সরওয়ার কামাল
কথামুখ
আমলাতন্ত্র হলো রাষ্ট্র শাসনের
প্রাতিষ্ঠানিক ভিত, যার প্রাতিষ্ঠানিক দার্ঢ্যতা, কর্মকৌশলগত ধারাবাহিকতা ও কাঠামোগত জাড্যতাকে লৌহ-পিঞ্জরের
সাথে তুলনা করা হয়। বলা হয়ে থাকে, পৃথিবীতে আমলাতন্ত্রের উদ্ভব ঘটেছে আট হাজার বছর
পূর্বে। ভারতীয় সভ্যতায় মৌর্য শাসনকাল থেকেই সুগঠিত আমলাতন্ত্র চলে আসছে। সেই
তুলনায় পাশ্চাত্যে আমলাতন্ত্রের উন্মেষ ঘটে কিছুটা বিলম্বে; পশ্চিমা দর্শনের বুদ্ধিবাদি ঐতিহ্যের যৌক্তিক
ফসল হিসেবে। তবে আধুনিক আমলাতন্ত্র উত্তরাধুনিক অভিঘাতে তার সেই লৌহকঠিন রূপ
হারিয়ে ক্রমে দুর্বল হয়ে পড়েছে। অর্থনীতিবিদ ও সংগঠনতাত্ত্বিকরা মুক্ত-সমাজ এবং
অর্থপূর্ণ জীবন নিশ্চিতকরণে আমলাতন্ত্রের ভূমিকা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করতে শুরু করলে,
তাদের সাথে সুর মিলিয়ে অনেকেই যুক্তির ভিত্তিতে ন্যায় এবং ন্যায়ের ভিত্তিতে
মানুষের স্বাধীনতা ও মানবতার মুক্তিকামী আধুনিক চিন্তাকে মিথ বলে অভিহিত করতে থাকে।
তদুপরি, তাদের কাছে এই মিথ শেষতক চূড়ান্ত ত্রাসে পরিণত হওয়ার
সম্ভাবনা নিয়ে হাজির হলে, তারা প্রতিক্রিয়া দেখাতে শুরু করে। এক পর্যায়ে তারা অনুধাবন করে,
মুক্তির পথ উন্মুক্ত করতে গিয়ে বুদ্ধি সর্বদা আধিপত্য বজায় রাখে এবং বুদ্ধি
চূড়ান্ত পর্যায়ে সম্পদ, ক্ষমতা ও আধিপত্যের লক্ষ্যে কাজ করে।
এভাবে মানবতার মুক্তি আনার পরিবর্তে বুদ্ধি মানবতাকে লোহার খাঁচায় বন্ধী করে রাখে।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, নতুন প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের মাধ্যমে সমাজে যে পরিবর্তন ঘটে চলেছে, তা আমলাতান্ত্রিক সংগঠনের ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করেছে। টেলিযোগাযোগ, কম্পিউটার, ইন্টারনেটভিত্তিক তথ্য ও যোগাযোগের
নেটওয়ার্ক, স্মার্টফোন এবং এই ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহারে
সক্ষম কর্মীবাহিনী আমলাতান্ত্রিক সংগঠনের উৎপাদনের ক্ষমতাকে যেমন চ্যালেঞ্জ করেছে,
তেমনি এর সাংগঠনিক পরিসীমাকে অনির্দিষ্ট ও আবছা করেছে। সেই সাথে
ব্যবসায় প্রশাসনের নব্য উদারবাদি ধারণাকে আত্মস্থ করার মাধ্যমে আমলাতন্ত্রের লৌহ-পিঞ্জর শেষ পর্যন্ত যেন পাতলা বেলুনে পরিণত হয়েছে। আধুনিক আমলাতন্ত্রের উদ্ভব,
বিকাশ ও পরিণতি বিশ্লেষণ করলে, এর ওপর
উত্তরাধুনিক অভিঘাত এবং তজ্জনিত প্রাতিষ্ঠানিক দৌর্বল্য পরখ করা যায়। বিদ্যমান আলোচনায় আমলাতন্ত্রের আধুনিক
যুগ হতে উত্তরাধুনিক যুগে পর্বান্তরের কারণ ও স্বরূপ বুঝার প্রয়াসে আধুনিক ও উত্তরাধুনিক
গবেষণাসাহিত্য পাঠসহ মাঠপর্যায়ের অভিজ্ঞতার নিরিখে যৌক্তিক বিশ্লেষণ হাজির করার
প্রচেষ্টা নেওয়া হবে।
গবেষণাসাহিত্যের পুনর্পাঠ
সংগঠন তাত্ত্বিকদের উল্লেখযোগ্য
অংশই মনে করেন, আমলাতন্ত্র উৎপাদন সংগঠন হিসেবে কাঠামোগতভাবে এত সবল
এবং কার্যকর যে, এর কোন বিকল্প হতে পারে না। এছাড়া সমাজের মধ্যে আমলাতন্ত্র
এমনভাবে প্রোথিত আছে যে, একে দূর করা যেমন অসম্ভব তেমনি দূর
করার চেষ্টাটাও অপ্রয়োজনীয়। তবুও বিংশ শতাব্দির শেষের দিকে পশ্চিমা ধাঁচের
আমলাতন্ত্র ও যুক্তিবাদিতাকে পুনর্মূল্যায়নের অভিপ্রায়ে নতুন দার্শনিক পর্যালোচনা
হিসেবে উত্তরাধুনিক আমলাতন্ত্রের উৎপত্তি। সেইসাথে নতুন প্রযুক্তির অভিঘাতে উৎপাদন
সংগঠন হিসেবে এর অনিশ্চিত সক্ষমতাও উত্তরাধুনিক অবস্থার জন্ম দিতে ভূমিকা রেখেছে।
জার্মান সমাজতাত্ত্বিক ম্যাক্স
বেবারকে আধুনিক আমলাতন্ত্রের জনক বলা হলেও এই আধুনিকতার, বিশেষ করে যুক্তিবাদিতার ভিত্তিতে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর উদগাতা হিসেবে
প্লাতোকেই মান্য করতে হয়। প্লাতো তার 'রিপাবলিক' বা গণরাজ্য নামক পুস্তকের ষষ্ঠভাগে গ্লোকোনকে উদ্দেশ্য করে বলা সক্রাতেসের
সংলাপ মারফত বর্ণনা করেছেন যে, “শেষ পর্যন্ত দার্শনিকদের
সত্য, ভাল এবং ন্যায়ের জ্ঞান অনুসন্ধান করা উচিৎ”। এই ধরনের দাবিকে উপদেশ মান্য করে য়ুরোপীয়
চিন্তাবিদেরা যুক্তিবাদিতার ভিত্তিতে সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার
চেষ্টা করেছেন। প্লাতো যখন বলেন, রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে যুক্তি,
যার দ্বারা মানুষ সত্য, ভাল ও ন্যায়ের সন্ধান
করবে, তখন স্বাভাবিকভাবেই রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের দাবি
দার্শনিকের ছাড়া অন্য কারও বেশি হতে পারে বলে মনে করার কারণ নেই।
প্লাতোর মতোই আধুনিক দার্শনিকেরা
যুক্তিকে একমাত্র ভিত্তি হিসেবে ধরে নিয়ে সমাজে ন্যায়, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র এবং নৈতিকতা নিশ্চিত করার
প্রয়াস পেয়েছেন। কিন্তু উত্তরাধুনিক দার্শনিকেরা সেই যুক্তিপথ বদলে দিয়েছেন, ‘অধিকতর
ন্যায় কী’, সেই প্রশ্ন রেখে। তাদের কাছে ন্যায় নিশ্চিত করার আগে কোনটা অধিকতর
ন্যায়, সেটা পর্যালোচনা করা অধিক গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু কোনটা সবচেয়ে বেশি নৈতিক
সেটা অমীমাংসিত তর্ক, সেহেতু নৈতিকতা বিচারের ক্ষেত্রে তারা সর্বজনীন মানদণ্ডের পরিবর্তে
স্থানীয় মানদণ্ডের ভিত্তিতে ন্যায়কে সংজ্ঞায়িত করতে শুরু করেন। তারা যুক্তি ও
