Skip to main content

ভাষা-শিক্ষায় সাম্প্রদায়িকতা প্রসঙ্গে সলিমুল্লাহ খান

সরওয়ার কামাল

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ভারতে সাম্প্রদায়িকতার একটি নতুন রূপ দেখা দেয়, যা সমকালীন সমাজ ও রাজনীতি ছাড়িয়ে বাঙলা সাহিত্য অবধি বিস্তার লাভ করেছিল। এই সাম্প্রদায়িকতার বীজ রোপিত হয়েছিলো ঔপনিবেশিক যুগের ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে, যখন প্রাচ্যবাদ ও প্রতিক্রিয়াশীলতা দ্বারা তাড়িত হয়ে উইলিয়াম জোনস, উইলিয়াম ক্যারি, নাথানিয়েল ব্রাসি হালেদ এবং চার্লস উইলকিন্স কিছু সংস্কৃত পণ্ডিতের সহযোগিতায়, সংস্কৃতের অনুকরণে, বাঙলা ভাষার সংস্কার সাধন করছিলেন। তারা সংস্কৃতের ছাঁচে ভাষাবিধি ও শব্দভাণ্ডার তৈরি করেছিলেন। তারই প্রভাবে প্রাচীন ও মধ্যযুগের ভাষার সাথে নবায়িত বাঙলা ভাষার কৃত্রিম বিচ্ছেদ সম্পন্ন হলো। তুর্কি, আরবি ও ফারসি শব্দ যোগে গঠিত বাগবিধি এবং ইতিহাস পরম্পরায় বিবর্তিত ভাষা থেকে লোপ পেলো বাঙলার স্থানীয় লৌকিক রূপ এবং ধর্ম-বর্ণের বৈচিত্র্য। তাতে করে একধরনের সংস্কৃত প্রভাবিত মান ভাষা তৈরি হলো। এটা ছিল ভাষায় সাম্প্রদায়িকতা আমদানির ঔপনিবেশিক প্রয়াস। যারা এই ভাষা পরিস্থিতিকে গ্রহণ করেছিল, তাদের কাছে আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহার করা একটি ধর্মীয় চমক ও নতুনত্বের বাহাদুরি বলে গণ্য হলো। অথচ কে না জানে, ইংরেজ বেনিয়ারা ক্ষমতা দখল না করলে ভারতের রাষ্ট্রভাষা আজতক ফারসিই থেকে যেত? ভাষার সেই প্রক্ষেপ মান্য করলে ফারসি ভাষার প্রভাবে বাংলায় কিছু ফারসি শব্দ প্রবেশ করবে, এটাই ছিল স্বাভাবিক। অথচ বিংশ শতাব্দিতে কবি নজরুল ইসলাম যখন সাহিত্যে ফারসি শব্দ ‘খুন’ এস্তেমাল করছিলেন, তখন খোদ রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকেই বাধা আসলো। শুরু হলো বাঙলা ভাষায় সাম্প্রদায়িক শুদ্ধতাবাদি মেরুকরণ। বিংশ শতকে ভাষার এমন সাম্প্রদায়িক মেরুকরণে রবীন্দ্রনাথের দায় আছে। বাংলাদেশের তীক্ষ্ণধী ভাবুক সলিমুল্লাহ খান ভাষা-শিক্ষায় সাম্প্রদায়িকতার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের দায় চিহ্নিত করে লিখেছেন 'ঠাকুরের মাৎস্যন্যায়'।  

 


'ঠাকুরের মাৎস্যন্যায়' বইটি ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার মধুপোক থেকে প্রকাশিত হয়েছে। সলিমুল্লাহ খান রচিত ১৩১ পৃষ্ঠার বইটিতে কবি নজরুল সম্পর্কে মাত্র চারটি প্রবন্ধ আছে। তার মধ্যে মূল প্রবন্ধ তিনটি, প্রস্তাবনা আকারে আছে আরও একটি নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধ। সাথে সংবর্ধনা হিসেবে আছে রবীন্দ্রনাথের একটি অভিভাষণ, সেই অভিভাষণের প্রতিক্রিয়ায় নজরুলের জবাব, রবীন্দ্র-নজরুল বিতর্ক উপলক্ষে লেখা প্রমথ চৌধুরীর প্রবন্ধ এবং শেষে নজরুল রচিত কবিতা 'আমার কৈফিয়ৎ'।

 

বইটির মূল প্রতিপাদ্য ভাষা-শিক্ষায় সাম্প্রদায়িকতা। সম্প্রদায়নির্ভর ভাষারূপ দিয়ে ভাষার সাম্প্রদায়িক চেহারা তৈরি করে, সেই ভাষা কে কোথায় ব্যবহার করবে, এমন ক্ষমতা আরোপ করার মধ্য দিয়ে ভাষায় সাম্প্রদায়িকতার উদ্ভব, যে সাম্প্রদায়িকতা থেকে খোদ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও মুক্ত নন। বরং তার ‘ঠাকুর’ অবস্থান থেকে অন্যান্য কবি সাহিত্যিকদের সম্পর্কে তার মূল্যায়ন ও মন্তব্য বাংলাসাহিত্যে ‘ঠাকুরের প্রভাব’ আকারে বিরাজ করছে। এই প্রভাব ছোটর ওপর বড়র প্রভাব, ক্ষমতাহীনের ওপর ক্ষমতাবানের প্রভাব। বড় মাছের ছোটমাছ গেলার মতো বলে, সলিমুল্লাহ খান জানাচ্ছেন, এটা ন্যায় নয়, মাৎস্যন্যায়।

