সরওয়ার কামাল
অত্যাবশ্যকীয় হলেও খনিজ দ্রব্য হিসেবে লবণের উপযোগ
শেক্সপিয়র রচিত ‘কিং লিয়ার’ নাটকের কনিষ্ঠ রাজকন্যা কর্ডেলিয়ার পিতৃপ্রেমের মতো;
খুব বেশি নয়, আবার কমও নয়। অতীতে সামাজিক মর্যাদা, ক্ষমতা ও সম্পদের উৎস বলে
বিবেচিত লবণ এখনো ভোজ্য, শিল্প ও বাণিজ্যিক পণ্য হিসেবে সমাদৃত।পচননিবারক হিসেবেও
লবণের ব্যবহার ঐতিহাসিকভাবে অতি প্রাচীন। লবণের আছে নানা প্রকার; যার মধ্যে
ভোজ্যলবণ, সোডিয়াম ক্লোরাইড, হলো সোডিয়াম ও ক্লোরিনের সমন্বয়ে গঠিত একটি আয়নিক যৌগ।
উপকূলীয় অঞ্চলে বাষ্পীভবনের মাধ্যমে খোলামাঠে উৎপাদিত অপরিশোধিত লবণে সোডিয়াম ও
ক্লোরিন ছাড়াও ম্যাগনেসিয়াম, ক্যালসিয়াম হ্যালাইড, সালফেট, শৈবাল এবং পলিকণা যুক্ত
থাকে। সাগরের কিনারে থাকায় কক্সবাজার বাংলাদেশের প্রধান লবণ উৎপাদনকেন্দ্র। এখানে
প্রায় ৫২০০০ একর ভূমিতে লবণ চাষ হয়। অপরিশোধিত লবণের ক্ষেত্রে জাতীয় উৎপাদনের ৯৫%
কক্সবাজারে উৎপাদিত হয়, যার মধ্যে কেবল মহেশখালীতেই উৎপাদিত হয় ৩০% (প্রায়)।
মহেশখালীর দুইলক্ষাধিক লোক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে লবণ উৎপাদনে জড়িত। জাতীয়
উৎপাদনের হিসেব নিলে দেখা যায়, ৮টি জোনে প্রায় ৫ লক্ষ লোক উৎপাদন প্রক্রিয়ার সাথে
যুক্ত। প্রক্রিয়াকরণ ও বিপণনে জড়িতদের অন্তর্ভুক্ত করলে লবণশিল্পের ওপর নির্ভরশীল
লোকের সংখ্যা হয় ২৫ লক্ষের মতো। বাংলাদেশে ভোজ্যলবণের বর্তমান চাহিদা ৮.৭৬ লক্ষ
মেট্রিক টন। শিল্প, মৎস্য এবং প্রাণিসম্পদে ব্যবহারের লক্ষ সামনে রাখলে মোট
অপরিশোধিত লবণের চাহিদা দাঁড়ায় ২৩.৩৫ লক্ষ মেট্রিক টন। ফি বছর লবণের চাষ, চাহিদা
এবং চাষের জায়গা বৃদ্ধি পেলেও, মাঠ পর্যায়ে লবণের দাম কখনো কখনো অপ্রত্যাশিত মাত্রায়
কমতে থাকে।
দীর্ঘদিন ধরে লবণখাতকে কৃষি নাকি শিল্প হিসেবে বিবেচনা করা হবে,
এই নিয়ে প্রান্তিক চাষী ও মিল মালিকদের মধ্যে মতভিন্নতা ছিলো। ফলে লবণ সংক্রান্ত
কী নীতি নিয়ে এগোবে, এই নিয়ে নীতি নির্ধারকদের মধ্যেও দ্বিধা ছিলো। পাকিস্তান আমলে
‘ইপসিক’ এবং স্বাধীনতাত্তোরকালে বিসিক লবণ উৎপাদনের ক্ষেত্রে কারিগরি জ্ঞান,
তথ্যভাণ্ডার এবং ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত প্রণোদনা ও সহযোগিতা দিয়ে আসছে। স্বার্থসংশ্লিষ্টদের
সাথে ধারাবাহিক সংলাপ শেষে লবণখাতকে কুঠির শিল্পের অধীন শিল্প বলে ঘোষণা করা
হয়েছে। শিল্প ঘোষণার পর ২০১১, ২০১৬ এবং ২০২২ সালে তিন তিনটি জাতীয় লবণনীতি প্রণীত
হয়েছে। সর্বশেষ জাতীয় লবণনীতিটি গেজেট আকারে প্রকাশিত হয় ২০২২ সালের ২৩ মার্চ। এই লবণনীতিতে
চাষী, ব্যবসায়ী এবং মিল মালিকসহ সাধারণ ভোক্তাশ্রেণির স্বার্থ নিয়ে সরকারের নীতি ও
