Skip to main content

মহেশখালীর ইতিহাস: পুরাণ, মানে ও বাস্তবতা

সরওয়ার কামাল*

 মহেশখালীর ইতিহাস চট্টগ্রামের অন্যান্য অঞ্চলের মতোই তিমিরাবৃত, আজ অবধি অবহেলিত, বলা যায় প্রায় অনুদ্ঘাটিত; তাই সার্বিক অর্থে অসম্পূর্ণ। শুধু মহেশখালী নয়, বৃহত্তর পরিসরে চট্টগ্রাম প্রসঙ্গেও এমন লিখিত বর্ণনা পাওয়া যায় না, যা স্থানীয় ইতিহাসের নমুনা হিসেবে তাৎপর্যপূর্ণ। দীর্ঘকালব্যাপী বাংলা, ত্রিপুরা ও আরাকানের ত্রিমুখী দ্বন্ধে সদাপরিবর্তনশীল রাজনৈতিক ভূগোলে মহেশখালীর অবস্থান ছিল অতিশয় গৌণ, প্রান্তবর্তী, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এবং বসতিবিহীন টলেমি, চেঙ্গ হো, ইবনে বতুতা, জন ডি সিলভেইরা, সিদি আলি ছেহলভি, রালফ ফিচ, সেবাস্টিয় ম্যানরিক এবং সিজার ফ্রেডেরিক প্রমুখ বিদেশি পরিভ্রাজকের দিনলিপিতে উল্লেখ না থাকায় মধ্যযুগের ইতিহাসে এই দ্বীপের হদিস পাওয়া যায় না। জে ডি বারোস, জেমস রেনেল ও ফ্রান্সিস বুকানন যদিও এই দ্বীপের কথা উল্লেখ করেছেন, তবুও বিভ্রান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে সেইসব নামের ভিন্নতা, যা দিয়ে তারা মহেশখালীকে নির্দেশ করতে চেয়েছেন। ইতিহাসে উল্লেখিত বেশকিছু নাম সম্ভাব্য মহেশখালী বলে অনুমান করা যায়, যার মধ্যে মাছু, বাকাল, বাকোলা, মৈনাক, মাছুখালী, মেক্সাল, মাছখালী, মহিষখালি ও মহেশখালী অন্যতম। ত্রিপুরার রাজমালা ও আরাকান রাজদরবারের ইতিবৃত্ত রাজোয়াঙে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের কিছু কিছু ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়, কিন্তু তাতে মহেশখালী সম্পর্কিত সুস্পষ্ট তথ্য নেই। ইতিহাস কেবল বইয়ের পাতায় লিখিত থাকবে, ব্যাপারটা এমন নয়। রংতুলি দিয়ে আঁকা অর্ধপৃষ্ঠার একটি চিত্রকর্মেও বিশেষ যুগ কিংবা ঐতিহাসিক ঘটনাপর্বের রূপ বিম্বিত থাকতে পারে হয়তো তাই, বইয়ের পাতায় নয়, মহেশখালীর ইতিহাস খুঁজতে হবে অন্য কোথাও।    

 

গতিশীল সাংস্কৃতিক রূপান্তরের ভেতর দিয়ে মানবসমাজের বিশেষ কোন ঘটনা ইতিহাসের রূপ পরিগ্রহ করেতাই ইতিহাসবিদগণ বিক্ষিপ্ত তথ্য-উপাত্ত গুছিয়ে যা পরিবেশন করেন, তা যত না বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের ফল, তার চেয়ে অধিক মনস্তাত্ত্বিক প্রতিক্রিয়া ই এইচ কার তার ‘হোয়াট ইজ হিস্ট্রি’ নামক গ্রন্থে ইতিহাস বলতে ঘটনা এবং ঘটনার রেকর্ড বুঝিয়েছেন (কারঃ ১৯৮৭)[1] অতীতের ঘটনা বিশেষ বিবরণের মারফত বর্তমান পাঠকের কাছে পৌঁছে, কিন্তু ঘটনা ও বিবরণের মধ্যে যে প্রামাণ্য তুরীয়ভাবে বহমান থাকা দরকার, তা স্থানীয় ইতিহাসে কদাচিৎ বজায় থাকেরেকর্ড ও প্রমাণের অভাবতো আছেই, ঘটনায় লেখনযোগ্য ঐতিহাসিকতার অভাবও কম নয়। বর্ণনায় বিশেষ ঘটনা কেন ঘটেছে, তার কার্যকারণ ব্যাখ্যা না থাকলে তা ইতিহাস পদবাচ্য হয় না। এইদিক থেকে মহেশখালীর ইতিহাস রচনার সমস্যাগুলো ধ্রুপদী এবং স্থান-কাল নির্বিশেষে সাধারণ; তদুপরি পুরাণ, মানে এবং বাস্তবতার মিশেলে একাকার।

 

ইতিহাসে লেখকের নিজস্ব মনোভাব প্রতিফলিত হয় বলে তা বাস্তবসত্য নয়, ঘটনার বিবরণ মাত্র। বাস্তবসত্য পদটিও চেতনচিত্রবাদের দিক থেকে সোনার পাথরবাটি তুল্য। বাস্তব ও সত্য অভিন্ন নয়, একথা আজ সর্বজনমান্যযেকোন ঘটনাই একটি বিশেষ দেশকালে ঘটে, অথচ এর মানে তৈরি হয় ভিন্ন দেশকালে (মানস্লোঃ ১৯৯৭)[2], যেখানে লেখক নিজেই মানে তৈরির দায় নেয় আমাদের ইন্দ্রীয়লব্দ প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাও কালের দিক থেকে বর্তমানের নয় অভিজ্ঞতা বিবেচনায় মানুষ বর্তমানে বাস করে না, বাস করে অতীতেআয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের যে চেহারা আমরা দেখি, সেটা কয়েক ন্যানো সেকেন্ড পূর্বের। একইভাবে, আমাদের মুখনিঃসৃত শব্দগুলো যখন আমাদের কানে পৌঁছে, তখন কয়েক ন্যানো সেকেন্ড কাল অতিক্রান্ত হয়ে যায় অর্থাৎ আমাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার জগত চূড়ান্ত অর্থে অতীতের জগত। এমনকি আমাদের ভবিষ্যতও সম্ভাব্য অতীত মাত্র। এভাবে অতীত এবং অতীতকে বর্ণনা করার প্রক্রিয়ায় আমরা সত্য ও বাস্তব, যুগপৎ হারিয়ে ফেলি। ফলত, মহেশখালীর ইতিহাসে কী সত্য, আর কী বাস্তব, তা নির্ণয় করা অনেকটা খালের কাদায় চিরিং মাছ ধরার মতো   

 

