জার্মান নিবাসি মার্কুস গ্যাব্রিয়েল নয়া কিসিমের দর্শন প্রস্তাব করেছেন। তাই সাম্প্রতিক কালে নয়া দার্শনিকচিন্তার উদ্গাতা হিসেবে তাকে নিয়ে বেশ সাড়া পড়েছে। ব্যক্তিগতভাবে দার্শনিক হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার সাথে সাথে তার প্রস্তাবিত দর্শনকেও চিহ্নিত করা হচ্ছে একটি বিশেষ দার্শনিক ঘরানা আকারে, যার অভিধা নয়াবাস্তববাদ। বয়স বেশি নয় কিন্তু এর মধ্যেই তিনি অনর্গল কথা বলতে পারেন দশ দশটি ভাষায়। শেলিং এর পরে সর্বকনিষ্টতার রেকর্ড ভেঙ্গে অলঙ্কৃত করেছেন বন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেসর এবং সভাপতির পদ। জাঁ পল সার্তের পরে রকস্টারের জনপ্রিয়তা নিয়ে এমন কোন দার্শনিকের আবির্ভাব ঘটে নি, যার তুলনা হতে পারে মার্কুসের সাথে। অনেকে আবার তাকে জার্মান দর্শনের পুনরুত্থানের পুরুহিত হিসেবেও ভাবতে শুরু করেছেন। ২০১৫ সালে প্রকাশিত “জগতটা কেন নেই” বা Why the world does not exist শিরোনামে বই লিখে পৃথিবীতে সাড়া ফেলে দিয়েছেন। বলা হয়ে থাকে ২০১৫ সালে দর্শনের সবচেয়ে সফল বই এটি। যেখানে তিনি বলেছেন, এই গ্রহে যা কিছু আছে, সবই আছে; শুধু জগতটা নেই। তিনি কুয়েন্টিন মিলাসোঁ এবং স্লাভোজ জিজেকের দর্শনকে তুলনামূলক বিচারের আওতায় আনেন এবং সে সাথে জার্মান দর্শনের সাথে ব্রিটিশ-মার্কিন দর্শনের মধ্যে সম্পর্ক তৈরির জন্য ঘটকালি করারও যেন দায় নিয়েছেন। নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে তার গুরু থমাস নেগেলের প্রভাবে বাস্তববাদি দৃষ্টিকোণ থেকে অধিবিদ্যার মৌলিক প্রশ্নগুলোকে পরখ করে দেখেন এবং সেগুলোর জবাবের জন্য কান্টের মতো অধিবিদ্যার অধিবিদ্যা চর্চা না করে বরং প্রস্তাব করেন অধিবিদ্যার বাস্তববাদ।
কেউ
কেউ তার যুক্তিকে অভিহিত করেছেন অধিবিদ্যক শূণ্যতাবাদ হিসেবে, আবার কেউ দেখেছেন অনুধ্যানমূলক বাস্তববাদ হিসেবে। সেজন্যেই একই সাথে কেউ তাকে বলেছেন উত্তর-উত্তরাধুনিকতাবাদি, আবার কেউ বলেছেন প্রচলিত ঘরানার
তত্ত্ববিদ । তবে এসব লকবের অনেক কিছুই তিনি সরাসরি
অস্বীকার করেছেন অথবা অন্যায্য প্রমাণ করেছেন। যেমন, অনুধ্যানমূলক বাস্তববাদের কথা তিনি সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছেন।
ধ্রুপদী ধারার দর্শন পাঠের মধ্য দিয়ে, বিশেষ করে গ্রীক
দর্শন ও জার্মান ভাববাদের সবক হজম করে মার্কুস গ্যাব্রিয়েল দার্শনিক হওয়ার প্রয়াস
পেয়েছেন। তার প্রধান প্রধান রচনাগুলোর মধ্যে রয়েছে, অতিবর্তী
তত্ত্ববিদ্যা (Transcendental Ontology) , জার্মান
ভাববাদে বিষয়ী নিয়ে জিজেকের সাথে যৌথভাবে লিখেছেন পুরাণ, উন্মাদনা
ও ঠাট্টা (Mythology, Madness and Laughter), সংবেদের জায়গাঃ নয়াবাস্তববাদি
তত্ত্ববিদ্যা ( Field of Sense: A Newrealist ontology) , জগতটা
কেন নেই ( Why the World does not exist), আই এম নট আ ব্রেইন (I am not a brain) ও নয়াঅস্তিত্ববাদ ( New-Existentialism) ইত্যাদি।
বন যখন পশ্চিম জার্মানির রাজধানী, সে সময় তার বেড়ে ওঠা রাইনে, যেটা
কিনা বেলজিয়াম, ফ্রান্স ও নেদারল্যাণ্ডের নিকটবর্তী।
