Skip to main content

অনুপম সেনের দৃষ্টিতে ভারতের সামাজিক অর্থনীতি

সরওয়ার কামাল *

বাংলাদেশের অন্যতম সমাজবিজ্ঞানী অনুপম সেন। পেশায় অধ্যাপক হলেও তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক, সাংগঠনিক ও সাংস্কৃতিক ভূমিকার জন্য তিনি গণবুদ্ধিজীবী হিসেবে সর্বজনমান্য। যুক্তিবাদিতা, ধর্মবিযুক্ততা এবং সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক-সমাজ গঠনের বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইয়ের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থেকে প্রতিভার স্ফুরণ ও মানসালোকের পিদিম জ্বেলে প্রতিক্রিয়াশীলতার আঁধার দূরীকরণে বলীয়ান ভূমিকা রাখার জন্য তিনি রেনেসাঁমানব বলেও খ্যাত বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষাতেই তিনি পরিমিত কিন্তু উৎকৃষ্ট মানের প্রবন্ধাবলি রচনা করেছেন। সেইসব রচনার সাহিত্যমান বিচারে তাকে সাহিত্যিক না বললে সত্যের বরখেলাপ হয় গবেষক এবং গবেষকদের উস্তাদ হিসেবেও তিনি সমকালীন চিন্তাবিশ্বে সমাদৃতভারতে রাষ্ট্র কায়েমের ঐতিহাসিক পর্যায়ে শ্রেণির উদ্ভব ও শিল্পায়নের সামাজিক অর্থনীতি নিয়ে তিনি কানাডার ম্যাকমাস্টার য়ুনিভার্সিটিতে গবেষণা করেছিলেন তাঁর সেই পিএইচডি গবেষণাজাত সন্দর্ভটি ১৯৮২ সালে রাউটলেজ হতে 'The State, Industrialization and Class formation in India' শিরোনামের বই আকারে প্রকাশিত হয় এতে মার্ক্সবাদি দৃষ্টিকোণ থেকে ভারতের উৎপাদনপ্রণালী এবং সামাজিক শ্রেণির স্বরূপ বিশ্লেষণের মাধ্যমে তাত্ত্বিক ও মাঠকর্মজাত অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি দেখাতে চেষ্টা করেছেন যে, উৎপাদন ব্যবস্থার ভিন্নতা থাকায় এখানে সামাজিক শ্রেণিসমূহ পরস্পর হতে স্বাধীন ভূমিকা পালন করেছে, যা সাধারণত প্রচলিত মার্ক্সবাদি শ্রেণিতত্ত্বের সাথে যায় না অনুপম সেনের লেখায় এমন ঐতিহাসিক নজির পাওয়া যায়, যা থেকে এটা সহজেই অনুমেয় যে, স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতীয় সমাজের স্থবিরতা এবং অনুন্নয়নের পেছনে রয়েছে বিশেষ রোগ যদিও তিনি শুরুতেই স্বীকার করেছেন যে, ভারত রাষ্ট্রের স্বরূপ অন্বেষণ এবং সামাজিক অর্থনীতি, বিশেষ করে শিল্প বিকাশে এর ভূমিকা নির্ণয় করতেই তিনি বইটি লিখেছেন

তিনি এই বইতে রাষ্ট্রের উৎপাদনপ্রণালীর বিশ্লেষণ করেছেন এবং সামাজিক অর্থনীতির বিবর্তনের সাথে রাষ্ট্রের সম্পর্ক বিচার করেছেন তার মতে, ভারতে বিশেষ উৎপাদনপ্রণালী বিদ্যমান থাকার কারণেই রাষ্ট্র সামাজিক শ্রেণিসমূহ থেকে স্বতন্ত্র ভূমিকা পালন করতে পেরেছে প্রথাগত মার্ক্সবাদি দৃষ্টিকোণ থেকে রাষ্ট্রকে সর্বদা শ্রেণিসংগ্রামের উপায় হিসেবে ভাবা হয়, অথচ ভারতে ঘটেছে অন্যথা রাষ্ট্রগঠনের প্রক্রিয়ায় বিদ্যমান উৎপাদনপ্রণালীর ভিত্তিতে ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণির উদ্ভব এবং শ্রেণিসমূহের মধ্যে যে দ্বান্ধিক বিরোধ দেখা দেয় ভারতের ক্ষেত্রে সেরূপ দেখা দেয়নি ভারতীয় সমাজে উৎপাদনপ্রণালীর, বিশেষ করে উৎপাদিকাশক্তির বিকাশ এবং উৎপাদন সম্পর্কের জায়গায় এক ধরনের সামাজিক মালিকানা ও সমাজনির্ভরতা লক্ষ্য করা যায় এখানে রাষ্ট্রের চেয়ে সমাজের একটি মৌলিক ভূমিকা ছিল ঐতিহাসিক বিবর্তনের মাধ্যমে রাষ্ট্র যখন তার নির্দিষ্ট রূপ পরিগ্রহ করে, তখন তা সামাজিক অবস্থার বিবর্তনের প্রতিক্রিয়ায় সামাজিক পরিবর্তনের সাথেও নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয় ভারতে রাষ্ট্রের যে স্বতন্ত্র ধারা, তা এশীয় উৎপাদনের ধরণজাত বলেই ভারতীয় অর্থনীতির পুঁজিবাদে রূপান্তরের ধারা ব্যাহত হয়েছে পুঁজিবাদে রূপান্তরের গতিমন্থরতাই অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ব্যাহত করে উপনিবেশায়নের দিকে ধাবিত করেছে

তিনি তার গবেষণাগ্রন্থে উল্লেখ করেছেন ঔপনিবেশিক যুগে, লোকজ শ্রেণিসমুহের বিপরীতে রাষ্ট্রের স্বনির্ভরতা এসেছিল সমাজ গঠন থেকে, যা ছিল কিছুটা এশীয়, কিছুটা সামন্ত এবং কিছুটা পুঁজিবাদি যার সাথে যুক্ত আছে নগরকেন্দ্রিক বুর্জোয়াদের প্রতি উপনিবেশিক রাষ্ট্রের মাথানিচু ভাব ভারতে উপনিবেশবিরোধি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের সম্ভাবনা নিয়ে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের সুযোগ তৈরি হয়েছিলো, তা অচিরেই সামাজিক-রাজনৈতিক স্থবিরতাসহ স্থায়ী দারিদ্র্যে পর্যবসিত হয় এর পেছনে যে দৃশ্যমান কারণগুলোকে বিশেষজ্ঞগণ প্রাথমিকভাবে সনাক্ত করেছিলেন, তা হলো, জনসংখ্যা বিস্ফোরণ, কৃষিক্ষেত্রে কারিগরি উন্নয়নের অসমতা, জাতপ্রথা, স্বজনপ্রীতি, অভিজাততন্ত্র, জ্যোতিষীদের ভবিষ্যৎবাণীর ওপর অতিমাত্রিক নির্ভরতা এবং আধ্যাত্মিক অতীতচারিতার দিকে মানুষের সমূলে প্রত্যাবর্তন অথচ ভারতীয় শাসকগোষ্ঠী নিজেদের অর্থনৈতিক অনুন্নয়নের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে ব্যর্থ হয়েছিলো তারা কেন ব্যর্থ হয়েছিল তার একটি মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায় ভি এস নাইপলের মূল্যায়নে। উপন্যাসিক ভি এস নাইপলের মতো, অনুপম সেনও পরোক্ষভাবে বলতে চেয়েছেন যে, ভারতীয়রা সরাসরি নিজেদের প্রতি দৃষ্টিপাত করতে পারে না, কারণ তাতে যে অসহ্য দৃশ্য তারা দেখতে পাবে, তা তাদের পাগল করে ছাড়বে ভারতীয়দের পরোক্ষ দৃষ্টিজাত বয়ানের বিপরীতে ঐতিহাসিক নজির টেনে স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতীয় সমাজের স্থবিরতা ও অনুন্নয়নের কারণ চিহ্নিত করতে গিয়ে লেখক শুরুতেই জানিয়ে দিয়েছেন যে, ভারত রাষ্ট্রের সামাজিক অর্থনীতির স্বরূপ, বিশেষ করে শিল্প বিকাশে এর ভূমিকা এবং সামাজিক অর্থনীতির অগ্রগামিতা কিংবা পশ্চাদগামিতার সাথে রাষ্ট্রের যে দ্বান্ধিক সম্পর্ক তা ব্যাখ্যা করা এবং শ্রেণি সংগ্রামের ভেতর দিয়ে রাষ্ট্রের যে চারিত্র্য দাঁড়ায়, তা কীভাবে উৎপাদন ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করে তা দেখানোই ছিলো তার অন্বিষ্ট

