Skip to main content

মানবতাবাদের পুনর্বিচার



মানবতাবাদের পুনর্বিচার
সরওয়ার কামাল
Man is the measure of all things - Protagoras.
সবার ওপরে মানুষ সত্য, তাহার ওপরে নাই- বড়ো চণ্ডীদাস। 

সবার ওপরে মানুষ সত্য তাহার ওপরে নাই- বলে কথিত আপ্তবাক্যটি যখন বারবার বাংলাভাষী মানুষকে শুনিয়ে বিভ্রান্ত করা হয়, তখন মানবিকতা ও মানবতাবাদের ফারাকের বিষয়টি জানা কিংবা জানিয়ে দেয়া অনিবার্য হয়ে পড়েছেমানবতাবাদকে কতটা নির্দোষ মনে করা হলে বা গৌরবজনক মনে করা হলে এই অচল তত্ত্ব একচেটিয়াভাবে আমাদের বুদ্ধিবৃত্তির জায়গা দখল করে থাকে, তা সহজে অনুমেয়। নিজেদের ইতিহাস বিস্মৃত হয়ে, বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্যকে পাশ কেটে তথাকথিত বাজার কাটতি লোকপ্রিয় মতবাদের প্রতি নির্বিচার আসক্তির কারণে, মানবতাবাদ এবং মানবতাবাদি জীবনদর্শনকে মানবপ্রেম ও মানবিকতার জায়গায় প্রতিস্থাপিত করে এবং য়ুরোপীয় দীপায়নকালের কিছু গুদামপচা রাজনৈতিক শ্লোগানকে পাইকারি হারে  আমাদের জ্ঞানগরীব জনপরিমণ্ডলে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। মাঝে মধ্যেই কিছু বীভৎস দুর্ঘটনা দ্বারা আমাদের মানবিক বোধ ও বিবেকের পাতলা আবরণে (মেম্ব্রেন) যখন কড়া ধাক্কা লাগে তখন আমাদের সংবেদনশীল কোমল বিবেক নিদারুনভাবে বিদীর্ণ হয়, অনেকটা কমলালেবুর কোয়ার আবরণের মতো করে ফেটে যায়। তখন কোন দাওয়াই আমাদের এই বিবেকের ক্ষত সারাতে সক্ষম হয়না শুধু ফাটা বিবেকের সারবত্তাটাই কেবল তরল আকারে উপচে পড়ে এবং এই পর্যায়ে এসে আহাজারি করতে করতে, ঠেকে ও ঠকে আমরা বুঝি যে মানবিকতাআলাদা জিনিস। তুর্কী সৈকতে পড়ে থাকা শিশু, আলান কুর্দির লাশ দেখে যখন মানুষের বিবেকে প্রবল ধাক্কা লাগে, বিশ্বের মালিকানা নিয়ে, সম্পদের মালিকানা নিয়ে, কৃত্রিম সীমানা নিয়ে সংঘাত ও কৃত্রিম বিধি কিংবা প্রতিষ্ঠানের দোহাই দিয়ে মানুষের অকৃত্রিম জীবনকে নিঃশেষ করে দেয়ার মানবিক টানাপড়েনে যখন মানুষ হাবুডুবু খায়, তখন মানবিকতা ও মানবতাবাদের দার্শনিক সীমানা নিয়েও নতুন ভাবান্তর প্রয়োজন। মানবিকতা ও মানবতাবাদের ভিন্ন দ্যোতকতা স্পষ্ট করা জরুরি মনে করি, তাই মানবতাবাদের সমকালীন প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে একটি যৌক্তিক বিশ্লেষণ হাজির করার মানসে এই নিবন্ধের অবতারণা। কাজেই মানবিক ঝোঁক ও মানবতাবাদের নানা ধরণ নিয়ে আলোচনা সেরে দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে এর একটি পর্যালোচনা দাঁড় করানোর প্রয়াস চালাচ্ছি।   
      