 

‘ঠাকুরের মাৎস্যন্যায়’ প্রবন্ধে সলিমুল্লাহ খান দেখিয়েছেন নোবেল পুরস্কার পেয়ে, জমিদারি উত্তরাধিকার পেয়ে, এমনকি রাজনীতি না করেও সামাজিক প্রভাবপ্রতিপত্তি নিয়ে, রবীন্দ্রনাথ কীভাবে, সার্বিক অর্থে, একজন গুরু হয়ে উঠেছিলেন। চিরকেলে বাণী লিখে যথার্থ কাব্যের রচয়িতা হয়ে উঠেছিলেন। তিনি শুধু কবি নয়, একেবারে ভাষার গুরু বৈকি। তাইতো নজরুল যখন ফারসি শব্দ এস্তেমাল করছেন, বিশেষ করে রক্তের পরিবর্তে 'খুন' লিখছেন, তিনি তা বরদাশত করতে পারেন নি। এটা ন্যায় নয়। সলিমুল্লাহ খান মনে করেন, এখানে দুর্বলের ওপর শক্তিমানের প্রভাব, প্রকারান্তরে মাৎস্যন্যায় ঘটেছে, এবং তাতে রবীন্দ্রনাথের দায় আছে।

 

সলিমুল্লাহ খানের দ্বিতীয় প্রবন্ধ 'ভাষা শিক্ষায় সাম্প্রদায়িকতা: রবীন্দ্রনাথের সাধনা'। এটি একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ। এখানে তিনি বুদ্ধদেব বসুর উদ্ধৃতি দিয়ে দেখিয়েছেন, রবীন্দ্রনাথ বাংলা ভাষার রক্ত-মাংসে মিশে আছেন। বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের সম্মোহন থেকে বেরোবার ইচ্ছে যেন রাজদ্রোহের শামিল। সেই প্রভাববলয় থেকে বেরিয়ে 'প্রতিভাবান বালকের মতো’ লিখলেও, রবীন্দ্রনাথের পরে নজরুলই প্রথম মৌলিক কবি। যদিও বসুর দাবি, নজরুলের কবিতায় যে পরিমাণ উত্তেজনা মিলে সেই পরিমাণ পুষ্টি মিলে না, তবুও নজরুলই বাংলা সাহিত্যে নতুন যুগের প্রবর্তক। তবে এই বিষয়ে ভিন্নমত কাজী আবদুল ওদুদের। ওদুদের মতে, নজরুল নতুন যুগের প্রবর্তক নয়, ভারতের একজন স্মরণীয় কবি মাত্র।

 

কবি নজরুল বাঙলা সাহিত্যে নতুন যুগের উদ্গাতা কিনা, এই তর্ক আপাতত উহ্য রেখেও চোখ বুলানো যায়, রবীন্দ্রনাথের ‘সাহিত্যধর্ম’ প্রবন্ধে, যেখানে তিনি নতুন কবিদের সাহিত্য নিয়ে আপত্তি প্রকাশ করেছেন। ঠাকুরের আপত্তি সলিমুল্লাহ খান ঠাকুরের জবানেই পেশ করেছেন, ‘নতুন যুগের সাহিত্য বে-আব্রু, হুজুগে, নিত্য নয়’। এই সাহিত্যে অভাব আছে চিরায়ত বৈশিষ্ট্যের, আছে নিছক বিজ্ঞানমদমত্ত ডিমোক্রাসি। নতুন যুগের সাহিত্যে মানুষের জীবধর্ম ও চিত্তধর্মের সীমা নিয়ে বিরোধ বাধে। তার পর্যবেক্ষণ হলো, নতুন যুগে বিজ্ঞানের প্রভাব কোন সীমানা মানছে না। সর্বত্র তার অনধিকার প্রবেশ। অথচ, রবীন্দ্রনাথের মতে, ‘বৈজ্ঞানিক কৌতুহলের ঔৎসুক্য সাহিত্যে চিরকাল টিকতে পারে না'। 'মানুষের রসবোধে যে আব্রু আছে সেইটেই নিত্য, যে আভিজাত্য আছে রসের ক্ষেত্রে সেইটেই নিত্য'। রবীন্দ্রনাথ নতুন যুগের সাহিত্যকে নেতিবাচক বচনে সংজ্ঞায়িত করার প্রয়াস পেয়েছেন। অথচ কোন সংজ্ঞা না-বাচক বচনে দিলে যৌক্তিক অনুপপত্তি ঘটে। সংজ্ঞা দিতে হয় সদর্থক বচনে, আছেবাচকতা দিয়ে।  

 

নতুন যুগের সাহিত্য মূল্যায়ন করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ রুচির বিরোধও চিহ্নিত করেছেন। তার মতে, বিজ্ঞানের প্রভাবজাত নির্লজ্জতা সাহিত্যে হট্টগোল বৃদ্ধি করেছে। এটা আধুনিক সাহিত্যের বাহাদুরি। বিজ্ঞানবাদি সাহিত্যিক নিত্যবস্তুর সাধনা নয়, সত্যবস্তুর/ রিয়ালিটির অর্চনা করবেন। য়ুরোপের ডাডাইজমের মতো সাহিত্যে চমক দেওয়াই এর চরম উৎকর্ষ। এক পর্যায়ে রবীন্দ্রনাথ কিছুটা শ্লেষের সাথেই উল্লেখ করেছেন, ‘নতুনত্ব দেখে আমাদের দেশের স্কুল মাস্টারেরা অভিভূত হয়ে পড়ে’। স্পষ্ট যে, সাহিত্যের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ রক্ষণশীল।