প্রাচীন রোম সাম্রাজ্যের অংশ হিসেবে রাইনে পুরনো ঐতিহ্যের অভাব ছিলো না, তার ওপর কসমোপলিটান শহর হিসেবে ছিলো উদার সাংস্কৃতিক পরিবেশ। তাই
জার্মানির রাইনে জন্ম নিয়ে দর্শন পড়াটা আকস্মিক ছিলো না। তারপরও
বলতে হবে তার দর্শনমগ্নতা শুরু হয়েছিলো আকস্মিকতা দিয়ে। তার বয়স সবে চৌদ্দ কি পনেরো, একটি পার্টিতে গিয়ে পাঠ শুনেন
শোপেনহাওয়ারের বই হতে; একটি বিশেষ অনুচ্ছেদ, যেখানে গুহার
রূপকের আদলেই পেশ করা হয়েছে সেই প্রশ্ন, “আমরা কীভাবে
জানি আমাদের জীবনটা দীর্ঘ স্বপ্নমাত্র নয়?” কাকতালীয়ভাবে
এর কিছু দিনের মধ্যেই স্কেটবোর্ডিং করতে গিয়ে তিনি পড়ে যান। কনুই ভেঙ্গে যায়। শুয়ে
থাকতে হয় হাসপাতালের বেড়ে। এই অবসরকে তিনি শোপেনহাওয়ার ও কিয়ার্কেগার্ড পড়ার জন্য
ব্যবহার করেন। কিন্তু তাদের দর্শনে যে যুক্তিগুলো ছিলো তা তার কাছে যথার্থ মনে হয়নি।
তাই তিনি কান্টের ‘ক্রিটিক অব পিউর রিজন’ বা ‘বিশুদ্ধবুদ্ধির পর্যালোচনা’ পাঠ করতে
শুরু করেন এবং কান্টের অধিবিদ্যা আত্মস্থ করতে শুরু করেন। এক সময় জার্মানে কোন
ব্যক্তির বৌদ্ধিক পরিপক্কতা বিচারের জন্য সে কান্টের বইটি পড়ছে কি না জিজ্ঞেস করা
হতো। তবে মার্কুস সেই লোকপ্রিয় পরীক্ষা দিতে নয়, বরং জীবনের অর্থ খোঁজতে একাধারে
শেষ করলেন কান্ট, হেগেল, নীটশে এবং শোপেনহাওয়ারের দর্শন।
উত্তরাধুনিকতাবাদ, বিজ্ঞানবাদ ও প্রকৃতিবাদের পর্যালোচনা শেষে মার্কুস এসব মতবাদ ও
প্রায়োগিক মডেলের অসারতা প্রমাণ করে তার নিজস্ব পথ তৈরি করে নেন। তবে এই পথ তৈরি
করার আগেই তাকে সাফ করতে হয়েছে অতিবর্তী ভাববাদের নানা জঞ্জাল। এমনকি জার্মান
দর্শনের আসল গুরু কান্টের অনেক কিছুই তিনি নাকচ করেছেন। তিনি বিজ্ঞানবাদের অসারতা
প্রমাণ করেন সংবেদ অঞ্চলের বহুত্ব ও প্রেক্ষিতের তারতম্য দ্বারা, আবার জার্মান ভাববাদের অনেকটাই বর্জন করেন। কান্ট অধিবিদ্যার মৌলিক বিবেচনার ক্ষেত্রে কল্পনার আশ্রয় নিয়েছেন। কারণ কান্ট
প্রথমেই বলেছেন, স্বয়ংসত্তাকে জানা যায় না, তবে মানবীয় চিন্তার
কাঠামো ও অবস্থানের দিক থেকে, স্থান-কালের আধারে বিশেষ
অস্তিমানতা কল্পনা করা যায়। কিন্তু স্বয়ং স্থান-কালের আঁধার কী অর্থে আছে বা
অস্তিত্ববান তা স্পষ্ট নয়। কীসের অস্তিত্ব আছে, আর কীসের নেই, তার পার্থক্য বিচার
করতে গেলে, আগে অস্তিত্ব কী, তা জানা প্রয়োজন। অথবা
কীভাবে আমরা কোন কিছুর অস্তিত্ব সম্পর্কে অবগত হই তা অনুধাবন করতে হয়। সবকিছুই আছে,
শুধু জগতটা নেই, কথাটা স্ববিরোধী শুনাতে
পারে। তবে মার্কুস জগত ও মহাজগতের অস্তিত্বকে যেভাবে সংজ্ঞায়িত করেন, তাতে অনেকগুলো তত্ত্ববিষয়ক অঞ্চলের সংবেদ এলাকায় কাল্পনিক বস্তুর
নিজস্ব বস্তুডোমেইন থাকার কথা বলেন। এমনকি বস্তুকেও মানুষ একটি পরিপ্রেক্ষিত থেকে
দেখে, যে পরিপ্রেক্ষিতের কোন সীমা নেই। অর্থাৎ পৃথিবীর
সমস্ত বস্তুগত ও অবস্তুগত জিনিসের অস্তিত্বকে আমরা যে পরিপ্রেক্ষিত থেকে বিবেচনা
করি, স্বয়ং জগতের অস্তিত্বকে সেই পরিপ্রেক্ষিত থেকে
বিবেচনা করা যায় না। এখানেই বৈজ্ঞানিক প্যারাডাইমের সীমাবদ্ধতা। যেমন ধরুন,