 রাজনীতির ইতিহাসে দেখা যায়, সমাজ হতেই রাষ্ট্রশক্তি উৎপত্তি লাভ করে, কিন্তু উৎপত্তির পরে রাষ্ট্র নিজেকে সমাজের ঊর্ধ্বে প্রতিষ্ঠিত করে সমাজের মানুষ যে আকাঙ্ক্ষা নিয়ে রাষ্ট্র গঠন করে, রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে কিংবা রাষ্ট্রনির্ভর নতুন শ্রেণির উদ্ভব ঘটে এটাকে শাসকগোষ্ঠী বলা হবে, নাকি শাসন পরিচালনার আঙ্গিক শক্তি বলা হবে, তা নিয়ে বিতর্ক আছে। তবে ভিন্ন ভিন্ন রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডের ভেতর দিয়ে রাষ্ট্র নিজেই এই নতুন স্বতন্ত্র গোষ্ঠীশ্রেণি সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে ওই নবসৃষ্ট শ্রেণির উদ্ভবের সাথে জড়িত বিদ্যমান শ্রেণির বা সামাজিক শ্রেণির স্বার্থের সাথে নবসৃষ্ট শ্রেণির দ্বন্ধ দেখা দেয় অর্থাৎ সমাজের স্বার্থ এবং রাষ্ট্রের স্বার্থ আলাদা হতে শুরু করে এভাবে সমাজবদ্ধ মানুষের স্বার্থ এবং শাসকগোষ্ঠীর স্বার্থ আলাদা হওয়ার মধ্য দিয়ে এবং তাদের এই রকম শ্রেণিশক্তি ও ক্ষমতার দ্বন্ধের ভেতর দিয়ে যে রাষ্ট্রের বিকাশ ঘটে, তার বিকাশকালীন চরিত্র ও পরিচালন পদ্ধতি ব্যাখ্যা করার জন্য সেন মার্ক্সীয় দ্বান্ধিকতার তত্ত্ব ও পদ্ধতির আশ্রয় নিয়েছেন একইসাথে উৎপাদন ব্যবস্থার ধারাবাহিক পরিবর্তনের ফলে শ্রেণিগঠনের সামাজিক গতিবিদ্যা কীভাবে অনুধাবন করা যায়, তার পাঠোদ্ধার করতে গিয়ে মার্ক্স ও এঙ্গেলসের লেখা হতে এতো বিস্তৃত উদ্ধৃতি দিয়েছেন যে, বইয়ের এক তৃতীয়াংশের লেখার ভার মার্ক্স এবং এঙ্গেলসই বহন করেছেন বললে অত্যুক্তি হবে না তাই তার ব্যাখ্যা যে আসলেই মার্ক্সিস্ট এই ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই আমরা শুধু দেখব এই মার্ক্সিস্ট ব্যাখ্যার স্বরূপ কী শেষে তার এই ব্যাখ্যার সীমাবদ্ধতাটুকু চিহ্নিত করতে পারলেই আমাদের পর্যালোচনা বর্তে যায়। এখানে সতর্কতা জারি করা সমীচীন হবে যে, মার্ক্সের বিচ্ছিন্নতার তত্ত্ব, শ্রেণী ও শ্রেণিসংগ্রামের তত্ত্ব, উৎপাদনপ্রণালী, উদ্বৃত্ত মূল্যতত্ত্ব এবং রাষ্ট্রের বিলোপ সংক্রান্ত মৌলিক প্রত্যয় সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা না থাকলে এই আলোচনা নিয়ে অগ্রসর হওয়া সমস্যাপূর্ণ হতে পারে।  

যাইহোক, রাষ্ট্রের সাথে আর্থসামাজিক প্রগতি ও পশ্চাদগতির সম্পর্কের যে সমস্যা, সেটা দ্বান্ধিক। মার্ক্সীয় তত্ত্ব ও পদ্ধতি দিয়ে এই দ্বান্ধিকতার স্বরূপ ব্যাখ্যা করাটা ছিল, সেনের গবেষণার একটি উদ্দেশ্য। মার্ক্সবাদি দ্বান্ধিকতার দিক থেকে রাষ্ট্রকে শুধুমাত্র রাজনৈতিক ইচ্ছা বা সার্বভৌমত্বের মতো কিছু বিমূর্ত ধারণার সমষ্টি হিসেবে দেখা হয় না, বরং নিয়ত পরিবর্তনশীল অথবা আপাত স্থির উৎপাদনের ধরন নি:সৃত সামাজিক গতিবিদ্যার প্রতিফলন হিসেবে দেখা হয়। সমাজ ও শ্রেণি গঠনের ক্ষেত্রে উৎপাদনের প্রক্রিয়া এবং ধরন কতটা ভূমিকা রাখে সেটা নির্ভর করে উৎপাদিকা শক্তিসমুহের উন্নয়ন এবং উৎপাদন সম্পর্কের ওপর। যেহেতু এগুলো সমাজে সমাজে ভিন্নতা দেখায়, বিশেষ করে প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট কারণে, তাই মার্ক্সীয় ব্যাখ্যার একটা স্বাতন্ত্র্য হচ্ছে একে শুধু রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে না দেখে সামাজ বিশ্লেষণের জায়গা থেকেও দেখা। ভারতের ক্ষেত্রেও অনুপম সেন, রাষ্ট্র ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে উৎপাদনের ধরণ এবং তাদের রূপান্তরের দিকে দৃষ্টিপাত করেছেন। কারণ এগুলোই ঐতিহাসিকভাবে ভারতরাষ্ট্রের ভিত্তি যুগিয়েছে। রাষ্ট্রকে শ্রেণি সংগ্রামের একটি ক্ষেত্র হিসেবে দেখলে, শ্রেণি সংগ্রামের ভেতর দিয়ে রাষ্ট্রের রূপ কী দাঁড়াবে, তার আকার বা ধরণ কেমন হবে সেটা বিচার করতে হবে শ্রেণিসমূহের চরিত্র, উৎপাদিকাশক্তির বিকাশ ও মালিকানার বণ্টন এবং শ্রেণিদ্বন্ধের স্বরূপ বিশ্লেষণের মাধ্যমে।  

ভারতের উৎপাদনপ্রণালী

ব্রিটিশপূর্ব ভারতের উৎপাদনপ্রণালী এবং সমাজগঠনের দিকে আলোকপাত করে অনুপম সেন দেখাতে চেয়েছেন যে, অন্য যে কোন দেশের মতোই ভারতে শিল্পায়নের প্রক্রিয়াটি রাষ্ট্র এবং সমাজের শ্রেণিসমূহের চরিত্র ও ধরনের সাথে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। কিন্তু পশ্চিমা দেশের মতো পুঁজিবাদি ব্যবসায়িক সমাজের বিকাশের মধ্য দিয়ে এখানে শিল্পায়ন ঘটেনি। য়ুরোপে শিল্প বিপ্লবের পূর্বে এক ধরনের পুঁজিবাদি ব্যবসায়িক সমাজ গড়ে উঠেছিল। বিপরীতে ভারতে পুঁজিবাদের বীজ রোপিত হয়েছিল ঔপনিবেশিক শাসকের হাতে। পুঁজিবাদ এখানকার মাটিলগ্ন সমাজব্যবস্থা থেকে গজায়নি। এখানে আদিম সমাজের বিলুপ্তির সাথে সাথে দাস ব্যবস্থা কিংবা সামন্তব্যবস্থা দানা বাঁধেনি। বরং আদিম সমাজের পরেই এশীয় উৎপাদনের ধরণ চালু হয়েছিল। য়ুরোপে ব্যবসায়প্রথা চালু থাকায় সেখানে উদ্ধৃত্ত উৎপাদনের, অর্থাৎ খেয়ে পরে বাঁচার পরেও পণ্য বিনিময়ের তাগিদে অধিকতর উৎপাদন করার বাজার সংস্কৃতি শুরু হয়েছিল। ফলে ওখানে ব্যবসায় ও বাণিজ্যের সম্প্রসারণের সাথে সাথে সামন্ত প্রভুদের দ্বারা কৃষক শোষণ বেড়েছিল, যার মাধ্যমে তারা উদ্বৃত্ত উৎপাদনের টার্গেট পূরণ করতো। এভাবে ক্রমাগত শ্রমশোষণ এবং উদ্বৃত্ত উৎপাদনের মাধ্যমে ওখানে ভূমিহীন কৃষকদের মধ্য হতে শ্রমনির্ভর দিনমজুরের উদ্ভব ঘটে। এই যে ভূমিহীন শ্রমনির্ভর দিনমজুর, তাদের সাথে ভূমিমালিক সামন্তদের উৎপাদন সম্পর্ক নিয়ে বিরোধ দেখা দেয়। কারণ, ততদিনে উৎপাদনের হাতিয়ার একচেটিয়াভাবে সামন্তদের হাতে চলে যায়। অন্যদিকে ভূমিহীনরা উৎপাদিকাশক্তি হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েমাটি কর্ষণ করে, গায়ের ঘাম ফেলে যারা ফসল উৎপাদন করছে, সেই ফসলের সাথে তাদের সম্পর্ক নিবিষ্ট নয়, বিচ্ছেদেরকারণ ওই ফসলের ওপর তাদের মালিকানা নেই। এসবের মালিক সামন্তপ্রভু। উৎপাদিকাশক্তির, বিশেষ করে ভূমি, পানির উৎস ও ফসলের মালিকানা নিয়ে এই যে প্রভু ও মজুরের বিরোধ, তা থেকেই শ্রেণি চেতনা গড়ে ওঠে।