কৌশল ব্যক্ত হয়েছে। কাজেই, জীবিকানির্ভর সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যচেতনার জায়গা থেকে
সামাজিক অর্থনীতি ও অর্থনৈতিক সংস্কৃতির নিরিখে বাংলাদেশে, এবং বিশেষ করে
মহেশখালীতে, লবণশিল্পের হালহকিকত ও ভবিষ্যৎ পর্যালোচনা করা এখন অত্যন্ত প্রাসংগিক।
অধুনা গুরুত্ব কমে গেলেও সভ্যতার ইতিহাসে লবণের আছে
গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। লবণের সাথে আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, ভাষা, বসতি, সমাজ,
সংস্কৃতি, রাজনীতি, যুদ্ধ, প্রজনন স্বাস্থ্য এবং খাদ্যাভ্যাস ওতপ্রোতভাবে জড়িত। প্রান্তিক
লবণচাষী মালংগীদের টিকে থাকাও লবণের লাগসই উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহারের সাথে নিবিড়ভাবে
যুক্ত। ঐতিহ্যের সন্ধানে ইতিহাসের পাতা উল্টালে লবণের কিছু গৌরবচিহ্ন দৃষ্ট হয়। প্রায়
৪৭০০ বছর পূর্বে প্রাচীন মিশরে ফারাওদের মৃতদেহ মমিকরণে আর্দ্রতারোধী লবণ ব্যবহার
করা হতো। প্রাচীন রোমে, প্রায় ২৭০০ বছর পুর্বে, চতুর্থ সম্রাট আনকাস মার্সিয়াসের
জমানায় লবণমুদ্রার প্রচলন ছিল। রাষ্ট্রীয় কর্মচারীদের লবণ স্যালারি দেওয়া হতো বলে
লবণের ল্যাটিন নাম হয়েছে স্যালারিয়াম।
পৃথিবীর অন্য যেকোন অঞ্চলের মতো ভারতবর্ষেও লবণ অত্যন্ত
জনগুরুত্বপূর্ণ খনিজ উপাদান হিসেবে বিবেচিত হতো। তখন এখনকার মতো খোলামাঠে
বাষ্পীভবনের মাধ্যমে লবণ উৎপাদন হতো না। বড় বড় কড়াইয়ে তাপ দিয়ে উৎপাদন করা হতো।
অবশ্য কিছু লবণ খনি থেকেই আহরণ করা হতো। খুব দুর্লভ এবং মূল্যবান আয়নিক যৌগ হিসেবে
লবণের উৎপাদন, বিনিময় ও ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে তদারক করা হতো। কৌটিল্যের
অর্থশাস্ত্রে লবণ বিষয়ক উচ্চ প্রশাসনিক পদ উল্লেখ করা হয়েছে 'মূখ্য লবণ
কর্মাধ্যক্ষ' বা চিফ সল্ট কমিশনার। মৌর্য সাম্রাজ্যে লবণ ছিল একচেটিয়া সরকারি
উৎপাদনযন্ত্রের অধীন। সরকারের কাছ থেকে কড়াই ভাড়া নিয়েই লবণ উৎপাদন করতে হতো। কেবল
উচ্চশ্রেণির ব্রাহ্মণ ও উৎপাদনকারী শ্রমিকরাই বিনামূল্যে লবণ নিতে পারতো। তখন লবণ
ব্যবহারের অধিকার একটি উচ্চ সামাজিক মর্যাদা হিসেবে বিবেচিত হতো।
ভোজ্যলবণ এবং অন্যক্ষেত্রে ব্যবহার্য লবণ পৃথকভাবে সংরক্ষণ
করা হতো। লবণে ভেজাল দেওয়া এবং বিনা অনুমতিতে লবণ উৎপাদন করা অত্যন্ত গুরুতর অপরাধ
ছিল বলে নিয়ম লংঘনের জন্য পেনালকোডে সর্বোচ্চ শাস্তি ধার্য্য ছিল। চট্টগ্রাম ও
কক্সবাজার অঞ্চল মৌর্য এবং গুপ্ত সাম্রাজ্যের অংশ ছিলো না। তাই মৌর্য সাম্রাজ্যের
লবণনীতি এতদাঞ্চলে কার্যকর ছিলো না। তবুও বর্মী শাসনামলে, বিশেষ করে চন্দ্র বংশের