আপনি আছেন। কোথায় আছেন? বাসায়। বাসা
কোথায়? চট্টগ্রামে। চট্টগ্রাম কোথায়? বাংলাদেশে। বাংলাদেশ কোথায়? দক্ষিণ এশিয়ায়।
দক্ষিণ এশিয়া কোথায়? এশিয়ায়। এশিয়া কোথায়? পৃথিবীতে। পৃথিবী কোথায়? শূন্যে। শূন্য কোথায়? কোথাও না। মানে আমরা আছি এক ধরনের নাইয়ের মধ্যে, কাজেই পৃথিবীর অস্তিত্ব নেই। কারণ হলো, শেষ প্রশ্নটি ছাড়া বাকি প্রশ্নগুলোর উত্তর পেতে আপনি একইরকম স্থান-কালের
আধার, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি
ও প্যারাডাইম ব্যবহার করেছেন। কিন্তু শেষ প্রশ্নের ক্ষেত্রে পৃথিবীর অস্তিমানতা
বোঝার জন্য আপনি যাকে আধার মানেন সেই আধার বৈজ্ঞানিক আধার না। অর্থাৎ পূর্বেকার
প্রশ্নগুলোর উত্তর যে সংবেদ অঞ্চলে ধরা দিয়েছে, শেষ
প্রশ্নের জবাব সেই সংবেদ অঞ্চলে ধরা দেয় না। তাই অস্তিত্বকে বুঝতে হবে সংবেদ
অঞ্চলের সাথে আপেক্ষিক সম্পর্কের ভিত্তিতে। কিন্তু এসব কথা বিজ্ঞানবাদিরা স্বস্তির
সাথে নেন না। কারণ তারা মনে করেন মহাজগতের সবকিছুরই একটি বস্তুগত ভিত্তি আছে।
পৃথিবীর অস্তিত্বও বস্তুগত ভিত্তির ওপর নির্ভর করে। কিন্তু মার্কুস বলেন, সবকিছুর অস্তিত্ব বস্তুগত ভিত্তির ওপর নির্ভর করে না। এমনকি বস্তুগত
ভিত্তিও অনেকসময় সংবেদের ভিন্নতা দেখায়।
কান্টের কাছে অস্তিত্ব হলো বিশ্বকে ধারণ করা। অর্থাৎ স্থান-কালের কাঠামোতে
ব্যক্তিবিশেষ বা বস্তুবিশেষকে ধারণ করা। আমরা যখন বলি টেবিলে একটি বই আছে, তখন আমরা বোঝাতে চাই যে, পৃথিবী একটি বিশেষ স্থান-কালে ‘বই’ নামক এই বস্তুটিকে ধারণ করে। একই মডেল ব্যবহার
করে যদি আমি জগতের অস্তিত্ব বিচার করি তাহলে প্রশ্ন আসবে জগত কি জগতকে ধারণ করে? এই যে ধারণ করা বলতে আমরা আসলে কী
বোঝাতে চাই? অংশ ও সমগ্রের সম্পর্ককে আমরা কীভাবে দেখি?
এই সম্পর্কের সমগ্র অবয়বটাকে কী আমরা দেখতে পাই? অথবা আমরা যদি বলি জগত হলো স্থান-কালের অধীন এক সত্তা, যা জগতে আছে, তখন তা কি আদৌ কোন সংবেদ তৈরি
করে?
কান্ট দুই ধরনের অস্তিত্বের মধ্যে পার্থক্য করেছেন; একটি ব্যক্তিবিশেষের অস্তিত্ব এবং
আরেকটি জগতের অস্তিত্ব। মানুষের চিন্তাকে মানবীয়
অবস্থান থেকে দেখার কারণে মানুষ মনে করে যেভাবে অন্য বস্তুসকল আছে, সেভাবে জগতটা
আছে। মানুষের যে অভিজ্ঞতা তার আলাদা আলাদা সংবেদ অঞ্চল বা ডোমেইন আছে। টেবিলের ওপর
একটি বইয়ের সংবেদ যে ডোমেইনে সংবেদ তৈরি করে, জগতের অস্তিত্ব সেই একই ডোমেইনে সংবেদ তৈরি করে না। কারণ, এই দুই প্রকার
অস্তিত্বের ব্যাপারে আমাদের সংবেদ তৈরির প্রক্রিয়াটাকে দুইটি অঞ্চলে আলাদা করে
দেখতে হয়। যেখানে অস্তিত্ব বলতে আমরা কিছু গুণের অস্তিত্ব বুঝাচ্ছি। অর্থাৎ
পৃথিবীতে আছে এই রকম দুইটি বস্তুকে আলাদাভাবে জানার জন্য পার্থক্য রচনাকারি গুণ।
অন্যদিকে জগতের অস্তিত্বকে জগতের ভেতরের কোন বস্তুর অস্তিত্বের সাথে গুণগত পার্থক্য বা তুলনা করে জানা যায়
না। কাজেই আমরা জগতে যেসব জিনিসের অস্তিত্ব আছে বলে মানি
সেসবের অস্তিত্ব এই অর্থে আছে যে সেগুলো একটি বিশেষ প্রেক্ষিতে আমাদের কাছে ধরা
দেয়, যেটাকে মার্কুস
বলছেন সংবেদ অঞ্চল। এই ধরণের সংবেদ অঞ্চলের সংখ্যা অসংখ্য।