 বিপরীতে, ভারতে য়ুরোপের মতো সামন্ত প্রভু ছিলনা, বরং তারা ছিল বেশির বেশি রাজস্ব আদায়কারী। কৃষক যে ফসল উৎপাদন করতো, তা থেকে একটা অংশ রাজস্ব আদায়কারীকে দিয়ে বাকিটা সে নিজে ভোগ করতো। এতে করে সে তার নিজের কায়িকশ্রমে উৎপাদিত পণ্যের একটা অংশ নিজের কাছেই রাখতো, যার সাথে ওই কৃষক বা উৎপাদক ঘণিষ্ঠতা অনুভব করতোফলে তার মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবোধ দানা বাঁধেনিকাজেই, এখানে মালিক বনাম শ্রমিকের কিংবা কৃষকের দ্বন্ধ দেখা দেয়নি। অন্যদিকে রাজস্ব আদায়কারীরা যেহেতু রাজস্ব নিয়েই খালাস, উদ্বৃত্ত পণ্য নিয়ে তাদের মধ্যে ব্যবসায় লিপ্ত হওয়ার কিংবা পণ্য বিনিময়ের প্রয়োজন দেখা দেয়নি। যে সময়ে ভারতীয় সমাজে বণিকশ্রেণির উদ্ভব ঘটছে, সেই সময়ে ভারত উপনিবেশে পরিণত হয়ে পড়েছে। কাজেই উপনিবেশপূর্ব ভারতে বাণিজ্যিক পুঁজির বিকাশ ঘটেছে এমন বলা যায় না। যে বাণিজ্যিক পুঁজির ভিত্তিতে য়ুরোপে শিল্পায়নের বিকাশ ঘটেছিলো, ইতিহাসের যৌক্তিক বিশ্লেষণ থেকে এটিই অনুমিত হয় যে, উপনিবেশপূর্ব ভারতে সেরূপ পুঁজির বিকাশ ঘটেনি।

অনুপম সেন ভারতে পুঁজির দুর্বলতার তিনটি ফ্যাক্টর চিহ্নিত করেছেন। যার প্রথমটা হলো, কৃষি ও শিল্পের গ্রামকেন্দ্রিক ঐক্য এবং ভূমির ওপর প্রভুদের আইনগত মালিকানার অনুপস্থিতি। যার কারণে বুর্জোয়ারা কৃষককে তার জমি থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি কিংবা উৎপাদনের হাতিয়ারের মালিকানা থেকে উচ্ছেদ করতে পারেনি। দ্বিতীয়টি, রাজনৈতিক ক্ষমতার বিকেন্দ্রিকতার অভাব। যার ফলে রাষ্ট্র আরোপিত বাধা অতিক্রম করা বুর্জোয়াদের পক্ষে কঠিন ছিলো। পুঁজিবাদি উৎপাদনপ্রণালী উদ্ভবের ক্ষেত্রে বণিকদের পুঁজির একটি ভূমিকা থাকে। য়ুরোপে এই বণিকদের পুঁজিকে কেন্দ্র করেই পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদনপ্রণালীর বিকাশ ঘটেছিলোকিন্তু ভারতে প্রথমদিকে পুঁজিনির্ভর উৎপাদন ব্যবস্থার বিকাশে এই বণিকশ্রেণির পুঁজির অনুপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। তৃতীয়টি হলো, ভারতে পুঁজিবাদি উৎপাদন ব্যবস্থা বিকাশের পূর্বে রাষ্ট্রকে প্রভাবিত করতে পারে এমন বাণিজ্যিক পুঁজির অনুস্থিতিভারতে এশীয় ধরনের উৎপাদনপ্রণালী সামন্ত ব্যবস্থার চেয়ে স্থির ছিল। ফলে তার দ্বান্ধিক গতিময়তা য়ুরোপীয় পুঁজিবিকাশের দ্বান্ধিকতার চেয়ে জাড্যতাপূর্ণ ছিল। রাষ্ট্র এবং কৃষকের মাঝে জোতদাররা আলাদা একটি স্বাধীন পুঁজিবাদি শ্রেণি হিসেবে দাঁড়াতে পারেনি। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের বাইরে গিয়ে রাজস্ব আদায়কারী জোতদারদের আলাদা কোন দাবি আদায়ের সুযোগ ছিল না। তারা কৃষককে নিজের ইচ্ছায় ব্যবহার করতে পারতো না। ফলে, তাদেরপক্ষে কৃষককে মজুরিনির্ভর শ্রমিকে পরিণত করা সম্ভব হয়নি।

কোন সমাজের শ্রেণীসমূহের প্রকৃতি নির্ভর করে ওই সমাজের অর্থনীতির প্রকৃতির ওপর। ভারতে উৎপাদনের হাতিয়ার ছিল সামাজিক মালিকানার অধীন। এই ধরনের উৎপাদনপ্রণালীকে মার্ক্স বলেছেন, এশীয় ধরনের উৎপাদন প্রণালী। এখানে জমি ও কৃষির ধরণটাই এমন যে, কারো ব্যক্তিমালিকানায় অর্থাৎ সামাজিক মালিকানাকে অগ্রাহ্য করে এককভাবে কোন ব্যক্তি তার উৎপাদন ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে পারবে না। জমির গঠন, ভূ-প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য, পানির উৎসের বণ্টন, ফসলী মৌসুম এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ উৎপাদনের প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট উপাদানগুলো কোন ব্যক্তির একক নিয়ন্ত্রণের অধীন ছিল না। খাজনা আদায়কারীরা রাজার এজেন্ট ছিল মাত্র, ভূমির মালিক কিংবা কৃষকের মালিকানার পথে বাধা হিসেবে ছিলো না

 ভারতীয় শহরের দিকে দৃষ্টিপাত করলেও এখানকার বুর্জোয়াদের দুর্বলতাগুলো সহজে চিহ্নিত করা যায়। ভারতীয় অর্থনীতির স্থবিরতার একটা প্রধান কারণ ছিল এই যে, এখানে রাষ্ট্র নিজেই শহর গড়ে ওঠার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। নগরায়ন হলো বুর্জোয়া অর্থনীতি বিকাশের পূর্বশর্ত। ডি আর গ্যাডগিলের বরাত দিয়ে অনুপম সেন জানান, প্রাচীন ভারতে শহরগুলো ছিল হয় ধর্মীয় তীর্থস্থান, কোন প্রদেশের রাজধানী অথবা কোন বাণিজ্যিক স্থান। শিল্পের কারণে ওইসব শহর গড়ে ওঠেনি। এ থেকে বুঝা যায় নগরায়ন ও শিল্পায়নের সমকালীনতাজাত ঐক্য ছিল না। সতেরো এবং আঠারো শতকের দিকে পশ্চিমের সাথে বাণিজ্য শুরু হওয়ার পর থেকে ভারতে সমৃদ্ধ বণিকশ্রেণির উদ্ভব ঘটে। পরে তারা একটি শক্তিশালী সামাজিক শ্রেণিতে পরিণত হয়। কিন্তু কীভাবে তারা এই সামাজিক শক্তি অর্জন করলো, তা বিশ্লেষণ করতে গেলে মোঘল শাসনের অবসান, কোম্পানি শাসন এবং সর্বোপরি উপনিবেশিক শাসনের ধারাবাহিক পরিবর্তনগুলো মাথায় রাখতে হয়। মূলত মোঘলদের প্রভাব ক্ষুণ্ন হওয়ার ক্ষেত্রে এই উদীয়মান বণিকশ্রেণির ভূমিকা ছিল। উপনিবেশপূর্ব সময় থেকেই বিশ্বব্যাপী ভারতীয় বস্ত্রের চাহিদা ছিল। এই বাণিজ্য বাড়তে থাকলে ভারতীয় বণিকশ্রেণি ক্রমাগত প্রভাবশালী সামাজিক শক্তি হিসেবে আবির্ভুত হতে লাগলো। এই ধরনের বণিক, বিশেষ করে জগৎ শেঠদের ভূমিনির্ভর উৎপাদন ছিল না কিংবা সামন্তপ্রভুত্ব ছিল না ভূমির সাথে এবং স্থানীয় উৎপাদন প্রণালীর সাথে সম্পর্কহীন থাকা সত্ত্বেও এই ধরনের অর্থনৈতিক পরগাছারা সামাজিক অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেছিল। অন্য যে কোন শিল্পের তুলনায় বস্ত্রশিল্পের প্রাধান্যকে ভিত্তি করে এই বণিকশ্রেণির প্রভাব প্রতিপত্তিও বাড়তে শুরু করলো