শাসনকাল থেকেই কক্সবাজার অঞ্চলে লবণ উৎপাদন চালু হয় বলে অনুমান করা যায়। লবণ
উৎপাদনের সাথে স্থানের নামকরণের কিছু চিহ্ন কক্সবাজার অঞ্চলেও লক্ষ করা যায়। তার
একটি হলো, টেকনাফ উপজেলার সাবরাং। ‘সাবরাং’ একটি বার্মিজ শব্দ। এর অর্থ লবণের ডেইল
বা উপত্যকা। প্রাচীন রোমে যেমন সল্ট রোড আছে, কক্সবাজারে সাবরাং আছে। যদিও লবণ
উৎপাদনে অগ্রণী অঞ্চল এখন মহেশখালী।
মহেশখালীতে ঠিক কবে লবণ উৎপাদন শুরু হয়েছে তার সন তারিখ
উল্লেখ করার সুযোগ নেই। কিন্তু ইতিহাসের কিছু উপাদান আছে, যার ভিত্তিতে অনুমান করা
চলে। তার একটি হলো, মগ শাসনের আমলে প্রতিবেশি স্থানসমূহের নামকরণ। যেমন, পূর্বেই
উল্লেখ করেছি, টেকনাফের 'সাবরাং'। বর্মী শাসনের ব্যাপ্তি বিবেচনায় এতদাঞ্চলে লবণ
উৎপাদনের সূত্রপাত হাজার বছর পূর্বে বলে ধারণা করা যায়। তবে মহেশখালী অতীতে মূল
ভূখণ্ডের সাথে যুক্ত থাকায় এবং জঙ্গলাকীর্ণ পাহাড়ি বনাঞ্চল হওয়ায় এখানে লবণ চাষের
সূত্রপাত হয়েছে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের তুলনায় কিছুটা বিলম্বে। মধ্যযুগে বিদেশী
পরিভ্রাজকের বর্ণনায় কক্সবাজারে লবণ উৎপাদনের বিষয় উল্লেখ নেই। আবাদি জমি ও
লোকবসতির পরম্পরা বিবেচনায় নিলে সাড়ে তিনশো থেকে চারশো বছর পূর্বে মহেশখালীতে লবণ
চাষের সূত্রপাত বলে ধারণা করা যায়।
‘মেমোরেন্ডাম অব দ্য রেভেনিউ হিস্ট্রি অব চিটাগাং’-এর
রচয়িতা চিটাগাঙয়ের তৎকালীন কালেক্টর এইচ জে এস কট্টনের ধারস্ত হলে আমরা ব্রিটিশ
আমল থেকে শুরু করে পরবর্তী ঘটনা পরম্পরা সম্পর্কে কিছুটা দিশা পাই। তিনি লিখেছেন, ১৭৬৫
সালে দেওয়ানি লাভ করার পর লবণ, পান-সুপারি এবং তামাকের দেশীয় ব্যবসা একটি বিশেষ
কোম্পানিকে দেওয়া হয়, যাতে করে য়ুরোপীয় চাকরিজীবীরা লাভবান হতে পারে। তাদেরকে বেতন
দেওয়ার পরিবর্তে এই মহালগুলোর দায়িত্ব দেওয়া হয় (কট্টনঃ ১৮৮০, পৃ-১৯১)। তখন এক মণ
লবণের দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল দুই রুপি।কিন্তু ১৭৬৮ সালে সেই কোম্পানি বিলুপ্ত হয়।
তাই কোম্পানির পরিবর্তে সরাসরি দেশীয় সওদাগর এবং জমিদারদের জন্য উন্মুক্ত করে
তাদের লবণ উৎপাদনের জন্য সনদ দেওয়া হয়। তখন শর্ত দেওয়া হয়, তারা লবণ উৎপাদন করতে
পারবে কেবল কোম্পানির জন্য। এভাবে পাঁচ বছর চলার পর, ১৭৭৭ সালে সর্বপ্রথম প্রকৃত
চাষীদেরকে লবণ উৎপাদনের অধিকার দেওয়া হয়। কিন্তু কিছুদিন না যেতেই ১৭৮০ সালে নতুন ব্যবস্থা
চালু করা হয়। চাষের মাধ্যমে লবণ উৎপাদন বন্ধ করে বিশেষ ব্যবস্থায় লবণ এজেন্টের
মাধ্যমে শুধুমাত্র কোম্পানির জন্য, কোম্পানির নির্ধারিত দামে লবণ উৎপাদন চালু করা