যুক্তিবাদিতার পরিবর্তে যুক্তির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
প্লাতোর যুক্তিবাদি চিন্তাকেই
দীপায়নপর্বের য়ুরোপীয় দার্শনিক দেকার্ত, কান্টরা সতেরো শতকের
শেষের দিকে পুনরুজ্জীবিত করে, যা আমাদের কাছে আধুনিকতাবাদ
বলে পরিচিত। পরে হেগেল এবং ম্যাক্স বেবার যুক্তিবাদিতার ভিত্তিতে আধুনিক
আমলাতন্ত্রের দর্শন প্রচার করেন। যদিও আধুনিক আমলাতন্ত্রের উন্নয়নে উপযোগবাদি
দার্শনিক জেরেমি বেন্থাম ও মিলের ভূমিকাকে খাটো করে দেখার অবকাশ নেই, তবুও ম্যাক্স বেবার ও হেগেলকেই প্রধান তাত্ত্বিক হিসেবে মেনে নিতে হয়।
যুক্তিবাদিতা হলো আধুনিক
আমলাতন্ত্রের অন্যতম সারসত্তা। কাজেই ফরাসি দার্শনিক দেকার্তের জ্ঞানের নিশ্চয়তা
বিষয়ক বুদ্ধিবাদি চিন্তাকে পর্যালোচনা না করে এই ধরনের আলোচনা অগ্রসর হতে পারে না।
তার কার্তেসীয় প্রকল্পে বুদ্ধির ভূমিকা প্রধানত দুইটি। একটি হলো, আমাদের
অস্তিত্বের জ্ঞানতাত্ত্বিক ভিত্তি হিসেবে (Cogito Ergo sum) বুদ্ধিকে গ্রহণ করা, অপরটি হলো, ঈশ্বর বা
সত্যকে দেখার মাধ্যম হিসেবে বুদ্ধির ভূমিকা।
কান্টের ভিন্নপথ
ইমানুয়েল কান্ট প্লাতোপন্থী
চিন্তাকে ভিন্ন পথে নিয়ে যান। তার মতে, ব্যবহারিক দিক থেকে বৌদ্ধিক ক্ষমতার গুরুতর
সমস্যা রয়েছে। পর্যালোচনা ও সমালোচনা ছাড়া বুদ্ধির ব্যবহার এক ধরনের গোঁড়ামি, যার ফলে অনেক কিছু ভিত্তিহীন হওয়া সত্ত্বেও মেনে নেয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়।
কারণ বিশুদ্ধ চিন্তা অনেক কিছুকে পূর্বত:সিদ্ধ হিসেবেই
চিহ্নিত করতে সক্ষম। তাই পর্যালোচনা ছাড়া বিশুদ্ধচিন্তা, এমনকি
গণিতে বিশ্বাস স্থাপন করাও, তার মতে, অনুচিত। অর্থনীতির ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞরা অনেকসময়
পূর্বতঃসিদ্ধ সত্যকে মেনে নিয়ে অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারণ করে কিন্তু জনগণ কিংবা
বাজার সেই সত্যের অনুরূপ আচরণ করে না। রাজনীতির ক্ষেত্রেও পূর্বতঃসিদ্ধ সত্য কখনও
কখনও ফ্যান্টাসিতে পর্যবসিত হয়।
কন্টিনেন্টাল দার্শনিক লক, বার্কলে
ও হিউম একমত পোষণ করেছেন যে, অযাচাইকৃত বুদ্ধি প্রায়শই জগৎপ্রকৃতি
সম্পর্কে অমূলক অনুমান ও নৈতিক নীতির ভিত্তি হিসেবে গৃহীত হয়ে যেতে পারে। অর্থাৎ অমূলক
অনুমান নিজেই নৈতিকতার ভিত্তি হিসেবে দাঁড়িয়ে যেতে পারে। কারও দোষ বা গুণ বিচারের
ক্ষেত্রে কিংবা কোন কাজের নৈতিক মূল্য বিচারের ক্ষেত্রে এই ধরনের অমূলক অনুমানের
ভিত্তিতে ঘটনার নৈতিক মূল্য বিচার করা হয়ে থাকে বৈকি। তাই, কান্ট
অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভরশীলতাকে যেমন প্রত্যাখ্যান করেছেন, তেমনি
বুদ্ধিকে চেক দেওয়ার জন্য তার পদ্ধতির মধ্যেই অযাচাইকৃত বুদ্ধির বিপরীত ক্ষমতাকে
চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছেন। আধুনিকতাবাদি দৃষ্টিকোণ থেকে বুদ্ধি শুধু সব সত্যের
উৎসই নয়, ন্যায়েরও উৎস। বিপরীতে কান্টের নৈতিক অবস্থান এমন
যে, নৈতিকতা শেষ পর্যন্ত কল্পরাজ্যের সমাজে পর্যবসিত হয়,
যেখানে ব্যক্তিবর্গ সত্যিকার অর্থেই মুক্ত এবং নিজেরা অন্য কোন উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত
না হয়ে নিজেরাই নিজের লক্ষ্য হয়ে ওঠে।
আমলাতন্ত্র ও শাসন পরিচালনের দক্ষতা
আমলাতন্ত্রের জন্ম হয়েছে মানুষের
যাবতীয় কর্মকাণ্ডকে সর্বোচ্চ দক্ষতার সাথে সম্পাদন ও আয়োজনের বৌদ্ধিক প্রয়াস
হিসেবে। বুদ্ধির প্রয়োগের মাধ্যমে মানুষকে মুক্তি দিতে য়ুরোপীয় দার্শনিকরা
আমলাতন্ত্রের উন্মেষ ঘটান। তারা উৎপাদনের দক্ষতা বাড়ানো, দ্রব্যমূল্য কমানো এবং জীবনমানের উন্নয়ন ঘটানোর লক্ষ্যে আমলাতন্ত্রের ওপর
নির্ভর করেন। আমলাতন্ত্রনির্ভর জটিল কাঠামোবদ্ধ সংগঠনে শ্রম বিভাজন ও পারস্পরিক
সহযোগিতার মাধ্যমে ব্যক্তিগত দুর্বলতাসমূহ দূর করে সংগঠনের সামষ্টিক উৎপাদনের
সর্বোচ্চ ক্ষমতাটা নিশ্চিত করা হয়। আমলাতন্ত্রের মতো জটিল সংগঠনগুলো টিকে আছে,
এই জন্য যে, এতে ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতাসমূহ সাংগঠনিক আন্ত:সম্পর্কের ভিত্তিতে উতরানো যায়। এছাড়া আমলাতন্ত্র সামাজিক নিয়ন্ত্রণের
একটি মোক্ষম ব্যবস্থা, যার সামাজিক ক্ষমতা নিহিত থাকে বৈধতা
ও দক্ষতার সাথে ক্ষমতা চর্চার মধ্যে।
ম্যাক্স বেবার আমলাতন্ত্রকে অন্য
সংগঠনের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বলেছেন; যেভাবে একটি মেশিন
অকারিগরি হাতিয়ার থেকে শ্রেষ্ঠ, সেভাবে
আমলাতন্ত্র অন্যান্য সংগঠন হতে শ্রেষ্ঠ। দক্ষতা, নৈর্ব্যক্তিকতা,
যুক্তিবাদিতা ও কর্মবিভাজনের স্তরবিন্যাস মিলে সাংগঠনিক উৎপাদন
নিশ্চিতকরণের এক সুসংহত ব্যবস্থা হলো আমলাতন্ত্র। ম্যাক্স বেবারের সাথে আধুনিকতাবাদি
চিন্তার দিক থেকে কিংবা আমলাতন্ত্রের যুক্তিবাদিতা প্রসংগে হেগেলের মিল বৈ অমিল
নেই।
জার্মান দার্শনিক হেগেল আমলাসমাজকে
সর্বজনীন সমাজ বলেছেন। কারণ
তারা সর্বজনীন স্বার্থে কাজ করেন। নাগরিক সমাজের ব্যক্তিগত স্বার্থ থাকে, কিন্তু
আমলাসমাজের স্বার্থ সর্বজনীন। সর্বোচ্চ রাজনৈতিক সচেতনতা এবং গণমানুষের কর্মকাণ্ড
সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন বলে আমলাদেরকে রাষ্ট্রের স্তম্ভ বলা হয়।
