মাস্টার শাহ আবদুল মোস্তফা স্মরণে
.......................
আজ ২৮ এপ্রিল, মাস্টার শাহ আবদুল মোস্তফার (১৯৬৭-২০০২) ২০তম মৃত্যু বার্ষিকী। প্রয়াত শাহ আবদুল মোস্তফা (নুরুচ শফি) ছিলেন প্রেরণাদায়ী শিক্ষক। নাতিদীর্ঘ জীবনে তিনি শিক্ষার্থীদের কাছে বৃত ছিলেন শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায়। মোস্তফার জন্ম সত্তরের দশকে, মহেশখালীর জাগিরাঘোনা গ্রামের গোলালির ভিটায়। দু’দুটো মহাযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ ও মারির প্রভাব কাটিয়ে গোত্রমাতার যোজনায় যখন ঘুরে দাঁড়ানোর প্রয়াস চলছে, তখন তার আবির্ভাব পরিবারের কনিষ্ঠ ছেলে হিসেবে। শিক্ষিত চাচা-মামাদের নিস্পৃহতায় অনালোক গৃহকোণে তখনো জ্ঞানের পিদিম জ্বলছিল মা-খালাদের প্রবর্তনায়। সেই টিমটিমে পিদিমের পরশ পেয়ে, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার নানা বৈতরণী পেরিয়ে, মেধার অবমাননা কিছুটা রুখে দিতে পেরেছিলেন তিনি। কাজেই, তার ক্যারিয়ার প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির বিষমতায় ম্লান হওয়া সত্ত্বেও ব্যক্তিত্ব ছিল মননের বিভায় প্রোজ্জ্বল।
বলাবাহুল্য, দারিদ্র্যক্লিষ্ট শৈশবে পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে প্রতিভার বিকাশ রুদ্ধ হয়েছিল মোস্তফার। তবুও তার প্রতিভায় বৈচিত্র্যের কমতি ছিল না। লেখায়, বলায়, উপস্থাপনে, অংকনে, রন্ধনে এবং সর্বোপরি শৈল্পিক নৈপুণ্যে তার দক্ষতা ছিল মুগ্ধকর। যুবাকালে আধ্যাত্মিকতায় দীক্ষা নিয়েছেন ভুবনবিখ্যাত দু’জন আলেমের কাছে। নব্বই দশকে কুতুবজুম আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠালগ্নে তিনি শিক্ষকতায় প্রবেশ করেন। ৯১’র ঘূর্ণিঝড়ের পরে নতুন সমাজচেতনার উন্মেষ ঘটায় মহেশখালীতে তখন শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রস্ফুটনকাল চলছে। ওই সময়েই তিনি বিদ্যালয় ও মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেছেন এক যুগ। ২০০২ সালে হৃদযন্ত্রের বিপর্যয় ঘটা অবধি পুটিবিলা ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসায় দরস দিয়েছেন। ছকে মাপা প্রাত্যহিক রুটিনের বাইরে একজন শিক্ষক ও বন্ধুর ভূমিকা ব্যতীত তার অন্য পরিচয় ছিল না। তবুও পরিচয়ের পরিসর ছাড়িয়ে অগণিত মানুষের সাথে তার সংযোগ ঘটেছে। মেলমহব্বতে পুষ্ট হয়েছে বয়ান ও স্মৃতির সম্ভার।
মোস্তফার পূর্বপুরুষদের বসতি মহেশখালীর কুতুবজুমে। তিনিও তার অনাড়ম্বর জীবনের সুদীর্ঘকাল যাপন করেছেন কুতুবজুমেই। যে কয়বছর সেখানে ছিলেন না, সেই সময়টাও তিনি কাটিয়েছেন কুতুবজুমীয় আবহ ও আচ্ছন্নতায়। স্মর্তব্য, তার বন্ধু এবং শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই কুতুবজুম এলাকার। কাজেই কুতুবজুমে মাধ্যমিক শিক্ষালয়ের সূচনাকার্যে যুক্ত থাকবেন, এটা অপ্রত্যাশিত ছিল না। শিক্ষার্থীদের কাছে তিনি নানাভাবে ও নানা পরিচয়ে ধরা দিয়েছেন। তার ক্লাসের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল বিষয় ও শিক্ষার্থীদের ওপর তার কমান্ড। কোন বিষয়ে তার তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ এবং সজ্ঞাপ্রসূত মন্তব্যে চিন্তার নবদিগন্ত খোলে যেত। শিক্ষার্থীদের প্রতি তার সহমর্মিতা ব্যাপ্ত ছিল তাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক সংকট উত্তরণের প্রয়াস ছাড়িয়ে আর্থিক অনটন ঘুচানোর কোশেশ পর্যন্ত।