সাধারণ মানুষতো বটেই, বিদ্বজ্জনেরাও অনেক সময় মানবিকতা ও মানবতাবাদকে এক করে দেখেন। কারণ, মানুষি চেতনার অভিন্ন বলয়ে মানবিকতা ও মানবতাবাদের মতাদর্শিক ভারকেন্দ্র থাকায়, অনেক সময় পরস্পরাঙ্গী অঞ্চলে এই দুই বোধের জড়াজড়ি চলে। ফলে আমরা বুঝে ওঠতে পারি না আসলে কোনটা দ্বারা কী বোঝায়। মানবিকতা ও মানবতাবাদের সাধারণ অন্তর্প্রবিষ্ট অঞ্চল থাকার কারণে সরল দৃষ্টিকোণ থেকে মানবিকতা ও মানবতাবতাবাদকে এক করে দেখার পিচ্ছিল পথ তৈরি হয়েছে। মানুষ সমাজে বাস করে। সামাজিক প্রাণী হিসেবে পার্থিব জীবনে মানুষের প্রতি মানুষের টান আছে,  পারস্পরিক সহযোগিতার প্রবণতা আছে সাধারণ স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য মানুষের মধ্যে যূথবদ্ধ প্রয়াস আছে  মূলত মানবপ্রেম ও মানবপ্রীতি হচ্ছে মানুষের স্বভাব, যেখানে ভাব মানে আছে, আর স্বভাব মানে যা নিজের মধ্যে আছে। কাজেই মানুষের মধ্যে নিজেদের প্রতি নিজেদের  প্রীতিবোধ, কল্যাণবোধ ও মমত্ববোধ ইত্যাদি চেতনা ও প্রবণতা আছে। মানুষের প্রতি মানবিক আচরণের মনস্তাত্ত্বিক ঝোঁক ও সমস্ত সৃষ্টিকুলের প্রতি মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণের সহজাত প্রবৃত্তি মনুষ্যসত্তার মধ্যেই নিহিত। মানুষ যে পৃথিবীতে মানুষ হিসেবে টিকে আছে, এর মধ্যে এক ধরণের সচেতন প্রয়াস আছে। মানুষ মানুষ হতে চায়, মানুষরূপে বাঁচতে চায়। এই যে বাঁচার আকুতি, এটা একটি মানবিক আকুতি। একইভাবে মানুষ মানুষকে বাঁচাতেও চায়। এজন্য সে মানুষের বিপদে, দুর্বিপাকে এগিয়ে আসে। এটা মানুষের প্রতি মানুষের মানবিক সাড়া, যাকে আমরা মানবতা বলি। মানবতা মানুষের এক ধরণের সহজ বৈশিষ্ট্য। সহজ অর্থ যদি ধরি, মানুষের সাথে জন্মেছে যা, তাহলে বলতে হবে মানুষ মানবতা নিয়েই জন্মে। কিন্তু পৃথিবীতে আসার পর বা জন্মের পর মানুষ যখন তার ইন্দ্রীয় সম্পর্কে সচেতন হয়, ইন্দ্রীয়উপাত্ত নির্ভর প্রত্যক্ষণ দ্বারা চারপাশকে জানতে শিখে,তখন সে সহজ বোধ ও আগন্তুক বোধের দ্বান্ধিক বিরোধের মধ্যে পড়ে যায়। তখন সে নিশ্চয়তা চায়, নিজের অস্থিত্বের, চেতনার, সংবেদনের এবং প্রত্যক্ষণজনিত জ্ঞানের। আপাত প্রমাণের ভিত্তিতে, খণ্ডিত স্থান-কালের প্রত্যক্ষণকে মানুষ সত্য হিসেবে ধরে নেয়।এই ধরণের একটি বিশ্বাসের জোরে মানুষ ঘোষণা করতে শুরু করে, সত্য তা, যা মানুষের প্রত্যক্ষণে ধরা দেয়। মানুষের কাছে যা সত্য বলে প্রতিভাত হবে, তাই সত্য। ফলে জ্ঞানতাত্ত্বিকভাবে মানবকেন্দ্রিকতার নাম দাঁড়ায় মানবতাবাদ। মানবতা যদি হয় মানুষের অন্তরঙ্গ, মানবতাবাদ হচ্ছে বহিরঙ্গ; একটি সহজ, আরেকটি আগন্তুক বা নির্মিত। এই ধরণের মানবতাবাদের একটি আদিকল্প হচ্ছে ম্যান ইজ দ্য ম্যাজার অব অল থিংস, যেটা প্রোটাগোরাসের ( খ্রি পূর্ব ৪৯০-৪২০) ঘোষণা আকারে বহুলভাবে প্রচারিত। 

বিজ্ঞান কিংবা ইতিহাস একটি বিশেষ আদিকল্পকে ঘিরে দাঁড়ায়, পরে নতুন প্রশ্ন,  উপাত্ত, তথ্য ও তত্ত্বের প্রায়োগিক কৌশলের সম্মিলনে নবতর জবাব হাজির করার মাধ্যমে সামনের দিকে এগোয়, কখনো পাল্টা প্রতিকল্প সৃষ্টি করার মাধ্যমে স্থানিক ও কালিক ব্যাপ্তিতে বিস্তার লাভ করে। এ ভাবেই মানবিকতা ও মানবতাবাদ পরস্পরের আদিকল্প ও প্রতিকল্প আকারে ইতিহাস জুড়ে অগ্রসর হয়েছে। কখনো দর্শন, কখনো ধর্ম ও কখনো বিজ্ঞানের মোড়কে তা সভ্যতার ভবিতব্য হিসেবে আমাদের সামনে পরিবেশিত হয়েছে।  
 