 

ব্রিটিশদের জয় এবং সামাজিক শ্রেণির উদ্ভব

শিল্পের ধারাবাহিক বিকাশ, বণিকশ্রেণির উদ্ভব এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রসারের মধ্য দিয়ে ভারতে সামাজিক শ্রেণির উদ্ভব ঘটে। পলাশীর প্রান্তরে ১৭৫৭ সালে নবাবের বিরুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি একটি সংঘবদ্ধ লুঠেরাতে পরিণত হয়। পূর্বে ভারতে বাণিজ্যের জন্য এই কোম্পানিকে প্রচুর কর দিতে হতো। কিন্তু বিজয়ের পর করের এই বাধাতো থাকলোই না, বরং তাদের মুনাফা ও লুঠপাট বাড়লো বিনা বাধায়। ভারতের কারুশিল্পী এবং বয়নশিল্পীরা কোম্পানির এজেন্টের কাছে জিম্মি হয়ে পড়লো। গোমস্তা বলে পরিচিত এজেন্টদের নিজস্ব কর্মচারীদের মাধ্যমে কোম্পানি আমলে শোষণ ও অত্যাচারের মাত্রা মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছলো। কোম্পানিই এককভাবে পুরো বাজার দখল করে নিয়ন্ত্রণে নিলো। স্থানীয় বণিকদেরকে তাদের বাজার হতে পণ্য ক্রয়ে বাধা দিয়ে এক প্রকার উচ্ছেদ করা হলো এবং সেই পণ্য কোম্পানি হতে বেশি দামে কিনতে বাধ্য করা হলো। বাংলা লুঠ করে যে অর্থ পাওয়া গেল, সেটা ইংল্যান্ডে প্রাথমিক পুঁজি গঠনের একটি অন্যতম উৎস ছিলো। য়ুরোপ ও ভারতের পারষ্পরিক বাণিজ্যে ব্যালেন্স অব পেমেন্ট ভারতের পক্ষে ছিল। কিন্তু কোম্পানির মুনাফামুখি কার্যক্রমের ফলে এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা কুক্ষিগত করার ফলে ব্যালেন্স অব পেমেন্টের অবস্থা বিপরীত হয়ে গেলো। যে ভারত সারা বিশ্বে বস্ত্র রপ্তানি করতো, শিল্প বিপ্লবের পরে তাকে তারা বস্ত্র আমদানিকারক ও ব্রিটিশ শিল্পপুঁজির বাজারে রূপান্তর করলো। ভারতের বস্ত্রশিল্প ধ্বংস না করলে বিলেতের শিল্পবিপ্লব এত ব্যাপ্তি পেত না। শিল্প বিপ্লবের পরে ভারতে বিলেতি শিল্পের কাঁচামাল উৎপাদনের ব্যবস্থা করা হলো। নতুন শিল্প ও অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণ করা হলো। এতদিন ভারত যে শিল্পের ওপর নির্ভরশীল ছিল তাকে পুনর্জাগরিত করার প্রয়াস নেওয়া হলো।

 

নতুন ভূমি ব্যবস্থার প্রবর্তন

ভারতকে বাজারে পরিণত করা এবং কাঁচামাল যোগানোর পশ্চাদভূমিতে রূপান্তর করার মধ্য দিয়ে গ্রামীণ ভূমিকে পণ্যে রূপান্তর করা হলো। আগে এখানে ভূমি বেচাকেনা করা যেত না এবং সর্দারের মত ছাড়া বিচ্ছিন্ন করা যেত না। কিন্তু ভূমির বিনিময়যোগ্যতা সৃষ্টি পণ্যায়নের মাধ্যমে কৃষির বাণিজ্যিকীকরণ শুরু হলো। তা সত্ত্বেও পুরোপুরি পুঁজিবাদি উৎপাদনপ্রণালী গৃহীত হয়নি। প্রথাগত রাজস্বের জায়গায় নির্ধারিত হারে ভূমিকর আদায়ের ব্যবস্থা চালু করা হলো। পরে চিরস্থায়ী ব্যবস্থা চালু করার মাধ্যমে জমিদারি ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হলে সামন্ত ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটে। এই ভূমি ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে ভারতীয় কৃষি সমাজে পুঁজির গঠনের প্রাথমিক পর্বের সুত্রপাত হয়। এই পুঁজি গঠন প্রক্রিয়ার হাত ধরে শিল্পায়নের বিকাশ শুরু হয়কিন্তু কিছুদিন না যেতেই জমিদারদের মধ্যে এক শ্রেণির এবসেন্টি জমিদারের উদয় ঘটে, যারা অনেকটা অর্থনৈতিক পরগাছা হিসেবে, নিজেদের জমিদারীতে অনুপস্থিত থেকেও জমিদারি চালিয়ে যেতে থাকলো। নতুন ভূমি ব্যবস্থা উৎপাদনের ধরণই পাল্টে দিলোপরগাছা জমিদাররা সরাসরি ভূমির সাথে যুক্ত না থেকে এক ধরনের মধ্যসত্ত্বভোগী নিয়োগের মাধ্যমে কৃষকের উদ্বৃত্ত শ্রমের সুবিধাভোগীতে পরিণত হলোতাদের এই উদ্বৃত্ত পুঁজি তারা বিলাসী দ্রব্য কেনার জন্য ব্যবহার করতে শুরু করে। নতুন আইন প্রবর্তন, কৃষির বাজারীকরণ এবং মুনাফাখোর মহাজনদের ঋণের ব্যবসা বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে ভূমির ওপর কৃষকের মালিকানা লোপ পেতে লাগলো এবং এক পর্যায়ে ঋণদাতা মহাজনরাই ওই ভূমির মালিক হতে শুরু করলো। এইভাবে কৃষকের সাথে ভূমির দূরত্ব বাড়তে লাগলো এবং কৃষকরা ভূমিহীন কৃষিমজুরে পরিণত হলো।

 

নতুন বাণিজ্যনগর ও স্থানীয় বুর্জোয়ার উত্থান

নগরকেন্দ্রিক শিল্পের বিকাশ ও বাণিজ্যের প্রসারের সাথে নগরের উদ্ভব ও বিকাশ এবং বাণিজ্যের মন্দাভাবের সাথে নগরের পতন সম্পর্কিত ইতিহাস সর্বজনবিদিত ভারতের বিভিন্ন নগরও এই পরিণতি ভোগ করেছেতবে ইংরেজের নতুন ভূমি ব্যবস্থাপনাজাত অভিঘাতে আঠারো শতকের দ্বিতীয়ার্ধের দিকে বুর্জোয়া উত্থানের সাথে সাথে শিল্পনির্ভর নতুন বাণিজ্যনগরের গোড়াপত্তন ঘটতে দেখা যায়। ভারতকে ব্রিটিশ পণ্যের বাজারে পরিণত করতে রেললাইন নির্ভর যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং নগর সৃষ্টি করা হয়। ভারতে আধুনিক শিল্পায়নের সূচনা ঘটে রেলপথ উন্নয়নের মাধ্যমে। ফলে যেই সময়ে কলকাতা, বম্বে, মাদ্রাজ কিংবা কানপুরের জৌলুস বাড়তে শুরু করে, সেই সময় ঢাকা, মুর্শিদাবাদ, লক্ষনৌ, কাঞ্জোর ইত্যাদি নগরের শ্রী লোপ পেতে থাকে। বম্বে, কলকাতা ও মাদ্রাজের মতো বন্দরনগরী দিয়ে ভারতীয় তুলা, গম, চাল, পাঠ, চা, নীল, রাবার ইত্যাদি রপ্তানি এবং বস্ত্রশিল্পের সরঞ্জামসহ বিলেতে উৎপাদিত পণ্য আমদানি করা হতো। আমদানি-রপ্তানিকে কেন্দ্র করে এক ধরনের মুৎসুদ্দি শ্রেণির উদ্ভব ঘটে। অন্যদিকে ভারতের প্রধান শিল্প বস্ত্রের কিছু মালিকানা স্থানীয়দের হাতে থাকলেও পাট ও কয়লাভিত্তিক শিল্পের মালিকানা পুরোপুরি ব্রিটিশদের হাতে চলে যায়।