এই প্রেক্ষাপটে আমরা মহেশখালীর ইতিহাস রচনার সাধারণ কিছু সমস্যা চিহ্নিত করতে চাই। স্থানীয় ইতিহাসের সাধারণ সীমাবদ্ধতা পর্যালোচনা পূর্বক মহেশখালীর ইতিহাসের ভবিষ্যৎ অভিমুখ নির্দেশ করা গুরুত্বপূর্ণ এই ক্ষেত্রে তথ্যের অপ্রতুলতা আছে। পূর্বেই উল্লেখ করেছি, মহেশখালীতে জীবনসংস্কৃতি ও সভ্যতার দীপবর্তিকা এসেছে বেশ বিলম্বেঅন্যদিকে পেগু, আরাকান, ত্রিপুরা এবং চট্টগ্রামের প্রান্তবর্তী অঞ্চল হিসেবে মহেশখালী দীর্ঘকাল ব্যাপী দৃষ্টির আড়ালেই ছিল      

 

বলা বাহুল্য, মহেশখালী নামের দ্বীপটি আজ উপজেলা হিসেবে পরিচিত। উপজেলা স্থানীয় পর্যায়ের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল। সোনাদিয়া, রূপাদিয়া (যেটি পরবর্তীতে সোনাদিয়ার পূর্বাংশে যুক্ত হয়ে সোনাদিয়ার সাথে একীভূত হয়ে যায়), হামিদার দিয়া ও মাতারবাড়িসহ একগুচ্ছ দ্বীপ নিয়ে তুফানপীড়িত উপকূলীয় পাহাড়ি অঞ্চল হিসেবে মহেশখালীর খ্যাতি আছে বটে, তবে সমকালীন ইতিহাসের পাতায় দ্বীপের চেয়ে আদিনাথ মন্দিরের নামই অধিক দীপ্তিতে দীপ্যমান মন্দিরটি তর্কাতীতভাবে এই দ্বীপের সবচেয়ে পুরনো সাংস্কৃতিক স্মারকচিহ্নের একটি। মন্দিরের আদিস্থাপনা ও নির্মাণশৈলী চতুর্দশ শতকের বলে অনুমান করা হয় (বাতেনঃ ২০১১)[3] বস্তুগত উপাদানের ভিত্তিতে মহেশখালীর ইতিহাস তালাশ করার ক্ষেত্রে প্রাসংগিকভাবেই আদিনাথের স্থাপত্যশৈলী সর্বাগ্রে বিবেচ্য এই পর্যন্ত মহেশখালী সম্পর্কে সাধারণ্যে যে বয়ান ব্যাপৃত রয়েছে, তারমধ্যে আদিনাথ মন্দিরকেন্দ্রিক পুরাণ, শ্রুতি এবং নির্মিতি প্রাধান্য লাভ করেছে। মন্দির ব্যতীত গোরকনাথের ঘাট বা গোরক্ষনাথের ঘাট, যা লৌকিক উচ্চারণে গোরকঘাটা হিসেবে সর্বজনস্বীকৃত, তা ইতিহাসের এক বিশেষ সাংস্কৃতিক পর্যায়কে নির্দেশ করে। তাঁতি যুগের নাথপন্থীদের প্রভাবে আদিনাথ ও গোরকঘাটা নামের উৎপত্তি ঘটেছে বলে অনুমান করা হয় (কানুনগো-১৯৮৮)[4] এসব নাম চট্টগ্রামে নাথপন্থার উদ্ভব, বিকাশ এবং বিলয়ের সাক্ষ্য বহন করছে বলে তা মহেশখালীর ইতিহাসের ইশারা আকারে তাৎপর্যপূর্ণ

 

চন্দ্র বংশের শাসনকালে (৭৮৮-৯৫৭) আরাকান ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে শৈব মতবাদ এবং তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব দেখা যায়। নাগ ও নাথপন্থীরা এই তান্ত্রিক বৌদ্ধদের দল বিশেষ আদিনাথ, মৎস্যেন্দ্রনাথ, মীননাথ, তারানাথ, চৌরংগনাথ, গোরক্ষনাথ ও জলন্দরনাথ প্রমুখ নাথপন্থিদের নাম তাদের ভক্ত কিংবা অনুসারীদের দ্বারা স্মরণীয় ছিল বলেই হয়তো তীর্থ নির্দেশার্থে এইসব নামের উদ্ভব সমসাময়িক তিব্বতি ক্রনিকলে চট্টগ্রাম ও আরাকানে সিদ্ধাচার্য ও তান্ত্রিকদের দ্বারা তান্ত্রিক বৌদ্ধমত প্রচারের কথা উল্লেখ আছে। বার্মায় পাগান শাসনামলে (১০৪৪-১৩০০) হীনযানী বৌদ্ধ মতবাদ চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছিল

 

উল্লেখ্য, মগধ হতে বিতাড়িত হওয়ার পর চট্টগ্রাম অঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্মের দৃশ্যমান প্রসার ঘটেছিল, বৌদ্ধদের সংখ্যাও স্ফীত হয়েছিল তার পুর্ব থেকেই বিভিন্ন পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির কারণে বৌদ্ধ ধর্ম তার বিশুদ্ধ রূপ হারায়। যেহেতু রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতার উপর নির্ভর করে ধর্ম ও সংঘের স্থিতি ও বিস্তৃতি ঘটেছিল, সেহেতু কালক্রমে রাজনৈতিক অধোগতির কারণে বৌদ্ধ ধর্মও পৃষ্ঠপোষকতা হারায়। পরবর্তীতে ভক্তি আন্দোলন ও বিভিন্ন মতবাদের প্রভাবে সমন্বয়মূলক সংস্কার ঘটে বৌদ্ধ ধর্মে। এভাবে ষষ্ঠ শতকের মাঝামাঝিতে বুদ্ধদেব বিষ্ণুর একজন অবতার হিসেবে গৃহীত হন ক্রম রূপান্তরের ফলে ক্ষয়িষ্ণু বৌদ্ধ ধর্ম দ্বাদশ শতকের দিকে তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্মে রূপ নেয় এটা ছিল চট্টগ্রামে কিংবা বঙ্গে বৌদ্ধদের অধঃপতিত রূপ (চাকমাঃ ২০০৩)[5] বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন চর্যাপদ ছিল এই তান্ত্রিক বৌদ্ধদের রচনা। সিদ্ধদের হাতে বৌদ্ধ ধর্মের আরো বিকৃতি ঘটে এক পর্যায়ে তা শাক্ত মতবাদের সাথে একীভূত হয় (চাকমাঃ ২০০৩)[6] বৌদ্ধ মরমিবাদ ও শাক্ত মতবাদের সমন্বয়ে গড়ে উঠে নাথধর্ম। শাক্ত ধর্মে ব্রহ্মের পুরুষ রূপ হলো যোগেশ্বর, আদিনাথ শিব অন্যদিকে, শৈব সম্প্রদায়ের প্রধান দেবতা, যিনি হিন্দু ধর্মের ত্রিশক্তি ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিবের মধ্যেও প্রধান, তিনি হলেন শিব  

 