এদিকে মতবাদ হিসেবে যে মানবতাবাদ প্রতিষ্ঠা পেয়েছে তারও আছে রকমফের। বিশ্বসভ্যতার ইতিহাসে অন্ততঃ পাঁচ প্রকার মানবতাবাদ শনাক্ত করা যায় চীনের লাও জো (৬০০খ্রি পূর্ব) ও কনফুসিয়াসের ( প্রকৃত নাম কং ফু জি , জন্ম-৫৫১ খ্রি পূর্ব ) মানবতাবাদ আর গ্রীক প্রোটাগোরাসের মানবতাবাদের পার্থক্য আছে। প্রথম দুজনের মানবতাবাদের মূল সুর মানবপ্রেম বা মানবিকতা, অন্যদিকে প্রোটাগোরাসের মানবতাবাদের ও য়ুরোপীয় দীপায়ন পরবর্তী মানবতাবাদের মূল সুর জ্ঞানতাত্ত্বিক নিশ্চয়তার ক্ষেত্রে মানুষের প্রাধান্য। মানবিকতা নির্ভর ইহজাগতিক মানবতাবাদ এবং প্রাচ্যের ধর্মীয় ভাবাদর্শ প্রভাবিত মানবতাবাদের অভিমূখ অভিন্ন। যার সাধারণ গন্তব্য মানবপ্রেম ও মানবকল্যাণ। মানবিকতা ও মানবতাবাদের মধ্যে স্পষ্ট ব্যবধান আছে। প্রথমটি মানুষের আচরণগত ও মনস্তাত্ত্বিক ঝোঁক নির্দেশ করে, শেষেরটি জ্ঞানতাত্ত্বিক বিচারের ক্ষেত্রে মানবকেন্দ্রিকতা ও মানবীয় প্রত্যক্ষণের নিশ্চয়তা নির্দেশ করে।

মানবকেন্দ্রিকতা
এছাড়া জ্ঞানের মালিকানা ও জ্ঞান-উৎপাদন ক্ষমতার প্রকাশ নিয়েও আছে যথেষ্ট বাহাস। ধর্ম দাবী করে যে মানুষ সত্য নয়, ইশ্বর সত্য। ইশ্বরের সত্যতা এবং জ্ঞানের সত্যতার ভিন্ন দ্যোতনা আছে। ইশ্বর সত্য মানে ইশ্বরের সৎগুণ আছে, অর্থাৎ ইশ্বর সৎ। আর সৎমানে থাকা, উপস্থিতি বা বিরাজমানতা। অতএব ইশ্বর সত্য এর মানে হল, ইশ্বর আছেন। ধর্মে জ্ঞানের মালিক মনে করা হয় ইশ্বরকে। ইশ্বরের কাছ থেকে মানুষ জ্ঞান লাভ করে। কিন্তু ইশ্বরের সাথে সম্পর্ক স্থাপন ব্যতিরেকে জ্ঞান হাসিল করা যায় না। ইশ্বরের সাথে সম্পর্কের অপর নাম ধর্ম। ফলে ইশ্বরের কাছ থেকে ধর্মের পথ ধরেই জ্ঞান আসে। এ দিকে গ্রিক প্রোটাগোরাসকে বাদ দিলে, য়ুরোপীয় আলোকপর্বের সময় এরাসমাসসহ অন্যান্য চিন্তানেতাদের ঘোষণাও এ রকম যে, জ্ঞানের মালিক ইশ্বর নন। মানুষ চাইলে জ্ঞানের মালিক হতে পারে। মানুষ নিজেই হতে পারে নিজের ভাল-মন্দ, ঔচিত্য-অনুচিত্যের নির্ধারক। নিজের ভাগ্য ও নিয়তির নির্মাতা। ইশ্বরমূখী জ্ঞানতাত্ত্বিকগণ মনে করেন জ্ঞান ইশ্বরের নির্দেশ, প্রত্যাদেশ অথবা ইশারা। ঐশ্বরিক ইঙ্গিতজাত, নিদর্শন নিঃসৃত, আত্মোপলব্ধি দ্বারা প্রাপ্ত নির্দেশনাই জ্ঞান। তাই ভাল-মন্দের, ঔচিত্য- অনুচিত্যের মাপকাঠি বিশেষ দেশ-কালে প্রাপ্ত প্রত্যক্ষণের আরোহ মূলক সিদ্ধান্ত হতে পারে না।   
  
