মৃত্যুর সীমানায় জীবনের এষণা
.............................................................
জন্মিলে মরতে হয়। এটি জগতের নিয়ম। সাধারণত কোন ঘটনা ব্যতিক্রম ছাড়া বারবার একইভাবে ঘটলে তাকে আমরা নিয়ম বলি। জীবনের অবসানে মৃত্যু আছে, কেবল নিয়মের মৃত্যু নেই। সেজন্য এর নাম নিয়ম, মানে 'নি+য়ম', অর্থাৎ যম নেই যার। যেমন মেঘ থেকে বৃষ্টি হয়, এটি নিয়ম। যদি বলি বাতাস থেকে বৃষ্টি হয়, এটি অনিয়ম। বাতাস থেকে বৃষ্টি হয় না। তবে বাতাসে জলীয়বাষ্পের পরিমাণ বেড়ে গেলে হাল্কা বৃষ্টির মতোই গায়ে পানি লাগতে পারে, আর্দ্রতায় সিক্ত হতে পারে ভূমি, যা কোনোভাবেই বৃষ্টি পদবাচ্য নয়। মৃত্যুতে জীবনের সমাপ্তি ঘটে, নাকি জীবনের পরিবর্তন ঘটে, কিংবা জীবনাদলের বদল ঘটে, সেটি এখনো অমীমাংসিত তর্ক । তবে , জন্মকে মানুষ উদযাপন করে সানন্দে; মৃত্যুতে বিহ্বল হয়, বেদনায় মুষড়ে পড়ে। জন্মে আশাবাদ থাকে, মৃত্যুতে থাকে বেদনা, বড়জোর অন্যের সমবেদনা। মৃত্যুতে মানুষ উল্লাসও প্রকাশ করে, তবে তা ইতিবাচক অর্থে নয়, নেতিবাচক অর্থে। বিশেষ কোন শত্রুর মৃত্যুতে মানুষ স্বস্তি প্রকাশ করে, ক্রুরতায়, তীব্র আবেগে উল্লাস প্রকাশ করে।
যারই জীবন আছে, তার জীবনের নিজস্ব হিসেব আছে। কখনো দিন, মাস বা বছর মেপে, কখনোবা জীবনের কীর্তি মেপে জীবনের পরিমাপ করা হয়। অনন্ত সময়ের তুলনায় ক্ষণিকের জীবন নিতান্তই তুচ্ছ অথচ মানুষের কাছে কত মূল্যবান! জীবনকালের ব্যাপ্তি এবং কীর্তির পরিমাণের মধ্যে এক ধরনের সহযোগ আছে। তাইবলে দীর্ঘ জীবন পেলেই জীবন সার্থক হবে এমন ভাবা সমীচীন নয়। অনেক সময় ক্ষণজন্মা ও ক্ষণজীবী মানুষ কীর্তিতে মহীয়ান হয়ে কালান্তরে পদচিহ্ন রেখে যায়। তবে বাঁচতে চাওয়াটাই যে কোন প্রাণীর সাধারণ প্রবণতা, যে কারণে স্রেফ বেঁচে থাকাটাও অনেক সময় সার্থকতা বলে বিবেচিত হয়।
সাধারণত তিন ধরনের মানুষকে পৃথিবীতে বেশিদিন বাঁচতে দেখা যায়, নিরেট ধার্মিক, অতিনিয়মনিষ্ট মানুষ, অতিখারাপ মানুষ। এই তিন ধরনের মানুষের মধ্যে বাঁচার তীব্র আকাঙ্ক্ষা থাকে। ফরাসি দার্শনিক হেনরি বার্গসোঁর প্রস্তাবিত 'ইলান ভাইটাল' বা ‘জীবনশক্তির প্রবাহ’ তাদের তীব্র। দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে সক্রাতেস থেকে জীবন এবং মৃত্যুর আলোচনা শুরু করতে হয়। গ্রীক দার্শনিকদের মধ্যে প্লাতো, তারও আগে সক্রাতেস, জীবনকে শরীর ও আত্মার সমষ্টি বলে ভাবতেন। প্লাতোর আকারবাদি দর্শনে আত্মা জীবনসত্তার একটি আকার হিসেবে ধরা দেয়, যেখানে শরীরি অবয়ব জীবনের বস্তুগত আকার বলে স্বীকৃত। মৃত্যুতে শারীরিক অবয়বের বিলোপ ঘটলেও আত্মার লয় ঘটে না বলে তার বিশ্বাস। প্লাতোর সংলাপ ফায়ডোতে আমরা সক্রাতেসের জবানীতে মৃত্যুর পূর্বমুহুর্তে সক্রাতেসের মৃত্যুভাবনার সাথে পরিচিত হই। মৃত্যুকে সক্রাতেস তিন দিক থেকে দেখেছেন। তত্ত্ববিষয়ক অঞ্চলে মানুষের অস্তিমানতা হিসেবে, মনস্তাত্ত্বিক জায়গা থেকে এবং জ্ঞানতাত্ত্বিক পর্যালোচনার আলোকে। তার কাছে মৃত্যু হচ্ছে শরীর হতে আত্মার বিচ্ছেদ। মৃত্যু হচ্ছে ঈশ্বরের সাথে, পরমসত্তার সাথে মিলিত হওয়ার সুযোগ। শরীরী ইন্দ্রীয় দিয়ে মানুষ প্রকৃত সত্তাকে জানতে পারে না। কারণ,ভুল ইন্দ্রীয়উপাত্ত দিয়ে শরীর মানুষের মনকে, আত্মাকে বিভ্রান্ত করে। ইন্দ্রীয়ের মাধ্যমে জীবনে যে সুখ আমরা উপভোগ করি, তা