কাজেই নাথধর্ম হলো বৌদ্ধ তান্ত্রিক মত, শাক্ত ও শৈব মতবাদের সমন্বয়, যদিও এতে শৈব আচারের প্রাধান্য বেশি তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্ম থেকে উৎপত্তি লাভ করে শৈব ও শাক্ত মতবাদের সাথে একাত্ম হয়ে নাথপন্থা হিন্দু ধর্মে স্থিত হয়, যদিও নাথপন্থা প্রকৃতার্থে না বৌদ্ধ, না হিন্দু ধর্ম নাথপন্থীরা বেশকিছু সিদ্ধগুরু অনুসরণ করতো, তার মধ্যে প্রথম নাথগুরু হলেন শিব বা আদিনাথ বা আদিবুদ্ধ (কানুনগোঃ ১৯৮৮)[7] আদিগুরুর কাছে যোগসাধনা করতে মৎস্যেন্দ্রনাথ মহেশখালীতেই ধ্যানমগ্ন থাকতেন বলে অনুসারীরা দাবি করেন ভবানী দাস রচিত ময়নামতির গানএ দ্বিতীয় সিদ্ধ গোরক্ষনাথের আবাস চট্টগ্রাম বলে উল্লেখ করা হয় (কানুনগোঃ ১৯৮৮)[8] এবং গোরক্ষনাথ মহেশ দ্বীপেই যোগের তালিম নেন বলে ধারণা করা হয় গোরক্ষনাথের শিষ্য জলন্দরিপাদ, যিনি গোপীচন্দ্রের রাজত্বের কালে চাটগাঁ ভ্রমণ করেন বলে উল্লেখ আছে তিব্বতি ক্রনিকলে, তিনিও মহেশ দ্বীপে এসেছিলেন বলে অনুমান করা হয় অবশ্য গোরক্ষনাথের পর তেমন প্রভাবশালী সিদ্ধ না থাকায় অনুসারী যোগীরা ব্রাক্ষণ রাজার প্রভাবে পুনরায় ঈশ্বর অনুসারী হয়ে হিন্দু ধর্মে প্রত্যাবর্তন করেন

 

একাদশ শতাব্দিতে শেখ ফয়জুল্লাহ রচিত গোরক্ষ বিজয়এ নাথপন্থীদের পেশা দেখানো হয়েছে তাঁত বুনন তাই নাথপন্থীদের সময়কালকে তাঁতী যুগ হিসেবে অভিহিত করা হয় মহেশখালীতে নাথপন্থীদের যাতায়াতকালে যে গোপীচন্দ্র রাজত্ব করতেন, গীতিকারগণ তাকে গোবিচন্দ্র বলে শনাক্ত করেন যদিও সুনির্দিষ্ট তারিখ উল্লেখ নেই, চন্দ্রবংশের শাসনপরিক্রমা বিবেচনায় এই কালিক পর্যায়টি ১০২০ থেকে ১০৪৫ বলে গ্রাহ্য করা হয় তাই গোরক্ষনাথের শিষ্যদের দ্বারা আদিনাথ ও গোরকঘাটা নামকরণের কালও একই বলে অনুমান করা যায়

 

পুরাণ ও রামায়ণের কাহিনী ঘিরে মহেশখালীর নামকরণ সংক্রান্ত একটি প্রবল মত প্রচলিত রয়েছেলোককাহিনী অনুসারে মহেশখালী দ্বীপে মহাদেব শিবের আগমন ঘটে ত্রেতা যুগে (বাতেনঃ ২০১১)[9] তখন, রাম-রাবণের যুদ্ধের সময়, রাবণ শিবকে আনতে যান কৈলাসে। কৈলাস হতে লংকায় যাওয়ার জন্য রাবণকে শর্ত দেওয়া হয়, যেন শিবকে কাঁধে নিয়ে বিরতিহীনভাবে যাত্রা করেন। শর্ত মেনে রাবণ শিবকে কাঁধে নিয়ে কৈলাস হতে লংকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। কিন্তু যাত্রাপথে রাবণের মুত্রপীড়া দেখা দেয়। প্রাকৃতিক কর্ম সারতে রাবণ শিবকে নিয়ে মৈনাক পাহাড়ে বিরতি নেন। এতে মহাদেব শিবের দেওয়া শর্ত ভঙ্গ হয়। শর্ত ভঙ্গের কারণে শিব মৈনাক পাহাড়েই থেকে যান। শিব রাবণকে শিবলিঙ্গ বর দিয়েছিলেন, এটিও মৈনাক পর্বতেই রয়ে যায়। মহাদেব শিব হলেন আদিনাথ, তার নামেই এই মন্দির। অন্যদিকে আদিনাথের ১০৮টি নামের একটি হলো মহেশ, তাই আদিনাথের নাম মহেশ অনুসারে এই দ্বীপের নাম মহেশখালী হয়েছে বলে অধিক প্রচার আছে। পাশাপাশি মৈনাক পর্বতের নাম অনুসারে, মৈনাক, তা থেকে মইসখাল এবং মইসখাল থেকে মইশখালী নামের উদ্ভব ঘটেছে বলেও অনুমান করা হয় (বাতেনঃ ২০১১)[10] এযাবৎ লিখিত ইতিহাসে ‘মহেশখালী’ নামকরণ মূলত উনবিংশ শতাব্দির ঘটনা। ইতিপূর্বে এই নামের উল্লেখ পাওয়া যায় না।   

 

মৈনাক পাহাড়ের উত্তরে রয়েছে মুদির ছড়া বা মুতির ছড়া, এই ছড়া মুতের ছড়া বলে অনুমিত, যেখানে রাবণ মুত্রনির্গমন করেছিলেন বলে ধারণা করা হয়। রামায়ণের সুন্দরাকান্ডে নোনাসমুদ্রে মৈনাক পর্বতের অবস্থানের কথা বলা আছে। সন্ন্যাসীরা মৈনাক পর্বতস্থ আদিনাথের প্রশস্তি গেয়েছেন। মুহাম্মদ আবদুল বাতেনের পুস্তকের সূত্রে পাওয়া যায়-

 

মৈনাকে নামেতে গিরি সমুদ্র ভিতর।

শোভিছে তাহার শৃঙ্গ অতি মনোহর।।

এথায় শিবের বাস ইচ্ছা হল মনে।

চাপিল রাবণে বাম অঙ্গুলী চালানে।।

তদবধি আদিনাথ রহিল তথায়।

ভারত প্রসিদ্ধ দেব নিজ মহিমায়।

 