মহাজন, জমিদার ও মুৎসুদ্দিদের হাতে ভারতীয়দের পুঁজি কেন্দ্রীভূত হওয়ার মাধ্যমে ভারতে অর্থনৈতিক পুঁজি গঠিত হলেও কালক্রমে বাণিজ্যিক গোষ্ঠীর মাধ্যমে শিল্পের ক্ষেত্রেও ভারতীয়দের উপস্থিতি বাড়তে থাকে। ভারতকে ব্রিটিশদের বাজার হিসেবে টিকিয়ে রাখতে গেলে এর যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটাতে হবে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটাতে গেলে যে শিল্পায়ন করতে হবে, তা লর্ড কার্জনসহ উচ্চপদস্থ ব্রিটিশ কর্মকর্তারা অনুধাবন করেছিলেন। শিল্পায়নের লক্ষ্যে তাদের গৃহীত পদক্ষেপের ফলে নগরকেন্দ্রিক বুর্জোয়াদের উত্থান ঘটে।

 সর্বহারা শ্রেণীর উদ্ভব এবং নতুন মধ্যবিত্তের উত্থান

ব্রিটিশ শিল্পবিপ্লবের প্রভাবে ভারতে হস্তশিল্প এবং কারুশিল্পের বিলোপ সাধিত হয়। কিন্তু শিল্পায়নের মাধ্যমে যে নতুন করে শ্রমনির্ভর মজুরের উদ্ভব ঘটলো তাদের সাথে পূর্বেকার কৃষক কিংবা কারুশিল্পীদের পার্থক্য দেখা দিলো। আগেকার কৃষক এবং শ্রমিকের মালিকানা ছিল তাদের উৎপাদিকা শক্তিতে। উৎপাদন সম্পর্কে তারা কারও একচেটিয়া কর্তৃত্বের অধীনে ছিল না। কিন্তু শিল্পায়ন বৃদ্ধির সাথে তাল মিলিয়ে ভূমিহীন শ্রমসর্বস্ব মজুরের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকলো। এদিকে শহরগুলোতে সরকারি কর্মচারী, উকিল, ডাক্তার, শিক্ষক এবং অন্যান্য পেশাজীবীর সংখ্যাও বাড়তে লাগলো। শিক্ষিত শ্রেণীর এই পেশাজীবীরা অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে কোন শ্রেণীর বর্গে পড়ে না। তারা উৎপাদনের সাথে সম্পর্কহীন পরগাছা হলেও রাষ্ট্র হতে সবচেয়ে বেশি পৃষ্টপোষকতা তারাই পেতে শুরু করে। শহুরে বুর্জোয়া অর্থনীতির সহযোগী সৃষ্টি করার প্রয়াসে ব্রিটিশ ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল। এই শিক্ষিতরা কৃষির ওপর নির্ভরশীল ছিল না। তারা সরকারি চাকরীর প্রতি আগ্রহী ছিল। তবে জমিজমা এবং স্ট্যাট ক্রয় করে নিজেদের আভিজাত্য প্রকাশ করার মতো চাতুর্যতার আশ্রয় গ্রহণ করতে গিয়ে তারা কখনো কখনো কৃষির সাথেও সম্পৃক্ত থাকতো। সেটা একান্তই বিলাসের অভিলাষে। নতুন অর্থনীতিতে বাজারের চাহিদার বিপরীতে শিক্ষিতের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় তারা যেমন সরকারি চাকরির প্রতি নির্ভরশীল ছিলো, তেমনি শিক্ষাক্রম ও শিক্ষার উদ্দেশ্য স্থানীয় সামাজিক বাস্তবতা ও উৎপাদনমুখি না হওয়ায় এই শিক্ষিত মধ্যবিত্তরা শিল্প বিকাশে কিংবা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে ভূমিকা রাখতে পারলো না। যদিও রাষ্ট্রীয় শাসন পরিচালনায় তাদের ভূমিকা ছিলো, চাকরির বাইরে থাকা উদ্বৃত্ত শিক্ষিতদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে এবং উৎপাদিকাশক্তির সান্নিধ্যে আনা যায়নি। ফলে পুঁজিগঠন ও প্রশিক্ষিত শ্রমিকের অভাবে ভারতে উপনিবেশিক শাসনকালে জায়মান পুঁজিবাদ হতে শিল্পপুঁজিবাদে রূপান্তরের প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়েছিল। অন্যদিকে সর্বহারা কিংবা নতুন শিক্ষিত শ্রেণী কেউই রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারলো না।  


সামাজিক শ্রেণিসমূহের বিপরীতে রাষ্ট্রের আধিপত্য বিদ্যমান থাকায় ভারতীয় বুর্জোয়ারা ব্রিটিশ বুর্জোয়া অর্থনীতির পাল্টা কোন অর্থনৈতিক সুবিধা আদায় করে নিতে পারেনি। রাষ্ট্রীয় পোষকতার কারণে ব্রিটিশ বুর্জোয়ারা ভারতীয়দের পরাভূত করতে পেরেছে। জননীতি ও সরকার পরিচালন প্রক্রিয়ায় নিজেদের প্রতিনিধিত্ব এবং শক্তির উপস্থিতি নিশ্চিত করতে না পারায় অর্থনৈতিক সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও ভারতীয় বুর্জোয়ারা পেছনে পড়ে রইলো। বুর্জোয়াদের দুর্বলতার কারণে ব্যক্তিখাতে শিল্পায়ন বাধাগ্রস্ত হলো। অন্যদিকে এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্র নিজেই শিল্পায়নের দায় নিয়ে সমাজতান্ত্রিক ভূমিকা নিতে শুরু করলো। এভাবে সমাজতন্ত্রের নামে সরকারি শিল্পের বিকাশ এবং সরকারি শিল্পের নামে শ্রমিকের ওপর সরকারের আধিপত্য কায়েম হলো। ভারতে ব্যক্তিমালিকানাধীন শিল্পখাত এতো দুর্বল ছিল যে, বৃহত্তর শিল্পপ্রতিষ্ঠার সক্ষমতা এবং ইচ্ছে কোনটাই এর ছিল না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে এবং বিশেষত স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বেসরকারি শিল্পখাত কিছুটা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেতে শুরু করে। শিল্পনীতি, ব্যাংকিং সুবিধা, নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার এবং প্রশিক্ষিত শ্রমিকের সরবরাহ মিলে শিল্পায়নের একটা উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি হয়।

 রাষ্ট্রের শিল্পনীতি এবং বুর্জোয়াদের প্রতিক্রিয়া

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে টাটা ও বিড়লাদের নেতৃত্বে ভারতে শিল্পায়নের জন্য বম্বে পরিকল্পনার নীল নকশা প্রণয়ন করা হয়। এই পরিকল্পনায় রাষ্ট্র কর্তৃক শিল্প বিকাশে প্রণোদনা দেওয়াসহ সরকারি ভূমিকার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়। শিল্পের মালিকানা, শিল্পের ব্যবস্থাপনা এবং শিল্পের নিয়ন্ত্রণ, এই তিন ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ কামনা করা হয়। সমাজকল্যাণ এবং সামাজিকভাবে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য হাসিলের জন্য রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের দাবি যৌক্তিকতা পায়।