 

নিত্যবস্তু বাদ দিয়ে সত্যবস্তু বা রিয়ালিটির চর্চা সাহিত্যে দুই নেতিবাচক পরিণতি নিয়ে এসেছে; দারিদ্র্যের আস্ফালন এবং লালসার অসংযম। ফলে একটা কৃত্রিম সস্তা সাহিত্য, বাছবিচারহীন পাঠকের পক্ষে সাহিত্যিক অপথ্য হিসেবে হাজির হয়েছে। বুঝা যাচ্ছে, ধৈর্য হারিয়ে রবীন্দ্রনাথ তার বক্তব্য ছাড়িয়ে বক্তাদেরও আক্রমণ করে বসেছেন। এই ধরনের চিন্তাগত ত্রুটি ও যৌক্তিক ফ্যালাসিকে যুক্তিবিদ্যায় ‘এড হোমিনেম’ বলা হয়। নতুন সাহিত্য সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের সাধারণ আপত্তিগুলো বাদ দিয়ে সুনির্দিষ্ট অবস্থান চিহ্নিত করতে পাঠকদের ফিরে তাকাতে হবে একটি সংবর্ধনা সভার দিকে।  

 

১৯২৭ সালের ১৩ ডিসেম্বর প্রেসিডেন্সি কলেজের দর্শনের অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ দাসগুপ্ত (যিনি একসময় চট্টগ্রাম কলেজের অধ্যাপক ছিলেন) রবীন্দ্র পরিষদের ব্যানারে ঠাকুরের একটি সংবর্ধনার আয়োজন করেন। সেখানে রবীন্দ্রনাথ একটি অভিভাষণ পাঠ করেন, যা পরবর্তীতে 'শনিবারের চিঠি' ও 'বাঙ্গলার কথা' নামক দুইটি পত্রিকায় ছাপানো হয়। রবীন্দ্রনাথ সেই অভিভাষণে নজরুল ইসলামের নাম নেন নি। নজরুলের নাম মুখে না নিলেও নজরুলের সাহিত্যকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে ছাড়েন নি; তুচ্ছতা দেখাতে গাফিলতি করেন নি। রবীন্দ্রনাথের মতে, নজরুলের সাহিত্য শক্তিহীন, অপটু ও কৃত্রিম। অত্যন্ত সঙ্গত কারণেই নজরুল তার প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। তিনি রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে কড়া অভিযোগ তুলে বললেন, ‘রবী শুধুমাত্র সাহিত্য নিয়ে নয়, লেখকদের অভিশপ্ত জীবনের দারিদ্র্য নিয়ে বিদ্রুপ করেছেন’।

 

প্রেসিডেন্সি কলেজে প্রদত্ত অভিভাষণে রবীন্দ্রনাথ ভাষায় 'রক্ত' শব্দের পরিবর্তে 'খুন' ব্যবহার করায় দোষ ধরেছেন। তবে, তা নজরুল নাকি জনৈক হিন্দুকে লক্ষ্য করে তা নিয়ে মতদ্বৈততা আছে। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত মনে করেন, নজরুল রবীন্দ্রনাথকে ভুল বুঝেছিলেন। এই অভিভাষণের প্রতিক্রিয়ায় নজরুল লিখলেন, ‘বড়র পিরীতি বালির বাধ’। তাকে লক্ষ্য করে লেখা প্রবন্ধের কোন উত্তর দিলেন না ঠাকুর মহাশয়। উত্তর দিলেন, রবীন্দ্রনাথের ভাইজি জামাই ব্যারিস্টার প্রমথ চৌধুরী, তার 'বঙ্গ সাহিত্যে খুনের মামলা' নামক প্রবন্ধে। চৌধুরী দাবি করেছেন, রবীন্দ্রনাথের কথাগুলো নজরুলকে উদ্দেশ্য করে বলা হয় নি।

 

পরবর্তীতে প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের বক্তব্যের বিশেষ সংকলনে (সাহিত্যের পথে) একটি 'হিন্দু' শব্দ যোগ করে নজরুল থেকে নিশানা সরানো হলো অন্যত্র। রবীন্দ্রনাথ ১৩৩২ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মিলনের 'শিউড়ি' অধিবেশনের সভাপতির বক্তব্যে বাংলা ভাষায় মুসলমানি মালমসলা বাড়ানোর ক্ষেত্রেও আপত্তি করেন নি, কিন্তু হিন্দুরা তা করবে, তা তিনি একেবারেই মেনে নিতে পারেন নি। রবীন্দ্রনাথের মতে, নতুন যুগের বাংলা সাহিত্য নিয়ে হিন্দু-মুসলমান বিরোধ ভালো নয়। সেইসময় অনেক নেতাই মনে করতেন, বাংলা ভাষার প্রতি মমত্ব বেড়ে গেলে তা প্রকারান্তরে ভারতের বৃহৎ ঐক্যসাধনে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে। অথচ খুনের ব্যবহার নিয়ে আপত্তি তোলার পূর্বে রবীন্দ্রনাথ বাংলাদেশের ভাষা ও সাহিত্যে মিলনের স্বপ্ন দেখেছিলেন। সেইসময় তিনি সাহিত্যে সাম্প্রদায়িকতা ও জাতিভেদ মানেন নি। যেহেতু নতুন যুগের সাহিত্য পুরাতন সাহিত্যের অনুকৃতি নয়, নতুন সৃষ্টি। তাই এ নিয়ে হিন্দুতে-মুসলমানে বিরোধ। এই বিরোধ শুধু হিন্দু-মুসলমানে নয়। হিন্দুতে হিন্দুতে এবং মুসলমানে মুসলমানেও। ভাষা বাদ দিয়ে বৃহত্তর ভারতীয় ঐক্যসাধনের প্রস্তাব যেমন আত্মঘাতি, একইভাবে মুসলমান সমাজের ঐক্য চাওয়াও আত্মঘাতী।