নিকটঅতীতে গ্রামীণ শিক্ষাগুরুদের একটি প্রীতিকর রসম ছিল। ছাত্রদের রাস্তা দিয়ে যেতে দেখলে কাছে ডাকতেন। কুশলাদি জিজ্ঞেস করতেন। এরপর বাংলা ও ইংরেজি ব্যাকরণের খুঁটিনাটি জিজ্ঞেস করতেন। টেন্স, ভয়েস ও অনুবাদ মিলে গুরুত্বপূর্ণ কিছু সবক বাতলে দিতেন। যেন ক্ষণিক আলাপে সম্পূরক বিদ্যাদান। তখন স্কুল পর্যায়ে নেস্ফিল্ডের ‘ম্যানুয়াল অব ইংলিশ গ্রামার’ ছিল পঠনপাঠনের মাপকাঠি। রেন এন্ড মার্টিনের ইংলিশ গ্রামারও কদর পেয়েছিল কিছুটা। তবে, অধিকাংশ বিদ্যার্থীর ওমর গুজরে যেত পুস্তকবিহীন। এই কারণেই হয়তো, জাগিরাঘোনার মোস্তাক মাস্টারের লেখা ‘গৃহশিক্ষক’ বইটি ‘অল ইন ওয়ান’ হিসেবে সমাদৃত হয়েছিল। তখন বইয়ের ঘাটতি পূরণ করতো শিক্ষকের বাড়তি ক্লাস। মোস্তফা বই লিখেন নি, তবে গভীর ভাবনাপুষ্ট চিঠি লিখেছেন লেখক এবং তার অন্যান্য ছাত্রদের কাছে। ইংরেজি, বাংলা এবং সিলেবাস বহির্ভুত শিক্ষায় তিনি উদ্ভুদ্ধ করতেন শিক্ষার্থীদের। উপযুক্ত ভঙ্গিমা ও পটুতায় বক্তৃতা এবং বিতর্ক চর্চার তালিম দিতেন। সুন্দর হস্তাক্ষরে শৈলীপূর্ণ প্যামপ্লেট ও পোস্টার তৈরি করে দিতেন।
মোস্তফা শিক্ষক হিসেবে কেমন ছিলেন, তা তার ছাত্রদের কাছে সুবিদিত। নিঃসন্দেহে তিনি উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা যোগাতেন। স্বপ্ন দেখাতেন। উপরি হিসেবে বিদ্যাও দিতেন। ক্ষীণ রোজগারের কিয়দংশ শিক্ষার্থীদের কল্যাণে বিলাতেন। বলার চেয়ে শুনতেন বেশি। শিক্ষার্থীদের ওপর তার মনোযোগ এতো নিবিষ্ট ছিল যে তিনি অনেকের ক্যারিয়ার প্রজেকশন নিয়ে আগাম বলতে পারতেন। তার অকাল প্রয়াণে সরাসরি ছাত্রতো বটেই, উত্তরকালের শিক্ষার্থীরাও যত্নবান শিক্ষকের দরদি ডাক-দোহাই থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
সামাজিক মাধ্যমে প্রদর্শনবাদিতার যুগে একজন অখ্যাত শিক্ষককে আমরা কেন স্মরণ করবো, তার যৌক্তিকতা নিয়ে অনেকেরই ঔৎসুখ্য থাকতে পারে। আজ আমরা মোস্তফাকে স্মরণ করছি তার জীবনাদর্শ ও হৃদয়বান সাহসী ব্যক্তিত্বের জন্য। শিক্ষকতা, এখনো, সমাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পেশার একটি। তার চেয়ে বড় কথা, মৃত বই থেকে সরাসরি জ্ঞান পাওয়া যায় না। শিক্ষকই মৃত বইকে জীবন্ত করে তোলেন। শিক্ষকহীন শিক্ষা, দুর্বিনীতের স্পর্ধা। একজন মানুষ কয়টা ডিগ্রি নিলো, কয়টা বই পড়লো, তা দিয়ে জ্ঞানের পরিমাপ করা যায় না। জ্ঞান, যেমনটা ইমাম মালিক (র) বলেন, ‘এমন এক আলো, যা আল্লাহ মানুষের অন্তরে দিয়ে থাকেন’। শিক্ষক ছাত্রদের অন্তরে সেই আলোর সন্ধান করেন।
জ্ঞান ও মানুষের রূহানি অস্তিত্ব সম্পর্কে ধারণা লাভ করা একজন ব্যক্তিশিক্ষকের কীর্তি মূল্যায়নের প্রস্তুতি হিসেবে কাজের। দার্শনিক হেগেলের মতে, মৃত্যু ছাড়া মানুষের জীবন পূর্ণতা পায় না। কারণ মৃত্যু ব্যতীত মানুষের আত্মচেতনা জন্মে না। স্বীয় শরীর, সমাজ ও দুনিয়াবি মোয়ামেলা থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন না হওয়া পর্যন্ত সে আসলে ব্যক্তিই হয়ে উঠছে না। সমাজসংলগ্ন সামষ্টিক জীবনযাপন করে, দুনিয়ার নানা কিছুর সাথে সম্পর্কের জালে বন্দি হয়ে মানুষ ম্যাক্রো চেতনার অংশ হয়ে থাকে। মৃত্যু মানুষকে সমাজ ও সামষ্টিক অস্তিত্ব থেকে মুক্তি দিয়ে ব্যক্তিঅস্তিত্ব ও ব্যক্তিচেতনার উন্মেষ ঘটায়।