রামায়াণ ও পুরাণ ঘিরে মহেশখালীর ইতিহাসের একটি বিশেষ বয়ান আছে। পূর্বোল্লিখিত নাথপন্থীদের প্রভাব এবং তাদের প্রভাবে মন্দির ও ঘাটের নামকরণের সাথে এই বয়ানের একটি কাঠামোগত মিল রয়েছে। আদিনাথ মন্দিরের ইতিহাসের সাথে একদিকে যেমন কিছু পৌরাণিক কাহিনী জড়িত, অন্যদিকে নূর মোহাম্মদ শিকদার কর্তৃক মন্দির স্থাপনের ঘটনাও বিশেষ মর্যাদায় প্রচার পেয়েছে (বাতেনঃ ২০১১)[11]মিথ ও বাস্তব কীভাবে আমাদের দৈনন্দিন বয়ানের মানে তৈরিতে ভূমিকা রাখে তার কিছু ব্যাখ্যা পাওয়া যায় বিখ্যাত নৃতাত্ত্বিক ক্লদ লেভিস্ত্রসের গ্রন্থ ‘মিথ এন্ড মিনিং’ এবং দমোদর ধর্মানন্দ কোসাম্বীর ‘মিথ এন্ড রিয়েলিটি’ গ্রন্থে। মহেশখালীর ইতিহাসের সংকট ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে পুরাণ, মানে এবং বাস্তবতার সম্পর্ক চিহ্নিত করা যায় এই প্রেক্ষিতেপুরাণ ও বাস্তবতার সম্পর্কের অন্তরালে মানুষের ভাষা ও চিন্তার তুরীয় যৌক্তিক কাঠামো ফল্গুধারার মতো বহমান থাকে। এই ধরনের বয়ানের সমান্তরাল অর্থ উদ্ঘাটন করা অনুসন্ধিৎসু পাঠকের দায়। দাবাখেলায় গুটিগুলো যেমন একটি নির্দিষ্ট ছকে একে অপরের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখে, ভাষা ও চিন্তার ক্ষেত্রেও কিছু যৌক্তিক কাঠামো কাজ করে পুরাণ ও নাথপন্থীদের কাহিনীতে আদিনাথ ও শিব একটি সাধারণ কাঠামো হিসেবে কাল পরম্পরায় মানুষের মন, চিন্তা, ভাষা এবং সাংস্কৃতিক আচরণের মাধ্যমে প্রবাহিত হয়ে এইপর্যন্ত এসেছে। অন্যদিকে বৌদ্ধ ধর্ম থেকে উৎপত্তি লাভ করে হিন্দু ধর্মে প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে নাথপন্থা আদিনাথের কাহিনী ও ইতিহাসকে যৌক্তিক কাঠামো যুগিয়েছে। যে রাজনৈতিক ও দার্শনিক কারণসমূহ বিশেষ মতবাদের উদ্ভব ঘটায়, অনুসারী তৈরি করে এবং কালের প্রবাহে নতুন কিছু তৈরির ক্ষেত্রে যোগযোগ উপযোগী কাঠামোর সঙ্গতি বিধান করে, তা পুরাণ, বাস্তব ও ভাষাগত মানে তৈরির ক্ষেত্রে সংশ্লেষাত্মক ভূমিকা পালন করে। কাহিনীর মধ্যে এক ধরনের যৌক্তিক শৃঙ্খলা তৈরি হয়, যদিও বাহ্যিকভাবে তা অবিশ্বাস্য ঠেকে। এই শৃঙ্খলাই কাহিনীর অর্থ বা মানে তৈরির প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে। ভাষার সিনট্যাক্সের সাথে লজিক্যাল সিনট্যাক্স যুক্ত হয়ে বাস্তবের রূপক হিসেবে কাহিনী বা বয়ানের অর্থ তৈরি হয়। অনেকক্ষেত্রে ভাষা কিংবা অভিধান ছাড়াই তা কেবল যুক্তির সংগতি দিয়ে তৈরি হতে পারে। যেভাবে জ্যামিতির একটি বিশেষ রেখা আমাদের কাছে তার অর্থ নিয়ে হাজির হয়, বৃষ্টির শব্দ একটি বিশেষ ছন্দ নিয়ে হাজির হয়, তেমনি কালব্যাপী প্রবাহিত একটি কাহিনী অভিধানগত অর্থের সংশ্লেষ ছাড়াই অর্থবহ হতে পারে। বিজ্ঞান ও পুরাণ সমান্তরালে অর্থ তৈরি করে। বিজ্ঞান দিয়ে কিংবা যুক্তি দিয়ে পুরাণকে অস্বীকার করতে হবে, এমন কথা নেই। কিন্তু পুরাণকে পুরাণের আদলে এবং বাস্তব ঘটনাকে ঘটনার আদলে বুঝা সমীচীন।            

 

বর্তমানে প্রায় চার লক্ষাধিক জনসংখ্যা অধ্যুষিত মহেশখালী দ্বীপের ভূগোল ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে পরিবর্তিত হয়েছে। পর্তুগীজ মানচিত্রকর জাও দে বারোস কর্তৃক ১৫৫০ সালে তৈরি মানচিত্রে কয়েকটি স্থানের নাম পাওয়া যায়, যার মধ্যে মাছু নামে একটি দ্বীপ ও বাকালা নামে একটি খাড়ি রয়েছে যদিও পর্তুগিজরা স্থানীয় নামের একটিও শুদ্ধ উচ্চারণে লিখতে পারে নি, তবুও মানচিত্রের সাথে সমসাময়িককালের পরিভ্রাজকদের বর্ণনা মিলিয়ে এই নামগুলোর সাথে দ্বীপের অস্তিত্ব শনাক্ত করা যায়। এইক্ষেত্রে জে ডি বারোসের মানচিত্র তৈরির মাত্র চার বছর পরে, ১৫৫৪ সালে, তুর্কী পরিভ্রাজক সিদি আলি ছেহলভি লিখিত ‘মুহিত’ নামক গ্রন্থে বাকাল বলে চিহ্নিত একটি দ্বীপের উল্লেখ পাওয়া যায় (আহমদঃ ১৯৯৫)[12]বাকাল নদীর তীরে অবস্থিত বলেই হয়তো মহেশখালী দ্বীপকে বাকাল বলে আখ্যায়িত করা হয়েছিল। সেই মানচিত্রের সাথে সিদি আলির বর্ণনা মিলিয়ে প্রফেসর জোসেফ এফ হ্যামার বাকাল ও মহেশখালী অভিন্ন বলে মনে করেছিলেন (আহমদঃ ১৯৯৫)[13]বাকাল ছাড়াও বাঁকখালী নদীর আরো একটি নাম পাওয়া যায়, ইস্ট পাকিস্তান ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ারে, যেখানে বাঁকখালীর পূর্বনাম উল্লেখ করা হয়েছে খুরুশিয়া নদী হিসেবে (রিজভীঃ ১৯৭০)[14] সার্ভেয়ার জেনারেল হিসেবে মেজর জেমস রেনেল কর্তৃক ১৭৮৬ সালে প্রস্তুতকৃত মানচিত্রে মহেশখালীর নাম মাছখাল হিসেবে দেখানো হয়েছেরেনেল তার মাঠ জরীপকালের স্মৃতি নিয়ে ১৭৯৩ সালে একটি বই লিখেন, ‘মেমোয়ার অব আ ম্যাপ অব হিন্দুস্তান অর মুগল এম্পায়ার’ শিরোনামে। এই বইতে মহেশখালী সম্পর্কে বর্ণনা নেই, যদিও কক্সবাজার সংলগ্ন বেশ কিছু অঞ্চলের সমসাময়িক পরিস্থিতির বর্ণনা রয়েছেতবে গ্রহণযোগ্য মানচিত্র আঁকায় রেনেলের যেমন সুনাম আছে, তেমনি রেনেলের মানচিত্রে ব্যবহৃত নামও গ্রহণযোগ্য বলা যায়। এইদিক থেকে মহেশখালী ইংরেজ আমলের প্রারম্ভে মাছখালী ছিল বলেই ধারণা করা যায়।  

 