হয়। এভাবে এজেন্টের মাধ্যমে নিমকমহল চালু করে কোম্পানির জন্য একচেটিয়া ব্যবসা ৭০
বছরব্যাপী চালু রাখা হয়। ইংরেজরা লবণ উৎপাদনের জন্য মালংগীদের শর্তসাপেক্ষে অগ্রিম
দাদন দিতো। এরইমধ্যে মালংগীদের কেউ কেউ নিজেরা বিনা অনুমতিতে লবণ উৎপাদন করতে গেলে
লবণ এজেন্টের সাথে বিরোধ তৈরি হয়। এতে জমিদারদের উস্কানিও ছিল কিছুটা। ফলে ১৮১৭ সালে
চাষীদের পক্ষ থেকে প্রথম লবণবিদ্রোহ দেখা দেয়। ভারতের উড়িষ্যা ও গুজরাটসহ অন্যান্য
অঞ্চলেও লবণ নিয়ে ইংরেজ ও স্বদেশীদের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। দ্বিগুণ হারে লবণট্যাক্স
আরোপ করাসহ ১৮৮২ সালের সল্ট এক্ট প্রণয়নের মাধ্যমে ভারতীয়দের বিলেতি লবণ কিনতে
বাধ্য করলে লবণ আন্দোলন আরও বেগবান হয়। ইতিমধ্যে ১৮৮৫ সালে ব্রিটিশ সরকারের
রাজনৈতিক সহযোগী সংগঠন হিসেবে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হয়। গুজরাট ও
উড়িষ্যায় লবণ চাষীদের আন্দোলনের উত্তাপ কংগ্রেসের সমকালীন সদস্যদের উদ্দীপ্ত করে।
এভাবে নতুন করে স্বাধীনতার চেতনায় উজ্জীবিত হয় ভারতীয় জনতা। লবণ আন্দোলন ক্রমে
গুরুত্ব ও ব্যাপকতা পেয়ে ১৯২৯ সালে লবণ
সত্যাগ্রহ এবং ১৯৩০ সালে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে লবণ মার্চের রূপ পরিগ্রহ করে।
সেই সময় সরোজিনী নাইডু লবণ নিয়ে ইংরেজিতে কবিতা রচনা করেন। কাজেই লবণ চাষীরা উপনিবেশকালের
প্রারম্ভ থেকেই নিবিড় রাজনৈতিক সচেতনতা প্রদর্শন করে এসেছে। লবণের গুরুত্ব এবং লবণ
সংক্রান্ত বিষয়ে দেশীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের সংযোগ সাধারণ জনগণের রাজনৈতিক সংহতি
প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রেখেছে।
বাংলাদেশে লবণরাজনীতি সেরকম উত্তাপ না ছড়ালেও গুরুত্ব কম পায়নি
। স্বাভাবিকভাবেই লবণের দাম কখনো বাড়ে, কখনো কমে। লবণের দাম ও বাজার ঘিরে সাধারণ
চাষীদের রাজনৈতিক জনমতের প্রতিফলন ঘটে জনপরিসরে। স্থানীয় প্রশাসনের সাথে মতবিনিময়কালে
তারা সরকারের কাছে তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে নীতিগত প্রশ্ন তুলে।
ব্যতিক্রম হলেও সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে লবণশিল্পের বাস্তব অবস্থা জানার চেষ্টা
করা হয়। এই ধরনের প্রেক্ষাপটে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কক্সবাজারের
ভারুয়াখালিতে লবণের মাঠ পরিদর্শন করেন ১৯৭৫ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি। বিচ্ছিন্নভাবে চট্টগ্রামের
বিভিন্ন অঞ্চলে, বিশেষ করে, বাঁশখালী, চকরিয়া, পেকুয়া, খুরুস্কুল, চৌফলদণ্ডি,