মিথ্যা, বড়জোর আপাত সত্য। ইন্দ্রীয়সমূহের বিশেষ গঠন, স্থান-কালের বিশেষ ছাঁচে মাপা সংবেদনের কারণেই আমাদের কাছে তা সুখ বলে অনুভূত হয়। মৃত্যু মানুষকে মিথ্যা অনুভূতিজাত এই ধরনের ভুল জ্ঞান হতে মুক্তি দেয়। ইন্দ্রীয় উপাত্তের ভ্রান্তি থেকে মুক্তি পেয়েই মানুষ জ্ঞানতাত্ত্বিকভাবে পরিপক্বতা লাভ করে। শরীর শুধু ভুল উপাত্ত দিয়েই মানুষকে বিভ্রান্ত করে না, মনস্তাত্ত্বিকভাবে আকাঙ্ক্ষা, কামনা, ভীতি ও মোহ তৈরির মাধ্যমে সত্য হতে দূরে রাখে বা সত্যোপলব্দি হতে নিবৃত রাখে। তাই বিশুদ্ধ জ্ঞান পেতে হলে শরীরের প্রভাব হতে আত্মাকে মুক্ত রাখতে হবে। দর্শন হচ্ছে বিশুদ্ধ জ্ঞানের চর্চার মাধ্যমে সদগুণ অর্জনের প্রয়াস। তাই দর্শন এক ধরনের মৃত্যুর প্রশিক্ষণ, এই অর্থে যে, দর্শন মানুষকে শরীর বা ইন্দ্রীয় প্রভাবিত ভ্রান্ত জ্ঞান হতে মুক্ত থাকতে সাহায্য করে। একজন দার্শনিকের জ্ঞান সেইদিনই পূর্ণতা পায়, যেদিন তিনি মারা যান। সক্রাতেসের জবানিতে কিংবা প্লাতোর চিন্তায় মৃত্যুভীতি থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় শনাক্ত করা যায়, তা হলো সদগুণ অর্জন করা, আর সদগুণ অর্জন করার পূর্ব শর্ত হলো দার্শনিক হওয়া বা জ্ঞানপ্রেমি হওয়া, সত্যমগ্ন হওয়া। তাই সক্রাতেসের মতে, দার্শনিকের মৃত্যুভীতি নেই।
জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট প্লাতোর এই যুক্তি গ্রহণ করেন নি, এই জন্য যে, অন্য প্রাণীদের তুলনায় মানুষের সংবেদের পার্থক্য আছে। মানুষ ইন্দ্রীয়োপাত্তের ভিত্তিতে ধারণা তৈরি করে এবং একাধিক ধারণার ভিত্তিতে বাচনিক অনুমান গঠনে সক্ষম। যেহেতু মানুষ আত্মসচেতন প্রাণী, সেহেতু মানুষ নিজের আবেগ, আকাঙ্ক্ষা, ইন্দ্রীয়জ প্রভাব বা ঝোঁক এবং সংস্কার হতে নিজের চেতনাকে নিরাপদ দূরত্বে রেখে বিশুদ্ধ চিন্তার মাধ্যমে ঘটনার আবেগনিরপেক্ষ পর্যালোচনা করতে সক্ষম। এদিকে, মানুষের আত্মসচেতনতা সম্পর্কিত কান্টের এই মূল্যায়নকে হেগেল দ্বান্ধিকতার সাথে যুক্ত করে মৃত্যু মোকাবেলার কৌশল বাতলে দিয়েছেন। হেগেলের কাছে জীবন হলো, চক্রকভাবে গতিশীল এক অসীম ও অনির্দিষ্ট ঐকিক প্রক্রিয়া, যেখানে জীবন্ত বস্তুসমূহ আসা-যাওয়ার খেলায় একে অপরের মধ্যে বিলীন হয়। জীবনের সামগ্রিক স্থিরতার অন্তরালে নিহিত বৈচিত্র্য ও পার্থক্যের কারণে এক গতিশীল চপল অস্থিরতা কাজ করে, যা ব্যক্তিঅস্তিত্বের সীমা ছাড়িয়ে জীবনকে একটি পুনরুৎপাদনকারি ও অপরাপর অস্তিমান সত্তা গ্রহনকারি প্রক্রিয়াতে পর্যবসিত করে। ব্যক্তিসত্তার অধিবলয়ে জীবন এক ব্যক্তি হতে অপরাপর ব্যক্তিসত্তা বা বস্তুসত্তাকে উৎপাদন করে চলেছে। তাই সত্তাকে টিকিয়ে রাখতে হলে অপর সত্তায় বিলীন হওয়া বা অপর সত্তাকে নিজের মধ্যে আত্মীকরণ রোধ করা বাঞ্ছনীয়। বিষয়টিকে স্পষ্ট করার জন্য আমরা একটা দুর্বাঘাসের উদাহরণ টানতে পারি, যে ঘাস মাটি হতে পানি ও অন্যান্য রাসায়নিক উপাদান, সুর্য হতে তাপ এবং বাতাস হতে কার্বণ ডাই অক্সাইডকে নিজের মধ্যে আত্মীকরণ করছে। অন্যদিকে একটি ছাগল যখন এই দুর্বাঘাসকে ভক্ষণ করে তখন ঘাসের সত্তা ছাগলের মধ্যে বিলীন হয়ে যাচ্ছে এবং ঐ ছাগলের দুধ যখন কোন ব্যক্তি পান করে তখন ঐ ব্যক্তির মধ্যে ছাগলের সত্তা, যার মধ্যে দুর্বাঘাসের সত্তা বিদ্যমান, যুক্ত হচ্ছে। হেগেল জীবনকে একটি প্রবহমান তরল অবস্থা হিসেবেই দেখেছেন............