হেগেলের মতে আমলাদের প্রধান কাজ
দুইটি। এক: জনসমাজের যাবতীয় কর্মকাণ্ড তদারকি করা, যাতে তারা
নিজেরাই অহংবাদি ও স্বার্থান্বেষী দলে পরিণত না হয়; দুই:
উচ্চ পর্যায়ের আমলাদের পক্ষ থেকে রাজার পরামর্শদাতা
হিসেবে রাষ্ট্রের যাবতীয় কর্মকাণ্ড সম্পর্কে প্রকৃত অবস্থা তোলে ধরা। তবে হেগেল
আমলাদের প্রধান দুইটি দুর্বলতার কথাও স্বীকার করেন। তা হলো, কর্মবিভাজনের বাহুল্য ও যান্ত্রিকতা। তবে
দক্ষতা ও নিরপেক্ষতা প্রসংগে তিনি আমলাদের জন্য নৈতিক শিক্ষা দরকার বলে মনে করেন,
যেন তারা সর্বজনীন দৃষ্টিকোণ থেকে সরকারি কর্মকাণ্ড মূল্যায়নের
সক্ষমতা অর্জন করতে পারেন।
ম্যাক্স বেবার ও হেগেল দু'জনই
মনে করেন, রাষ্ট্রের সেবায় জীবন উৎসর্গ করার মধ্য দিয়ে আমলারা একটি সামাজিক শ্রেণি
গঠন করতে পারে। সেলক্ষ্যে
আমলাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক স্বার্থকে কর্ম ও সেবা প্রদান হতে পৃথক রাখতে হবে। হেগেলের দাবি, আমলাতন্ত্রের প্রধান মূল্যবোধ বা সদগুণ হবে স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা। সেইসাথে বিশেষ স্বার্থের প্রতি নৈর্ব্যক্তিকতা দেখানো। প্রশাসনিক কাজে
নিরপেক্ষতা ও স্বাধীনতা বজায় রাখার সাথে আমলাতন্ত্রের আইনগত তাৎপর্য এবং বৈধতার
সম্পর্ক রয়েছে। তাই আইনের নৈর্ব্যক্তিক প্রয়োগের মাধ্যমে কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা চর্চা করা
বাঞ্ছনীয়। হেগেল মনে করেন, একটি যুক্তিবৃত্তিক রাষ্ট্র,
এমনকি জনপ্রশাসন যখন নৈর্ব্যক্তিক আইন ও বিধিবিধান দ্বারা পরিচালিত হয়
শুধু তখনই আমলাতন্ত্র বিশুদ্ধ প্রকারের আইনি কর্তৃত্বের রূপ পায়।
যুক্তির ভিত্তিতে মানবমুক্তির
প্রসংগে হেগেল ও ম্যাক্স বেবারের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। বেবার স্বাধীনতাকে
দুইভাগে ভাগ করেন, সদর্থক ও নঞর্থক। সদর্থক স্বাধীনতা হলো
কোন কাজ করার স্বাধীনতা এবং নঞর্থক স্বাধীনতা হলো কোন কাজ করা হতে নিজেকে নিবৃত্ত
রাখার স্বাধীনতা। উদারবাদি রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে নঞর্থক স্বাধীনতাই মানুষের
মুক্তির চাবি কাঠি বলে মনে করা হয়, যেখানে রাষ্ট্র ব্যক্তি ও সামাজিকজীবন এবং
ঘটনার ক্ষেত্রে কম হস্তক্ষেপ করবে বা হস্তক্ষেপ করা থেকে নিবৃত্ত থাকবে। মানুষের
সামাজিক ও নাগরিক জীবনকে সূক্ষ্মভাবে দেখলে বোঝা যায়, শুধুমাত্র
রাজনীতি সচেতন মানুষই নিজেকে স্বাধীন ভাবতে পারে। কিন্তু কার্ল মার্ক্সের শ্রেণিসংগ্রামের
নিরিখে দেখলে রাষ্ট্রকে কেন্দ্র করে সামাজিক শ্রেণিগুলোর মধ্যে অবিরাম সংগ্রাম
চিহ্নিত করা যায়, যেখানে বুর্জোয়ারা পুঁজি এবং উৎপাদিকাশক্তির মালিকানা লাভের
মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রভাব অর্জন করে। শ্রমিকশ্রেণি নিজেরাও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা
এবং নির্বাচনী রাজনীতির ভোটার নির্ভরতার সুযোগ নিয়ে রাজনৈতিক প্রভাব অর্জন করতে চেষ্টা
করে। সামাজিক শ্রেণীসমূহের এই ধরনের সংগ্রামের বিপরীতে আমলাতন্ত্র তার নিজস্ব
রাজনৈতিক অভিলাষ থেকে বুর্জোয়াদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়। এভাবে শ্রেণিবিরোধের
দ্বান্ধিকতার ভেতর দিয়ে আমলাতন্ত্র, সর্বোপরি আমলাতন্ত্রনির্ভর শাসন পরিচালনে
রাষ্ট্রযন্ত্র এক ধরনের শ্রেণিনিরপেক্ষ স্বাধীনতা বজায় রাখে। কিন্তু যেসব রাষ্ট্রে
বুর্জোয়াদের একচ্ছত্র প্রভাব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেই সব রাষ্ট্রে বুর্জোয়ারা আমলাতান্ত্রিক
বুর্জোয়া প্রশাসন ও আইনসভার নিয়ন্ত্রণ নেয়। এভাবে আমলাতন্ত্রের স্বাধীনতা কমে
যাওয়ার মাধ্যমে রাষ্ট্র একটি বিশেষ বুর্জোয়াশ্রেণির আধিপত্যের অধীনে চলে যায়। সেই ক্ষেত্রে সর্বহারাদের যাওয়ার আর কোন জায়গা থাকে
না। কাজেই নিরপেক্ষ আমলাতন্ত্র হলো বুর্জোয়া কর্তৃক সর্বহারা বা প্রলেতারিয়েত
নিপীড়নের প্রধান বাধা। তাই শ্রমনির্ভর মজুরেরও শেষ আশ্রয়।
হেগেলের কথারই প্রতিধ্বনি করে ফরাসি
দার্শনিক মিশেল ফুঁকো বিচার বিভাগকেও আমলাতন্ত্র বলেছেন। হেগেল তার 'ফিলজফি অব রাইট' গ্রন্থে
বিচারবিভাগ ও পুলিশকে নির্বাহী বিভাগের অংশ হিসেবে দেখেছেন, যেখানে
নির্বাহী বিভাগ রাষ্ট্র এবং নাগরিক সমাজের মধ্যে মধ্যস্থতা করে। ফুঁকোর ক্ষমতার ধারণা এখন আমলাতন্ত্রে
ব্যবহৃত হচ্ছে। বেবারীয় হাইয়ারার্কির জায়গায় সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ক্ষমতার
নেটওয়ার্ক আমলাতন্ত্রের সোপানসমূহে সমতলতা আনয়নের কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। ফুঁকোর
ক্ষমতাতত্ত্ব উদারবাদি বিকেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়ার সাথে লাগসই হওয়ার কারণে
আমলাতন্ত্রে সমতলতা আনয়ন ও ক্ষমতা ও প্রাতিষ্ঠানিক বিকেন্দ্রীকরণ জোরদার
হয়েছে।
বাঁকবদল
উনিশ শতকের শেষের দিকে নীটশে
আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির পুরো ভিত্তিটাকে চ্যালেঞ্জ করে বসে। On
the Ground of Genealogy of Morals গ্রন্থে নীটশে, আরিস্তোতলীয় দাবি, 'মানুষ স্বাভাবিকভাবে জানতে চায়,
তাই জ্ঞানই হলো আলো', এই ধরনের চিন্তাকে
আক্রমণ করে বলেন, মানুষের প্রধান প্রকৃতি হলো টিকে থাকার