মানবিকতা মানুষের সার্বক্ষণিক যাপিত জীবনের ভাল-মন্দের সাথে সংশ্লিষ্ট। মানুষকে বাঁচাতে হলে, মানুষের কল্যাণ করতে হলে মানবিকতা থাকা চাই। তাই মানবিকতা কাঙ্ক্ষিত, কিন্তু মানবতাবাদ বিতর্কিত, অগ্রহণযোগ্য এবং ক্ষেত্র বিশেষে মানবতাবাদঔদ্ধত্যমূলক মূঢ়তারই নামান্তর। মূঢ়তা বলছি এই জন্য যে, মানুষ যখন নিজেই ঘোষণা দেয় যে, সে সব সত্যের মাপকাঠি, তখন মানুষের আপেক্ষিক, খণ্ডিত, প্রত্যক্ষণ নির্ভর সত্যকে পরম সত্য মনে করার কারণে মানবতাবাদ কার্যত একটি গোঁড়া ও কট্টরপন্থী মতবাদে পর্যবসিত হয়। মানুষের সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান আরোহমূলক কিন্তু আগে থেকেই সবার ওপরে মানুষ সত্য, তাহার ওপরে নাই বললে তা অবরোহমূলক উপপাদ্যে পরিণত হয়। ব্যক্তি মানুষের অভিজ্ঞতার ওপর এ ধরণের উপপাদ্য প্রয়োগ করে সমস্ত প্রতিপাদ্য বিষয়ে যে সিদ্ধান্তই ( সবিচার/ নির্বিচার ) নিই না কেন, তা ভ্রান্তিপূর্ণ হতে বাধ্য। কারণ এক্ষেত্রে প্রধান আপ্তবাক্যটি যে সত্য তা যাচাই করার সুযোগ নাই। মানুষই সত্য, এরূপ দাবী করা আরও একাধিক কারণে অবৈধ। প্রথমত, মানুষই সত্য বলার মানে হচ্ছে, মানুষ যা জানে তা সত্য ও নিশ্চিত। সে ক্ষেত্রে মানুষের জ্ঞানের সত্যতা, নিশ্চয়তা ও বৈধতা কি তার স্বকীয়, নিজস্ব ও অন্তর্গত বিষয় নাকি মানুষের চেতনার বাইরে বাহ্যিক জগতের সাথে মানসচৈতন্যের সম্পর্কের ওপর নির্ভরকরে তা নির্ণয়ের প্রশ্ন আসে। ইউরোপীয় আলোকায়নের প্রধান জ্ঞানতাত্ত্বিক সবক হচ্ছে, জ্ঞান তৈরি হয়; বাইনারি পজিশনে, বিষয় ও বিষয়ীর, মন ও বস্তুর সম্পর্কের ভিত্তিতে জ্ঞান তৈরি হয়। অর্থাৎ মানুষ যা জানে তা এক ধরণের নির্মিতি, বহুপাক্ষিক, অন্ততপক্ষে দ্বিপাক্ষিক নির্মিতি। কাজেই মানুষ যখন নিজের চেতনার সাথে বাহ্যিক জিনিসের সম্পর্ককে একতরফাভাবে সত্য বলে ঘোষণা দেয়, তখন বাহ্যিক জিনিসকে বাহ্যিক জিনিসের পক্ষ থেকে বিচার করার অবকাশ থাকা সত্ত্বেও তা অগ্রাহ্যকৃত হয়ে পড়ে। অন্যদিকে মানুষের পক্ষ থেকে মানুষের নিজের বিশুদ্ধ চেতনাকে জানার বা সত্তার চেতনচিত্রকে জানার ( Phenomenology of spirit ) ব্যাপারটিও গৌণ হয়ে পড়ে। কারণ সে ক্ষেত্রে বাহ্যিক জগতের সম্পর্ক থেকে নিজের চেতন সত্তাকে আলাদা করা (Mereology ) প্রয়োজন হয়ে পড়ে। ফলে মানুষ যা জানে বলে দাবী করে, তা হলো মূলত নিজের চেতন সত্তায় বিম্বিত, নির্মিত, খণ্ডিত প্রত্যক্ষণের চেতন-চিত্র মাত্র। মানবতাবাদি জ্ঞানতত্ত্বের জায়গায় বিজ্ঞান নামক জ্ঞানকাণ্ডের ( যার গৌরবজনক আবিষ্কার ও প্রযুক্তির শনৈ শনৈ উন্নতি বর্ণনা করতে গেলে বিজ্ঞানীদেরও হুঁশ জ্ঞান থাকে না, তার ) ভিত্তিও যথেষ্ট দুর্বল। রেনে গুয়েনন, কার্ল পপার, থমাস কুন, পল ফেয়ারাবেন্ড বিজ্ঞানের পদ্ধতিগত সীমাবদ্ধতা ও ত্রুটির কথা জানিয়েছেন। বিজ্ঞান এ পর্যন্ত যা করেছে, তা হল ল অব দ্য নেইচারএর সাথে ল অব পারসেপশন এর যোগসূত্র স্থাপন করা। কাজেই প্রত্যক্ষণলব্ধ জ্ঞান দিয়ে প্রকৃতির ও অনন্ত সময়ের ওপর খবরদারি করা নিছক মূঢ়তা। এই ধরণের মূঢ়তা দ্বারা তাড়িত হয়ে আমরা নিজেদের আইনকে, বিধিকে আরোপ করে দিচ্ছি প্রকৃতির ওপর। ফলে প্রকৃতির সাথে আমাদের মহাজাগতিক শাসনগত বৈরিতা তৈরি হচ্ছে, তার একটি উল্লেখযোগ্য ও ছকবাঁধা ব্যর্থতা হচ্ছে একটি ভারসাম্যপূর্ণ বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তুলতে না পারা। বিশ্বব্যবস্থাকে স্রেফ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে না দেখে পৃথিবী নামক গ্রহের সমস্ত প্রাণ ও জড় উপাদানের প্রাকৃতিক ব্যবস্থাপনার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে প্রকৃতির নিয়মের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ সার্বিক ব্যবস্থা  দরকার। কিন্তু সবকিছুর ওপরে মানুষের স্বার্থকে স্থান দিতে গিয়ে পরিশেষে মানুষসহ সমগ্র সৃষ্টিকুলের অস্থিত্বকে আমরা বিপন্ন করে তুলেছি। তাই জ্ঞানতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে মানবতাবাদ অগ্রহণযোগ্য। বস্তুতঃ বিশ্বজুড়ে মানুষ ও সমস্ত প্রাণীদের ধ্বংসাত্মক পরিণতিও অনিষ্টের কারণ মানবতাবাদি জ্ঞানতত্ত্ব, মানুষের মানবতাবাদ প্রসূত দৃষ্টিভঙ্গি ও কাজ। অন্তত যুক্তির নিরিখে এবং ঐতিহাসিক বিচারের নিরিখে দেখলে এমনটাই প্রতীয়মান হয়। [ তবে মানবতাবাদ বিরোধী মতবাদও এক ধরণের মানবকেন্দ্রিক মতবাদ। কারণ মানুষকে বাদ দিয়ে মানুষের যুক্তির কথা চিন্তা করা যায় না। কিন্তু মানুষ ব্যতীত অন্যান্য প্রাণী ও বস্তুজগতের অন্তর্নিহিত যুক্তিকে হিসেবে নিলে মানতে হয় যে যুক্তির একটি মানব নিরপেক্ষ আকার আছে।] 