ভারতে রাজনৈতিক দলগুলোর, বিশেষ করে কংগ্রেসের সমর্থকরা ছিল গ্রামীণ কৃষক এবং দরিদ্র মানুষ। তারা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হোক, তা চায়নি। ফলে প্রচলিত ভারতীয় সমাজতান্ত্রিকতা অবলম্বন করে রাষ্ট্রীয় শিল্পনীতি গ্রহণ করা হয়েছিলো। পণ্ডিত নেহরু মনে করেছিলেন, ব্যক্তিমালিকানাধীন শিল্পের চেয়ে রাষ্ট্রীয় শিল্পের বিকাশ ঘটলে দেশের অর্থনীতিতে সামাজিক ন্যায় ও পুঁজির বণ্টনের ভারসাম্য বজায় থাকবে। তবে রাষ্ট্র কর্তৃক গৃহীত সমাজতান্ত্রিক নীতি নতুন কিছু ছিল না। সমাজে আগে থেকেই প্রচলিত সমাজতান্ত্রিক নীতিগুলোকে নেহরু সমাজতন্ত্র ঘেঁষা নীতির মাধ্যমে বৈধতা দিয়েছিলো মাত্র। এদিকে, বুর্জোয়া ও সর্বহারা শ্রেণী প্রতিনিয়ত রাষ্ট্রের সাথে তাদের সম্পর্ক নির্ধারণের লড়াইয়ে লিপ্ত। তারা স্থিরভাবে বসে নেই। অন্যদিকে রাষ্ট্র একক কোন শ্রেণীর আধিপত্যের সম্ভাবনাকে প্রতিরোধ করে চলে। আমলাতন্ত্র হচ্ছে রাষ্ট্র কর্তৃক শ্রেণীআধিপত্য প্রতিরোধের প্রধান হাতিয়ার।

ভারতে ক্ষুদ্র শিল্পের বিকাশ গতি পেয়েছিল দুইটি কারণে। ভারীশিল্পের মতো ক্ষুদ্রশিল্পের ওপর কোন ধরনের নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়নি এবং করের বোঝা চাপানো হয়নি। বরং কাঁচামালের ক্ষেত্রে ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে। এভাবে ভারীশিল্পের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ এবং ক্ষুদ্র শিল্পের প্রতি প্রণোদনা বজায় থাকার কারণে এই শিল্প ভারীশিল্পে আত্মীকৃত হতে পারেনি। অধিকন্তু ক্ষুদ্রশিল্পের পুঁজি বৃদ্ধি পেয়েছিলো। সরকার ঋণ প্রদান, প্রযুক্তিগত সুবিধা প্রদান এবং বাজারজাতকরণের সুবিধা দিয়ে ক্ষুদ্রশিল্পকে সামনে যাওয়ার গতি দিয়েছিলো। তাতে করে সমাজে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছিলো এবং বেকারত্ব কমেছিলো। কিন্তু এই ধরনের শ্রমঘন শিল্প ভারীশিল্পের তুলনায় বেশি গড় পুঁজি ব্যবহার করে অথচ গড় উৎপাদনের দিক থেকে ভারী শিল্পের তুলনায় পিছিয়ে থাকে। কাজেই পুঁজি বাঁচানোর কথা বিবেচনা করলে ভারীশিল্প ক্ষুদ্রশিল্পের চেয়ে লাভজনক। তবে অনুপম সেনের এই মূল্যায়নের একটি সীমাবদ্ধতা আছে। তা হলো, পুঁজির বাইরেও যে মানুষের জীবনের নানা দিক ও বিবেচনা আছে, সেটি লাভ-লোকসান বিবেচনার মানদণ্ড হিসেবে উপেক্ষিত থাকে। সামাজিক উন্নয়নে এবং মানুষের মানবিক সংস্কৃতির সংরক্ষণে ক্ষুদ্রশিল্পের ভূমিকা বেশি। তদুপরি ক্ষুদ্রশিল্পের ক্ষেত্রে বুর্জোয়া কর্তৃক সর্বহারা শোষণের সম্ভাবনা কম। আয়ের বণ্টনেও একটা ভারসাম্য বজায় থাকে বলে ক্ষুদ্রশিল্পের সামাজিক গুরুত্ব বেশি। তবে ক্ষুদ্রশিল্পের বিকাশ এবং এর প্রতি প্রনোদণা ভারীশিল্পের জন্য পুঁজি গঠনের প্রক্রিয়ায় বাধা হয়ে দাঁড়ালে তা জাতীয় অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি, বুর্জোয়ার বিকাশ এবং সর্বোপরি শিল্পায়নের সংকট আকারে আবির্ভুত হয়। রাষ্ট্র চেয়েছিল শ্রেণী আধিপত্য রোধ করতে। অন্যদিকে বুর্জোয়ারা চেয়েছিলো রাষ্ট্রীয় নীতিতে প্রভাব রাখার মাধ্যমে ব্যক্তিমালিকানাধীন শিল্পের বিকাশ ঘটাতে। কিন্তু কংগ্রেসের কৃষক নির্ভরতা এবং বুর্জোয়াদের রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের অভাবসহ আমলাদের তুলনায় তাদের শিক্ষা ও দক্ষতার অভাব এই শিল্প বিকাশে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। ভারতে ১৯৫১ সালে প্রণীত শিল্প আইনের মাধ্যমে বেসরকারি শিল্পখাত নিয়ন্ত্রণের অবাধ ক্ষমতা রাষ্ট্রের হাতে রাখা হয়। শিল্প স্থাপনার জন্য সরকারের কাছ থেকে লাইসেন্স নেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়। এছাড়া ১৯৫৬ সালে কোম্পানি আইন করার পর বেসরকারি খাতের ওপর অধিকতর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সরকারের এই নিয়ন্ত্রণের নীতি সফল হয়নি। ধীরে ধীরে হলেও বেসরকারি খাতের বিকাশ ঘটেছে। কতিপয় শিল্পপতির হাতে পুঁজির সমাবেশ ঘটার মাধ্যমে কিছু কর্পোরেট গ্রুপের হাতে বেসরকারি পুঁজির একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ শুরু হয়। প্রথমদিকে শিল্প ও পুঁজির ওপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের কারণে এবং বুর্জোয়াদের দুর্বলতার বিপরীতে সরকারি প্রণোদনা নির্ভর ক্ষুদ্র শিল্প ও সরকারি মালিকানাধীন ভারি শিল্পের মাধ্যমে যে অর্থনৈতিক সংস্কৃতি তৈরি হলো, তা পরে বেসরকারি খাতের বিকাশের মাধ্যমে সহজে পরিবর্তিত হয়নি। ফলে মানুষ সরকারি পুঁজি ও সরকারি চাকরির ওপর নির্ভরশীল রয়ে গেলো।

 

সামাজিক অর্থনীতির স্বরুপ

কৃষিভিত্তিক সমাজের মূল কাঠামোর বিশ্লেষণ ছাড়া তার সামাজিক অর্থনীতি, শ্রেণীগঠন এবং শিল্পায়নের ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব নয়। ভারতের শিল্পায়ন যে কৃষির ওপর নির্ভরশীল ছিলো তার অন্য্যতম কারণ, অনুপম সেনের মতে, তিনটি। এক, কাঁচামাল। দুই, সস্তা কৃষি শ্রমিকের জন্য এবং তিন, শিল্পপণ্যের ক্রেতা হিসেবে কৃষকের ভূমিকা জন্য। ভারতে ব্রিটিশ শাসনের পূর্বে সমাজ ছিল কৃষি ও হস্তশিল্প নির্ভর এবং সব দিক থেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ। গ্রামের উদ্বৃত্ত উৎপাদনসমূহ খাজনা হিসেবে সরকার নিয়ে নিতো। কিন্তু ব্রিটিশরা ক্ষমতা নেওয়ার পর খাজনার হার এতো বাড়িয়ে দিলো যে, খাজনা হয়ে দাঁড়ালো সরকারের আয়ের প্রধান ও প্রাথমিক উৎস। ফ্লাউড কমিশনের প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে লেখক জানান, ব্রিটিশরা কালক্রমে চার হাজার পার্সেন্ট পর্যন্ত খাজনা বৃদ্ধি করে।