ইতিহাসবিদ ড. আবদুল করিম জে ডি বারোসের মানচিত্র ব্যাখ্যা করতে গিয়ে চকরিয়ার পাশে দেখানো মাছু দ্বীপকে মহেশখালী বলে অনুমান করেছেন। খাল দ্বারা বিচ্ছিন্ন হয়ে এই মাছু পরবর্তীতে মাছুখাল বা মাছুখালী হয়। মহেশখালী নামটি এই মাছুখাল থেকেই উৎপত্তি লাভ করেছে বলে ধারণা করা হয়।

 

ফ্রান্সিস বুকানন নামে এক স্কটিশ ডাক্তার দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গে মসলা চাষের উপযুক্ত স্থান খোঁজতে বের হন ১৭৯৮ সালে। তিনি চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারসহ আরাকান ভ্রমণ করেন। ভ্রমণের প্রারম্ভিক পর্যায়ে, ১৭৯৮ সালের ৩০ মার্চ মাছখালিতে পা রাখেন (বুকাননঃ ২০১৮)[15] তিনি মহেশখালীতে বাঙালি, আরকানি ও মারমা সম্প্রদায়ের দেখা পান। এখানে মগদের, যারা আরাকান থেকে এসেছিল, তিনি জুম চাষ করতে দেখেনচার দিনের অবস্থান শেষে তিনি ৩ এপ্রিল, ১৭৯৮ মাছখালী ত্যাগ করেন। বুকানন তার দিনপঞ্জিতে মানুষ, প্রকৃতি, চাষাবাদ সংক্রান্ত বিবরণ ছাড়াও বেশকিছু স্থানের নাম উল্লেখ করেছেন। বুকাননের অনুমান, এই দ্বীপসংলগ্ন খালে প্রচুর মাছ পাওয়া যায় বলেই হয়তো দ্বীপের নাম মাছখালী হয়েছে। বুকাননের আগমনের ৮২ বছর পর ১৮৮১ সালে ইউলিয়াম হান্টার কর্তৃক রচিত ‘দ্য ইম্পেরিয়াল গেজেটিয়ার অব ইন্ডিয়া’তেও এই দ্বীপের নাম মাছখালী বলে উল্লেখ করা হয়েছে (হান্টারঃ ১৮৮১)।[16] তাদের বর্ণনা থেকে অনুমিত হয়, মাছখালী নামটি পরবর্তীতে শব্দোচ্চারণগত পরিবর্তনের কারণে মহেশখালী হয়েছে।

 

বঙ্গোপসাগরের ফানেল সদৃশ মুখপ্রান্তে স্থিত অঞ্চল বলেই ফি বছর প্রলয়ঙ্করী কিছু ঘূর্ণিঝড় মহেশখালীর উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এমন অসংখ্য ধ্বংসাত্মক ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে ১৫৬৯ সালের একটি ঘুর্ণিঝড় মহেশখালীকে মূল ভূখণ্ড থেকে পৃথক করেছে বলে একটি ধারণা প্রচার পেয়েছে সুনীতি ভূষণ কানুনগোর বরাতে (কানুনগোঃ ১৯৮৮)[17]সুনীতি ভূষণ কানুনগো চট্টগ্রামের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করেছেন। তার রচিত ‘হিস্ট্রি অব চিটাগাং’ নামক গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে ইম্পেরিয়াল সিভিল সার্ভিসের এল এস এস ও’মালি’র তরফে ঘূর্ণিঝড়ে মহেশখালী মূলভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন (ও’মালিঃ ১৯০৮)[18] ও’মালি যার তরফে ইস্টার্ণ বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ারে এই তথ্য উল্লেখ করেছেন, তিনি হলেন ভেনিসের পরিভ্রাজক সিজার ফ্রেডেরিক। কিন্তু সিজার ফ্রেডেরিক নিজের ভ্রমণবৃত্তান্তে যে দ্বীপের কথা উল্লেখ করেছেন, সেটি মহেশখালী নয়, সন্দ্বীপ (ফ্রেডেরিকঃ ২০০৪)[19] প্রায় একই সময়ে ইতালিয়ান পরিভ্রাজক নিকোলাও মানুচ্চি তার ‘স্টোরিয়া দো মোগর’ (মুগল যুগের কাহিনী)তে যে তুফানের বর্ণনা দিয়েছেন, সেটাও ঠিক ঘূর্ণিঝড় নয়। সুনামির মতো জলোচ্ছ্বাস, যাকে মানুচ্চি অভিহিত করেছেন Macoraes নামে (মানুচ্চি-১৯০৭, পৃ-৩৭১)[20] এই ধরনের তুফান এতদাঞ্চলে পৌনঃপুনিকভাবে এসেছে, কিন্তু একটি পাহাড়ি অঞ্চলকে সাগর দিয়ে বিচ্ছিন্ন করার মতো এতো তীব্রতা নিয়ে এসেছে বলে উল্লেখ পাওয়া যায় না। সুনীতি ভূষণ কানুনগো সন্দ্বীপ সম্পর্কিত তথ্য মহেশখালীর বলে দাবি করেছেন।

 

অন্যভাবে, ভূমিকম্পের কারণে ভূগাঠনিক বিপর্যয়ের ফলে মহেশখালী মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারে। ও’মালি এবং সুনীতি ভূষণ কানুনগো এই ধরনের একটি ভূমিকম্পের কথা উল্লেখ করেছেন, যেটি ২ এপ্রিল, ১৭৬২ তারিখে সংঘটিত হয়েছিল। এতে চট্টগ্রামের কাছে উল্লেখযোগ্য কিছু অংশ পানিতে মজ্জিত হয়েছিল (ও’মালিঃ ১৯০৮[21], কানুনগোঃ ১৯৮৮[22]) কক্সবাজার অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়ের ইতিহাস এবং ভূমিকম্পের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে মহেশখালী কীভাবে মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে, তার একটি আনুমানিক ধারণা পাওয়া যায়। উভয়বিধ বিপর্যয়ের তুলনামূলক তথ্য পর্যালোচনা করলে অনুমিত হয়, বিচ্ছেদের কারণ ঘূর্ণিঝড় নয়; ভূমিকম্প। তবে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস এই বিচ্ছিন্নতাকে ত্বরান্বিত এবং অধিক ব্যাপ্ত করে থাকতে পারে 

 