 

রবীন্দ্রনাথের মতে, সাহিত্য ক্ষণকালের নয়, চিরকালের বস্তু। তাই তিনি প্রত্যাশা করেন, চিরায়ত তরুণ নতুন শব্দ নিয়ে চমক দেখাবে না। তারা ক্ষণকালের তুচ্ছতা থেকে, জীর্ণতা থেকে নিত্যকালের আনন্দরূপকে আবরণমুক্ত করে দেখবার চায়। নান্দনিকতার দাবি হলো, সার্থক দেখানো, বাস্তব দেখানো নয়। চিরন্তনতা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের এই ধরনের চিন্তা, সলিমুল্লাহ খানের বিচারে, ফ্যাসিবাদি বা চিত্তাকর্ষক চিন্তা।

 

এদিকে রবীর বিরোধীতা নজরুলের লেখায় খুনের ব্যবহার, নাকি নতুনত্ব নিয়ে, তাও পরিস্কার করেছেন সলিমুল্লাহ খান। নজরুলের রেফারেন্স টেনে তিনি দেখিয়েছেন, রবীন্দ্রনাথের অবস্থান নতুনত্ব বিরোধী নয়, নজরুলের ‘খুন’ বিরোধী। কারণ রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের মতে, ইটালিকে উদ্দেশ্য করে লেখা কবিতায় 'চিরন্তন' ঘোমটা খোলা না লিখে 'উতারো ঘোমটা' লিখেছেন। নজরুল নিজের সাফাই গেয়ে আরও বলেছেন, তিনি আরবি-ফারসি শব্দ এস্তেমাল করেছেন সৌন্দর্য সৃষ্টি করার জন্য, উত্তরাধিকারের দাবিতে, সামাজিকতার তাগিদে। কারণ বাংলা কাব্যের পাঠকের অর্ধেকই মুসলমান। তাই এই সামাজিকতাকে রবী কর্তৃক সাম্প্রদায়িকতা বলে তুচ্ছ করা সমাজের অস্তিত্ব অস্বীকার করার সমার্থক।

 

প্রমথ চৌধুরীর প্রচেষ্টায় রক্ত ও খুনের বিরোধ কিছুটা প্রশমিত হয়েছিলো বলে ধারণা করা হলেও রবীন্দ্রনাথ শেষ পর্যন্ত 'মক্তব ও মাদ্রাসার বাঙলা'কে ভাষা শিক্ষায় সাম্প্রদায়িকতা আকারেই দেখেছেন। ভাষায় প্রাণধর্ম রক্ষা করার নিয়ম ব্যাখ্যা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ জাতিবিদ্বেষপুষ্ট উদাহরণ দিয়ে ভাষার মুসলমানিকরণ করার প্রস্তাব দিয়েছেন।

 

এই বিষয়ে সলিমুল্লাহ খান দেখিয়েছেন, ভাষার মূল প্রকৃতির নিজস্ব বিধানের দোহাই দিয়ে বাংলা ভাষায় খুনের অস্তিত্ব অস্বীকার করে রবীন্দ্রনাথ ভাষার ‘লক্ষণা’ মানছেন না। সলিমুল্লাহ খান নিজ বচনেই ব্যক্ত করেছেন, রবীন্দ্রনাথ ভাষার রূপক গ্রহণ করবেন অথচ লক্ষণা মানবেন না, এটা লজ্জাজনক। এই ভাষাজ্ঞান কবি নজরুল আটাশ বছর বয়সেই রপ্ত করেছেন। অথচ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জানেন না! তাই, খুনের মতো ফারসি শব্দ শুধু মুসলমানের জীবনযাত্রা বর্ণনায় চলবে, অন্যত্র চলবে না, রবীন্দ্রনাথের এমন বিচার সাম্প্রদায়িকতা দোষে দুষ্ট। বিচারের এমন ব্যত্যয়কেই সলিমুল্লাহ খান ন্যায় নয়, মাৎস্যন্যায় বলেছেন। ভারতবর্ষে সাম্প্রদায়িকতার শুরু গোরক্ষা আন্দোলন দিয়ে, মসজিদের পাশে ঢাকঢোল ও গানবাজনার উস্কানি দিয়ে। রবীন্দ্রনাথের পৃষ্ঠপোষকতায় তা শেষ পর্যন্ত ভাষা-শিক্ষায় সাম্প্রদায়িকতা আকারে দেখা দিলো।

 

সলিমুল্লাহ খান তার তৃতীয় প্রবন্ধ 'নজরুল ইসলাম ও আধুনিক বাংলা কবিতা'য় আবদুল ওদুদ কর্তৃক নজরুল বিচার পর্যালোচনা করেছেন। ওদুদ নজরুলকে পূর্ণ কবিতার রচয়িতা নয়, মাত্র চরণের রচয়িতা বলেছেন। তাতে কবি-কল্পনার পূর্ণাঙ্গতার অভাব দেখতে পেয়েছেন। সলিমুল্লাহ খান হদিস দিয়েছেন, ওদুদের কাছে নজরুলের সাহিত্যিক মর্যাদা ধর্তব্যের মধ্যেই পড়ে না, তবে তার একটা ঐতিহাসিক মর্যাদা সহজেই চোখে পড়ে। বিশেষত গণজাগরণের দিক থেকে। বিদ্রোহী কবিতা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আবদুল ওদুদ নজরুলকে একজন অসাধারণ ভাববিলাসী ও অভিমানী, ব্যর্থপ্রেমের বেদনায় গভীরভাবে আহত কবি বলে সাব্যস্ত করেছেন। তিনি লক্ষ করেছেন, নজরুল রবীন্দ্র, সত্যেন্দ্রনাথ ও ইরানি কবি হাফিজের প্রভাবে বেড়ে উঠেছেন। বেড়ে উঠেছেন বাংলার সন্ত্রাসবাদীদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা রেখে। ওদুদ যেমন, লেখক ও মন্ত্রী হুমায়ুন কবিরও নজরুলকে অসহযোগ আন্দোলনের কবি হিসেবে দেখেছেন।