অভিপ্রায়, যা আধিপত্যের অভিপ্রায়ে রূপান্তরিত হয়। তার মতে, সক্রাতেস
জানতে চান নি অথবা জ্ঞানের পাগল ছিলেন না, বরং সোফিস্টদের
বিরুদ্ধে তর্কে জেতার অভিপ্রায়জাত উদগ্রতা থেকে তিনি জানতে চেয়েছেন। তাই নীটশের
কাছে দার্শনিক অনুসন্ধানের পুরো ইতিহাসটাই 'ক্ষমতার অভিপ্রায়'। তার মতে, যুগে যুগে মানুষ প্রভাব খাটানোর
আকাঙ্ক্ষা থেকে কিংবা অপরকে দমিত করার আকাঙ্ক্ষা থেকে ঈশ্বর, সত্য, ভাল এইসব ধারণা বানিয়ে নিয়েছে। ওইসবের
অস্তিত্বকে ন্যায্যতা দেয়ার জন্য নয়, তাদের ইচ্ছাকে
ন্যায্যতা দেয়ার জন্য। তাই, আধুনিক বুদ্ধিবাদিতা ও জ্ঞানবাদি
আধুনিকতার বিপরীতে প্রথম চিন্তক হিসেবে নীটশেকে গণ্য করা যায়।
নীটশে আমলাতন্ত্র কিংবা সংগঠন
সম্পর্কে আলোকপাত করেননি, কিন্তু ম্যাক্স ওয়র্কহেইমার, থিওডোর অডর্নো প্রমূখ নীটশের মন্তব্যকে রাজনৈতিক চিন্তা হিসেবে দাঁড় করান। তাদের মতে, যুক্তিবাদিতা মানুষকে মুক্তি
দিতে পারেনি, কারণ যুক্তিবাদিতাকে শুধুমাত্র বিশেষ উদ্দেশ্যে হাতিয়ার হিসেবে
ব্যবহার করা হয়েছে। যুক্তিবাদিতার মাধ্যমে যে মানবমুক্তির সম্ভাবনা ছিল, তা
ক্ষমতার অভীপ্সা ও আধিপত্যের কারণে ভিন্ন উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়েছে।
এতৎসত্ত্বেও, ওয়র্কহেইমার ও
এডর্নো যুক্তিবাদিতার পক্ষ অবলম্বন করেছেন। তাঁরা মনে করেন, একমাত্র যুক্তিবাদিতাই
নীটশীয়ান ক্ষমতার অভীপ্সাকে চেক দিতে পারে। তাঁরা কান্টিয়ান পর্যালোচনাকে ধরে
রাখতে চান, তবে এধরনের পর্যালোচনা যেন আলাদা কোন ব্যবস্থা গড়ে না তোলে, সেই
ব্যাপারেও সতর্কতা অবলম্বন করতে চান। মার্ক্সবাদ
যেমন পুঁজিবাদি অর্থনীতির পর্যালোচনা করে, ফ্রাংফূর্ট স্কুলের ক্রিটিক্যাল
তত্ত্ববিদরাও আধুনিকতাবাদের নতুন পর্যালোচনার মাধ্যমে প্রচলিত আমলাতন্ত্রের
ত্রুটিগুলো চিহ্নিত করার প্রয়াস পেয়েছেন। তারা দর্শনকে বৃহত্তর সমাজতত্ত্ব হিসেবে
প্রতিষ্ঠা করে সামাজিক প্রগতি নিশ্চিত করতে চেয়েছেন। তবে, তারা মনে করেন, সমাজতন্ত্রের জন্য উপযুক্ত বস্তুগত শর্ত উপস্থিত
থাকলেও শ্রমিকের এবং সর্বহারাদের চেতনাগত ঐক্য নেই বলে পুঁজিবাদকে ঠেকানো যাচ্ছে
না।
ওয়র্কহেইমার ও এডর্নো Dialectic
of Enlightenment-গ্রন্থে পশ্চিমা যুক্তিবাদিতা নির্ভর সভ্যতা এবং সমাজ
পরিচালন পদ্ধতির সমালোচনা করেছেন। শুধু শ্রেণিসংগ্রাম নয়, দীপায়ন পর্বের দর্শন
দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তারা সবকিছুই নতুন করে পর্যালোচনার দাবি করেন। তাদের মতে,
যুক্তি অথবা পর্যবেক্ষণ এককভাবে সমাজ পর্যালোচনার উপায় হতে পারে না। এই দু’য়ের সমন্বয়ী
পদ্ধতিতে সমাজকে বুঝতে হবে। এতে তারা যে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি তুললেন তা হলো, ‘
সত্যিকার মানবীয় অবস্থায় না থেকে মানুষ কেন নতুন বর্বরতার দিকে ধাবিত হচ্ছে’? তারা
আমলাতন্ত্রের সমালোচনা করতে গিয়ে মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে আমলাতান্ত্রিক ও
রাষ্ট্রীয় এজেন্সির অনুপ্রবেশে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। এডর্নোর মতে, ব্যক্তি যখন
রাষ্ট্রের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল হয়ে পড়ে তখন তারা বুর্জোয়াশ্রেণি কর্তৃক শোষণ ও
নিপীড়ন প্রতিরোধের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। এডর্নো রাষ্ট্রীয় পুঁজি এবং আমলাতন্ত্র
নির্ভর শিল্পায়নের জায়গায় বাণিজ্যিক পুঁজির বিকাশ ও ব্যক্তিখাতে শিল্পায়নের
মাধ্যমে ব্যক্তির স্বাধীনতা আসুক, এই কামনা করেছিলেন। কিন্তু সেই স্বাধীনতাকামি
ব্যক্তির বুর্জোয়াদের কাছে জিম্মি হতে সময় লাগলো না। ফলে, শ্রমিকদের যে ক্ষোভের
জায়গা, প্রতিরোধের ইস্যু এবং নেতৃত্বের পদ, সবই বুর্জোয়াদের দখল ও প্রভাবাধীনে চলে
গেলো। এই ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ আমলাতন্ত্র ছাড়া শ্রমনির্ভর
মজুরের দাঁড়াবার জায়গা ও আশ্রয় নেই। আমলাতন্ত্রের মতো যুক্তিবাদি সংগঠনের ক্ষমতার
প্রতি ভীত হয়ে তাঁরা সমাজে বিপরীত ক্ষমতা হিসেবে অবস্থান নিতে চান। যুক্তিবাদিতার
চর্চা করে মানবতার মুক্তি ও ব্যক্তিস্বাধীনতা নিশ্চিত করা যাবে না বলে তারা
আধুনিকতাবাদের সমালোচনা করেন। তাঁরা আধুনিক চিন্তার পদ্ধতিগত সীমানা ও দার্শনিক
পরিধিতে থাকেন, যেন রাজার প্রতি ভক্তি অক্ষুণ্ণ রেখেই রাজার যে কাপড় নেই, সেটা বলে
দিতে পারেন। অনেকটা কান্টের মতোই। কান্ট যখন বিশুদ্ধ বুদ্ধির পর্যালোচনা এবং
ব্যবহারিক বুদ্ধির পর্যালোচনা লিখার পর ধর্ম বিষয়ে পর্যালোচনা লিখতে ইচ্ছে করলেন,
তখন প্রুসিয়ার রাজার কাছে সেই পর্যন্ত লেখার স্বাধীনতা চাইলেন। রাজা বললেন, দর্শন
চর্চা কর, স্বাধীনতা উপভোগ কর, তবে রাজার প্রতি ভক্তি অক্ষুণ্ণ রেখো। রাজার প্রতি ভক্তি অক্ষুণ্ণ রাখতে গেলে
ধর্মের সমালোচনা করা যাবে না। ফলে কান্ট চূড়ান্ত স্বাধীনতা পেলেন না। অথচ যতটুকু
পেলেন, তা যুক্তিবাদিতার জায়গা থেকে যথেষ্ট বলে মনে করলেন।
ম্যাক্স বেবারের শেষের দিকের
রচনা, ‘The
Protestant Ethics and The Spirit of Capitalism’এ বিদৃত
হতাশাবাদি অবস্থানের সাথে নীটশে, ওয়ার্কহেইমার ও এডর্নোর অবস্থান ঘনিষ্ট। তার মানে