তাই আমাদের উচিত অন্ধভাবে মানবতাবাদি না হয়ে মানবিকতার চর্চা করা। মানবপ্রেম ও বিশ্বপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হওয়া। মানুষ সবার সেরা বলে অন্য প্রাণী ও পার্থিব কিংবা বৈশ্বিক উপাদানগুলো, যার ওপর মানুষ ও অপরাপর প্রাণীর অস্থিত্ব নির্ভর করে, তাকে অগুরুত্বপূর্ণ মনে না করে, আমাদের এমন প্রেমে মশগুল ও কর্মে শামিল হওয়া উচিত, যা দ্বারা আমরা বাঁচব, সবাই বাঁচবে, এবং পৃথিবীর সমস্ত প্রাণী ও অপ্রাণী  বাঁচবে

প্রত্যেক দার্শনিক মতবাদই তার নিজস্ব স্থান-কালে দানা বাঁধে। বাস্তবে তার প্রয়োগ, উপযোগিতা এবং বিশেষ ঘটনাকে ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে এর সামর্থ্য বিবেচনা করে ঐ মতবাদের যথার্থতা বিচার করা হয়অনাগতকালে তার প্রাসঙ্গিকতা কতটুকু তা হিসেব করে, জ্ঞানকাণ্ডের তুলনামূলক বিচারে তা অনুধাবন করে,

কান্ট ও হেগেল
কান্ট যখন মানুষের নৈতিক স্বাধীনতার কথা পাড়েন, তখন মানুষের নৈতিক আদর্শের কেন্দ্রবিন্দুতে স্বাধীনতাকে স্থাপন করেন। কিন্তু স্বাধীনতা চর্চাকারী হিসেবে, সদিচ্ছা পোষণকারী হিসেবে, শেষ পর্যন্ত মানুষই তার চিন্তার কেন্দ্রে থাকে। কান্টের দর্শনকে আমরা বিচারবাদ বলে জানি, যেখানে বৌদ্ধিক বিচার ও বিশুদ্ধ চিন্তার পর্যালোচনাকে নৈতিক সত্তার পরিণতি হিসেবে দেখা যায়।  

ধূলির ধরণিতে ঈশ্বরের জয়যাত্রা পরিবেশন করতে গিয়ে হেগেল সত্তাকে বৌদ্ধিক বলে বিবেচনা করেছেন এবং যা কিছুই বৌদ্ধিক তাকে সত্তা বলে মান্যতা দিয়েছেন। ফলে মানুষের সাথে সত্তার সম্পর্কও বৌদ্ধিক আকার দ্বারা নির্ধারিত হওয়ার অবকাশ রাখে। অর্থাৎ,  

অগাস্ট ক্যোঁতে
সামাজিক ঘটনার শরীরতত্ত্ব বা সামাজিক পদার্থবিদ্যা নিয়ে শিহরণ জাগানো কথা বলে অগাস্ট কোঁতে সনাতন খ্রিস্টান ধর্মের জায়গায় মানবতার ধর্ম নামীয় অলীক ও অবাস্তব প্রস্তাবনা এনেছেন, যেখানে বিধাতার আসনে মানবতা নামক এক বিমূর্ত সত্তাকে অধিষ্টিত করার প্রয়াস পেয়েছেন। এবং যেখানে বৈজ্ঞানিক নিয়মেই সামাজিক বিধানগুলো কাজ করবে এবং মানুষ মানবতার লক্ষেই কাজ করবে। কোঁতের মতে মানবতাবাদ এক ধরণের বৈজ্ঞানিক ধর্ম, যা অলৌকিক সত্তায় নয়, দৃষ্টবাদি বিজ্ঞানের দ্বারা ন্যায্য বলে ঘোষিত সরকারি সেবা ও কার্যক্রমের প্রতি আনুগত্য পোষণ করে।