মহেশখালীর ইতিহাস রচনার প্রয়াসে সম্প্রতি শাহ আলম নামে একজন লেখক ‘সাগর তনয়া মহেশখালী’ শিরোনামে একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। গ্রন্থটিতে অনেকগুলো পৌরাণিক কাহিনীর সন্নিবেশ ঘটেছে। যুক্তিবিদ্যায় কাহিনীর এই ধরনের বর্ণনাকে ঘটনার মালা বা ঘটনা সংযোজন বা ‘কলিগেশন অব ফ্যাক্ট’ বলা হয়। ঘটনার সমান্তরালে বাস্তব ও পুরাণ বা মিথের কিছু সাধারণ কাঠামোর ভিত্তিতে মিথের অর্থের নবায়ন ঘটেমধ্যযুগের অসংখ্য পুঁথিতে বাস্তবের সাথে পুরাণ মিলিয়ে কাহিনী পয়দা করা হয়েছে (ছফাঃ ১৯৯৫)[23] আমরা মহেশখালীর ইতিহাসের ক্ষেত্রেও পুরাণ ও বাস্তবের মিশেলে দোআঁশলা বয়ান পাই ব্রিটিশ বার্মার প্রথম চীফ কমিশনার কর্নেল এ পি ফায়ের রচিত ‘হিস্ট্রি অব বার্মা’য় চট্টগ্রাম ও আরাকান সংক্রান্ত যেসব কাহিনী উল্লেখ করা হয়েছে, উদাহরণ হিসেবে সেগুলোও একই ধরনের সৃজনশীল কল্পনা দোষে দুষ্ট। স্থানকালগত দূরত্বের কারণে এবং নির্ভরশীল ঐতিহাসিক উপকরণের অভাবে শোনা কথাকে গ্রাহ্য করায় ইতিহাসে বিবিধ ভ্রান্তির উদ্ভব ঘটতে পারে।     

 

ভাষার দিক থেকে সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়, ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ এবং ড. মনিরুজ্জামান চাটগাঁইয়া ভাষাকে বাংলার উপভাষা বা আঞ্চলিক বুলি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। নিঃসন্দেহে মহেশখালী তথা কক্সবাজারের ভাষায় মগধী প্রাকৃত ভাষার প্রভাবই সবচেয়ে বেশি। এছাড়াও পালি, আরবি, ইংরেজি, ফারসি, পর্তুগিজ, উর্দু, বর্মী ইত্যাদি নানা ভাষার প্রভাব এই ভাষায় পরিলক্ষিত হয়। ত্রিপুরা, বাংলা এবং আরাকানের ত্রিমুখী সঙ্গমের ত্রিবেণীতে অবস্থিত বলে এখানে ভূগোল, ভাষা এবং রাজনৈতিক অঞ্চল পরিবর্তনের কিছু প্রভাব পড়েছে। কাজেই সুনির্দিষ্ট কোন একরৈখিক ইতিহাস আমাদের অন্বেষার পাথেয় হবে না। ত্রিপুরার রাজদরবারে রচিত রাজমালা এবং আরাকানের রাজোয়াংসহ ক্যাপ্টেন হিরাম কক্সের ডায়েরী, ‘জার্নাল অব আ রেসিডেন্স ইন দ্য বার্মান এম্পায়ার এন্ড মোর পার্টিকুলারলি এট দ্য কোর্ট অব অমরাপুরা’ও আমাদের ইতিহাসের রসদ যোগায়। আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ তার ইসলামাবাদ গ্রন্থে যদিও তিনি চাটগাঁইয়া ভাষাকে বাংলার দুহিতা হিসেবে দেখেছেন, তবুও তিনি চাটগাঁইয়া ভাষাকে একটি স্বতন্ত্র ভাষা হওয়ার যোগ্য বলে দাবি করেছেন (ইসলামাবাদিঃ ২০১৭)[24]সাংবাদিক ও লেখক মোহাম্মদ আবদুর রশিদ সিদ্দিকী ‘চট্টগ্রামী ভাষাতত্ত্বে’ লিখেছেন, ‘বঙ্গদেশের সীমান্তবর্তী জেলা হিসেবে চট্টগ্রামের অধিবাসীরা বাঙালি, কিন্তু চাটগাঁইয়া ভাষা বাংলা হতে স্বতন্ত্র’   

 

অস্বীকার করার উপায় নেই, ভাষা সবসময় একটি গতিশীল প্রপঞ্চ। বিভিন্ন ভাষা ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ের প্রভাবে ভাষা ও শব্দ বদলে যায় প্রতিনিয়ত। তা সত্ত্বেও মহেশখালীর ভাষা মূলত বৃহত্তর অর্থে চাটগাঁইয়া ভাষা। ভাষা ও শব্দের মধ্যে স্থানীয় ইতিহাসের অনেক উপকরণ পাওয়া যায়। একটি শব্দ যেভাবে উচ্চারিত হয়, তা বিশেষ স্থান-কালের সাংস্কৃতিক অবস্থা নির্দেশ করে চাটগাঁইয়া ভাষার মূল হলো মাগধী প্রাকৃত। ফলে, অন্যদের কাছে কিছুটা দুর্বোধ্য মনে হলেও বাংলার সাথে এর মিল বেশি।  

 

বৃহত্তর চট্টগ্রামের প্রান্তিক অঞ্চল হিসেবে মহেশখালীর ইতিহাস খোঁজতে হয়, চট্টগ্রাম সম্পর্কে লিখিত বইপত্রের পাদটীকায়। রেফারেন্স আকারে বেশ কিছু বই পাওয়া যায়। আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের ইসলামাবাদ নামক গ্রন্থে চার্লস স্টুয়ার্ট রচিত ‘হিস্ট্রি অব বেঙ্গল’ এর প্রভাব লক্ষ করা যায়। কবি কংকন মুকুন্দরাম চক্রবর্তী ও কবি সৈয়দ সুলতানের রচনাবলি, মৌলভী হামিদুল্লাহ খান বাহাদুর রচিত ‘আহাদিসুল খাওয়ানিন’ এবং শিহাবুদ্দিন আহমদ তালিশ রচিত ‘ফতহীয়া-ই-ইবরিয়া’, জোয়াকিম জোসেফ এ ক্যাম্পোস রচিত ‘হিস্ট্রি অব দ্য পর্তুগিজ ইন বেঙ্গল’ এবং চৌধুরী শ্রীপূর্ণচন্দ্র দেববর্ম্মা তত্ত্বনিধি রচিত ‘চট্টগ্রামের ইতিহাস’ প্রভৃতি গ্রন্থে বৃহত্তর চট্টগ্রামের কাহিনী উল্লেখ আছে বটে, এসব বইয়ে মহেশখালীর ইতিহাস সেভাবে বর্ণিত হয় নি। কিছুক্ষেত্রে তথ্যপঞ্জি উল্লেখ না থাকায় মহেশখালী বিষয়ে আসলেই কী বলা হয়েছে, তা নিরূপণ করা দুরূহআরাকানি ক্রনিকল রাজোয়ানে মহেশখালীকে আরাকানি ভাষায় ‘মাহাজো’ বলা হয়েছে (তত্ত্বনিধিঃ ২০১৯)[25]

 