তাঁরা সবাই এমন ধারণা পোষণ করেন যে, আমলাতন্ত্র হলো উদ্দেশ্যমূলক যুক্তিবাদিতা,
যাতে যুক্তি ও তাড়না এতোই শক্তিশালী যে, তা মানবতার মুক্তির বদলে মানবতাকে
লৌহপিঞ্জরে আবদ্ধ করে রাখে। বেবার আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার সুবিধাগুলোর কথা বললেও
মনুষ্য স্বাধীনতার জন্য অন্তর্নিহিত বাধা ও সমস্যাগুলোও অনুধাবন করেছেন।
এদিকে এডাম স্মিথও যুক্তি দেন যে,
শ্রমবিভাজনের কারণেই প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন
বেড়েছে। কারণ মানুষ যখন কাজকে বিশেষ শ্রেণিতে ভাগ করে তখন তা অধিকতর দক্ষতা ও
পারঙ্গমতার সাথে করা যায়। আমলাতন্ত্র
হচ্ছে জটিল সংগঠনের একটি কাঠামোধারী ব্যবস্থা, যেখানে শ্রমবিভাজনের কারণে
অবিশ্বাস্য উৎপাদন ক্ষমতার উদ্ভব ঘটে। তবে, আমলাতান্ত্রিক কতৃত্ব তিনটি নীতির ওপর
নির্ভর করে, যেখানে ১) সংগঠনের কর্মকাণ্ড দাপ্তরিক কর্তব্য আকারে বণ্টিত থাকে, ২)
আদেশ দানের ক্ষমতা কঠোরভাবে বিধিবদ্ধ থাকে, ৩) শুধুমাত্র যাদের প্রয়োজনীয় যোগ্যতা
রয়েছে, তারাই নিয়োগপ্রাপ্ত হয়। বেবারের মতে, অন্য যেকোন সংগঠনের চেয়ে টেকনিক্যালি
এগিয়ে থাকার কারণে আমলাতান্ত্রিক সংগঠনের ব্যাপ্তি বৃদ্ধি পেয়েছে। আমলাতান্ত্রিক
সংগঠনের প্রধান শক্তি, জাড্য ও স্তরীকৃত ক্ষমতার বলয়, যেখানে অধঃস্তনরা
উর্ধ্বতনদের দ্বারা আদিষ্ট হন। গোপনীয়তার সংস্কৃতি এই ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করেছে মাত্র। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এখানে সবাই একই
আমলাতান্ত্রিক অভিলক্ষ্যে কাজ করে।
আমলাতান্ত্রিক সংগঠনের নেতিবাচক
দিকে হলো, এর কার্যকরতা ও দক্ষতা আসে ব্যক্তিগত স্বাধীনতার বিনিময়ে। আদর্শ
আমলাতন্ত্র মেশিনসুলভ। যখন কোন সংগঠন মেশিনের মতো কাজ করে, তখন এর সাথে যুক্ত
লোকজন তৈলযুক্ত বন্ধনীর মতো সে কাজগুলোই করে, যা মেশিনের স্বাভাবিক কার্যক্রমকে
সচলা রাখে। ব্যক্তিগত কাজ সে যত ভাল উদ্দ্যোগেই করা হোক না কেন, তা সংঘাত ও দ্বন্ধ
তৈরি করে। আমলাতন্ত্র লৌহপিঞ্জরে পরিণত হয়, মানবীয় আচরণের বিকল্প সুযোগগুলো
সীমাবদ্ধ ও বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে বলেই। ব্যক্তির
স্বাধীনতার বিনিময়ে এখানে প্রতিষ্ঠানের দক্ষতা ও কার্যকরতা বজায় রাখা হয়।
আমলাতন্ত্রের উত্তরাধুনিক
চ্যালেঞ্জ
যুক্তিবাদিতা নির্ভর আমলাতন্ত্রের
প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো এবং সচেতনভাবে নির্মিত দাপ্তরিক ভাষাকে মানুষের আচরণ
নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের পদ্ধতি উত্তরাধুনিক কালে এসে ব্যাপক
চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। যদিও আধুনিক ধারণার পরিবর্তে মানুষ নতুন নতুন ধারণার
সাথে খাপ খাইয়ে নিচ্ছে, একইসাথে মানুষ নিজেকে গোলোকায়িত সাংস্কৃতিক আধিপত্যের
ভিক্টিম ভাবতেও শুরু করেছে। উত্তরাধুনিককালে মহাবয়ানের অবলুপ্তির সাথে সাথে
মানুষের সামাজিক পরিচিতি গুরুত্ব হারাচ্ছে। ফলে সামাজিক যূথবদ্ধতার জায়গা সংকুচিত
হয়েছে। মানুষ নিজেকে সামাজিক প্রাণী ভাবার চেয়ে বিশেষ প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা,
সংগঠনের কর্মী, পেশাজীবী শ্রেণী/গোষ্ঠীর সদস্য বলে পরিচয় দিতে শুরু করেছে। এর ফলে
মানুষের মধ্যে এক ধরনের সামাজিক বিচ্ছিন্নতাবোধ দানা বাঁধছে। সামাজিক বন্ধন ঢিলে
হয়ে পড়ছে। সমাজে বসবাসরত মানুষের মধ্যে যে সংস্কৃতিভিত্তিক মূল্যবোধ ছিল সেগুলো
ক্রমাগতভাবে অপসৃত হচ্ছে এবং এক ধরনের কর্পোরেট মূল্যবোধ তৈরি হচ্ছে। এতে
পুঁজিবাদি তৎপরতাগুলোই এক ধরনের সাংস্কৃতিক মুখোশে ফিরে আসছে। মানুষকে পেয়ে বসেছে
অতৃপ্ত বাসনা, যে বাসনা চরিতার্থ করতে গিয়ে মানুষের ব্যক্তিসত্তাই যেন ভেঙেচুরে
যাচ্ছে।
সরকারি দপ্তরের কোন মুখপাত্র যখন
বলেন, ‘তাকে ক্লিয়ার মেসেজ দেওয়া হয়েছে’, তখন বোঝা যায় ক্লিয়ার মেসেজটা কী। শুধু
মেসেজের অর্থটাই অধরা রয়ে যায়। কারণ, দাপ্তরিক বার্তা এবং ভাষার অর্থ যে আলাদা
জিনিস। শব্দকে অর্থ ও আবেগবিযুক্ত করে যে বার্তা তৈরি হয়, সেটা আমলাতান্ত্রিক
জ্ঞানতত্ত্বের একটি প্রাথমিক সবক। আধুনিককালে তৈরি হওয়া আমলাতন্ত্রের দাপ্তরিক ভাষার
মূল লক্ষ্য ছিল সংগঠনের কর্মচারি এবং সেবা গ্রহীতার কাছে বার্তা পৌঁছানো। শব্দের
অর্থ এবং বার্তা এই দুইটিকে আলাদাভাবে বিচার করে, শব্দকে ব্যক্তিগত আবেগবিযুক্ত
করে অর্থ এবং বার্তাকে পৃথক করা হয়েছিল। ভাষা
দার্শনিক ভিটগেনস্টাইন শব্দের ব্যবহারনির্ভর অর্থ বা অভিজ্ঞতাভিত্তিক অর্থের ওপর
গুরুত্ব দেন কিন্তু জন সার্লে বার্তা এবং অর্থের পার্থক্যকে অগ্রাহ্য করতে অসম্মতি
জানান। কারণ আমলাতান্ত্রিক বার্তা ডিকশনারিতে থাকে না, এটা একটা ঐতিহ্য এবং
সাংগঠনিক কাঠামোগত আদেশ দ্ব্বারা নির্ধারিত হয়। দাপ্তরিক ভাষার এই বার্তা আদেশ পালনের
এক ধরনের ডিসিপ্লিনারি ক্ষমতা বহন করে যার মাধ্যমে মানুষের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। কিন্তু উত্তরাধুনিককালে ভাষাকে মানুষের
আচরণ নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা যাচ্ছে না। অন্তত এতে শতভাগ সাফল্য
আসছে না। কারণ ভাষা শুধু মানুষের আচরণ নিয়ন্ত্রণ ও সত্য বর্ণনার হাতিয়ার নয়। ভাষা