সার্ত্রে ও হাইডেগার বাহাস
মানবতাবাদ নিয়ে সার্ত্রের সাথে হাইডেগারের বিতর্ক বেশ জমজমাট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই ১৯৪৫ সালে,এক্সিস্টেন্সিয়ালিজম ইজ আ হিউম্যানিজম শিরোনামে প্যারিসে প্রদত্ত ভাষণে সার্ত্রে অস্তিত্ববাদকে মানবতাবাদেরই একটি ধরণ হিসেবে বর্ণনা করেন। সে সময় তার নাস্তিক্যবাদি ও শুন্যতাবাদি অস্তিত্ববাদের বিরুদ্ধে ক্যাথলিক ও কম্যুনিস্টদের সমালোচনা মোকাবেলা করার জন্য এই বিষয়টি খোলাসা করা তার জন্য জরুরী হয়ে পড়েছিল। জীবন যখন অর্থহীন হয়ে পড়ে, বিচ্ছিন্নতা ও নিঃসঙ্গতায় থেকে থেকে যখন মানুষ বিবমিষায় ভোগে তখন তীব্র যাতনায় এক অধিবিদ্যক অবস্থায় নিমজ্জিত হয়ে মানুষ মানসিক বিবর্তে, তীব্র যাতনার উল্লাস থেকে মানুষ নিজের সৃজনী শক্তির শৈল্পিক প্রকাশের মাধ্যমে জীবনের যথার্থতা প্রতিপাদনের চেষ্টা করে। অর্থহীন জীবনের নতুন অর্থ তৈরি করে। সার্ত্রের মতে অস্তিত্ব ব্যতিরেকে সত্তা নেই, কোন কিছু অস্তিত্ববান হয়ে ওঠার পরই মাত্র তার সত্তা জানান দেয়। আগে থেকেই সত্তা বিরাজমান আছে আর পরে সে সত্তা অনুযায়ী কোন কিছু অস্তিত্ববান হয়ে ওঠে, এমন মতকে সার্ত্রে বর্জন করেন। দেকার্তের মতো বিষয়ী সত্তাকে ভিত্তি করে, পূর্ব নির্ধারিত সারসত্তা অনুযায়ী, যা ইশ্বরের মনে বিরাজমান, মানুষের অস্তিত্ববান হয়ে ওঠা অবান্তর। যেহেতু ঈশ্বরের অস্তিত্বের কোন প্রমাণ নেই, মানুষের সারসত্তা সম্পর্কিত ধারণা ধারণকারী বা ভাব পোষণকারী কেউ নেই, সুতরাং মানুষ হচ্ছে তাই, যা সে তার প্রয়াসের মাধ্যমে হয়ে ওঠে। একমাত্র মানুষেরই অস্তিত্ব আছে। কারণ মানুষ সম্ভাবনাময় অপূর্ণ সত্তা। সে তার অসীম সম্ভাবনার পথে ক্রমাগত সংগ্রাম করে অগ্রসর হয় এবং সত্তাবান হয়ে ওঠেমানুষ নিজেই অস্তিত্ববান থাকে, নিজের অস্তিত্বকে মোকাবেলা করে, বাস্তবতার সিঁড়ি বেয়ে সে ক্রমাগত নিজের পরিচয় ও সংজ্ঞা নির্ণয় করে। কাজেই নিজেকে নিজে সংজ্ঞায়িত করা বা নিজের পরিচয় নির্মাণের পূর্ব পর্যন্ত মানুষের কোন সংজ্ঞা নেই। নিজের ইচ্ছায়, নিজের প্রয়াসে, সংগ্রামের মাধ্যমেই মানুষ নিজের সংজ্ঞা নির্মাণ করেপূর্ব নির্ধারিত কোন স্বয়ংসত্তা নয় বলে মানুষ অন্যান্য বস্তুকণা বা জিনিসের মতো নয়, বরং অসীম সম্ভাবনা তার। মানুষ নিজের প্রচেষ্টায় অনেক কিছু হয়ে ওঠে। একটি পাথর সর্বদা পাথর, কিন্তু মানুষ প্রয়াসের মাধ্যমে অসীম সম্ভাবনার দিকে যাত্রা করে। তাই মানুষের ভাগ্য বা নিয়তির বা পরিণতির জন্য সে নিজেই দায়ী। মানুষ একটি বিশেষ পরিস্থিতির বিপরীতে নিজের লড়াই ও মোকাবেলাকে উপলব্ধি করে। 

যেহেতু ঈশ্বর নেই, সেহেতু মূল্য নিরূপণের জন্য স্বর্গীয় কোন মানদণ্ড নেই, যার পাল্লা ও বাটখারায় মেপে আমরা মানুষের কাজের ভাল-মন্দ বিচার করব। সুতরাং ভাল-মন্দের মাপকাঠি মানুষই। মানুষ ঐতিহাসিক শর্তের নিগড়ে আবদ্ধ, ঐশ্বরিক নিয়তি নির্ধারিত ছকে জীবন যাপনের জন্য আসে নি। বরং যৌক্তিক, আত্মসচেতন ও স্বাধীন সত্তা। আলোকপর্বের ভাবুকদের মতো ঈশ্বর বিরোধিতা না করেও সার্ত্রে ঈশ্বরের অপ্রয়োজনীতা বা ঈশ্বর হতে মানুষের স্বাধীনতার কথা বলেন।  

 যার প্রতিক্রিয়ায় ১৯৪৬ সালে লেটার অন হিউম্যানিজম লেখেন। ১৯৪৭ সালে লুকাস এক্সিস্টেন্সিয়ালিজম এন্ড মার্ক্সিজম শিরোনামে প্রতিক্রিয়া লেখেন। অস্তিত্ববাদিরা মহাজগতকে অযৌক্তিক সত্তা হিসেবে দেখে, অন্যদিকে  মার্ক্সবাদিরা মনে করে জগত কিছু নিয়মের অধীন।[1] এবং দ্বান্ধিক বস্তুবাদের নিয়মের মূলস্বরূপ। অস্তিত্ববাদিদের কাছে জগত,  জীবন ও ঘটনা হচ্ছে অর্থহীন, এবসার্ড। আর বিজ্ঞানবাদি মার্ক্সিস্টদের কাছে জীবন সার্থক, ঘটনাসমূহ যুক্তিযুক্ত।