ব্রিটিশ আমলে অফিসিয়াল হিস্ট্রি নামে দাপ্তরিক প্রতিবেদনের কিছু মূল্যবান সংগ্রহ রয়েছে, যেগুলোর ঐতিহাসিক গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে ইতিহাসবিদ রমিলা থাপার আপত্তি তুলেছেন। তবুও এই দাপ্তরিক প্রতিবেদনগুলোতে সেই সময়কার গুরুত্বপুর্ণ তথ্য সন্নিবেশিত হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। তবে, এইক্ষেত্রে ইংরেজদের রাজনৈতিক অভিমত ও প্রাচ্যবাদি দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে সতর্ক থাকা বাঞ্ছনীয়। এই ধরনের একটি মূল্যবান দলিল হলো, এইচ জে এস কটন রচিত ‘মেমোরান্ডাম অন দ্য রেভেনিউ হিস্ট্রি অব চিটাগাং’ (কটনঃ ১৮৮০)[26]এই দলিলের একেবারে শেষ পৃষ্ঠায়, ২৩৩ পৃষ্ঠায়, ১৭৭৯ থেকে ১৮৩৯ পর্যন্ত মহেশখালীর ভূমি মালিকানা ও খাজনার ইতিহাস সংক্ষিপ্তভাবে বর্ণিত রয়েছেএই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ওয়ারেন হেস্টিংস ও এডোয়ার্ড ভেলার কর্তৃক রবার্ট ওয়ারলেজের নামে দ্বীপটি অনুমোদন দেওয়া হয়। মূলত ভূমি আবাদ করে অন্তত আট বছর বিনা খাজনায় ভোগ করার শর্তে ভদ্রলোককে এই অনুমোদন দেওয়া হয়। ১৭৭৯ সালের ৭ সেপ্টেম্বর বোর্ড মিটিংয়ে এই অনুমোদন পাস হলেও ১৭৮২ সাল পর্যন্ত এটি স্বাক্ষরিত ও বিলিবন্দেজ হয় নি। পরিশেষে ১৭৮২ সালের ২০ নভেম্বর, রবার্ট ওয়ারলেজ ২০,০০০ টাকার বিনিময়ে চিটাগাং এর কালেক্টর চার্লস ক্র্যাফটসের কাছে দ্বীপের মালিকানা হস্তান্তর করেন। কালেক্টর মিস্টার ক্র্যাফটস ১৭৮৬ সালের ৫ জানুয়ারি ৪০,০০০ টাকার বিনিময়ে দেওয়ান কালীচরণ কানুনগোর কাছে দ্বীপের মালিকানা হস্তান্তর করেন প্রভাবতী নামে তার বিধবা স্ত্রী বিদ্যমান থাকলেও তিনি ছিলেন বিপুত্রক। ফলে ১৭৯০ সালে কালীচরণের মৃত্যুর পর তার পালকপুত্র চন্ডিচরণ এই দ্বীপের মালিক হন। কালীচরণের বিধবা স্ত্রীর জীবদ্দশায় পালকপুত্র চন্ডিচরণ মারা গেলে প্রভাবতীর নামেই ১৭৯৩ সালে এই দ্বীপের বন্দোবস্ত হয়। ১৮২৬ সালে প্রভাবতীর মৃত্যুর পর তার ইতিপূর্বে প্রয়াত পালকপুত্র চন্ডিচরণের পালকপুত্র শরৎচন্দ্র মহেশখালী দ্বীপের মালিক হন। শরৎচন্দ্রের দেহাবসানের পর তার পুত্র কৈলাসচন্দ্র এই দ্বীপের জমিদারি অর্জন করেন। পাকিস্তান সরকার কর্তৃক ১৯৫০ সালে জমিদারি প্রথা বাতিলের সময় মহেশখালীর সর্বশেষ জমিদার ছিলেন বাবু অজিত কুমার রায় বাহাদুর চৌধুরী।

 

মহেশখালীর ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে ইতিহাসের উপকরণ, উৎস, মানদণ্ড ও পদ্ধতি নির্ধারণ করা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এই পর্যন্ত আমরা মহেশখালীর ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় দলিল দস্তাবেজে স্থানীয় ঘটনা উল্লেখের অভাব দেখতে পাই। একইভাবে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, পুরাণ ও বাস্তবতার বাইনারি বয়ানে ঐক্য বিধান করা, যা অত্যন্ত কঠিন। যেকোন স্থানীয় ইতিহাসের ক্ষেত্রে এই ধরনের সমস্যা রয়েছে। চন্দ্রবংশের শেষ রাজা কিংবা গোরক্ষনাথের কাল হিসেব করলে মহেশখালীর সাংস্কৃতিক ইতিহাস কম করে হলেও প্রায় নয়শো বছরের। এই নয়শো বছরে লিখিত বা স্থাপিত ঐতিহাসিক নিদর্শন অপ্রতুল। যা কিছু আছে, তা বিজ্ঞানের নামে, কিংবা নবায়নের নামে বিকৃত হয়ে যাচ্ছে। ফলে ইতিহাস দিনদিনে অধরা রয়ে যাচ্ছে। অথচ ইতিহাসের সাথে সংযুক্তি না থাকলে, মানুষের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ে। অন্যান্য যেকোন সাংস্কৃতিক দক্ষতার মতো, ইতিহাসও কোন সমাজের নিরাপত্তা ব্যবস্থার অংশ। এমনকি পুরাণ, এই বিজ্ঞানের যুগেও, সাংস্কৃতিক নিরাপত্তা বিধান করতে সক্ষম। মানুষের উৎস, অগ্রযাত্রা ও অভিমুখ ইতিহাসের ওপর নির্ভরশীল। নিশ্চয়ই মহেশখালীর ইতিহাস তার যাবতীয় সংকটের জায়গা থেকে উদ্ধার পাবে, মহেশখালীর মানুষকে সামনে যাওয়ার প্রেরণা যোগাবে।

 

ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তানের কাছ থেকে রক্ত ঝরিয়ে নতুন করে মুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ। এই স্বাধীন বাংলাদেশ পঞ্চাশ বছর পুর্ণ করেছে। পঞ্চাশ বছরে মহেশখালীতেও অজস্র ঐতিহাসিক ঘটনাবলি ঘটেছে। মহান মুক্তিযুদ্ধতো আছেই, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে মহেশখালীর অনেক ব্যক্তি বৃহত্তর বাঙালির পক্ষে ভূমিকা রেখেছে। মহেশখালীতে শিক্ষা, চিকিৎসা, সমবায়, কৃষি, মৎস্য এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নের ইতিহাস অতি বাস্তব এবং কালিকভাবে নৈকট্যের। শিক্ষা ও সংস্কৃতির জায়গায় মহেশখালীর যে বিকাশ ও সম্ভাবনা, তা আমাদের ইতিহাস সচেতনতার ওপর নির্ভর করবে। তাই মহেশখালীর ইতিহাস, যাবতীয় সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে, মুক্তি পাক।

 

 

সরওয়ার কামাল ।।  লেখক ও গবেষক            



·       সরওয়ার কামাল, লেখক ও গবেষক

[1] Carr, E. H.(1987) What is History(2nd ed.), London, Penguin Books, pp-7, 9

[2] Munslow, Alun.(1997) Rethinking History: The Journal of Theory and Practice, Vol-, Page-, London

[3] বাতেন, মুহম্মদ আবদুল (২০১১) মহেশখালীর আদিনাথ মন্দিরের ইতিকথা, চট্টগ্রাম, বলাকা প্রকাশন, পৃ-৩৩  

[4] Qanungo, Suniti Bhushan (1988), A History of Chittagong, Vol-1, Chittagong, Signet Library, pp-93

[5] Chakma, Niru Kumar (2003), Bauddha dharma , Banglapedia, Asiatic Society Bangladesh, Dhaka