মার্কুস সেক্ষেত্রে কান্ট হতে ভিন্নভাবে এক ধরনের অধিঅধিবিদ্যা বা
মেটামেটাফিজিক্স এর অবতারণা করেন। হাইডেগারও বলেছিলেন যে, জগত নেই মনে করাটা অধিঅধিবিদ্যক
শূন্যতাবাদ। জগতের সত্তা, পরমস্বরূপ, গঠন, আকার এসব ধারনাগতভাবে শূন্য।
তবে মার্কুস কান্ট এবং হেগেলের অধিবিদ্যা বিষয়ক
চিন্তার সূত্রকে কাজেও লাগিয়েছেন তার নিজস্ব বোঝাপড়া তৈরির ক্ষেত্রে।
মার্কুসের মূল প্রতিপাদ্য হলো অস্তিত্ব। কোন কিছু হওয়া বলতে আসলে কী বোঝায়? ধরুন করিম ( হয় ) একজন শিক্ষক।
শিক্ষক হওয়া মানে কী? শিক্ষকের অস্তিত্ব এবং শিক্ষকের শিক্ষক হওয়া এক জিনিষ নয়।
শিক্ষককে এখানে আমরা তিনভাবে জানতে পারি। প্রথমত, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ইন্দ্রীয়
উপাত্তভিত্তিক সংবেদের মাধ্যমে, দ্বিতীয়ত, শিক্ষকের স্বয়ংসত্তা ও শিক্ষক যেভাবে
আমাদের চেতনায় ধরা দেয় তার পার্থক্য বিচারের নিরিখে এবং তৃতীয়ত, শিক্ষক কীভাবে
শিক্ষকসত্তা নিয়ে অস্তিত্ববান হয়ে ওঠে তার স্বরূপ হিসেবে। কাজেই, সংবেদ, অধিবিদ্যা এবং তত্ত্ববিদ্যার জায়গা থেকে
তিনভাবে আমরা কোনকিছুর অস্তিত্ব, এইক্ষেত্রে শিক্ষকের অস্তিত্ব ভাবতে পারি।
গ্যাব্রিয়েল এখানে গ্রহ হিসেবে পৃথিবীর অস্তিত্ব অস্বীকার করছেন না। তিনি
ভাববাদি নন যিনি বস্তুর স্বাধীন অস্তিত্বকে অস্বীকার করবেন। তিনি সত্তাগত
একত্ববাদের বিপক্ষে। কোন কিছুই শূন্য বা নিঃসঙ্গভাবে অস্তিত্বশীল না। সব কিছুই
অন্য কোন না কোন কিছুর সাথে সম্পর্কের সূত্রে, বিশেষ ডোমেইনে থাকে। প্রত্যেক সত্তাই তার নিজ নিজ
ডোমেইনের সত্তা। যে কোন বস্তু আছে কি নেই তা নির্ভর করে এটি কোন ডোমেইনে আছে তার
ওপর অথবা এটি কোন সংবেদ অঞ্চলে আছে তার ওপর। প্রত্যেক ডোমেইনের জন্য আলাদা আলাদা
নীতি, নিয়ম ও আইন আছে, যা দ্বারা ঐ বস্তুকে সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নায়িত করা যায়। একটি দেশকে যেমন
তার সংবিধান ও আইন দ্বারা বোঝা যায়, বা মহাজগতকে যেমন প্রাকৃতিক নিয়মের দ্বারা বোঝা যায়,
সেভাবে বিশ্বকে বোঝার জন্য বা এর অস্তিত্ব অনুধাবনের জন্য এরূপ
কোন সাধারণ নীতি বা আইন থাকা দরকার। কিন্তু সেই রকম কোন নীতি নেই। তাই জগতের অস্তিত্বও নেই।
গ্যাব্রিয়েল যে নয়াবাস্তববাদ প্রস্তাব করছেন তা সত্তার অস্বীকৃতি হিসেবে নয়
বা ভাববাদ, প্রতিবাস্তববাদ,
বহির্জাগতিক বাস্তবের অস্বীকৃতি নয়, বরং এর মূল প্রতিপাদ্য হল এই যে, এমন কোন সত্তা নেই যাকে জগত বলা যাবে। যা আছে তা হলো
বিষয় ( অবজেক্ট ) ও সংবেদের জায়গা (ফিল্ড অব সেন্স)। এখানে, যাকে আমরা জানি বা যা আমাদের জানার পরিসরে স্থান
পায়, তা হলো ‘বিষয়’; অন্যদিকে ওই বিষয়টি যে অবস্থানে বা লোকেশনে আমাদের মধ্যে
সংবেদ তৈরি করে তা হলো সংবেদের জায়গা। বস্তু কিংবা বিষয় যে পদ্ধতিতে বিষয়ীর সাথে
যোগাযোগ স্থাপন করে, যে প্রক্রিয়ায় জ্ঞেয় বিষয় জ্ঞাত হয়, তার যোগাযোগের মূল
জায়গাটিই হলো সংবেদের জায়গা।
মার্কুসের
মতে, সাম্প্রতিক
অধিবিদ্যার বেশিরভাগ ধারণাই ভ্রান্ত। জগত এবং বাস্তবতা পরস্পর বিনিময়যোগ্য অর্থে