ফরাসি দেশে সতেরশ সালের দিকে হিউম্যানিজমে শব্দটি মানবপ্রেম অর্থে প্রচার পায়।  

মানবেন্দ্রনাথ রায়ের নব্য-মানবতাবাদ

কার্ল ম্যানহাইম
কার্ল ম্যানহাইম মনে করেন, মানবতাবাদ একটি এলিট ভাবাদর্শ যা শিক্ষিত ও সম্পন্ন মানুষের স্বার্থ রক্ষার দিকে নজর দেয়। সংস্কৃতিবান ও বুদ্ধিমান অভিজাতদের আদর্শ ও মূল্যবোধকে সমগ্র মানবাজাতির ওপর চাপিয়ে দেয়ার পক্ষে ওকালতি করে বলে একে পুরোপুরি গণতান্ত্রিকও বলা যায় না।


ফুঁকো
মানবতাবাদ মানুষের বিষয়ী সত্তায় ধরা দেয়া সত্য ও সত্যের মানবকেন্দ্রিকতাকে মেনে নেয়। কিন্তু মিশেল ফুঁকো এই জায়গায় মানবতাবাদের বিপক্ষে অবস্থান নেন। কারণ মানুষ যে বিশেষ কাঠামো, জ্ঞানের শৃঙ্খলা ও বিশ্বাস ব্যবস্থার মধ্যে নিমগ্ন থাকে, বা যে ধরণের ক্ষমতার শাসনের ভেতর দিয়ে মানুষের জ্ঞান তৈরি হয় তা বিষয়ীগত ও বিষয়গত উভয় ধরণের জ্ঞানকে সংশয়াপন্ন ও প্রশ্নবিদ্ধ করে। মানুষ যেভাবে নিজেকে নির্মাণ করে, নিজের দায় দায়িত্ব ঠিক করে তা সমাজের বিশেষ ক্ষমতা কাঠামো দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। ক্ষমতা ও প্রতিষ্ঠানের সম্পর্ক দ্বারা বিষয়ী সত্তা নির্মিত হয়। মানুষ আসলে স্বাধীনভাবে নিজেদের সৃজনীশক্তি দিয়ে নয় বরং বিভিন্ন ধরণের আইনি  প্রতিষ্ঠান, বিধি ও ক্ষমতা কাঠামো ও ক্ষমতার চর্চা দ্বারা মানুষ নিজের সত্তাকে নির্মাণ করে এবং নিজের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে তাতে করে মানুষের চিন্তা, জ্ঞান ও ক্ষমতা বিশেষ শৃঙ্খলিত উৎপাদন প্রণালির ছকে ও ছাঁচে নির্মিত হয় বিধায় তা ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণে যেমন থাকে না, তেমনি ব্যক্তির মুক্তির পথও মুক্ত করে না। তবে প্রশ্ন আসতে পারে, ক্ষমতা ও জ্ঞানের শৃঙ্খলা এবং প্রতিষ্ঠানতো মানুষেরই তৈরি। সে ক্ষেত্রে হাইদেগারের কথা বলতে হবে, ব্যক্তির ইচ্ছা, মত ও ক্ষমতা যখন সামষ্টিক প্রয়াসের সাথে যুক্ত হয়, তখন ব্যক্তির ইচ্ছে ও মতের বিলোপ ঘটে এবং এক ধরণের ইচ্ছের গোলযোগ তৈরি হয়, যা এক অনিশ্চিত ব্যক্তিবোধের জন্ম দেয়। ফলে, ব্যক্তি এখানে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় থাকে না, বরং নিয়ন্ত্রিতের দায় পালন করে মাত্র।  