এইক্ষেত্রে, হেগেলের অভিমত না নিলেও, উভয় গোলার্ধের চিন্তার ইতিহাসে আত্মোপলব্দির গুরুত্ব সর্বজনগ্রাহ্য। গভীর উপলব্দি ছাড়া জ্ঞান সম্ভব নয়। জ্ঞানের সংজ্ঞা এখনো চারটি শর্তের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে; কোন ঘটনার সত্যতা, যুক্তিযুক্ততা, বিশ্বাস ও নিশ্চয়তার মধ্যে। কিন্তু অভাব ও অজ্ঞানতার যে জ্ঞান, নলেজ অব আনকন্সাস, সেটিই এখন লাকাঁর যুগের জ্ঞান। এটাও একধরনের আত্মোপলব্দি। এই ধরনের উপলব্দির জন্য মানুষকে কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়; প্রথাগত সংস্কার, কুসংস্কার ও বিশ্বাস ভেঙে নিজের উপলব্দি জানান দিতে হয়। এটা করতে গিয়ে মানুষকে ত্যাগ ও সাহসের পরাকাষ্ঠা দেখাতে হয়। ক্ষেত্রবিশেষে সামাজিক জ্ঞানের বয়ানকে পাহারা দিয়ে রাখতে হয়। তাই এখন জ্ঞানের পঞ্চম শর্ত হিসেবে হাজির হয়েছে সাহস। মোস্তফা শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের শর্তে সাহস যুগিয়েছেন, শর্তহীন শর্তে অর্থ দিয়েছেন, দর্পহীনতার শর্তে আত্মবিশ্বাস যুগিয়েছেন।
মহাজগত ও মহাকালে আমাদের জীবনকাল অতি তুচ্ছ ও সংক্ষিপ্ত। আধ্যাত্মিকতা ও নান্দনিকতার বাইরে এর কোন মূল্য আছে বলে জানা নেই। ব্যক্তিমানুষের দুনিয়াবি জীবন বাদ দিলে মহাজাগতিক প্রেক্ষাপটে জীবনের ভিন্ন অর্থ থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু সেটা আমাদের আয়ত্বের বাইরে। অস্তিত্বের আছে নানা স্তর ও বলয়। মহাসিন্ধুর এক বিশেষ ঢেউ যে তার ঢেউয়ের আকার পেল, সেটা একটি সম্ভাবনাময় সত্তা। মহাসিন্ধুর অজস্র সম্ভাবনা থেকে অকস্মাৎ একটি বিশেষ রূপ-আকারের, বিশেষ গতির, ঢেউ হিসেবে তার আবির্ভাব। ক্ষণকালেই তা স্বীয় সত্তায় প্রত্যাবর্তন করে। সমুদ্রে পানির ঢেউয়ের মতোই একটি গতিময় সত্তা হিসেবে প্রাণময় মানবরূপের উদ্ভব ও বিলয় আমাদের বিস্ময়াভিভূত করে। মানবজীবন যেন জীবন নয়, ঘটমান ব্যাপার, স্ট্যাট অব দ্য অ্যাফেয়ার্স। তাই জীবন নয়, কীর্তি নয়; আমরা স্মৃতির সার্থকতা বিচার করি। চূড়ান্ত অর্থে জীবনের সার্থকতা বিচারের মানে হয় না। কারণ এই বিচারের মাপকাঠি আমাদের হাতে নেই। আমাদের যা আছে তা হলো, সভ্যতা ও সংস্কৃতি, সেই সাথে পার্থিব বুঝব্যবস্থার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ কিছু আরোপিত মূল্যবোধ।
কালের কল্লোলে একদিন এই স্মৃতিও হারিয়ে যাবে। কিন্তু একজন ছাত্রদরদি শিক্ষক, তার ব্যয়বহুল দারিদ্র্য, এবং সর্বোপরি মানবিক ব্যক্তিত্বের সামাজিক ঝুঁকিগুলো আমাদের জন্য কামেলিয়াতের ইশারা হিসেবে থেকে যাবে। আধ্যাত্মিকতা ও নবীপ্রেমের দিকে ছিল তার নিবিড় নিষ্ঠা। দরূদ ছিল তার জবানে ও কলবে। একাকী থাকলে তিনি মৃদুকণ্ঠে দরূদ ও নাত আওড়াতেন। আ’লা হযরত আহমদ রেজা খান বেরলভি (র) রচিত নাতে রসুল (সঃ) ছিল তার অতিপ্রিয়। দোয়াকরি, আল্লাহ তাকে নবীপ্রেমিক হিসেবে কবুল করুন।
Comments