 

নজরুলের কবিতা কালের ধোপে টিকবে না বলে সাব্যস্ত করেন হুমায়ুন কবির। তার মতে, পুরাতন ঐতিহ্যের পুনরুজ্জীবনের মধ্যেই নজরুল ইসলামের প্রতিভার পরিচয় মিলবে। কিন্তু বাল্টার বেনিয়ামিনের মহিমাতত্ত্বের দোহাই দিয়ে সলিমুল্লাহ খান জানিয়েছেন, সৃজনশীলতা, প্রতিভা, চিরকালের মর্যাদা এবং বোধাতীতের হাতছানি'র অবসান, অর্থাৎ মহিমার অবসানে আধুনিকতার জন্ম। কাজী নজরুল ইসলামের 'আমার কৈফিয়ৎ' কবিতা প্রমাণ করে আধুনিক বাংলা কবিতা তার হাতেই সম্পন্ন হয়েছিল। ওদুদের 'শাশ্বত বঙ্গ' এবং হুমায়ুন কবিরের 'বাঙলার কাব্য' গ্রন্থ সাক্ষ্য মেনে সলিমুল্লাহ খান তাদের নজরুল বিচারের ত্রুটি চিহ্নিত করেছেন। সাথে বেনিয়ামিনের তত্ত্ব দিয়ে প্রমাণ করেছেন, বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার সূচনা নজরুলকে দিয়েই হয়েছিল।

 

সলিমুল্লাহ খানের চতুর্থ প্রবন্ধ 'জাতির নামে বজ্জাতি'। এই শিরোনামে নজরুলের একটি কবিতাও আছে। এতে খান দেখাতে চেষ্টা করেছেন, নজরুল ইসলামকে কেন্দ্র করে নতুন জাতীয় বিতর্কের সূচনা ঘটেছে। চিন্তার দেশ হিসেবে নজরুলের বাংলা, ব্রিটিশশাসিত অখণ্ড বাংলা। কবি গোলাম মোস্তাফার মতে, তার কাব্যাদর্শ ভারতকে স্বাধীন করবার, পাকিস্তান অর্জনের নয়। অথচ আবুল মনসুর আহমদ ভাবছেন, নজরুল ইসলামই পাকিস্তানের আসল প্রেরণাদাতা। তিনি মুসলিম বাংলার ভাষা ও ভাবের হীনম্মন্যতা দূর করে দিলেন। পলাশী যুদ্ধের পর নজরুল ইসলামই বাঙালি মুসলমানের জাগরণের প্রথম কবি।

 

নজরুল কবিতা লিখার পাশাপাশি সক্রিয় রাজনীতিও করেছেন। পরাধীনতা হতে মুক্তি এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম নজরুলকে একদিকে যেমন শ্রমিক ও কৃষকের সাথে একাত্ম করেছিল, তেমনি হিন্দু-মুসলমান ব্যবধান কমিয়ে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠায় ব্যস্ত রেখেছিল। তা সত্ত্বেও নজরুলের এই ভূমিকায় সন্তুষ্ট নয় অনেকেই। তাদেরই একজন কবি গোলাম মোস্তফা সমালোচনা করে লিখেছেন, নজরুল মূলতঃ সংকীর্ণ জাতীয়বাদকেই নিজের রাজনৈতিক আদর্শ মেনেছেন। নজরুলকে নিয়ে আশাহত গোলাম মোস্তফা নজরুলের লেখার পাকিস্তানি সংস্করণ চেয়েছিলেন, অবাঞ্চিত অংশগুলো বাদ দিয়ে। এভাবে সাহিত্যে সাম্প্রদায়িক স্বার্থের ভিত্তিতে কোন লেখকের ভূমিকা প্রত্যাশা করাও সাম্প্রদায়িকতা। এইজন্য সলিমুল্লাহ খান সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েনের আলাওল মূল্যায়নকেও সাম্প্রদায়িকতা দোষে দুষ্ট বলে চিহ্নিত করেছেন।

 