ব্রিটিশরা জমিদারি সৃষ্টি করার মাধ্যমে সামন্তপ্রথা চালু করলে উৎপাদনের ওপর কৃষক ও হস্তশিল্পীদের মালিকানা ব্যাহত হয়। কিছুক্ষেত্রে রায়তওয়ারি চালু করলেও কৃষক যে, তাদের ভূমিকে নিজের ভাবতে পেরেছে তা নয়। জমিদার, মহাজন, সুদখোর এবং অত্যধিক খাজনার হার, সবকিছু মিলে কৃষকের প্রতি অর্থনৈতিক নিপীড়ন বেড়ে গেলে তারা শ্রমনির্ভর মজুর এবং মহাজনদের টাকার গোলামে পরিণত হয়। উৎপাদনের হাতিয়ার ভূমির সাথে তাদের বিচ্ছেদ শুরু হলে তারা সর্বহারাতে পরিণত হয়। মানে নিজের কায়িক শ্রম ছাড়া উৎপাদনের হাতিয়ার, ভূমি, লাঙল, কোদাল, বলদ, পানি, বীজসহ সামগ্রিক উৎপাদিকা শক্তি তাদের হাতছাড়া হয়ে যায়। উৎপাদনের সক্ষমতাতো তারা হারালোই, অধিকন্তু মহাজনের ঋণের সুদ বইতে গিয়ে নিজের বাহুবল হারিয়ে তাদের সর্বশেষ সম্বল শ্রমশক্তিটুকুও হারাতে শুরু করে। ব্রিটিশরা যখন ভারতকে তাদের বাজার হিসেবে তৈরি করতে শুরু করে, তখন নতুন করে শিল্প উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে পর্যন্ত নানাবিধ দুর্বলতা এবং বুর্জোয়াদের ব্যর্থতা এবং রাষ্ট্র কর্তৃক বুর্জোয়াদের নিয়ন্ত্রণে রাখার কৌশল জারি থাকায় ভারতে পুঁজির বিকাশ, শিল্পায়ন এবং রাষ্ট্রে বুর্জোয়াদের নিয়ন্ত্রণের প্রয়াস সফল হুয়নি। সেনের বিশ্লেষণ থেকে বোঝা যায়, ভারতের কৃষকরা অশিক্ষা কিংবা অদক্ষতার কারণে দরিদ্র থাকেনি। তারা দরিদ্র রয়ে গেছে বিশ্বপুঁজিবাদ ও স্থানীয় পুঁজিবাদি উৎপাদনপ্রণালীতে তাদের সুবিধাটুকু নিশ্চিত করা হয়নি বলেই। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণেও তারা গরীব থাকেনি। বরং তাদের এই গরিবিয়ানা হলো ধীর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও যথাসময়ে শিল্পায়ন না হওয়ার ফল।

রাষ্ট্রকে কেন্দ্র করে সামাজিক শ্রেণিগুলো সংগ্রামে রত। বুর্জোয়াদের দুর্বলতার কারণে তারা আমলাতন্ত্রকে নিজেদের হাতিয়ার বানাতে পারেনি। কৃষক নির্ভরতার কারণে কংগ্রেসও বুর্জোয়াদের পক্ষ নেয়নি। অন্যদিকে আমলাতন্ত্রের নিজস্ব রাজনৈতিক অভিলাষ থাকার কারণে আমলাতন্ত্র নিজেই বুর্জোয়াদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়। এভাবে আমলাতন্ত্র এবং আমলাতন্ত্রনির্ভর শাসন পরিচালনে রাষ্ট্রযন্ত্র এক ধরনের শ্রেণিনিরপেক্ষ স্বাধীনতা বজায় রাখে। বুর্জোয়ারা যখন সুবিধে করতে পারে না, তখন তারা ঘূষ উৎকোচ দিয়ে আমলাতন্ত্রকে বশে আনার চেষ্টা করে। যখন দেখে যে তাতেও তাদের সময়, কাজ এবং দাপ্তরিক প্রক্রিয়াগত দীর্ঘসূত্রতা কমছে না, তখন তারা আমলাতন্ত্র ভাঙার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। আমলাতন্ত্র ভেঙে পড়লে বুর্জোয়ারা প্রশাসন ও আইনসভার নিয়ন্ত্রণ নেয়। আমলাতন্ত্রের স্বাধীনতা কমে যাওয়ার মাধ্যমে রাষ্ট্র একটি বিশেষ বুর্জোয়া শ্রেণির আধিপত্যে চলে আসে। ফলে সর্বহারাদের যাওয়ার আর কোন জায়গা থাকে না। নিরপেক্ষ আমলাতন্ত্র হলো বুর্জোয়া কর্তৃক সর্বহারা বা প্রলেতারিয়েত নিপীড়নের প্রধান বাধা এবং আশ্রয়।

 পর্যালোচনা

অনুপম সেনের গবেষণা গ্রন্থের এবং ভারতের সামাজিক অর্থনীতি বিশ্লেষণের একটা প্রধান দুর্বলতা হলো ব্যাখ্যার শেষে নিজস্ব মতের অপ্রতুলতা। তিনি তার সন্দর্ভের উপসংহারেও এই পরিমাণ উদ্ধৃতি দিয়েছেন যে, শেষকথাগুলোও একটি তাত্ত্বিক সাহিত্য পর্যালোচনায় পর্যবসিত হয়েছে। কার্লমার্ক্সের বিচ্ছিন্নতার তত্ত্ব, শ্রেণি এবং শ্রেণি সংগ্রামের তত্ত্বসমূহ ভারতীয় সামাজিক অর্থনীতি বিশ্লেষণে যথার্থ হলেও শ্রেণিহীন সমাজ আদৌ দ্বন্ধহীন সমাজ কিনা সেই প্রশ্নের আলোকে সামাজিক শ্রেণিগঠন এবং রাষ্ট্রগঠনে শ্রেণিসমূহের দ্বন্ধ নিয়ে ভিন্ন ব্যাখ্যার অবকাশ আছে। কারণ উপনিবেশপূর্ব ভারতে যে উৎপাদনপ্রণালী বিদ্যমান ছিলো, তাতে উৎপাদিকাশক্তির ওপর সাধারণ কৃষকের সামাজিক মালিকানা ছিলো সত্য, কিন্তু তাদের মধ্যে স্বার্থের দ্বন্ধ এবং গ্রাম্য রাজনীতি ও মাতব্বরির প্রকোপ যে দেখা দেয়নি তা বলা যায় না। হয়তো অর্থনৈতিক উৎস কিংবা উৎপাদিকা শক্তির দখল নিয়ে তাদের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়নি, কিন্তু আরও নানা ভৌত ও অভৌত বিষয় নিয়ে তাদের মধ্যে বিরোধ ছিলো। এছাড়া উৎপাদনপ্রণালীর মালিকানার ভিত্তিতে সামাজিক শ্রেণিগুলোর দ্বন্ধ ও ভেদ শুরু হয়নি। ভারতীয় সমাজে উৎপাদিকশক্তির বণ্টন, পেশা ও শ্রম নির্বাচনের ক্ষেত্রে জাতপ্রথা ও ধর্মের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিলো। জাতপ্রথা এবং ধর্মীয় মর্যাদা বিভাজনের শিকার হয়েও অনেকে পেশা এবং উৎপাদনী সক্রিয়তায় ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকা নিয়েছে।

 এশীয় ঘরানার উৎপাদন প্রণালীর ধারণাগত একটি সীমাবদ্ধতা আছে। সেটা হলো তার কালিক সীমাবদ্ধতা। অর্থাৎ বিশেষ কালে এসে ভারতীয় সমাজে সামাজিক মালিকানা নির্ভর অর্থনীতি গড়ে ওঠেছে। হতে পারে সেটা উপনিবেশ পূর্বকাল পর্যন্ত বজায় ছিলো। আধুনিক পুঁজিবাদি শিল্প বিকাশের জন্য যে ধরনের শ্রমনির্ভর মজুর, উদ্বৃত্ত পুঁজি এবং পণ্যবিনিময়ের সুযোগ সৃষ্টি হওয়া দরকার সেটি উপনিবেশ পূর্বকালতো বটেই, স্বাধীনতার পরেও যে তৈরি হলো, তা বলা যায় না। এই বিবেচনায় সেনের ব্যাখ্যাটি ঠিক আছে। মূলত সেন কর্তৃক নিরূপিত ভারতীয় অনুন্নয়নের সামাজিক অর্থনীতির কারণগুলো যথার্থ বলা চলে। শ্রেণি গঠনের পূর্বে এবং স্বাধীনতা পরবর্তী সামাজিক শ্রেণি গঠনের দিকে দৃষ্টিপাত করলে যে কালিক বৈশিষ্ট্যগুলো চিহ্নিত করা যায়, তাতে শ্রেণিগুলোর মধ্যে এক ধরনের শ্রেণিবিনিময় দেখা যায়। অর্থাৎ বুর্জোয়ারা মজুরে এবং মজুর থেকে বুর্জোয়া তৈরি হওয়ার নজির আছে অজস্র। সেই ক্ষেত্রে তাদের তাদের রাজনৈতিক ভূমিকাও পরিবর্তিত হয়। এই ক্ষেত্রে কেবল শ্রেণি বিষয়টা বা শ্রেণিবোধটা ট্রান্সেন্ডেন্ট আকারে অনুভবযোগ্য।