স্লাভোজ জিজেকের মতো অনেকেই মৃত্যুর পরে জীবন আছে কিনা সেটা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এবং উত্তরে পাল্টা প্রশ্ন রাখেন, মৃত্যুর আগেরটাকে জীবন বলা যাবে কিনা? অর্থাৎ আমরা সব সময় মৃত্যুর পরের জীবন নিয়ে অনুসন্ধান চালাই কিন্তু মৃত্যুর আগের সময়টাকে জীবন বলা যাবে কিনা সে বিষয়ে সিরিয়াসভাবে ভাবি না। আরভিন শ্রোয়েডিংগার এবং ক্রেইগ ভ্যানটার জীবনের প্রধান প্রাণসত্তা নিয়ে যে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান চালিয়েছেন তা দিয়েই জীবন সম্পর্কে আমাদের প্রাথমিক পাঠ শুরু হতে পারে। আমরা যেটাকে বলি শরীর, তা অনেকগুলো অঙ্গ, তন্ত্র, কলা ও কোষ দ্বারা তৈরি। শরীরের এই সমস্ত উপাদান যখন সচল থাকে, সক্ষম থাকে, তাকে আমরা প্রাণ বলি। কিন্তু প্রাণ হচ্ছে একটি গতিশীল পুনরাবৃত্তিমূলক প্রক্রিয়া। অর্থাৎ আমাদের শরীরে প্রতিমুহূর্তে কোষের ভাঙ্গাগড়া চলছে। অপচিতি ও উপচিতি ঘটছে। এতেকরে ডিএনএ ছাড়া কোষগুলো খুব দ্রুত মরে যায়। প্রতিদিন আমাদের শরীরের ত্বক থেকেই অন্তত পাঁচশত মিলিয়ন মরা কোষ ঝরে পড়ে। প্রতি দশটি রক্ত কণিকার মধ্যে পাঁচটি প্রতিদিনই মারা যায়। এ থেকে বুঝা যায় একইভাবে নতুন কোষ তৈরি না হলে আমরা মারা যাব। কথা হচ্ছে স্বাভাবিক কোষ কিভাবে মারা যায় আর নতুন কোষইবা কীভাবে তৈরি হয় তা না বুঝলে এই মেটাবোলিজম স্পষ্ট হবে না। স্বাভাবিকভাবে কোষের মরণ একটি বহুমুখী জটিল প্রক্রিয়া। গ্রীক ভাষায় এটাকে ‘’এপথসিস’’ বলা হয় যার মানে হল গাছের/ ফুলের পাপড়ি বা পাতা ঝরে যাওয়া। এই প্রক্রিয়াটাও বিভিন্নভাবে সম্পন্ন হয়ে থাকে। তবে মোটাদাগে বলা যায়, প্রথমে কোষের নিউক্লিয়াস ঘনীভূত হয়, কোষ কুঁচকে যায়, সাইটোপ্লাসম ঘনীভূত হয়, ডিএনএ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়,শেষে নিউক্লিয়াস কিছু বিচ্ছিন্ন ক্রোমাটিন বা নিউক্লিওসমাল ইউনিটে বিভক্ত হয়ে কোষের মৃত্যু ঘটে। পুরো প্রক্রিয়াটাকে কিছু জৈবরাসায়নিক পরিবর্তন হিসেবে সনাক্ত করা যায়। অন্যদিকে কোষ তৈরি হয় কোষ বিভাজনের মাধ্যমে।একটি কোষ দুইভাবে বিভক্ত হয়ে নতুন কোষ তৈরি হয়। ঠিক বিভাজনের আগে কোষে যে তেইশ জোড়া ক্রোমোজোম থাকে তাতে ছয় হাজার মিলিয়নের মত ডিএনএ কোড কপি হয়ে যায়। ডিএনএ হল প্রোটিন তৈরির নির্দেশনা। ফলে প্রত্যেকটি নতুন কোষে সমপরিমান ডিএনএ কোড বরাদ্দ হয়ে যায়। এই যে কোষের বৃদ্ধি এবং মৃত্যু তা একটি চক্রক প্রক্রিয়া, যা ঐ প্রক্রিয়াতেই উৎপন্ন হওয়া এক ধরনের প্রোটিন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এই প্রোটিন হল শৃঙ্খল আকারে যুক্ত এমাইনো এসিডের ব্লক। প্রাণ কী বুঝাতে গিয়ে আমি যে জৈব-রাসায়নিক আলোচনার সূত্রপাত করলাম তার কারণ আমরা জীবন শুরু করেছি একটি একক কোষ হিসেবে। বাবা থেকে অর্ধেক আর মা থেকে অর্ধেক জীন নিয়ে। জীনের মুল উপাদান হল ডিএনএ। সে কারণে আমাদের শরীরের পুরো পরিকল্পনা নির্দেশনা আকারে লিপিবদ্ধ আছে এই জীনে।
এবার প্রাণ সম্পর্কে বিভিন্ন চিন্তাবিদদের প্রামাণ্য তৎপরতার হদিস নেয়া যাক। ১৯৪৩ সালে ডাবলিনের ট্রিনিটি কলেজে আরভিন শ্রোয়েডিংগার ‘’প্রাণ কী’’ শিরোনামে একটি ভাষণ দেন। ঐ ভাষণে তিনি খুব দূরদর্শী কিছু ধারণা ব্যক্ত করেন। তিনি ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন যে, জীবন্ত কোষের রাসায়নিক কাঠামোতে বংশগত তথ্য, কোড আকারে লুকায়িত থাকতে পারে। তার সে ইঙ্গিত দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ক্রিক এবং ওয়াটসন ১৯৫৩ সালে ডিএনএ কাঠামো আবিষ্কার করেন। বিজ্ঞানী শ্রোয়েডিঙ্গারের সত্তর বছরেরও পরে একই শিরোনামে ২০১২ সালের ১২ জুলাই ট্রিনিটি কলেজের পরীক্ষা কেন্দ্রে ক্রেইগ ভ্যানটার একটি ভাষণ দেন। তিনি বলেন, এখন ডিএনএর জেনেটিক কোড পাঠ করা সম্ভব। প্রোটিন সংশ্লেষের মাধ্যমে নতুন ডিএনএ কোড লেখাও সম্ভব। শুধু তাই নয় পুরো জীন তৈরি করে নতুন কোষে পুরে দেয়াও সম্ভব। এর তাৎপর্য কী দাঁড়াল ? জীবন শুরুর যে মৌলিক উপাদান কোষ, কৃত্রিমভাবে তা তৈরি করা সম্ভব বলে জানা গেলো। ক্রেইগ বলেন, আমরা এখন জীববিজ্ঞানের ডিজিটাল যুগে আছি। অর্থাৎ কম্পিউটারের সফটওয়্যার ও প্রোগ্রামিং যেরকম ডিজিটাল কম্যান্ড ১ ও ০ দ্বারা লেখা সম্ভব, ডিএনএ কোডও সে রকম ডিজিটাল কম্যান্ড দ্বারা লেখা সম্ভব হবে। শ্রোয়েডিঙ্গার বলেছিলেন প্রাণ হচ্ছে এক ধরনের কোড, আর ক্রেইগ ভ্যানটার এসে বলছেন প্রাণ হচ্ছে ডিজিটাল কোড। পিথাগোরাসের কথার একটা প্রতিধ্বনি যেন আধুনিক যুগে ফিরে আসল।