মূলত নজরুল যুগের ধর্ম পালন করতে গিয়ে সর্বভারতীয় হয়েছেন। তাই বলে তিনি মুসলমান সমাজের দুর্দশার কথা ভুলেন নি। জাতীয়তাবাদি কবি থেকে নজরুল দুই দুইবার জাতীয় কবি হলেন। অথচ 'জাতীয় কবি' উপাধির আড়ালে তার জীবনব্যাপী সাধনা অস্বীকার করা হলো। তাকে কিছু উপহার সুবিধা দিয়ে, আহমদ ছফার মতে, বৃহত্তর বাঙালির প্রেক্ষাপট থেকে টেনে এনে সাম্প্রদায়িক ফ্রেমে আটকানোর প্রয়াস চললো। অথচ নজরুল, সৈয়দ মোহাম্মদ হোসেনের মতে, কোনদিন ধর্মভিত্তিক বিভাজ্য জাতীয়তায় বিশ্বাস করেন নি। ব্রিটিশ ভারতের জাতীয় চেতনা এবং বর্তমান স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় চেতনা রূপগত ও গুণগতভাবে স্বতন্ত্র হওয়ায় তাকে জাতীয় কবি বলে চিহ্নিত করে সীমিত করা ঐতিহাসিক ভ্রম। ছফার বরাতে সলিমুল্লাহ খান আরও উল্লেখ করেছেন, সেকালের বাঙালি মুসলমান সমাজের গর্হিত সংকীর্ণতাদোষ হতে নজরুল পুরোপুরি মুক্ত ছিলেন। তাকে সেই সংকীর্ণ খোপে বদ্ধ করার চেষ্টা তাই গর্হিত।

 

নজরুল ইসলামের সাম্য, মৈত্রী এবং সৌভ্রাতৃত্ববোধের প্রতীতীর প্রতি অনুরাগী ছিলেন বটে, তিনি কোন সম্প্রদায়কে ছোট করে দেখার পক্ষপাতী ছিলেন না। পাকিস্তান আমলে তার সাম্প্রদায়িকীকরণ এবং বাংলাদেশে জাতীয়করণের প্রয়াস, উভয়ই দোষের।

 

ঠাকুরের মাৎস্যন্যায় গ্রন্থে নজরুলকে ঘিরে ক্ষমতাবানদের অন্যায় এবং সাম্প্রদায়িকতা চিহ্নিত করতে গিয়ে লেখক সলিমুল্লাহ খান রবীন্দ্রনাথ, গোলাম মোস্তফা এবং সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েনের উদাহরণ দিয়েছেন। তাদের ভূমিকা কীভাবে সাম্প্রদায়িকতা দোষে দুষ্ট তা স্পষ্ট করেছেন। উদ্ধৃতি দানে পটু, বর্ণনার সাথে প্রামাণ্য হাজির করায় সিদ্ধহস্ত, সলিমুল্লাহ খান বিষয় পর্যালোচনায় যুক্তির ত্রুটি রাখেন নি। বাল্টার বেনিয়ামিনের মহিমাতত্ত্ব দিয়ে তিনি নজরুলের লেখায় আধুনিকতার লক্ষণ বুঝিয়েছেন। অন্যদিকে ভাষা দর্শনের ভিত্তিতে লক্ষণা ও রূপকের ব্যবহার দেখিয়ে রবীন্দ্রনাথকেও কুপোকাত করেছেন। বইয়ের দ্বিতীয়াংশ, সংবর্ধনা নিয়ে এখানে আর আলোকপাত না করাই সমীচীন। কারণ সলিমুল্লাহ খানের প্রবন্ধে এইসব লেখা হতে প্রচুর উদ্ধৃতি আছে। কেবল তার চিন্তার লাইন ও ধরন লক্ষ করাই যথেষ্ট।

 

বলা বাহুল্য, রেফারেন্স ও উদ্ধৃতির কারণেই সলিমুল্লাহ খানের লেখা স্বব্যাখ্যাত। নতুন করে ব্যাখ্যার অবকাশ কম। কাজেই, এইক্ষেত্রে লিখিত বিষয়ের আগাপাশতলা নিয়ে আলোকপাত করে পটভূমিটা স্পষ্ট করা যায়। ভাষা শিক্ষায় সাম্প্রদায়িকতার চর্চা নতুন নয়, অস্বাভাবিকও নয়। সেই চর্যাপদ থেকে ভাষায় সম্প্রদায় বিশেষের আধিপত্য চলেছে। রাজনৈতিক কারণে শব্দের অর্থ পরিবর্তনের ইতিহাসও বিরল নয়। বর্ণমালা নিয়ে আছে ছুত অচ্যুতের বালাই। ভাষার সাথে অন্যভাষা মিশলে শব্দেরও আদানপ্রদান ঘটে। শব্দ নিজেও সময়ে সময়ে, ব্যবহার বিশেষে নিজের অর্থ বদলায়। কাজেই ভাষার জগত একান্তই তরল, স্থির নয়। এছাড়া শব্দ তার পুরো ভাষাঅঞ্চল থেকেই নিজের অর্থ কুড়িয়ে আনে।

 

শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের আমলে বৃহৎ বঙ্গের একটি সমন্বয়বাদি ভাষা তৈরি হয়েছিল। বর্ণমালার সংস্কার করা হয়েছিল। বাঙলা ভাষা তার চারপাশের পরিবেশ থেকে, ব্যবহার থেকে, নদীর মতো ধারাবাহিক গতিপথ তৈরি করে নিয়েছে। যখনই ভাষাকে আদর্শের ভিত্তিতে, সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে শাসনের উপলক্ষ এসেছে, ভাষা থমকে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু আরোপিত বিধি চিরন্তনতা পায় নি। মানুষ নিজেই ব্যবহার করতে করতে ভাষা বদলে দিয়েছে, যদিও মানুষ ভাষা দিয়ে ভাষার দিগবলয়েই চিন্তা করে। উপনিবেশকালেও সংস্কৃতকরণের মাধ্যমে ভাষার ওপর ক্ষমতা চালানো হয়েছে। অন্যদিকে বিংশ শতাব্দিতে এসে রবীন্দ্রনাথও শব্দের ব্যবহার নির্ধারণ করে দিতে চান। মক্তব-মাদ্রাসার ভাষাকে সাম্প্রদায়িক ভাষা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করতে চান। নিজের প্রভাবশালী অবস্থানকে ব্যবহার করে দুর্বলের ওপর ক্ষমতা খাটাতে চান। বাঙলা ভাষায় ফারসি শব্দ ব্যবহারে আপত্তি জানাতে গিয়ে শ্লেষ, বিদ্রুপ, এমনকি ব্যক্তিগত আক্রমণ করতেও প্রবৃত্ত হন। এভাবে রবীন্দ্রনাথ নিজেই সাম্প্রদায়িকতার চর্চা করছেন। একইভাবে নজরুলকে ভুল বুঝেছেন রবীন্দ্রনাথসহ ওদুদ এবং গোলাম মোস্তফা। তারা প্রত্যেকে নিজ নিজ সাম্প্রদায়িক অবস্থান থেকে কবিকে পরখ করার চেষ্টা করেছেন।  