টেকনাফ এবং কুতুবদিয়ায় লবণ চাষ হয়। তবে লবণের মূল নিমকমহল এখন মহেশখালী।
লবণের দাম নিয়ে মাঝেমধ্যে চাষীদের মধ্যে কিছু অসন্তোষ দেখা
যায়। তাদেরই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০২১-২০২২ সালের বাজেটে দেশীয় লবণশিল্পকে বাচাঁতে
সোড়িয়াম সালফেট তথা শিল্পলবণ আমদানী নিষিদ্ধ করা হয়। ফলে দীর্ঘদিন ন্যায্যমূল্য
বঞ্চিত চাষীরা পুনরায় লবণের ন্যায্যমূল্য পেতে শুরু করে।
ইতিহাস ও ঐতিহ্যের বিস্তৃত পটভূমিতে সজাগ দৃষ্টি রেখে জাতীয়
লবণনীতির আলোকে মহেশখালী এবং সার্বিক অর্থে বাংলাদেশে লবণ উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণ ও
বাজারজাতকরণের বর্তমান অবস্থা ও ভবিষ্যত প্রক্ষেপ নিয়ে কিছু প্রসংগ উত্থাপন করা
যায়। আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি, লবণখাতকে শিল্প, নাকি কৃষি হিসেবে বিবেচনা করা
হবে, এই নিয়ে দীর্ঘ বিতণ্ডা জারি ছিল। চাষীরা চায়, এটি কৃষি হোক। মিল মালিকরা চায়,
এটি শিল্প হোক। স্বার্থের জায়গায় তারা ভিন্নমত পোষণ করলেও, শেষ পর্যন্ত লবণখাত
শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। শিল্প হওয়ার কারণে লবণকেন্দ্রিক অর্থনীতিতে কিছু
নীতিগত ও কৌশলগত প্রভাব পড়েছে। ফলে এইসব নীতির সুবিধাভোগী শ্রেণির ওপর কিছু
পূর্বতসিদ্ধ প্রভাব আগে থেকেই আঁচ করা যায়। অন্যদিকে, প্রান্তিক চাষী, বর্গা চাষী,
এমনকি ভূমিহীন অথচ লবণশিল্প নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর ওপর এই নীতির কী প্রভাব পড়তে
পারে, তাও অনুমান করা যায়।এসবের বাইরে যারা এই শিল্পের ওপর সরাসরি নির্ভরশীল নয়
কিন্তু উপকারভোগী কিংবা সাধারণ ভোক্তা, তাদের ওপরও কিছু অর্থনৈতিক এবং পরিবেশগত
প্রভাব পড়তে পারে।
স্মরণ রাখা দরকার, দেশে লবণের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎপাদন
খাতের জন্য সরকারি নীতির অভাব অনুভূত হচ্ছিল ব্রিটিশ আমল থেকেই। পাকিস্তান আমলে “আয়ুবের
আইন কড়া, লবণের দর কড়া”, বলা হলেও চাষীরা খুব একটা লাভবান হতে পারে নি। লবণশিল্পের
সাথে অনেকগুলো পক্ষ জড়িত, যাদের স্বার্থের জায়গাও বিভিন্ন। চাষী, মধ্যস্বত্বভোগী,
মিল মালিক, আমদানিকারক এবং খুচরা ক্রেতার স্বার্থ পুরোপুরি এক নয়।
চাষীদের ক্ষেত্রে জমির মালিকানা, বর্গাচাষের সুযোগ কিংবা
লিজ নেওয়ার অধিকার সমভাবে বণ্টিত নয়। অদ্যাবধি লবণ উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত
উৎকর্ষতা আসে নি। পলিথিন দিয়ে লবণ চাষ করলে সাদালবণ পাওয়া যায় বটে, এতে মাইক্রোপ্লাস্টিকের
উপস্থিতি সনাক্ত হওয়ায় লবণ উৎপাদনের বাহ্যপ্রভাব ইতিবাচক নয়। চাহিদা বৃদ্ধির কারণে