ব্যবহার করার কারণে এমনটা হচ্ছে। এই ধরনের শব্দসমষ্টি দ্বারা আমরা যা বুঝাই তা দ্বারা অস্তিত্বের গুণ প্রকাশক কোন
কিছুকে নির্দেশ করে না। কারণ এতে করে অধিবিদ্যাকে
স্রেফ তত্ত্ববিদ্যায় পর্যবসিত করা হয়। এই দুই ফিল্ডকে আলাদা রাখা দরকার।
তত্ত্ববিদ্যা হচ্ছে প্রণালীবদ্ধভাবে অস্তিত্বের অর্থ অনুসন্ধানের একটি প্রক্রিয়া
অথচ অধিবিদ্যা হলো সত্তা ও অবভাসের পার্থক্য বিচারকারি এবং জগত হিসেবে
জগতসম্পর্কীয় একটি সামগ্রিকতার তত্ত্বের (Theory of
totality ) বোঝাপড়া।
অধিঅধিবিদ্যক শূন্যতাবাদ বলতে গ্যাব্রিয়েল যা বোঝাতে চান তা হলো, এমন কোন জগতের অস্তিত্ব নেই, যার পরম প্রকৃতি, সারসত্তা, গঠন, কাঠামো, এসবের ধারণাগত আধেয় নেই। সব কিছুকে
ধারণ করে এই রকম একটি বড় জিনিসের ধারণা অধ্যাস মাত্র।
নয়াবাস্তববাদ বলতে মার্কুস তথাকথিত উত্তরাধুনিকতাবাদের, যা ছিলো ধর্ম
থেকে বিজ্ঞান পর্যন্ত সর্বত্রে অতিকট্টর ডান-বামের সামষ্টিক জীবনদর্শন, তার পরের মতবাদ বুঝিয়েছেন। জীবনের যে একটি সুনির্দিষ্ট অর্থ আছে বলে মনে
করার ঐতিহ্য তৈরি হয়েছিল, সেই ধরনের বিশ্বাস থেকে, জ্ঞানগত ধোঁয়াশা থেকে, মানুষকে মুক্ত করতে উত্তরাধুনিকতাবাদের
যাত্রা শুরু হলেও এটি, মার্কুসের মতে, আমাদেরকে
ধোঁয়াশা থেকে মুক্ত করার পরিবর্তে অধিকতর ধোঁয়াশায় ফেলেছে। উত্তরাধুনিকতাবাদিরা অধিবিদ্যার
বিরোধীতা করতে গিয়ে অধিবিদ্যাকে হেলুসিনেশন বলে ভাবতেন, সমগ্র
মানবজাতির একটি সামষ্টিক হেলুসিনেশন বা অমূলপ্রত্যক্ষ বলে মনে করতেন। অথচ অধিবিদ্যা
হলো জগতটা আসলেই কেমন তা বর্ণনা করার একটি তাত্ত্বিক প্রচেষ্টা। জগতটা আমাদের কাছে
কেমন লাগে বা এটি আমাদের মনে কী বোধ তৈরি করে তা নয়, বরং জগতটি
স্বরূপে কেমন তা উদঘাটন করাই হলো অধিবিদ্যার মূল লক্ষ্য। এক্ষেত্রে জগত মানে জগত।
মানুষের চেতনার আরশিতে অবয়ব প্রাপ্ত বা মানবীয় চেতনার মিতষ্ক্রিয়ায় সৃষ্ট জগত নয়।
ইমানুয়েল কান্ট যেমন ইন্দ্রিয় উপাত্ত ও ক্যাটেগরি অব
আন্ডারস্ট্যান্ডিং মিলে তৈরিকৃত মানবীয় বোধে গজায়িত জ্ঞানের কথা বলেছেন,
তেমন কোন জ্ঞানজ-জগতের অস্তিত্ব নয়।
একটি জিনিস আসলেই স্বরূপে কেমন, আর সেটাকে কেমন দেখায়, এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য আছে। সূর্যটি কেমন, আর সূর্যটাকে
কেমন দেখায়, এর মধ্যে ফারাক আছে। কাজেই একটি জিনিস আসলেই
কেমন তা জানতে গেলে, যে প্রক্রিয়ায় আমরা ওই জিনিসকে জানি,
সেই প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত মানবীয় প্রভাবগুলোকে দূরীভূত করতে হয়।
সেজন্য ক্যাটেগরি অব আন্ডারস্ট্যান্ডিং-এর মতো জ্ঞান উৎপাদনের ছাঁচগুলোকে বাদ দিতে হবে। কারণ ওই মানবীয় জ্ঞানের ছাঁচ এমন
কিছু যোগ করে, যা কোন বস্তু বা ঘটনার স্বরূপের অংশ নয়।
বিগত কয়েক শতাব্দিতে অধিবিদ্যা বিরোধী যে নানা প্রয়াস পরিলক্ষিত হয়েছে, তার চূড়ান্ত রূপ
দেখা যায় উত্তরাধুনিকতাবাদে। এটা সবাই মানেন যে, উত্তরাধুনিক
যুগ মানে অধিবিদ্যা পরবর্তী যুগ। উত্তরাধুনিক দার্শনিকদের মতে, কোন কিছু ঠিক ততটুকু অস্তিত্বশীল যতটুকু আমাদের বোধে ধরা পড়ে। অর্থাৎ অবভাস ব্যতিরেকে কোন কিছুর অস্তিত্ব