১৯৪৯ সালে ফ্রেড স্যাঙ্গার যখন ইনসুলিন নামক প্রোটিন এর এমাইনো এসিড কোডের ধারা বিন্যাস আবিস্কার করেন, তখন এটা অনেকটা পরিস্কার হয়েছিল যে ডিএনএ এর কপি তৈরি করা সম্ভব এবং তা প্যাঁচানো দ্বৈত কয়েলের মতোই। ১৯৬১ সালে গোবিন্দ খোরানা এবং মার্শাল নিরেনবার্গ তিন বর্ণবিশিষ্ট রৈখিক জেনেটিক কোড আবিষ্কার করেন, যেখানে প্রতিটি বর্ণ একেকটি এমাইনো এসিডের আদ্যাক্ষর হিসেবে বিবেচিত।১৯৭০ সালে হ্যাম স্মিথ রেস্ট্রিকশন এনজাইম আবিস্কার করেন। এটা আণুবীক্ষণিক কাঁচির ভূমিকা পালন করে, যার সাহায্যে আণুবীক্ষণিক পর্যায়ের জৈবপ্রযুক্তিতে বিপ্লব সাধিত হয়। ১৯৭৫ সালে ভ্যানটার যখন পিএইচডি গবেষণায় লিপ্ত তখন ডিএনএকে তিনিও এনালগ কোড হিসেবে ভাবতেন। কিন্তু যেই না ডিএনএর ধারাক্রম তৈরি সম্ভব হল, এই ডিএনএ কোডকে ডিজিটাল কোডে রূপান্তর করার কথা মাথায় আসে। সম্প্রতি একটি কোষের গাণিতিক মডেলিং করা সম্ভব হয়েছে। সেভাবে চলতে থাকলে কম্পিউটারে একটি কোষের সামগ্রিক নির্দেশনা, বিন্যাস, ইতিহাস এবং কোষের কার্যপরিধিরও মডেলিং করা সম্ভব হবে। তাই এই জগতে বেঁচে থাকা সমস্ত কোষকে ডিএনএ সফটওয়্যার দ্বারা পরিচালিত জৈব যন্ত্র হিসেবে দেখা হচ্ছে। এভাবে যদি প্রাণকে ডিজিটাল সংকেত ও আদেশে রূপান্তর করা যায় তাহলে হয়তো একদিন ডিজিটাল জগত থেকেই প্রাণ তৈরি করা সম্ভব হবে। ডিএনএ কোড বদলে যদি নতুন প্রজাতি তৈরি সম্ভব হয়, তাহলে নতুন ধরনের জীবও তৈরি সম্ভব হবে।
এতক্ষণ আমরা জৈবরাসায়নিক ব্যাখ্যা ও জৈব প্রযুক্তির পরিসীমায় প্রাণের স্বরূপ উপলব্দির চেষ্টা করেছি। ইদানিং পদার্থ বিজ্ঞানের নতুন আবিষ্কার আমাদের চারপাশের জগত সম্পর্কে নতুন ব্যাখ্যা হাজির করেছে। এটাও প্রাণকে ব্যাখ্যা করার জন্য সমান গুরুত্বপূর্ণ। যারা নাস্তিক তাদের একটা গোঁড়া অবস্থান আছে যে, যা আমরা দেখিনা তার অস্তিত্ব নেই। কিন্তু পদার্থ বিজ্ঞানীরা বলছেন, পদার্থের স্বরূপ আমরা পুরোটা দেখিনা। কারণ, পদার্থের অণু, পরমাণু ও উপপারমাণবিক কণাগুলোর মধ্যে তিন ধরনের জিনিষ থাকে। একটা হল পদার্থিক বস্তুগত সত্তা, একটি শক্তিসত্তা এবং অপরটি কণার ধর্ম। এই তিনটির মধ্যে একটি সত্তা দৃশ্যমান। বাকী দুইটি অদৃশ্য। এদিকে মহানক্সা নামের একটা বইতে স্টিফেন হকিং এবং লিওনার্দ ম্লদিনাও উপস্থাপন করেছেন নতুন কথা। তাদের মতে এই মহাজগতকে আমরা যত বড় বলে কল্পনা করি, এটা তার চেয়েও অনেক অনেক বড়। এরকম কোটি কোটি মহাবিশ্ব থাকতে পারে। সে কারণেই আমরা যে ধরনের পদার্থ দেখতে ও জানতে অভ্যস্ত তার চেয়ে একেবারে ভিন্ন রকম সত্তা বা পদার্থও থাকতে পারে। এমনকি পদার্থের প্রকৃতি ও ধর্ম ভিন্ন হতে পারে। আমাদের এই বিশ্বে বা জগতে পদার্থ যে রকম আচরণ করে এই উল্লেখিত অন্য পদার্থগুলো অন্য রকম আচরণ করতে পারে। তাহলে এই দৃশ্যমান জগতের অন্তরালে অদৃশ্যভাবে, শক্তি হিসেবে বা এক ধরণের আদেশ হিসেবে একটা সত্তা নিহিত থাকা অসম্ভব নয়।
প্রাণ ডিএনএ চক্র বা উপ পারমাণবিক কণার মতো একটি চক্রক আবর্তে পরিবর্তিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। ধরুন , আমরা যে এক গ্লাস পানি পান করছি এতে করে আমরা অক্সিজেন ও হাইড্রোজেনের বিলিয়ন বিলিয়ন কণাকে নিজের শরীরে আত্মীকরন করছি। হয়তো সে পরমাণুগুলো কিছুদিন আগে অন্য কোন দেহে, মাটিতে, পানিতে বা পদার্থে আবদ্ধ ছিল। আবার কিছুদিন না হতেই তা আবার আমার শরীর হতে বের হয়ে যাবে। এভাবে জীবনের- জগতের নিয়ত প্রত্যাবর্তনরত পারমাণবিক কণার মুক্ত ক্রীড়ার নামই প্রাণ। প্রাণের/জীবনের প্রতিটি অণু পরমাণু অস্থায়ী, শুধু অদৃশ্য ক্রীড়াময় তৎপরতা, সে তৎপরতার আদেশ বিন্যাসই নির্ধারণ করে আমাদের জীবনের অতীত- বর্তমান- ভবিষ্যৎ।
মুসলিমদের কাছে আত্মা হলো এক বিশেষ আদেশ বা কমান্ড। যদিও রিচার্ড ডকিন স্রষ্টা এবং আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন না, তবু জগতে যে এক ধরনের নিয়মের শৃঙ্খলা আছে, সে বিষয়ে সন্দেহ রাখেন না। সে ক্ষেত্রে জীবন মাইক্রো থেকে ম্যাক্রো লেভেলে মহাজাগতিক এক নিয়মের অধীনে বিশেষ ছকে আদেশ পালন করে চলছে বলা যায়। তাই মানুষের মৃত্যু মানে ধ্বংস নয়, বিলোপ নয়, বরং এক ধরনের রূপান্তর।
চলবে......