নতুন নতুন ধানিজমিতে লবণ চাষ করায় একদিকে যেমন ধানের উৎস কমছে, অপরদিকে আবাদি
জমিতে লবণাক্ততার প্রবেশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটা অনেকটা শাকের করাতের মতো অবস্থা।
বর্তমান লবণনীতিতে চাষীদের জন্য কয়েকটি স্পষ্ট পদক্ষেপ
নেওয়া হয়েছে। প্রকৃত চাষীদের লবণমাঠ বরাদ্দ দেওয়া, তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং
স্বাস্থ্যসুরক্ষার জন্য পদক্ষেপ নেওয়াসহ সহজশর্তে ঋণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি রয়েছে। এতে
আমদানি নিয়ন্ত্রণ করে দেশীয় উৎপাদন বৃদ্ধি করার জন্য প্রণোদনাও রয়েছে। বিসিকের
সুপারিশের ভিত্তিতে তফসিলি ব্যাংক থেকে লবণ চাষের জন্য সরকারি ভর্তুকি ব্যবস্থায়
৪% রেয়াতি সুদহারে একক কিংবা গ্রুপ ভিত্তিতে ঋণ গ্রহণের সুযোগ রাখা হয়েছে। লবণ
উৎপাদনের খরচ হ্রাস করার জন্য লবণমহাল ব্যবস্থাপনা নীতিমালা, ১৯৯২ অনুযায়ী
কার্যক্রম গ্রহণ করার জন্য স্থানীয় প্রশাসনকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
লবণের মধ্যস্বত্বভোগীরাও আর দশপাঁচজনের মতো ব্যবসায়ী, যদিও
তারা প্রান্তিক ব্যবসায়ী। চাষী ও মিল মালিকদের সাথে তাদের যোগাযোগ বেশি। মাঠ
পর্যায়ে লবণের দাম নিয়ন্ত্রণ এবং লবণের ওজন নিয়ে তাদের বিশেষ মানদণ্ড অনেকসময়
চাষীদের ক্ষোভের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু লবণখাতকে সচল রাখতে তাদের গুরুত্বপূর্ণ
ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না। চাষের প্রাথমিক বিনিয়োগ নিশ্চিতকরণ এবং লবণ
বাজারজাতকরণের দু’প্রান্তে তারা সহায়ক হিসেবে কাজ করে। লবণ সংরক্ষণ ও আমদানি
নিয়ন্ত্রণের সাথে তাদের স্বার্থ জড়িত। বিসিক কর্তৃক যে এক লক্ষ মেট্রিক টন বাফারস্টক
নিশ্চিত করার আশা ব্যক্ত করা হয়েছে, তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে মিল মালিকদের সাথে
সাথে মধ্যস্বত্বভোগীদেরও অনুকূল ভূমিকা প্রয়োজন। এই বাফার স্টক লবণের চাহিদাগত
ঝুঁকি এবং আমদানির নেতিবাচক প্রভাব প্রশমনে ভূমিকা রাখবে।
মিল মালিকদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে, যা একইসাথে
চাষা এবং ভোক্তা উভয় শ্রেণির জন্য অপরিহার্য। লবণনীতিতে আয়োডিনযুক্ত লবণ আইন-২০২১
বাস্তবায়নের জন্য এবং ভোক্তাদের চাহিদা পূরণের মাধ্যমে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য
তাদের সুনির্দিষ্ট ভূমিকা চিহ্নিত করা হয়েছে। মানুষের গলার পাশে একটি গ্রন্থি
রয়েছে। এর নাম থাইরয়েড গ্রন্থি। থাইরয়েডের কাজ জীবনপ্রদায়ী হরমোন নিঃসরণ করা। থাইরয়েড