নেই। মানে, অবভাস নেই এমন কিছুর অস্তিত্ব নেই। যদিও আমেরিকান উত্তরাধুনিকতাবাদি
দার্শনিক রিচার্ড রর্টি কিছুটা উদারতা দেখিয়ে বলেছেন যে, আমাদের
কাছে যতটুকু ধরা দেয়, তার বাইরেও কোন জিনিসের অজানা গুণ রয়ে
যেতে পারে। তবুও তিনি পরমসত্য জানার প্রয়াস চালানোর চেয়ে সাধারণভাবে মানুষ যা জানে,
তার প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করে জ্ঞানের মানবতাবাদি রূপকে স্বীকৃতি
দিয়েছেন।
উত্তরাধুনিকতাবাদিরা অধিবিদ্যার বিপরীতে যে বিকল্প প্রস্তাব করে, তা
হলো, নির্মাণবাদ
বা কনস্ট্রাক্টিভিজম, যার মূল প্রস্তাব হলো, জগতে কোন স্বাধীন ফ্যাক্ট বা ঘটনা নেই, বরং
জ্ঞানভাষ্য ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি দিয়ে মানুষ নিজেই বিভিন্ন আকারে ওইসব ফ্যাক্ট তৈরি
করে। ভাষাক্রীড়া বা জ্ঞানভাষ্যের বাইরে কোন কিছুর বাস্তবতা নেই। কান্ট যেমন বলেছেন,
কোন কিছুকে আমরা স্বরূপে জানতে পারি না। আমরা যা-ই জানি না কেন,
তার কিছুটা আমরা নিজেরাই ক্যাটেগরি দ্বারা তৈরি করে নিই। আমরা কান
দিয়ে শুনি, চোখ দিয়ে দেখি, নাক দিয়ে
ঘ্রাণ নিই, জিহ্বা দিয়ে স্বাদ নিই। অথচ মচমচে চানাচুর খাওয়ার
অভিজ্ঞতা, যার কিছুটা দর্শনান্দ্রীয় হতে প্রাপ্ত, কিছুটা চক্ষুইন্দ্রীয়
দ্বারা প্রাপ্ত, কিছুটা স্বাদ ইন্দ্রীয় জিহ্বা দ্বারা প্রাপ্ত, তা আমাদের
মনে এক অখণ্ড বোধ তৈরি করে। এই যে বিভিন্ন ইন্দ্রিয়ের ভিন্ন ভিন্ন উপাত্ত আমাদের অনুভবে
অখণ্ড বোধ তৈরি করে, তার কারিগরি ছাঁচ হলো, কান্টের মতে,
ক্যাটেগরিজ অব আন্ডারস্ট্যান্ডিং। কাজেই মচমচে চানাচুরের অনুভুতি কতটা চানাচুরের,
আর কতটা আমাদের নিজেদের আরোপিত তা বিবেচনায় নেয়া উচিত।
এই বিষয়ে মার্কুস একটি যুতসই উদাহরণ দেন, যেমন, রঙ। গ্যালিলিও গ্যালিলেই ও
নিউটন থেকে শুরু করে বিজ্ঞানজগতে এই ধারণা প্রচলিত হয়েছে যে, রঙের অস্তিত্ব নেই। এই সত্য দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে গ্যোয়েটে তার 'ডক্ট্রিন অব কালারস' লিখেছেন। অনেকে মনে করতে পারেন,
রঙ হলো সুনির্দিষ্ট দূরত্বের কতগুলো তরঙ্গ, যা
আমাদের সেন্সরি রিসেপ্টরে সংবেদন তৈরি করে বা সাড়া জাগায়। জগত স্বরূপত রঙবিহীন,
যা কিছু এলিমেন্টারি পার্টিক্যলের সমষ্টি এবং যা আমাদের কাছে মাঝারি
স্কেলে আসে। এই পার্টিক্যলগুলো পরষ্পরকে একটি কাঠামোতে গাঁথে, আর মানুষ বিশেষ স্থান-কাল থেকে ওই কাঠামোর মাধ্যমেই তা প্রত্যক্ষ করে। তার
মানে, আমরা যেভাবে যেমন জানি, জগতটা তা
থেকে একেবারেই ভিন্নরকম। কান্টপন্থী নির্মাণবাদ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে
উত্তরাধুনিকতাবাদিরা দাবি করেন যে, আসলে সবকিছু আমরাই
নির্মাণ করি। আমরা বিজ্ঞান, ধর্ম, রাজনীতি,
ভাষা, প্রণয়লীলা, কবিতা
ও সামাজিক প্রথাসহ নানা প্রাকৃতিক ভাষার চশমা দিয়ে জগতটাকে দেখি।
নয়াবাস্তববাদ এই ক্ষেত্রে দাবি করে যে, জগতটা স্বরূপে যেমন আছে আমরা একে তেমনভাবে
চিহ্নিত করতে পারি। উদাহরণস্বরূপ, আজকে ভোরের সূর্যটাকে যদি