.............................................................
জন্মিলে মরতে হয়। এটি জগতের নিয়ম। সাধারণত কোন ঘটনা ব্যতিক্রম ছাড়া বারবার একইভাবে ঘটলে তাকে আমরা নিয়ম বলি। জীবনের অবসানে মৃত্যু আছে, কেবল নিয়মের মৃত্যু নেই। সেজন্য এর নাম নিয়ম, মানে 'নি+য়ম', অর্থাৎ যম নেই যার। যেমন মেঘ থেকে বৃষ্টি হয়, এটি নিয়ম। যদি বলি বাতাস থেকে বৃষ্টি হয়, এটি অনিয়ম। বাতাস থেকে বৃষ্টি হয় না। তবে বাতাসে জলীয়বাষ্পের পরিমাণ বেড়ে গেলে হাল্কা বৃষ্টির মতোই গায়ে পানি লাগতে পারে, আর্দ্রতায় সিক্ত হতে পারে ভূমি, যা কোনোভাবেই বৃষ্টি পদবাচ্য নয়। মৃত্যুতে জীবনের সমাপ্তি ঘটে, নাকি জীবনের পরিবর্তন ঘটে, কিংবা জীবনাদলের বদল ঘটে, সেটি এখনো অমীমাংসিত তর্ক । তবে , জন্মকে মানুষ উদযাপন করে সানন্দে; মৃত্যুতে বিহ্বল হয়, বেদনায় মুষড়ে পড়ে। জন্মে আশাবাদ থাকে, মৃত্যুতে থাকে বেদনা, বড়জোর অন্যের সমবেদনা। মৃত্যুতে মানুষ উল্লাসও প্রকাশ করে, তবে তা ইতিবাচক অর্থে নয়, নেতিবাচক অর্থে। বিশেষ কোন শত্রুর মৃত্যুতে মানুষ স্বস্তি প্রকাশ করে, ক্রুরতায়, তীব্র আবেগে উল্লাস প্রকাশ করে।
যারই জীবন আছে, তার জীবনের নিজস্ব হিসেব আছে। কখনো দিন, মাস বা বছর মেপে, কখনোবা জীবনের কীর্তি মেপে জীবনের পরিমাপ করা হয়। অনন্ত সময়ের তুলনায় ক্ষণিকের জীবন নিতান্তই তুচ্ছ অথচ মানুষের কাছে কত মূল্যবান! জীবনকালের ব্যাপ্তি এবং কীর্তির পরিমাণের মধ্যে এক ধরনের সহযোগ আছে। তাইবলে দীর্ঘ জীবন পেলেই জীবন সার্থক হবে এমন ভাবা সমীচীন নয়। অনেক সময় ক্ষণজন্মা ও ক্ষণজীবী মানুষ কীর্তিতে মহীয়ান হয়ে কালান্তরে পদচিহ্ন রেখে যায়। তবে বাঁচতে চাওয়াটাই যে কোন প্রাণীর সাধারণ প্রবণতা, যে কারণে স্রেফ বেঁচে থাকাটাও অনেক সময় সার্থকতা বলে বিবেচিত হয়।
সাধারণত তিন ধরনের মানুষকে পৃথিবীতে বেশিদিন বাঁচতে দেখা যায়, নিরেট ধার্মিক, অতিনিয়মনিষ্ট মানুষ, অতিখারাপ মানুষ। এই তিন ধরনের মানুষের মধ্যে বাঁচার তীব্র আকাঙ্ক্ষা থাকে। ফরাসি দার্শনিক হেনরি বার্গসোঁর প্রস্তাবিত 'ইলান ভাইটাল' বা ‘জীবনশক্তির প্রবাহ’ তাদের তীব্র। দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে সক্রাতেস থেকে জীবন এবং মৃত্যুর আলোচনা শুরু করতে হয়। গ্রীক দার্শনিকদের মধ্যে প্লাতো, তারও আগে সক্রাতেস, জীবনকে শরীর ও আত্মার সমষ্টি বলে ভাবতেন। প্লাতোর আকারবাদি দর্শনে আত্মা জীবনসত্তার একটি আকার হিসেবে ধরা দেয়, যেখানে শরীরি অবয়ব জীবনের বস্তুগত আকার বলে স্বীকৃত। মৃত্যুতে শারীরিক অবয়বের বিলোপ ঘটলেও আত্মার লয় ঘটে না বলে তার বিশ্বাস। প্লাতোর সংলাপ ফায়ডোতে আমরা সক্রাতেসের জবানীতে মৃত্যুর পূর্বমুহুর্তে সক্রাতেসের মৃত্যুভাবনার সাথে পরিচিত হই। মৃত্যুকে সক্রাতেস তিন দিক থেকে দেখেছেন। তত্ত্ববিষয়ক অঞ্চলে মানুষের অস্তিমানতা হিসেবে, মনস্তাত্ত্বিক জায়গা থেকে এবং জ্ঞানতাত্ত্বিক পর্যালোচনার আলোকে। তার কাছে মৃত্যু হচ্ছে শরীর হতে আত্মার বিচ্ছেদ। মৃত্যু হচ্ছে ঈশ্বরের সাথে, পরমসত্তার সাথে মিলিত হওয়ার সুযোগ। শরীরী ইন্দ্রীয় দিয়ে মানুষ প্রকৃত সত্তাকে জানতে পারে না। কারণ,ভুল ইন্দ্রীয়উপাত্ত দিয়ে শরীর মানুষের মনকে, আত্মাকে বিভ্রান্ত করে। ইন্দ্রীয়ের মাধ্যমে জীবনে যে সুখ আমরা উপভোগ করি, তা মিথ্যা, বড়জোর আপাত