একটি জীবন্ত ও প্রবহমান সত্তা, যা আমলাতান্ত্রিক যুক্তিবাদিতার পরিধিতে স্থির নেই।
জাঁক দেরিদা ভাষা দিয়ে সমাজ নিয়ন্ত্রণের প্রজেক্টকে এক ধরনের মিথ বলে দাবি করেন।
দেরিদা সার্বিক নিয়ন্ত্রণের মধ্যে ভাষা নিয়ন্ত্রণের দিকে ইঙ্গিত দিয়ে ওই ধরনের
ভাষার অস্তিত্ব ও উপযোগিতা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেন। সরকারি চিঠি ও আদেশপত্রে বিদৃত
দাপ্তরিক ক্ষমতা এবং মানুষের আচরণ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা একই থাকছে না।
প্রথাগতভাবে আমলাদেরকে এক ধরনের
না-মানুষ বা আনম্যান ভাবা হয়। কারণ
তাদের আচরণে এমনভাবে নৈর্ব্যক্তিকতা নিশ্চিত করা হয়, যেন দাপ্তরিক সিদ্ধান্ত ও
কর্মকাণ্ডে তাদের ব্যক্তিগত আবেগের ছাপ না পড়ে। কিন্তু জার্মান দার্শনিক এডমুণ্ড
হুসার্ল ও মার্টিন হাইডেগার যে অবভাসবিদ্যা প্রচার করেছেন তাতে কান্টীয়
জ্ঞানবিদ্যা, যা এতোদিন আলোকায়নপর্বের জ্ঞানতত্ত্ব হিসেবে সমাদৃত হয়েছে, বিশেষ করে
বিষয় ও বিষয়ী নামক জ্ঞানতাত্ত্বিক বাইনারি অপজিশনে আমলা কর্তৃক কেস অনুধাবন ও
নাগরিক সম্পর্ক মোকাবেলার প্রধান জ্ঞানতাত্ত্বিক পদ্ধতি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে, তা
প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। কান্টের মতে, চিন্তা করা মানে সমন্বয় করা, বিষয় ও বিষয়ীর
সমন্বয়, জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়-এর সমন্বয়, ব্যক্তি ও বস্তুর সমন্বয়। কিন্তু জানার বিষয়টি
চিন্তার সাথে যুক্ত, বিশেষ করে জ্ঞেয় বিষয়ে চিন্তা করাই হলো জ্ঞান। অন্যদিকে জানার
সাথে নতুন শর্ত যুক্ত করার প্রশ্ন আসে। সেটা হলো জ্ঞাতা শুধু জ্ঞেয় বস্তুকে জানলেই
জানাটা নির্ভরযোগ্য হবে না, যতক্ষণ না জানার পদ্ধতিটাকেও জানা হচ্ছে। মানুষ চোখ
দিয়ে দেখে, কিন্তু চোখের যে মেকানিজম দ্বারা দেখার কাজ সম্পন্ন হয়, সেই বিষয়ে
সচেতন না থাকলে কোন কিছু সত্যিকার অর্থে দেখা হয়েছে বলে দাবি করার জ্ঞানতাত্ত্বিক
বৈধতা নেই।
হুসার্ল ও হাইডেগার উভয়েই বিষয় ও
বিষয়ীগত রিয়্যালিটির পরস্পরাঙ্গী অস্তিত্বের কথা স্বীকার করেছেন। একজন আমলা যখন
নাগরিক কিংবা কেস ডিল করেন তখন তিনি শুধু ব্যক্তি হিসেবে বা জ্ঞাতা হিসেবেই ডিল
করেন না, বিষয়ী কিংবা জ্ঞেয় হিসেবেও ডিল করেন। অর্থাৎ আমলা একইসাথে আমলা ও নাগরিক।
একইসাথে সেবা দাতা ও সেবাগ্রহীতা। ফলে আমলার মধ্যে আমলাসত্তা ও নাগরিকসত্তা
পরস্পরাঙ্গীভাবে বিরাজ করে। একটি বিশেষ পরিবেশে থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও সিদ্ধান্ত
বাস্তবায়ন সম্পর্কে যে বোঝাপড়া তৈরি হয়, তা থেকে স্বাভাবিক মনস্তাত্ত্বিক ঝোঁককে
আলাদা রেখে, বিবেচ্য বিষয়কে ভেতর থেকে দেখা, সর্বোপরি দেখার পদ্ধতিটাকে দেখা হলো,
হুসার্লের মতে বিশুদ্ধ জানার পদ্ধতি।
আমলাতন্ত্রে সংস্কার চাপাতে গিয়ে অনেকে
এমন ধারণা পোষণ করেন যে, কিছু নিয়মনীতি বানিয়ে খারাপ কিছু দূর করে ভাল কিছু করা
সম্ভব। কিন্তু এটা যুক্তি ও আমলাতন্ত্র দিয়ে যুক্তিবাদিতা ও আমলাতন্ত্রের ত্রুটি
দূর করার মতোই ঠেকে। অনেকটা ডাক্তার কর্তৃক নিজেকে নিজে রোগমুক্ত করার মতো। কিন্তু
এতে দীর্ঘসূত্রতা বাড়ে। কারণ যুক্তিবাদিতা অধিকতর যুক্তিবাদি ব্যবস্থার মাঝে
যৌক্তিক সংকটের মীমাংসা খোঁজে। তাই উত্তরাধুনিকতাবাদিরা যুক্তিবাদিতা ও
আমলাতন্ত্রের মধ্যে আমলাতন্ত্রের অতিরঞ্জন ও বাড়াবাড়ি সম্পর্কিত সমস্যা সমাধানের
আশা করেন না।
উদারবাদ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে
অনেকে একাডেমিক চর্চার জায়গা থেকেও আমলাতান্ত্রিক স্তর বিন্যাসে সমতলতা এনে
সংস্কার করার প্রস্তাব করেন। সাংগঠনিক
কর্তৃত্বের স্তরে সমতলতা এনে আমলাতন্ত্রে নারীর প্রবেশ ও বিচরণ বাড়ানো
নারীবাদিদেরও একটি প্রধান দাবি। তারা মনে করেন, আমলাতন্ত্রের স্তর কমালে সমস্যার
সমাধান হবে। কিন্তু উত্তরাধুনিকতাবাদিরা এটিকে রঙ লাগিয়ে পুরনো ইস্পাতের মরিচা দূর
করার সাথে তুলনা করেন। এই ধরনের স্বল্পমেয়াদি ব্যবস্থা, সমস্যাকে আড়াল করা ব্যতীত,
উপযুক্ত কোন সমাধান বলে গ্রাহ্যতা পায় না।
উত্তরাধুনিক চিন্তা শুধু আধুনিক
দর্শন ও সংস্কৃতিকে নয়, সমস্ত প্রতিষ্ঠানকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে। সমাজ ও
ব্যক্তি সম্পর্কে আমাদের পূর্বতঃসিদ্ধ ধারণাগুলোকেও চ্যালেঞ্জ করছে। যেহেতু আমলাতন্ত্রের
বৈধতা নির্ভর করে আধুনিক দার্শনিকদের দ্বারা প্রচারিত যুক্তিবাদিতা ধারণের ওপর,
সেহেতু যুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে মানবতার মুক্তি হলো এর পরম লক্ষ্য। ফলে অন্যান্য
অনেক ক্ষেত্র ছাড়াও উৎপাদনে কার্যকরতা ও দক্ষতা আনয়নের মাধ্যমে পণ্যের মূল্য কমানো
এবং জনগণের জীবনমান উন্নয়নে সহায়তা করা আমলাতন্ত্রের কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু আধুনিকতাবাদিরা
যেখানে জীবন ও প্রকৃতিকে যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করার মাধ্যমে শাসন পরিচালনের সংগঠন
ও প্রতিষ্ঠানকেও যুক্তি নির্ভর নিয়মাবদ্ধ কাঠামোর ভিত্তিতে দাঁড় করাতে চান,
উত্তরাধুনিকতাবাদিরা সেই কাঠামো ভাঙতে চান। তাদের মতে, সেই গোয়ার্তুমির যুগ এখন