রহিম শাহবাগ মোড়ে দাঁড়িয়ে দেখে এবং করিমসহ আমরা কয়েকজন কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে দাঁড়িয়ে
দেখি তাহলে সূর্যকে দুই জায়গা থেকে প্রত্যক্ষ করার ফলে ভোরের সূর্যের দুইটি আলাদা
অভিজ্ঞতা পাই। অধিবিদ্যার নীতি অনুযায়ী এই ক্ষেত্রে আসল বস্তু কিন্তু একটিই,
সূর্য। আমরা কে কোত্থেকে সূর্যকে দেখছি সেটা নিয়ে সূর্যের স্বরূপের
কোন বিকার নেই। তবে অভিজ্ঞতা নিয়ে আমাদের মতভিন্নতা আছে। যেমন, উত্তরাধুনিকতাবাদিরা এই ক্ষেত্রে তিনটি সূর্যের কথা বলবে। তোমার, আমার এবং তার। রহিমের, করিমের এবং আমার। এর বাইরে
সূর্যের কোন অস্তিত্ব নেই। কিন্তু নয়াবাস্তববাদিরা এই ক্ষেত্রে চারটি
বস্তু-অস্তিত্বের কথা বলে। যেমন,
১) সূর্য ,
২) শাহবাগ মোড় থেকে দেখা রহিমের সূর্য,
৩) কক্সবাজার থেকে দেখা করিমের সূর্য এবং
৪) কক্সবাজার থেকে দেখা আমার সূর্য।
নয়াবাস্তববাদিরা মনে করেন, ঘটনা সম্পর্কে চিন্তাগুলো একই শর্তে অস্তিত্বশীল
হয়, যেভাবে আমাদের চিন্তার অভিমূখে বস্তুসমূহ অস্তিত্বশীল
হয়। কোন ঘটনা সম্পর্কে চিন্তাগুলো ওই ঘটনারই সম্প্রসারণ মাত্র। চিন্তাগুলো নিজেই
আরেকটি ঘটনা। এই ক্ষেত্রে প্রচলিত অধিবিদ্যা ও নির্মাণবাদের কিছু সীমাবদ্ধতা আছে।
দুইটিই বাস্তবতা সম্পর্কে অযৌক্তিক সরলীকরণ দোষে দুষ্ট। সেইক্ষেত্রে দু'পক্ষই বাস্তবতাকে সংকীর্ণ একপাক্ষিকভাবে দেখে; হয়
এমন জগত হিসেবে যার কোন দর্শক নেই অথবা স্রেফ দর্শকদের জগত হিসেবে। এই জগতটা
কীভাবে চলছে, তা কেউ একজন তাকিয়ে আছে কিংবা তাকিয়ে নেই,
এই দুই অবস্থান থেকে দেখা হয়ে থাকে। কিন্তু নয়াবাস্তববাদি
গ্যাব্রিয়েল মার্কুসের মতে, এই দুই অবস্থানের কোনটিই ঠিক নয়।
জগত এই দুই অবস্থা থেকে মুক্ত। দর্শকবিহীন কিংবা দর্শকওয়ালা। প্রচলিত ঘরানার
অধিবিদ্যা অনুযায়ী এই জগতের কোন দর্শক নেই। উত্তরাধুনিকতাবাদিদের মতে, এই জগতটা মানুষের নির্মিতি মাত্র, জ্ঞাতার ফ্যান্টাসি
মাত্র।
আমরা যখন মহাবিশ্ব, মিল্কিওয়ে, এইসব ধারণার কথা বলি,
বিশেষত পদার্থবিজ্ঞানিরা যখন এইসব বিষয়ে আলাপ পাড়েন, তখন এক ধরনের বস্তু-ডোমেইনের কথা বলেন। কিন্তু জগত হলো সবকিছুর সমষ্টি,
যেখানে সরকার, স্বপ্ন, অবাস্তবায়িত
সম্ভাবনা, শিল্পকর্ম, এমনকি জগত
সম্পর্কে চিন্তা সবকিছুই আছে। এভাবে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক জিনিস এর অন্তর্ভুক্ত,
যা স্পর্শ করা যায় না। ফলে, জগতকে একটি ডোমেইনের
ডোমেইন হিসেবে চিন্তা করা যায়। এখানে প্রতিটি ডোমেইন এক জাতীয় জিনিসের সেট, হোক তা
বস্তুগত বা অবস্তুগত।
মার্কুসের মতে, এই জগত, যা সবকিছুকে কিংবা সবকিছুর আলাদা আলাদা
ডোমেইনকে ধারণ করে, তা অস্তিত্বশীল হতে পারে না। হয়তো
সবকিছুর অস্তিত্ব আছে, কিন্তু জগতের অস্তিত্ব নেই। মার্কুসের
দেওয়া একটা উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি আরও খোলাসা করা যায়। ধরুন, আমরা
একটি রেস্তোরাঁতে গেলাম, রাতের খাবার খেতে। এখানে কি এমন
ডোমেইন আছে, যা সব ডোমেইনকে ধারণ করে? আমরা
কি ওই রেস্তোরাঁতে আছে এই রকম সবকিছুর চারপাশে একটি করে বৃত্ত এঁকে দিতে পারি?