সত্য। ইন্দ্রীয়সমূহের বিশেষ গঠন, স্থান-কালের বিশেষ ছাঁচে মাপা সংবেদনের কারণেই আমাদের কাছে তা সুখ বলে অনুভূত হয়। মৃত্যু মানুষকে মিথ্যা অনুভূতিজাত এই ধরনের ভুল জ্ঞান হতে মুক্তি দেয়। ইন্দ্রীয় উপাত্তের ভ্রান্তি থেকে মুক্তি পেয়েই মানুষ জ্ঞানতাত্ত্বিকভাবে পরিপক্বতা লাভ করে। শরীর শুধু ভুল উপাত্ত দিয়েই মানুষকে বিভ্রান্ত করে না, মনস্তাত্ত্বিকভাবে আকাঙ্ক্ষা, কামনা, ভীতি ও মোহ তৈরির মাধ্যমে সত্য হতে দূরে রাখে বা সত্যোপলব্দি হতে নিবৃত রাখে। তাই বিশুদ্ধ জ্ঞান পেতে হলে শরীরের প্রভাব হতে আত্মাকে মুক্ত রাখতে হবে। দর্শন হচ্ছে বিশুদ্ধ জ্ঞানের চর্চার মাধ্যমে সদগুণ অর্জনের প্রয়াস। তাই দর্শন এক ধরনের মৃত্যুর প্রশিক্ষণ, এই অর্থে যে, দর্শন মানুষকে শরীর বা ইন্দ্রীয় প্রভাবিত ভ্রান্ত জ্ঞান হতে মুক্ত থাকতে সাহায্য করে। একজন দার্শনিকের জ্ঞান সেইদিনই পূর্ণতা পায়, যেদিন তিনি মারা যান। সক্রাতেসের জবানিতে কিংবা প্লাতোর চিন্তায় মৃত্যুভীতি থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় শনাক্ত করা যায়, তা হলো সদগুণ অর্জন করা, আর সদগুণ অর্জন করার পূর্ব শর্ত হলো দার্শনিক হওয়া বা জ্ঞানপ্রেমি হওয়া, সত্যমগ্ন হওয়া। তাই সক্রাতেসের মতে, দার্শনিকের মৃত্যুভীতি নেই।
জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট প্লাতোর এই যুক্তি গ্রহণ করেন নি, এই জন্য যে, অন্য প্রাণীদের তুলনায় মানুষের সংবেদের পার্থক্য আছে। মানুষ ইন্দ্রীয়োপাত্তের ভিত্তিতে ধারণা তৈরি করে এবং একাধিক ধারণার ভিত্তিতে বাচনিক অনুমান গঠনে সক্ষম। যেহেতু মানুষ আত্মসচেতন প্রাণী, সেহেতু মানুষ নিজের আবেগ, আকাঙ্ক্ষা, ইন্দ্রীয়জ প্রভাব বা ঝোঁক এবং সংস্কার হতে নিজের চেতনাকে নিরাপদ দূরত্বে রেখে বিশুদ্ধ চিন্তার মাধ্যমে ঘটনার আবেগনিরপেক্ষ পর্যালোচনা করতে সক্ষম। এদিকে, মানুষের আত্মসচেতনতা সম্পর্কিত কান্টের এই মূল্যায়নকে হেগেল দ্বান্ধিকতার সাথে যুক্ত করে মৃত্যু মোকাবেলার কৌশল বাতলে দিয়েছেন। হেগেলের কাছে জীবন হলো, চক্রকভাবে গতিশীল এক অসীম ও অনির্দিষ্ট ঐকিক প্রক্রিয়া, যেখানে জীবন্ত বস্তুসমূহ আসা-যাওয়ার খেলায় একে অপরের মধ্যে বিলীন হয়। জীবনের সামগ্রিক স্থিরতার অন্তরালে নিহিত বৈচিত্র্য ও পার্থক্যের কারণে এক গতিশীল চপল অস্থিরতা কাজ করে, যা ব্যক্তিঅস্তিত্বের সীমা ছাড়িয়ে জীবনকে একটি পুনরুৎপাদনকারি ও অপরাপর অস্তিমান সত্তা গ্রহনকারি প্রক্রিয়াতে পর্যবসিত করে। ব্যক্তিসত্তার অধিবলয়ে জীবন এক ব্যক্তি হতে অপরাপর ব্যক্তিসত্তা বা বস্তুসত্তাকে উৎপাদন করে চলেছে। তাই সত্তাকে টিকিয়ে রাখতে হলে অপর সত্তায় বিলীন হওয়া বা অপর সত্তাকে নিজের মধ্যে আত্মীকরণ রোধ করা বাঞ্ছনীয়। বিষয়টিকে স্পষ্ট করার জন্য আমরা একটা দুর্বাঘাসের উদাহরণ টানতে পারি, যে ঘাস মাটি হতে পানি ও অন্যান্য রাসায়নিক উপাদান, সুর্য হতে তাপ এবং বাতাস হতে কার্বণ ডাই অক্সাইডকে নিজের মধ্যে আত্মীকরণ করছে। অন্যদিকে একটি ছাগল যখন এই দুর্বাঘাসকে ভক্ষণ করে তখন ঘাসের সত্তা ছাগলের মধ্যে বিলীন হয়ে যাচ্ছে এবং ঐ ছাগলের দুধ যখন কোন ব্যক্তি পান করে তখন ঐ ব্যক্তির মধ্যে ছাগলের সত্তা, যার মধ্যে দুর্বাঘাসের সত্তা বিদ্যমান, যুক্ত হচ্ছে। হেগেল জীবনকে একটি প্রবহমান তরল অবস্থা হিসেবেই দেখেছেন............