  

সুলতানি আমলে পুঁথি সাহিত্য এবং অনুবাদ সাহিত্য একটি বিশেষ মোলায়েম ভাষায় চর্চিত হয়েছিলো। কিন্তু ঔপনিবেশিক বাঙলা ভাষার এই পেলবতার খোলস খসিয়ে সংস্কৃতের বেশ ধরেছে। সম্ভবত, প্রাচ্যবাদিরা ঐতিহ্য থেকে ভাষার একটি শৃঙ্খলা প্রতিষ্টা করতে চেয়েছেন। যেহেতু বিদ্যমান ভাষাগুলোর মধ্যে সংস্কৃতের নিয়মবদ্ধ রূপ ও ব্যবহারিক ঐশ্বর্য ছিলো, সেহেতু সংস্কৃতকে বাঙলা ভাষার মাতৃরূপ গণ্য করেছেন। সমস্যা বাধলো, অজান্তে ঔপনিবেশিকতার প্রভাবে সাহিত্যিকরাও এই কৃত্রিম রূপকে আসল গণ্য করে প্রচলিত প্রান্তিক ভাষাকে হীন ভাবতে শুরু করলে। সর্বোপরি, আরবি-ফারসির ব্যবহার নিয়ে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি দানা বাধলো। সলিমুল্লাহ খানের বইটিতে শুধু মাত্র খুনের মামলা নিয়ে বাহাস করা হলো। এর বাইরেও আল্লাহ, রসুল নিয়েও আপত্তির নজীর আছে। ইতিমধ্যে আবুল মনসুর আহমদ, মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ, গোলাম মোস্তফা, ফররুখ আহমদ, সাংবাদিক নুরুল কবির, ডঃ লুৎফর রহমান এবং ফয়েজ আলম ভাষাকেন্দ্রিক সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিয়ে লিখেছেন। নজরুল যদিও হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের প্রয়াসী ছিলেন, তার নিজ জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা নিপীড়িতের। তার মধ্যে ভাশা-সাম্প্রদায়িকতার নিপীড়ন অন্যতম।

 

কাজেই, সলিমুল্লাহ খান তার ‘ঠাকুরের মাৎস্যন্যায়’ গ্রন্থে মাত্র চারটি প্রবন্ধে যা দেখিয়েছেন, তাকে এক কথায় টিপ অব দ্য আইসবার্গ বলা যায়। এই ধরনের সাম্প্রদায়িকতার নজির আরও আছে। ছোটর ওপর বড়র আধিপত্য এখনো আছে। প্রান্তিক সংখ্যালঘুদের ভাষা এখনো জাতীয় ভাষাভাষীদের কাছে অচ্যুত। সলিমুল্লাহ খানের কৃতিত্ব এই যে, তিনি খুব পদ্ধতিগতভাবে, রেফারেন্সসহ এই সমস্যাকে চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছেন। মাঝারি লেখকদের দ্বারা তৈরি বিভ্রান্তি এড়াতে সলিমুল্লাহ খানের মতো লেখকের প্রবন্ধ পড়া জরুরি। সেটা সাম্প্রদায়িকতা প্রসঙ্গে আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তবে, এই বইয়ের একটি সমস্যা হলো, ভাষার সমস্যা। সাধারণ পাঠক আজকাল খানের ব্যবহৃত গুরুচন্ডালি ভাষায় অভ্যস্ত নয়। বর্ণনা প্রাঞ্জল হওয়া সত্ত্বেও পাঠক বাধা পায়। অনভ্যস্ত ভাষার বাধা। অন্যদিকে বইটি সংকীর্ণ পরিসরে হওয়ায় ভাষা-শিক্ষায় সাম্প্রদায়িকতার পুরো চিত্র উঠে আসে নি। লেখার সাথে যুক্ত ফূটনোট ও দোহাই ধরে রেফারেন্স বইগুলো পাঠ করলে পাঠকের পক্ষে সলিমুল্লাহ খানের যুক্তির ধরন বুঝা সহজ হবে।

ঝকঝকে উন্নত কাগজে ছাপানো বইটি অল্প সময়েই পড়ে শেষ করা যায়। সলিমুল্লাহ খানের অনুরাগী এবং ভাষার সাংস্কৃতিক রাজনীতি সম্পর্কে উৎসুক পাঠক এই বইটি পড়ে সমৃদ্ধ হবে।            

 