এখন খেয়াল করুন, এই রেস্তোরাঁতে শুধু আমরা নেই,
আরও অনেকে আছে। এখানে বেশ কয়েকটি টেবিলে তাদের নিজস্ব চাহিদা ও
পছন্দ অনুযায়ী দলীয় গতিময়তা নিয়ে মজে আছে বেশ কিছু ক্রেতা। এছাড়া আছে, ম্যানেজার, মালিক, কর্মচারী,
পাচক, পরিবেশক, পোকা-মাকড়,
এমনকি জীবাণু ও ব্যাকটেরিয়া, যা এই
রেস্তোরাঁতে বাস করে।
এখানে এমন ঘটনা আছে, যা সাব-এটমিক লেভেলে ঘটে চলেছে। যেমন, কোষের ভাঙা-গড়া, খাবার হজম হওয়াসহ হরমোনের বাড়া-কমা।
তাদের কিছু একে অপরের সাথে যুক্ত, আর কিছু একেবারেই
বিচ্ছিন্ন। ছাদের বীমে সবার অলক্ষ্যে চুপচাপ বসে থাকা মাকড়শাটি আমাদের খাদ্যাভ্যাস
ও মনোভাব সম্পর্কে কী ভাবছে? আমরা রেস্তোরাঁতে যে ঘটনার ভেতর দিয়ে যাচ্ছি,
মাকড়শাটি তার অবিচ্ছেদ্য অংশ যদিও সেই সম্পর্কে আমরা সচেতনভাবে অবগত নই। একইভাবে
খাদ্যগুলো আমাদের পাকস্থলীতে কীভাবে হজম হচ্ছে সেটাকে আমরা আমাদের অভিজ্ঞতালব্দ
ঘটনার অংশ মনে করছি না। এই রেস্তোরাঁতে এসবের বাইরেও অনেকগুলো বস্তু-ডোমেইন আছে,
ক্ষুদ্র বা বড় যার সাধারণ কোন পাটাতন ছাড়াই। অর্থাৎ এখানে অনেকগুলো জগত আছে।
সবগুলো জগত বা বস্তুবলয়কে, যা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ও স্থা-কালে জানা সম্ভব, আমরা এক
বা একাধিক সংবেদ অঞ্চলে অনুভব করতে পারি। কিন্তু জগত, ব্যাপারটি এই ধরনের
বস্তু-ডোমেইন বা মহাবিশ্বের চেয়েও বৃহত্তর কিছু, যা সব ডোমেইনের ডোমেইন। এই ধরনের
ডোমেইন অব ডোমেইনের অস্তিত্ব আমরা কল্পনা করতে পারি না।
মার্কুস
বলেন না যে, তার এই নয়াবাস্তববাদ একেবারে অকাট্য। তবে, যুক্তির নিরিখে এটিই অধিকতর
সঠিক। অধিকন্তু, জ্ঞানের নতুন নতুন সম্ভাবনা এবং দার্শনিক সংশয়ের নতুন ব্যাখ্যা
হয়তো আরও নতুন বিষয় আমাদের কাছে খোলাসা করবে। এই পর্যন্ত মার্কুসের যে সীমাবদ্ধতা
ধরা পড়ে তা হলো, জগত সম্পর্কে তার পৌনঃপুনিক নেতিবাচকতা। তিনি জগতকে অনেকগুলো
না-বাচক বচন দিয়ে সংজ্ঞায়িত করতে চান, অথচ সংজ্ঞা না-বাচকতা দিয়ে হয় না। যদি তাই,
হয় তাহলে, সুকুমার রায়ের সেই বিখ্যাত ছড়া, বাবুরাম সাপুড়ের ফাঁদে পড়বো, যেখানে
সাপটির চোখ, কান, নাক, দাঁত…ইত্যাদিতো নেই, কী আছে সেটিই কল্পনার অতীত। তো
মার্কুসের জগত আপাতত অকল্পনীয়, ‘সুকুমার রায়ের সাপ’।
লেখক
পরিচিতিঃ লেখক ও গবেষক
৫ মে, ২০১৮
নেত্রকোণা

Comments