মার্কুস গ্যাব্রিয়েল ও কুয়েতিঁ মেইলাসোঁ


[1] https://www.marxists.org/archive/novack/works/history/ch12.htm

Comments

উপকৃত হলাম। ধন্যবাদ।

Popular posts from this blog

মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার কারণ ও প্রতিকার

সরওয়ার কামাল শিক্ষাক্ষেত্রে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য সাফল্য রয়েছে। সামাজিক উন্নয়ন সূচকেও বাংলাদেশের অবস্থান প্রতিবেশি দেশগুলোর তুলনায় ভালো, যা সম্পর্কে প্রশংসা করে বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন প্রবন্ধ লিখেছেন “ ল্যানসেট ” নামক মেডিক্যাল জার্নালে। কিন্তু এতে আমাদের বগল বাজিয়ে আত্মতৃপ্তিতে ভোগার অবকাশ নেই। কারণ শিক্ষার্থী ঝরে পড়া এবং বিজ্ঞান শিক্ষা সংকুচিত হয়ে পড়া আমাদের সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভুত হয়েছে। শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার কারণে আমাদের শিক্ষার মূল লক্ষ্যগুলো হাসিল হচ্ছে না, যার একটি হলো সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করা, অপরটি হলো শিক্ষাক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় প্রণোদনার ন্যায্য বণ্টন নিশ্চিত করা। অর্থাৎ সব শিশুই যাতে সরকারের সুযোগ ব্যবহার করে উন্নত জীবনের সন্ধান করতে পারে, তার শতভাগ নিশ্চয়তা প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না। শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার বিভিন্ন কারণ রয়েছে, তার মধ্যে বিভিন্ন স্তরের শিক্ষার ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন কারণ রয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার প্রধান কারণ দারিদ্র্য ও অপুষ্টি বা স্বাস্থ্যহীনতা । মাধ্যমিক পর্যায়েও শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার ক্ষেত্রে দারিদ্র্য সমস্যার ...

মহেশখালীর সমাজ ও সংস্কৃতি

সরওয়ার কামাল সাগর কূলে গিরিকুন্তলা মোহিনী মহেশখালী দ্বীপের ৩৮৮ বর্গকিলোমিটার ভূত্বকে প্রায় পাঁচ লক্ষ লোকের বসতি। তাদের বসতি ঘিরে গড়ে উঠেছে উপকূলীয়-দ্বীপাঞ্চলীয় সমাজ। এই সমাজসভ্যদের মানসিক ঐক্য ও জীবনযাপন পদ্ধতি নিয়ে তৈরি হয়েছে শনাক্তযোগ্য বিশেষ স্থানীয় সংস্কৃতি। মানবজাতির চিরকালীন অভিযাত্রার অংশ হিসেবে দেশের নানা জায়গা থেকে হিজরত করে লোকজন এসে বসতি গেড়েছে মহেশখালীতে। তাই তাদের ভাষা ও আচরণে শনাক্ত করা যায় এমন বৈচিত্র্য ও তারতম্য, যা দিয়ে কক্সবাজারের অন্যান্য অঞ্চলের অধিবাসীদের তুলনায় মহেশখালীবাসীকে স্বতন্ত্রভাবে চিহ্নিত করা যায়। যে পার্থক্যসূচক বৈশিষ্ঠ্যাবলী নিয়ে মহেশখালীর সমাজ ও মানুষের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য তৈরি হয়েছে, চাটগাঁইয়া ভাষার উপভাষাতুল্য মহেশখালীর দ্বীপাঞ্চলীয় বুলি তার মধ্যে বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। [1] তবে সমস্যা হলো, লিখিত সাহিত্য ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের অভাবে স্থানীয় ইতিহাসের মতোই কালিক সূচকের নিরিখে এর জনসংস্কৃতি বর্ণনা করা দুরূহ। একেতো সংস্কৃতি স্বয়ং একটি ব্যাপক ধারণা, তদুপরি, এটি সতত পরিবর্তনশীল। ভাষা ও সংস্কৃতি স্রোতস্বী নদীর মতো বহমান। মানুষের কথা, স্মৃতি, পুরা...

মনোদর্শন

মনোদর্শনের কথামুখ দর্শনের একটি সরল সংজ্ঞার অভিপ্রায়ে আমরা বলতে পারি, দর্শন হলো জীবন, জগত ও পরমসত্তার প্রকৃত স্বরূপ সম্পর্কে যৌক্তিক ও সার্বিক ব্যাখ্যা দানের প্রচেষ্টা। অনুরূপভাবে বলা যায়, মনোদর্শন হলো দর্শনের সেই শাখা যেখানে মনস্তত্ত্বের দর্শন বা দর্শনের মনস্তত্ত্বসহ মানসিক বিষয় কিংবা মানসিক প্রপঞ্চের স্বরূপ নিয়ে আলোচনা করা হয়, যে বিষয়গুলো কার্যকারণগত দিক থেকে সত্তার কাঠামোর সাথে সম্পর্কিত। মূলত মনোদর্শন হলো মন, মনের ধারণা, মনের স্বরূপ, মানসিক ঘটনা, মনের কার্যাবলি, চেতনা ও সর্বোপরি দেহের সাথে চেতনার সম্পর্ক নিয়ে দার্শনিক অনুসন্ধানের প্রয়াস। আরও বিস্তৃত পরিসরে মনোদর্শনের বিষয়বস্তু নিয়ে আলাপের অবতারণা করলে মনের ধারণা, চেতনার স্বরূপ, প্রত্যক্ষন, সংবেদন, চেতনা, চেতনার কর্তা, আত্মজ্ঞান, অন্তর্দর্শন, কল্পনা, বিশ্বাস, আকাংক্ষা, অভিপ্রায়, দৈহিক ঘটনার সাথে মানসিক অবস্থার সম্পর্ক, অভিন্নতাতত্ত্ব, ব্যক্তিত্ব, মনোবিজ্ঞানের অন্যান্য প্রত্যয়, তত্ত্ব ও মডেলসহ নানা প্রসঙ্গ নিয়ে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করতে হয়। কাজেই দর্শনের একটি নতুন শাখা হলেও মনোদর্শনের বিষয়বস্তু যথেষ্ট সমৃদ্ধ, জটিল ও আন্তর্বৈষয়িক ...