আবুল (২০১২) চাটগাঁ ভাষার ইতিহাস অন্বেষা, চাটগাঁ ভাষার রূপ-পরিচয় ( ডঃ মাহবুবুল হক
ও শিমুল বড়ুয়া সম্পাদিত), চট্টগ্রাম: চাটগাঁ ভাষা পরিষদ। পৃ-২৫
[22]
Garland Cannon(1992) Sir William Jones,
language families, and Indo-European, Word, 43:1, p-50
[23] Dil,
Afia. (2014) Bengali Language and Culture.
Dhaka: Adorn Books. pp- 211
[24]
Saussure, Ferdinand De (2011) Course in
General Linguistics (Tr. Wade Baskin), New York: Columbia University Press.
Pp-21
[25] চট্টোপাধ্যায়, সুনীতিকুমার (১৯৯৬) বাঙ্গালা ভাষাতত্ত্বের ভূমিকা, নবম সংস্করণ,
কলকাতা: কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। পৃ-৩১
[26]
Id-pp-21
[27] Barua, Amit. (2020) A Comparative Study of Phonological Bengali
Language and Chittagonian dialect spoken in Bangladesh, Unpublished masters
thesis. Thailand: Mahachulalongkornrajavidyalaya University. Pp-8
[28] চট্টোপাধ্যায়, সুনীতিকুমার (১৯৯৬) বাঙ্গালা ভাষাতত্ত্বের ভূমিকা, নবম সংস্করণ,
কলকাতা: কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। পৃ-১০২
[29] আজাদ, হুমায়ুন (২০২১) তুলনামূলক ও ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞান, (৭ম মুদ্রণ), ঢাকা: আগামী প্রকাশনী.
পৃ-১৮-১৯
[30] Saussure, Ferdinand De (2011) Course in General Linguistics (Tr. Wade
Baskin). New York: Columbia University Press. Pp-102
[31] Id. p-103
[32] Id. p-111
[33] Id. P- 140
[34] Id. P-191
[35] Eco, Umberto. (1986) Semiotics and The Philosophy of Language.
Bloomington: Indiana University Press. Pp-1
[36] ইসলাম, মুহম্মদ নুরূল (২০২০) বাঙলা ভাষার আঞ্চলিক শব্দ বৈচিত্র্যঃ কক্সবাজার, কক্সবাজার: কক্সবাজার
সাহিত্য একাডেমি, পৃ- ২৭
[37]
Pei, Merio A. and Gaynor, Frank (1970) A
Dictionary of linguistics. London: Peter Owen. p.56
[38]
Chomsky, Noam. (1977) On Language.
New York: The New Press, Pp-169
[39] সিদ্দিকী, এম আবদুররশিদ (১৩৫৩ বাঙলা) চট্টগ্রামী-ভাষাতত্ত্ব, চট্টগ্রাম: পৃ-৩
[40] সিদ্দিকী, আবদুররশিদ (১৩৪২ বাংলা) চট্টগ্রামী-ভাষাতত্ত্ব, চট্টগ্রাম: পৃ-৭
[41] Chatterjee, Suniti Kumar. (1970) The Origin and Development of the Bengali
Language. London: pp-136-137
[42]
Edwards, John. (2009) Language and
Identity. New York: Cambridge University Press. P-57
[43]
Masica, Colin P. (1991) The Indo-Aryan
Languages. New York: Cambridge University Press. P-16
[44] সিদ্দিকী, আবদুররশিদ (১৩৫৪ বাংলা) চট্টগ্রামী ভাষাতত্ত্ব, চট্টগ্রাম: পৃ-২০
[45] Chatterjee, Suniti Kumar. (1970),
…vol- v, part-1, p-139-141
Comments