 যে সময়কালকে ফোকাসে রেখে অনুপম সেন গবেষণা করেছেন, সেই কালে ভারতীয় সামাজিক অর্থনীতিতে বুর্জোয়াদের উত্থানের ঘটনা খুব মন্থর গতিতে ঘটেছে। কারণ ভারতীয় বস্ত্রশিল্পকে ধ্বংস করার জন্য উপনিবেশিক শাসকরা সরকারি শিল্প স্থাপনের চেষ্টা করেছে। অন্যদিকে ভারতকে ব্রিটিশ পণ্যের বাজারে পরিণত করার কৌশল নিতে গিয়েও ভারতে ভারী শিল্পের বিকাশ ব্যাহত হয়েছে। এভাবে ভারতে পুঁজি ও শ্রমনির্ভর মজুরের উদ্ভব নানা উত্থান পতন ও দ্বান্ধিকতার মধ্য দিয়ে গেছে। কাজেই ইতিহাস ও শ্রেণিদ্বন্ধের ঘটনা এখানে সর্পীল ও ঘুর্ণাবর্তে পড়েছে। ভারতীয় সমাজে উৎপাদনসম্পর্ক এবং শ্রেণিসম্পর্ক গতিময় দ্বান্ধিকতার ভেতর দিয়ে এগিয়েছে।

 শ্রমিক সংগঠনগুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায়, বুর্জোয়ারাই সর্বহারাদের নেতা। অর্থাৎ শ্রমিকরা যে তাদের স্বার্থ নিয়ে বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে লড়বে, সেই লড়াইয়ের সিপাহশালার হলেন কতিপয় বুর্জোয়া। ফলে শ্রমিক বনাম মালিক কিংবা সর্বহারা বনাম বুর্জোয়াদের শ্রেণিসংগ্রাম এখন তাত্ত্বিক আদর্শের পর্যায়ে নেই। সামাজিক শ্রেণিগুলোর মধ্যেও এখন হাইব্রিডিটি পরিলক্ষিত হচ্ছে। কাজেই সামাজিক অর্থনীতি শুধু মার্ক্সীয় তত্ত্বের পরিধিতে স্থির নেই। উত্তরাধুনিক লক্ষণ দ্বারা আক্রান্ত হয়ে সামাজিক শ্রেণি এবং তাদের শ্রেণিস্বার্থ জটপাকা সুতোর মতো গেরোবদ্ধ হয়ে পড়েছে। তবে ইতিহাস এবং সামাজিক অর্থনৈতিক বাস্তবতা অনুধাবন করতে গেলে আমাদের পেছন থেকে, বর্তমান বাস্তবতার পেছনের ইতিহাস থেকে শুরু করতে হবে। সেই ঐতিহাসিক দ্বান্ধিকতা পাঠের ক্ষেত্রে  অনুপম সেনের গবেষণা আমাদের পাথেয় হতে পারে।

 লেখক পরিচিতিঃ

সরওয়ার কামাল, এমফিল গবেষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

      

 

Comments

Popular posts from this blog

মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার কারণ ও প্রতিকার

সরওয়ার কামাল শিক্ষাক্ষেত্রে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য সাফল্য রয়েছে। সামাজিক উন্নয়ন সূচকেও বাংলাদেশের অবস্থান প্রতিবেশি দেশগুলোর তুলনায় ভালো, যা সম্পর্কে প্রশংসা করে বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন প্রবন্ধ লিখেছেন “ ল্যানসেট ” নামক মেডিক্যাল জার্নালে। কিন্তু এতে আমাদের বগল বাজিয়ে আত্মতৃপ্তিতে ভোগার অবকাশ নেই। কারণ শিক্ষার্থী ঝরে পড়া এবং বিজ্ঞান শিক্ষা সংকুচিত হয়ে পড়া আমাদের সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভুত হয়েছে। শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার কারণে আমাদের শিক্ষার মূল লক্ষ্যগুলো হাসিল হচ্ছে না, যার একটি হলো সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করা, অপরটি হলো শিক্ষাক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় প্রণোদনার ন্যায্য বণ্টন নিশ্চিত করা। অর্থাৎ সব শিশুই যাতে সরকারের সুযোগ ব্যবহার করে উন্নত জীবনের সন্ধান করতে পারে, তার শতভাগ নিশ্চয়তা প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না। শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার বিভিন্ন কারণ রয়েছে, তার মধ্যে বিভিন্ন স্তরের শিক্ষার ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন কারণ রয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার প্রধান কারণ দারিদ্র্য ও অপুষ্টি বা স্বাস্থ্যহীনতা । মাধ্যমিক পর্যায়েও শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার ক্ষেত্রে দারিদ্র্য সমস্যার ...

তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি বিচিত্র ছলনা জালে

তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি বিচিত্র ছলনা জালে ............................................................................... সাম্প্রতিক কালে আমাদের নৈতিক উপলব্ধিতে, সামাজিক উদ্বেগে কিংবা মূল্যবোধে দৃশ্যমান পরিবর্তন এসেছে। প্রযুক্তির নিবিড় ব্যবহার, বিশ্বায়নের প্রভাব, বিশ্বরাজনীতির অভিঘাত, বাজার সংস্কৃতির ধাক্কা ও চরমপন্থী ভাবাদর্শের টানাপড়েনে আমাদের চিরকালীন মূল্যবোধ ভেঙ্গে পড়েছে। নৈতিকতার সীমানা সরে যাচ্ছে প্রথাগত বিশ্বাস ও প্রতিষ্ঠানসংলগ্নতা থেকে। গতিময় জীবনের অভিঘাতে চরম অস্থিরতা ব্যক্তি থেকে ব্যষ্টির ব্যাপ্তিতে বিরাজ করছে। সর্বত্র আহাজারি, শোনার অবসর নিয়ে হাজির নেই কেউ। মানুষ যে নির্বিকার তাও নয়, তারা বিকারগ্রস্থ, পূর্ণমাত্রায় ঘোরগ্রস্থ, কেবল অপ্রত্যাশিত ঘটনাপ্রবাহের সাথে তাল মেলানোতে। তারা এখন এমন সব বিষয়ে আলোড়িত হয়, যে বিষয়ের সাথে তাদের সরাসরি যোগ নেই। থাকলেও তা অনেক ক্ষীণ ও দূরবর্তী কার্যকারণ সম্পর্কে আবদ্ধ। একইভাবে, তারা এমন সব পরিণতি ভোগ করে, যার জন্য তারা নিজেরা দায়ী নয়। আর যারা দায়ী তারা এর পরিণতি ভোগ করেন না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষ বয়সের দিকে এই প্যার...

মহেশখালীর সমাজ ও সংস্কৃতি

সরওয়ার কামাল সাগর কূলে গিরিকুন্তলা মোহিনী মহেশখালী দ্বীপের ৩৮৮ বর্গকিলোমিটার ভূত্বকে প্রায় পাঁচ লক্ষ লোকের বসতি। তাদের বসতি ঘিরে গড়ে উঠেছে উপকূলীয়-দ্বীপাঞ্চলীয় সমাজ। এই সমাজসভ্যদের মানসিক ঐক্য ও জীবনযাপন পদ্ধতি নিয়ে তৈরি হয়েছে শনাক্তযোগ্য বিশেষ স্থানীয় সংস্কৃতি। মানবজাতির চিরকালীন অভিযাত্রার অংশ হিসেবে দেশের নানা জায়গা থেকে হিজরত করে লোকজন এসে বসতি গেড়েছে মহেশখালীতে। তাই তাদের ভাষা ও আচরণে শনাক্ত করা যায় এমন বৈচিত্র্য ও তারতম্য, যা দিয়ে কক্সবাজারের অন্যান্য অঞ্চলের অধিবাসীদের তুলনায় মহেশখালীবাসীকে স্বতন্ত্রভাবে চিহ্নিত করা যায়। যে পার্থক্যসূচক বৈশিষ্ঠ্যাবলী নিয়ে মহেশখালীর সমাজ ও মানুষের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য তৈরি হয়েছে, চাটগাঁইয়া ভাষার উপভাষাতুল্য মহেশখালীর দ্বীপাঞ্চলীয় বুলি তার মধ্যে বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। [1] তবে সমস্যা হলো, লিখিত সাহিত্য ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের অভাবে স্থানীয় ইতিহাসের মতোই কালিক সূচকের নিরিখে এর জনসংস্কৃতি বর্ণনা করা দুরূহ। একেতো সংস্কৃতি স্বয়ং একটি ব্যাপক ধারণা, তদুপরি, এটি সতত পরিবর্তনশীল। ভাষা ও সংস্কৃতি স্রোতস্বী নদীর মতো বহমান। মানুষের কথা, স্মৃতি, পুরা...