গ্রন্থিতে হরমোন সংশ্লেষের জন্য আয়োডাইড বা আয়োডিন দরকার। কিন্তু ক্যালসিয়াম ও
ম্যাগনেসিয়াম আয়োডিনকে থাইরয়েড গ্রন্থিতে ঢুকতে বাধা দেয়। ফলে স্বাভাবিক খাবারে যে
আয়োডিন থাকে তা থাইরয়েডে পৌঁছতে পারে না এবং কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে না। তাই অনুপুষ্টির
অভাবে গলগণ্ড রোগসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হতে পারে। এই অভাব পূরণের জন্য
খাবার লবণে পরিমাণ মতো আয়োডিন যুক্ত করা হয়। মিল পর্যায়ে গুণগত মান বজায় রেখে
পরিশোধিত ও আয়োডিনযুক্ত লবণ উৎপাদন করা এবং ভোক্তা পর্যায়ে পরিমাণ বজায় রাখার
দায়ভার মিল মালিকদের। বিসিক ও বিএসটিআই লবণের মাননিয়ন্ত্রণ মূলক কার্যক্রম গ্রহণে
স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তা চাইতে পারবে।
শিল্পক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য লবণ আমদানি বিষয়ে প্রান্তিক
চাষীদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ রয়েছে। সর্বশেষ লবণ নীতিতে এই ক্ষোভ প্রশমন করে দেশীয়
স্বার্থ সংরক্ষণের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। শিল্পখাতে ব্যবহৃত লবণের গ্রেড নির্ধারণ
করা হয়েছে, যাতে কেউ সোডিয়াম ক্লোরাইডের নাম দিয়ে সোডিয়াম সালফেট আমদানি করতে না
পারে।
পরিশেষে সাধারণ কিছু পরিবেশগত ঝুঁকি, জলবায়ু পরিবর্তনের
প্রভাব এবং উপকূলের নোনা পানিতে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি, সবকিছু মিলে লবণ শিল্পের
সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য কক্সবাজারের মানুষের বিজ্ঞানসম্মত ও
বাস্তবসম্মত প্রস্তুতি দরকার। একদিকে চাহিদার চাপ, অন্যদিকে ভুল প্রযুক্তির অভিঘাত
লবণশিল্পের জন্য অনভিপ্রেত পরিণাম নিয়ে আসতে পারে। এর সরাসরি প্রভাব পড়বে চাষী এবং
ভোক্তাদের ওপর। উপকূলীয় অঞ্চল হিসেবে পৌনঃপুনিক ঘূর্ণিঝড়ের আঘাত উপকূলবাসির সমূহ
ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। প্রাকৃতিক সম্পদ ও উৎসগুলো দায়িত্বজ্ঞানের সাথে ব্যবহার ও
সংরক্ষণ করতে না পারলে আমরা টেকসই পরিবেশ ও লাগসই জীবিকা নিশ্চিত করতে পারবো না। উৎপাদন
বৃদ্ধি করার জন্য পলিথিনের বিকল্প কী ব্যবহার করা যায় তা নিয়ে উদ্ভাবনী উদ্যোগ ও
গবেষণা করা দরকার। লবণ চাষী কল্যাণ সমিতি প্রান্তিক পর্যায়ে পরিবেশ ও প্রযুক্তিগত
সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করতে পারে।
উপকূলের বাসিন্দা হিসেবে আমরা নিজেরা চাই, লবণের উৎপাদন
টেকসই হোক, লবণের মান বিজ্ঞানম্মত হোক এবং লবণের বাজার প্রত্যাশিত হোক।
সরওয়ার কামাল ।। লেখক ও
গবেষক
Comments