নেই, যখন নিরপেক্ষ আমলাতন্ত্রের জন্য উইলসনীয় নীতিতে প্রশাসন ও রাজনীতির পৃথককরণ,
টেলরের নীতিতে বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা এবং ম্যাক্স বেবারের নীতিতে স্তরাবদ্ধ
নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে আদর্শ আমলাতন্ত্র হাজির ছিলো। পরিবর্তে এখন মানবতাবাদি
ব্যবস্থাপনা, জাপানী নিউ পাবলিক ম্যানেজমেন্ট এবং অংশগ্রহণমূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণের
প্রক্রিয়া চালু হয়েছে। ধ্রুপদী আমলাতন্ত্রে গোয়ার্তুমি আসে পরস্পরযুক্ত ব্যবস্থার যৌক্তিক
সংগতি ও সংহতি থেকে। সেখানে আমলাদের
ডিসক্রেশনারি ক্ষমতা লোকপ্রিয় সার্বভৌমত্বের কিছুটা খেলাপ করে। এমনকি আমলারা যদি
স্বাধীনভাবে সরকার প্রদত্ত বৈধ ক্ষমতাও ব্যবহার করেন, তাতে জনস্বার্থ নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত
হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। এই
ধরনের ক্ষমতাকে চেক দেয়ার জন্য যখন নতুন নতুন বিধিবিধান প্রণয়ন করা হলেও সমাধানের
পরিবর্তে নতুন বৈপরিত্য ও স্ববিরোধ দেখা দেয়। অর্থাৎ নতুন আইনের নতুন ব্যাখ্যা নতুন ত্রুটির উদ্ভব ঘটায়। ফলে বিধিবিধান
দিয়ে আমলাতন্ত্রের দোষ দূরীকরণের প্রয়াস সফল হয় না।
আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনে কোন কাজ
যথার্থভাবে করার চেয়ে কাজটি যে করা হয়েছে সেটা প্রদর্শন করা অধিক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে
ওঠেছে। সিগনিফায়ার যেন সিগনিফায়েডকে ছাড়িয়ে গেছে। এই ধরনের অনভিপ্রেত লক্ষণের কারণ
হলো কর্মকর্তাদের কর্মদক্ষতা এবং কাজের ফলাফল মূল্যায়নের জন্য গৃহীত ব্যবস্থা। নব্য
সরকারি ব্যবস্থাপনা মডেলের নিরিখে কর্মমূল্যায়নের জন্য যে সূচকগুলো ব্যবহৃত হয়
সেগুলোতে ভালো স্কোর তোলা এখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দক্ষতা ও ফলাফল নির্ভর
মূল্যায়নের নিরিখে সিদ্ধান্ত নেয়ার কারণে মূল কাজের চেয়ে কাজের প্রদর্শনী
গুরুত্বপুর্ণ হয়ে ওঠেছে।
নারীবাদ এবং সাংস্কৃতিক
বহুত্ববাদের প্রভাবে আমলাতন্ত্রে নারীর উপস্থিতি যেমন বেড়েছে, তেমনি আমলাতন্ত্রের
সাথে জনগণের এবং সমাজের সর্ববৃহৎ সংখ্যালঘুগোষ্ঠী হিসেবে নারীর সম্পর্ক বেড়েছে।
অন্যদিকে ফুঁকোর ক্ষমতাতত্ত্বের প্রভাবে এবং নব্য উদারবাদি নীতির প্রভাবে ক্ষমতার
সোপানে সমতলতা আনার কারণে আমলাতন্ত্র জনগণের কাছাকাছি এসেছে। সমাজের যে গরীবরা
আমলাতন্ত্রের প্রান্তিক অংশের সাথে সম্পর্কের ভিত্তিতে রাষ্ট্রকে মোকাবেলা করে,
তাদের সাথে আমলাতন্ত্রের সম্পর্ক বাড়ার কারণে গরীবদের ওপর উচ্চবিত্তদের প্রভাবও
কমতে শুরু করেছে। তবুও ধনী-গরীব, মালিক-মজুর দ্বন্ধ্বের অবসান হয়নি। বুর্জোয়া ও
সর্বহারা শ্রেণী প্রতিনিয়ত রাষ্ট্রের সাথে তাদের সম্পর্ক নির্ধারণের লড়াইয়ে লিপ্ত। অন্যদিকে রাষ্ট্র একক কোন শ্রেণীর
আধিপত্যের সম্ভাবনাকে প্রতিরোধ করে চলে। আমলাতন্ত্র সেই শ্রেণীআধিপত্য প্রতিরোধের
প্রধান হাতিয়ার হিসেবে রাষ্ট্রকে একক কোন শ্রেণির আধিপত্যের খপ্পর থেকে বাঁচাতে
সক্রিয়। এভাবে আমলাতন্ত্রের নিরপেক্ষতার ওপরে নির্ভর করে রাষ্ট্রের শ্রেণিনিরপেক্ষতা
ও সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার সক্ষমতা।
আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংস্কারের
মুখোশে নব্য উদারবাদি নীতি বিশেষ করে, সরকারি প্রতিষ্ঠানকে কর্পোরেট ম্যানেজমেন্টের
আওতায় এনে সরকারি প্রতিষ্ঠানে ভাড়াটে ব্যবস্থাপক বসিয়ে, কর্মীদের কর্মমূল্যায়নের
জন্য চকচকে সূচকের ছক বিস্তৃত করে খোদ রাষ্ট্রেরই বেসরকারিকরণ প্রক্রিয়া এখন
বিশ্বপুঁজিবাদের এজেণ্ডা। এটি
আমলাতন্ত্রের জন্য একটি শক্ত ধাক্কা। এইজন্য যে এটি একটি ছদ্মবেশি প্রোগ্রাম, যার
অন্তরালে নিহিত থেকে আমলাতন্ত্রকে দুর্বল করে আমলাতন্ত্রের ওপর বুর্জোয়াদের
আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে শ্রমিকশ্রেণির ওপর স্থায়ী বিজয় নিশ্চিত করা। ফলে
‘সংস্কার’ শব্দটি আমলাতন্ত্রের জন্য নির্দোষ প্রত্যয় নয়। এর পেছনে থাকে বাণিজ্যিক
কর্পোরেশনের একাডেমিক এজেন্টসহ বাণিজ্যিক পুঁজির অদৃশ্য হাত।
শেষকথা
কালের পরিক্রমায় মানুষের চিন্তা
এবং তৎপরতায় পরিবর্তন আসে। রাষ্ট্রদর্শন
ও সমাজ দর্শনের মতো আমলাতন্ত্রের রূপান্তরেও মানুষের পরিবর্তিত চিন্তার প্রতিফলন
ঘটেছে। নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের মোকাবেলায় রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের অভ্যন্তরে নতুন
নতুন কৌশল নেয়া হয়। রাষ্ট্রকে কেন্দ্র করে সমাজের ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণির স্বার্থের
বিরোধ মোকাবেলার সাথে সাথে আমলাতন্ত্র নিজেও একটি নৈর্ব্যক্তিক সত্তা নিয়ে নিজের
অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে সদা শামিল। উত্তরাধুনিককালে ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের যে
বিকেন্দ্রীকরণ ঘটেছে, সিদ্ধান্তগ্রহণে কতিপয়ের জায়গায় যে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর
অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়েছে, আমলা ও নিয়মকেন্দ্রিকতার পরিবর্তে যে সেবাগ্রহীতাকেন্দ্রিক
এপ্রোচ গৃহীত হয়েছে, ভ্রষ্টাচারের বিপরীতে যে শুদ্ধাচারের অঙ্গীকার নেয়া হয়েছে এবং
সর্বোপরি শাসন পরিচালনে উদ্ভাবনী শক্তির যে পৃষ্ঠপোষকতা বেগবান হয়েছে, তার পেছনে
নতুন যুগের চাহিদার সাথে আমলাতন্ত্রের মানিয়ে নেয়ার গরজ কাজ করেছে। তবে নতুন
পরিবর্তনের সবকিছুই যে কল্যাণকর ও যৌক্তিক তা নয়। ইতিমধ্যেই উদারবাদি নীতি,
বেসরকারিকরণ এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মতো মুনাফামুখি
প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরের বিরুদ্ধে মানুষ সোচ্চার হয়েছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানকে
অর্থনৈতিকভাবে অলাভজনক ও ব্যর্থ বদনাম দিয়ে যারা এতোদিন বেসরকারিকরণকে প্রমোট করে রাষ্ট্রের
ওপর সাধারণ জনগণের মালিকানা ব্যাহত করতে ভূমিকা রেখেছে, তারা নিজেরাই এখন জনরোষের
মুখে পড়েছে। এতৎসত্ত্বেও গোলোকায়নের চ্যালেঞ্জ, জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ, গভীর
প্রভাব ফেলে এমন অদৃশ্য দূরবর্তী কারণের চ্যালেঞ্জ, বাটারফ্লাই ইফেক্ট বা ক্যায়স
থিওরিজাত চ্যালেঞ্জ এবং কালোহাতির চ্যালেঞ্জ ( এমন ক্ষতিকর ঘটনা, যেটি সবাই দেখে ও
বুঝে কিন্তু কেউ প্রতিরোধের জন্য এগিয়ে আসে না) ইত্যাদি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায়
আমলাতন্ত্রে তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক কৌশল উন্নয়নের তৎপরতা চলছে। নীতিনির্ধারকদের
দ্বারা নেটওয়ার্ক তৈরির মাধ্যমে আমলাতন্ত্রকে পাশ কাটিয়ে কার্য হাসিল করার অভিমান
কাটিয়ে আমলারা নিজেরাই নিজেদের নেটওয়ার্কের মাধ্যমে কাজের সক্ষমতা বৃদ্ধির দিকে
মনোযোগী হয়েছে। ফলে আমলাতন্ত্র আধুনিক ও উত্তরাধুনিক উভয় চ্যালেঞ্জকের মোকাবেলার
সক্ষমতা অর্জনের তৎপর।
কর্পোরেট ম্যানেজমেন্টের প্রভাবে
এবং রাষ্ট্রের ওপর পুঁজিপতি শ্রেণির একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম হওয়ার কারণে
আমলাতন্ত্রের ফাংশনে কিছুটা পরিবর্তন আসলেও জনগণের নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যসেবা,
দুর্যোগ মোকাবেলা, সমাজকল্যাণ, সামাজিক ন্যায়বিচার ও শৃঙ্খলা এবং ক্রমবর্ধমান
প্রবীণ জনসংখ্যার সেবা নিশ্চিত করণে আমলাতন্ত্রের বিকল্প নেই। মানুষের বয়স,
লিঙ্গভিত্তিক সামাজিক পরিচয় ও নৃতত্ত্বভিত্তিক সাংস্কৃতিক পরিচয় নিয়ে রাষ্ট্রীয়
সুবিধা বণ্টনে যে বায়োপলিটিক্স চলে, তাতে আমলাদের দক্ষতা এবং নিরপেক্ষতাই পিছিয়ে
পড়াদের একমাত্র সম্বল। মানুষের ব্যক্তিজীবনের যে সার্বভৌম অধিকার তা এখনো
আমলাতন্ত্রের কার্যকরতার ওপর নির্ভর করে। ম্যাক্স বেবার প্রুসিয়ান আমলাতন্ত্রের
আদলে যে আমলাতন্ত্র প্রস্তাব করেছিলেন তা উত্তরাধুনিক চ্যালেঞ্জের মুখে কিছুটা
কোমলতা ও সমতলতা অর্জন করলেও তার দক্ষতা ও ফাংশন অবিকৃত রয়েছে। কালের গুণে ক্ষমতার
কেন্দ্র ও ক্ষমতার কার্যকরি নেটওয়ার্ক বিস্তৃত পরিসরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে মাত্র।
ভবিষ্যতে হয়তো আরও নতুন চ্যালেঞ্জ আসবে। আমলাতন্ত্রও নতুন বিবর্তনের ভেতর দিয়ে
যাবে, কিন্তু এর প্রয়োজনীয়তা ফুরাবে না।
গ্রন্থপঞ্জী:
ইয়ের্মাকোভা, ই. এবং রাতনিকভ ভ. ১৯৮৮.
শ্রেণী ও শ্রেণী-সংগ্রাম, মস্কো: প্রগতি প্রকাশন।
Agamben, Giorgio. 1998.
Homo Sacer, California: Stanford
University Press.
Bell, Daniel A. 2015. The China Model, New Jersey: Princeton
University Press.
Brooks, Thom. 2007. Hegel’s Political Philosophy, Edinburgh:
Edinburgh University Press.
Cochrance, Glynn. 2018. Max Weber’s Vision for Bureaucracy, London:
Palgrave Macmillan.
Foucault, Michel.1980. Power/Knowledge: Selected
Interviews and Other Writings, 1972–1977, ed. Colin Gordon. New York: Pantheon Books.
Gupta, Akhil. 2012. Red Tape, Durhum: Duke University Press.
Ho, Peter. 2018. The Challenge of Governance in A Complex
World, Singapore: World Scientific Publishing Company.
Horkheimer, Max and Adorno,
Theodor W. 2002. Dialectic of
Enlightenment, Translated by Edmund Jephcott, California: Stanford University Press.
Kant, Immanuel. 2015. Critique of Practical Reason, Translated by Mary Gregor, Cambridge:
Cambridge University Press.
Miller, Hugh T. and
Fox, Charles J. 2007. Postmodern Public
Administration, London: M.E. Sharpe.
Plato. 1991. The Republic, trans. Allan Bloom, USA: Basic
Books, Harper Collins Publishers.
Hummel, Ralph P. 2015. The
Bureaucratic Experience, New York, Routledge.
Sen, Anupam. 1982. The State, Industrialization and Class
formation in India, London: Routledge & Kegan Paul.
Weber, Max. 1947. The Theory of Social and Economic
Organization, Translated by A.M. Henderson and Talcott Parsons, New York:
Oxford University Press.
--------2001. The Protestant Ethic and The Spirit of
Capitalism, Routledge.
Comments