স্লাভোজ জিজেকের মতো অনেকেই মৃত্যুর পরে জীবন আছে কিনা সেটা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এবং উত্তরে পাল্টা প্রশ্ন রাখেন, মৃত্যুর আগেরটাকে জীবন বলা যাবে কিনা? অর্থাৎ আমরা সব সময় মৃত্যুর পরের জীবন নিয়ে অনুসন্ধান চালাই কিন্তু মৃত্যুর আগের সময়টাকে জীবন বলা যাবে কিনা সে বিষয়ে সিরিয়াসভাবে ভাবি না। আরভিন শ্রোয়েডিংগার এবং ক্রেইগ ভ্যানটার জীবনের প্রধান প্রাণসত্তা নিয়ে যে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান চালিয়েছেন তা দিয়েই জীবন সম্পর্কে আমাদের প্রাথমিক পাঠ শুরু হতে পারে। আমরা যেটাকে বলি শরীর, তা অনেকগুলো অঙ্গ, তন্ত্র, কলা ও কোষ দ্বারা তৈরি। শরীরের এই সমস্ত উপাদান যখন সচল থাকে, সক্ষম থাকে, তাকে আমরা প্রাণ বলি। কিন্তু প্রাণ হচ্ছে একটি গতিশীল পুনরাবৃত্তিমূলক প্রক্রিয়া। অর্থাৎ আমাদের শরীরে প্রতিমুহূর্তে কোষের ভাঙ্গাগড়া চলছে। অপচিতি ও উপচিতি ঘটছে। এতেকরে ডিএনএ ছাড়া কোষগুলো খুব দ্রুত মরে যায়। প্রতিদিন আমাদের শরীরের ত্বক থেকেই অন্তত পাঁচশত মিলিয়ন মরা কোষ ঝরে পড়ে। প্রতি দশটি রক্ত কণিকার মধ্যে পাঁচটি প্রতিদিনই মারা যায়। এ থেকে বুঝা যায় একইভাবে নতুন কোষ তৈরি না হলে আমরা মারা যাব। কথা হচ্ছে স্বাভাবিক কোষ কিভাবে মারা যায় আর নতুন কোষইবা কীভাবে তৈরি হয় তা না বুঝলে এই মেটাবোলিজম স্পষ্ট হবে না। স্বাভাবিকভাবে কোষের মরণ একটি বহুমুখী জটিল প্রক্রিয়া। গ্রীক ভাষায় এটাকে ‘’এপথসিস’’ বলা হয় যার মানে হল গাছের/ ফুলের পাপড়ি বা পাতা ঝরে যাওয়া। এই প্রক্রিয়াটাও বিভিন্নভাবে সম্পন্ন হয়ে থাকে। তবে মোটাদাগে বলা যায়, প্রথমে কোষের নিউক্লিয়াস ঘনীভূত হয়, কোষ কুঁচকে যায়, সাইটোপ্লাসম ঘনীভূত হয়, ডিএনএ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়,শেষে নিউক্লিয়াস কিছু বিচ্ছিন্ন ক্রোমাটিন বা নিউক্লিওসমাল ইউনিটে বিভক্ত হয়ে কোষের মৃত্যু ঘটে। পুরো প্রক্রিয়াটাকে কিছু জৈবরাসায়নিক পরিবর্তন হিসেবে সনাক্ত করা যায়। অন্যদিকে কোষ তৈরি হয় কোষ বিভাজনের মাধ্যমে।একটি কোষ দুইভাবে বিভক্ত হয়ে নতুন কোষ তৈরি হয়। ঠিক বিভাজনের আগে কোষে যে তেইশ জোড়া ক্রোমোজোম থাকে তাতে ছয় হাজার মিলিয়নের মত ডিএনএ কোড কপি হয়ে যায়। ডিএনএ হল প্রোটিন তৈরির নির্দেশনা। ফলে প্রত্যেকটি নতুন কোষে সমপরিমান ডিএনএ কোড বরাদ্দ হয়ে যায়। এই যে কোষের বৃদ্ধি এবং মৃত্যু তা একটি চক্রক প্রক্রিয়া, যা ঐ প্রক্রিয়াতেই উৎপন্ন হওয়া এক ধরনের প্রোটিন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এই প্রোটিন হল শৃঙ্খল আকারে যুক্ত এমাইনো এসিডের ব্লক। প্রাণ কী বুঝাতে গিয়ে আমি যে জৈব-রাসায়নিক আলোচনার সূত্রপাত করলাম তার কারণ আমরা জীবন শুরু করেছি একটি একক কোষ হিসেবে। বাবা থেকে অর্ধেক আর মা থেকে অর্ধেক জীন নিয়ে। জীনের মুল উপাদান হল ডিএনএ। সে কারণে আমাদের শরীরের পুরো পরিকল্পনা নির্দেশনা আকারে লিপিবদ্ধ আছে এই জীনে।
এবার প্রাণ সম্পর্কে বিভিন্ন চিন্তাবিদদের প্রামাণ্য তৎপরতার হদিস নেয়া যাক। ১৯৪৩ সালে ডাবলিনের ট্রিনিটি কলেজে আরভিন শ্রোয়েডিংগার ‘’প্রাণ কী’’ শিরোনামে একটি ভাষণ দেন। ঐ ভাষণে তিনি খুব দূরদর্শী কিছু ধারণা ব্যক্ত করেন। তিনি ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন যে, জীবন্ত কোষের রাসায়নিক কাঠামোতে বংশগত তথ্য, কোড আকারে লুকায়িত থাকতে পারে। তার সে ইঙ্গিত দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ক্রিক এবং ওয়াটসন ১৯৫৩ সালে ডিএনএ কাঠামো আবিষ্কার করেন। বিজ্ঞানী শ্রোয়েডিঙ্গারের সত্তর বছরেরও পরে একই শিরোনামে ২০১২ সালের ১২ জুলাই ট্রিনিটি কলেজের পরীক্ষা কেন্দ্রে ক্রেইগ ভ্যানটার একটি ভাষণ দেন। তিনি বলেন, এখন ডিএনএর জেনেটিক কোড পাঠ করা সম্ভব। প্রোটিন সংশ্লেষের মাধ্যমে নতুন ডিএনএ কোড লেখাও সম্ভব। শুধু তাই নয় পুরো জীন তৈরি করে নতুন কোষে পুরে দেয়াও সম্ভব। এর তাৎপর্য কী দাঁড়াল ? জীবন শুরুর যে মৌলিক উপাদান কোষ, কৃত্রিমভাবে তা তৈরি করা সম্ভব বলে জানা গেলো। ক্রেইগ বলেন, আমরা এখন জীববিজ্ঞানের ডিজিটাল যুগে আছি। অর্থাৎ কম্পিউটারের সফটওয়্যার ও প্রোগ্রামিং যেরকম ডিজিটাল কম্যান্ড ১ ও ০ দ্বারা লেখা সম্ভব, ডিএনএ কোডও সে রকম ডিজিটাল কম্যান্ড দ্বারা লেখা সম্ভব হবে। শ্রোয়েডিঙ্গার বলেছিলেন প্রাণ হচ্ছে এক ধরনের কোড, আর ক্রেইগ ভ্যানটার এসে বলছেন প্রাণ হচ্ছে ডিজিটাল কোড। পিথাগোরাসের কথার একটা প্রতিধ্বনি যেন আধুনিক যুগে ফিরে আসল।