সরওয়ার কামালঃ লেখক ও গবেষক।

Comments

Popular posts from this blog

মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার কারণ ও প্রতিকার

সরওয়ার কামাল শিক্ষাক্ষেত্রে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য সাফল্য রয়েছে। সামাজিক উন্নয়ন সূচকেও বাংলাদেশের অবস্থান প্রতিবেশি দেশগুলোর তুলনায় ভালো, যা সম্পর্কে প্রশংসা করে বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন প্রবন্ধ লিখেছেন “ ল্যানসেট ” নামক মেডিক্যাল জার্নালে। কিন্তু এতে আমাদের বগল বাজিয়ে আত্মতৃপ্তিতে ভোগার অবকাশ নেই। কারণ শিক্ষার্থী ঝরে পড়া এবং বিজ্ঞান শিক্ষা সংকুচিত হয়ে পড়া আমাদের সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভুত হয়েছে। শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার কারণে আমাদের শিক্ষার মূল লক্ষ্যগুলো হাসিল হচ্ছে না, যার একটি হলো সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করা, অপরটি হলো শিক্ষাক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় প্রণোদনার ন্যায্য বণ্টন নিশ্চিত করা। অর্থাৎ সব শিশুই যাতে সরকারের সুযোগ ব্যবহার করে উন্নত জীবনের সন্ধান করতে পারে, তার শতভাগ নিশ্চয়তা প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না। শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার বিভিন্ন কারণ রয়েছে, তার মধ্যে বিভিন্ন স্তরের শিক্ষার ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন কারণ রয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার প্রধান কারণ দারিদ্র্য ও অপুষ্টি বা স্বাস্থ্যহীনতা । মাধ্যমিক পর্যায়েও শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার ক্ষেত্রে দারিদ্র্য সমস্যার ...

তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি বিচিত্র ছলনা জালে

তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি বিচিত্র ছলনা জালে ............................................................................... সাম্প্রতিক কালে আমাদের নৈতিক উপলব্ধিতে, সামাজিক উদ্বেগে কিংবা মূল্যবোধে দৃশ্যমান পরিবর্তন এসেছে। প্রযুক্তির নিবিড় ব্যবহার, বিশ্বায়নের প্রভাব, বিশ্বরাজনীতির অভিঘাত, বাজার সংস্কৃতির ধাক্কা ও চরমপন্থী ভাবাদর্শের টানাপড়েনে আমাদের চিরকালীন মূল্যবোধ ভেঙ্গে পড়েছে। নৈতিকতার সীমানা সরে যাচ্ছে প্রথাগত বিশ্বাস ও প্রতিষ্ঠানসংলগ্নতা থেকে। গতিময় জীবনের অভিঘাতে চরম অস্থিরতা ব্যক্তি থেকে ব্যষ্টির ব্যাপ্তিতে বিরাজ করছে। সর্বত্র আহাজারি, শোনার অবসর নিয়ে হাজির নেই কেউ। মানুষ যে নির্বিকার তাও নয়, তারা বিকারগ্রস্থ, পূর্ণমাত্রায় ঘোরগ্রস্থ, কেবল অপ্রত্যাশিত ঘটনাপ্রবাহের সাথে তাল মেলানোতে। তারা এখন এমন সব বিষয়ে আলোড়িত হয়, যে বিষয়ের সাথে তাদের সরাসরি যোগ নেই। থাকলেও তা অনেক ক্ষীণ ও দূরবর্তী কার্যকারণ সম্পর্কে আবদ্ধ। একইভাবে, তারা এমন সব পরিণতি ভোগ করে, যার জন্য তারা নিজেরা দায়ী নয়। আর যারা দায়ী তারা এর পরিণতি ভোগ করেন না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষ বয়সের দিকে এই প্যার...

মহেশখালীর সমাজ ও সংস্কৃতি

সরওয়ার কামাল সাগর কূলে গিরিকুন্তলা মোহিনী মহেশখালী দ্বীপের ৩৮৮ বর্গকিলোমিটার ভূত্বকে প্রায় পাঁচ লক্ষ লোকের বসতি। তাদের বসতি ঘিরে গড়ে উঠেছে উপকূলীয়-দ্বীপাঞ্চলীয় সমাজ। এই সমাজসভ্যদের মানসিক ঐক্য ও জীবনযাপন পদ্ধতি নিয়ে তৈরি হয়েছে শনাক্তযোগ্য বিশেষ স্থানীয় সংস্কৃতি। মানবজাতির চিরকালীন অভিযাত্রার অংশ হিসেবে দেশের নানা জায়গা থেকে হিজরত করে লোকজন এসে বসতি গেড়েছে মহেশখালীতে। তাই তাদের ভাষা ও আচরণে শনাক্ত করা যায় এমন বৈচিত্র্য ও তারতম্য, যা দিয়ে কক্সবাজারের অন্যান্য অঞ্চলের অধিবাসীদের তুলনায় মহেশখালীবাসীকে স্বতন্ত্রভাবে চিহ্নিত করা যায়। যে পার্থক্যসূচক বৈশিষ্ঠ্যাবলী নিয়ে মহেশখালীর সমাজ ও মানুষের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য তৈরি হয়েছে, চাটগাঁইয়া ভাষার উপভাষাতুল্য মহেশখালীর দ্বীপাঞ্চলীয় বুলি তার মধ্যে বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। [1] তবে সমস্যা হলো, লিখিত সাহিত্য ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের অভাবে স্থানীয় ইতিহাসের মতোই কালিক সূচকের নিরিখে এর জনসংস্কৃতি বর্ণনা করা দুরূহ। একেতো সংস্কৃতি স্বয়ং একটি ব্যাপক ধারণা, তদুপরি, এটি সতত পরিবর্তনশীল। ভাষা ও সংস্কৃতি স্রোতস্বী নদীর মতো বহমান। মানুষের কথা, স্মৃতি, পুরা...