১৯৪৯ সালে ফ্রেড স্যাঙ্গার যখন ইনসুলিন নামক প্রোটিন এর এমাইনো এসিড কোডের ধারা বিন্যাস আবিস্কার করেন, তখন এটা অনেকটা পরিস্কার হয়েছিল যে ডিএনএ এর কপি তৈরি করা সম্ভব এবং তা প্যাঁচানো দ্বৈত কয়েলের মতোই। ১৯৬১ সালে গোবিন্দ খোরানা এবং মার্শাল নিরেনবার্গ তিন বর্ণবিশিষ্ট রৈখিক জেনেটিক কোড আবিষ্কার করেন, যেখানে প্রতিটি বর্ণ একেকটি এমাইনো এসিডের আদ্যাক্ষর হিসেবে বিবেচিত।১৯৭০ সালে হ্যাম স্মিথ রেস্ট্রিকশন এনজাইম আবিস্কার করেন। এটা আণুবীক্ষণিক কাঁচির ভূমিকা পালন করে, যার সাহায্যে আণুবীক্ষণিক পর্যায়ের জৈবপ্রযুক্তিতে বিপ্লব সাধিত হয়। ১৯৭৫ সালে ভ্যানটার যখন পিএইচডি গবেষণায় লিপ্ত তখন ডিএনএকে তিনিও এনালগ কোড হিসেবে ভাবতেন। কিন্তু যেই না ডিএনএর ধারাক্রম তৈরি সম্ভব হল, এই ডিএনএ কোডকে ডিজিটাল কোডে রূপান্তর করার কথা মাথায় আসে। সম্প্রতি একটি কোষের গাণিতিক মডেলিং করা সম্ভব হয়েছে। সেভাবে চলতে থাকলে কম্পিউটারে একটি কোষের সামগ্রিক নির্দেশনা, বিন্যাস, ইতিহাস এবং কোষের কার্যপরিধিরও মডেলিং করা সম্ভব হবে। তাই এই জগতে বেঁচে থাকা সমস্ত কোষকে ডিএনএ সফটওয়্যার দ্বারা পরিচালিত জৈব যন্ত্র হিসেবে দেখা হচ্ছে। এভাবে যদি প্রাণকে ডিজিটাল সংকেত ও আদেশে রূপান্তর করা যায় তাহলে হয়তো একদিন ডিজিটাল জগত থেকেই প্রাণ তৈরি করা সম্ভব হবে। ডিএনএ কোড বদলে যদি নতুন প্রজাতি তৈরি সম্ভব হয়, তাহলে নতুন ধরনের জীবও তৈরি সম্ভব হবে।
এতক্ষণ আমরা জৈবরাসায়নিক ব্যাখ্যা ও জৈব প্রযুক্তির পরিসীমায় প্রাণের স্বরূপ উপলব্দির চেষ্টা করেছি। ইদানিং পদার্থ বিজ্ঞানের নতুন আবিষ্কার আমাদের চারপাশের জগত সম্পর্কে নতুন ব্যাখ্যা হাজির করেছে। এটাও প্রাণকে ব্যাখ্যা করার জন্য সমান গুরুত্বপূর্ণ। যারা নাস্তিক তাদের একটা গোঁড়া অবস্থান আছে যে, যা আমরা দেখিনা তার অস্তিত্ব নেই। কিন্তু পদার্থ বিজ্ঞানীরা বলছেন, পদার্থের স্বরূপ আমরা পুরোটা দেখিনা। কারণ, পদার্থের অণু, পরমাণু ও উপপারমাণবিক কণাগুলোর মধ্যে তিন ধরনের জিনিষ থাকে। একটা হল পদার্থিক বস্তুগত সত্তা, একটি শক্তিসত্তা এবং অপরটি কণার ধর্ম। এই তিনটির মধ্যে একটি সত্তা দৃশ্যমান। বাকী দুইটি অদৃশ্য। এদিকে মহানক্সা নামের একটা বইতে স্টিফেন হকিং এবং লিওনার্দ ম্লদিনাও উপস্থাপন করেছেন নতুন কথা। তাদের মতে এই মহাজগতকে আমরা যত বড় বলে কল্পনা করি, এটা তার চেয়েও অনেক অনেক বড়। এরকম কোটি কোটি মহাবিশ্ব থাকতে পারে। সে কারণেই আমরা যে ধরনের পদার্থ দেখতে ও জানতে অভ্যস্ত তার চেয়ে একেবারে ভিন্ন রকম সত্তা বা পদার্থও থাকতে পারে। এমনকি পদার্থের প্রকৃতি ও ধর্ম ভিন্ন হতে পারে। আমাদের এই বিশ্বে বা জগতে পদার্থ যে রকম আচরণ করে এই উল্লেখিত অন্য পদার্থগুলো অন্য রকম আচরণ করতে পারে। তাহলে এই দৃশ্যমান জগতের অন্তরালে অদৃশ্যভাবে, শক্তি হিসেবে বা এক ধরণের আদেশ হিসেবে একটা সত্তা নিহিত থাকা অসম্ভব নয়।
প্রাণ ডিএনএ চক্র বা উপ পারমাণবিক কণার মতো একটি চক্রক আবর্তে পরিবর্তিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। ধরুন , আমরা যে এক গ্লাস পানি পান করছি এতে করে আমরা অক্সিজেন ও হাইড্রোজেনের বিলিয়ন বিলিয়ন কণাকে নিজের শরীরে আত্মীকরন করছি। হয়তো সে পরমাণুগুলো কিছুদিন আগে অন্য কোন দেহে, মাটিতে, পানিতে বা পদার্থে আবদ্ধ ছিল। আবার কিছুদিন না হতেই তা আবার আমার শরীর হতে বের হয়ে যাবে। এভাবে জীবনের- জগতের নিয়ত প্রত্যাবর্তনরত পারমাণবিক কণার মুক্ত ক্রীড়ার নামই প্রাণ। প্রাণের/জীবনের প্রতিটি অণু পরমাণু অস্থায়ী, শুধু অদৃশ্য ক্রীড়াময় তৎপরতা, সে তৎপরতার আদেশ বিন্যাসই নির্ধারণ করে আমাদের জীবনের অতীত- বর্তমান- ভবিষ্যৎ।
মুসলিমদের কাছে আত্মা হলো এক বিশেষ আদেশ বা কমান্ড। যদিও রিচার্ড ডকিন স্রষ্টা এবং আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন না, তবু জগতে যে এক ধরনের নিয়মের শৃঙ্খলা আছে, সে বিষয়ে সন্দেহ রাখেন না। সে ক্ষেত্রে জীবন মাইক্রো থেকে ম্যাক্রো লেভেলে মহাজাগতিক এক নিয়মের অধীনে বিশেষ ছকে আদেশ পালন করে চলছে বলা যায়। তাই মানুষের মৃত্যু মানে ধ্বংস নয়, বিলোপ নয়, বরং এক ধরনের রূপান্তর।
চলবে......
Comments