[6] Ibid

[7] Qanungo, Suniti Bhushan (1988), A History of Chittagong, Vol-1, Chittagong, Signet Library, pp-93

[8] Ibid-93

[9] বাতেন, মুহম্মদ আবদুল (২০১১) মহেশখালীর আদিনাথ মন্দিরের ইতিকথা, চট্টগ্রাম, বলাকা প্রকাশন, পৃ-২৩ 

[10] বাতেন, মুহম্মদ আবদুল (২০১১) মহেশখালীর আদিনাথ মন্দিরের ইতিকথা, চট্টগ্রাম, বলাকা প্রকাশন, পৃ-২৩

[11] বাতেন, মুহম্মদ আবদুল (২০১১) মহেশখালীর আদিনাথ মন্দিরের ইতিকথা, চট্টগ্রাম, বলাকা প্রকাশন, পৃ-২২  

[12] Ahmad, Mushtaque (1995), A Glimpses of Cox’s Bazar, Cox’s Bazar, Cox’s Bazar Foundation

[13] Ibid

[14] Rizvi, S. N. H.(1970), East Pakistan District Gazetteers, Dacca, East Pakistan Government Press, pp-

[15] Buchanan, Francis. (2018) Willem Van Schendel (ed), Francis Buchanan in South East Bengal (1798), Dhaka, University Press Limited

[16] Hunter, W. W.(1881), The Imperial Gazetteer of India(vol-2), London, Trubner & Co, PP-448

[17] Qanungo, Suniti Bhushan (1988), A History of Chittagong, Vol-1, Chittagong, Signet Library, pp-5

[18] O’Malley, L. S. S.(1908),  Eastern Bengal District Gazetteers, Calcutta, The Bengal Secretariat Book Depot,pp-

[19] Frederick, Caesar (2004), A Voyage to the East Indies, and Beyond the Indies, &c, reproduced in SOAS Bulletin of Burma Research, Vol-2, No-2, Autumn 2004, ISSN 1479-8484, pp-

[20] Manucci, Niccolao (1907), Tr. William Irvine, Storia Do Mogor, London, John Murray, pp- 371

[21] O’Malley, L. S. S.(1908),  Eastern Bengal District Gazetteers, Calcutta, The Bengal Secretariat Book Depot, pp-

[22] Qanungo, Suniti Bhushan (1988), A History of Chittagong, Vol-1, Chittagong, Signet Library, pp-9

[23] ছফা, আহমদ (১৯৯৫), বাঙ্গালী মুসলমানের মন, ঢাকা, খান ব্রাদার্স এন্ড কোম্পানি, পৃ-১৮

[24] সাহিত্যবিশারদ, আবদুল করিম, (২০১৭) ইসলামাবাদ, চট্টগ্রাম, বাতিঘর, পৃ- ৯৭,৯৮

[25] তত্ত্বনিধি, চৌধুরী শ্রীপূর্ণচন্দ্র দেববর্ম্মা, (২০১৯) চট্টগ্রামের ইতিহাস, ঢাকা, গতিধারা, পৃ-৮৭

[26] Cotton, H.J. S.(1880), Memorandum on the Revenue History of Chittagong, Calcutta, The Bengal Secretariat Press, Pp-233

Comments

Unknown said…
"মহেশখালীর ইতিহাস: পুরাণ, মানে ও বাস্তবতা" মহেশখালী নিয়ে আজ পর্যন্ত যত লিখা প্রকাশিত হয়েছে তার মধ্যে এই লিখাটিই সবচেয়ে তথ্যবহুল ও গুরুত্বপূর্ণ। প্রচুর পরিশ্রমের ফসল এই লিখা। এই লিখা মহেশখালী বাসীর গুরুত্বপূর্ণ সম্পদে পরিণত হবে।

Popular posts from this blog

মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার কারণ ও প্রতিকার

সরওয়ার কামাল শিক্ষাক্ষেত্রে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য সাফল্য রয়েছে। সামাজিক উন্নয়ন সূচকেও বাংলাদেশের অবস্থান প্রতিবেশি দেশগুলোর তুলনায় ভালো, যা সম্পর্কে প্রশংসা করে বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন প্রবন্ধ লিখেছেন “ ল্যানসেট ” নামক মেডিক্যাল জার্নালে। কিন্তু এতে আমাদের বগল বাজিয়ে আত্মতৃপ্তিতে ভোগার অবকাশ নেই। কারণ শিক্ষার্থী ঝরে পড়া এবং বিজ্ঞান শিক্ষা সংকুচিত হয়ে পড়া আমাদের সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভুত হয়েছে। শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার কারণে আমাদের শিক্ষার মূল লক্ষ্যগুলো হাসিল হচ্ছে না, যার একটি হলো সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করা, অপরটি হলো শিক্ষাক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় প্রণোদনার ন্যায্য বণ্টন নিশ্চিত করা। অর্থাৎ সব শিশুই যাতে সরকারের সুযোগ ব্যবহার করে উন্নত জীবনের সন্ধান করতে পারে, তার শতভাগ নিশ্চয়তা প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না। শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার বিভিন্ন কারণ রয়েছে, তার মধ্যে বিভিন্ন স্তরের শিক্ষার ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন কারণ রয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার প্রধান কারণ দারিদ্র্য ও অপুষ্টি বা স্বাস্থ্যহীনতা । মাধ্যমিক পর্যায়েও শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার ক্ষেত্রে দারিদ্র্য সমস্যার ...

তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি বিচিত্র ছলনা জালে

তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি বিচিত্র ছলনা জালে ............................................................................... সাম্প্রতিক কালে আমাদের নৈতিক উপলব্ধিতে, সামাজিক উদ্বেগে কিংবা মূল্যবোধে দৃশ্যমান পরিবর্তন এসেছে। প্রযুক্তির নিবিড় ব্যবহার, বিশ্বায়নের প্রভাব, বিশ্বরাজনীতির অভিঘাত, বাজার সংস্কৃতির ধাক্কা ও চরমপন্থী ভাবাদর্শের টানাপড়েনে আমাদের চিরকালীন মূল্যবোধ ভেঙ্গে পড়েছে। নৈতিকতার সীমানা সরে যাচ্ছে প্রথাগত বিশ্বাস ও প্রতিষ্ঠানসংলগ্নতা থেকে। গতিময় জীবনের অভিঘাতে চরম অস্থিরতা ব্যক্তি থেকে ব্যষ্টির ব্যাপ্তিতে বিরাজ করছে। সর্বত্র আহাজারি, শোনার অবসর নিয়ে হাজির নেই কেউ। মানুষ যে নির্বিকার তাও নয়, তারা বিকারগ্রস্থ, পূর্ণমাত্রায় ঘোরগ্রস্থ, কেবল অপ্রত্যাশিত ঘটনাপ্রবাহের সাথে তাল মেলানোতে। তারা এখন এমন সব বিষয়ে আলোড়িত হয়, যে বিষয়ের সাথে তাদের সরাসরি যোগ নেই। থাকলেও তা অনেক ক্ষীণ ও দূরবর্তী কার্যকারণ সম্পর্কে আবদ্ধ। একইভাবে, তারা এমন সব পরিণতি ভোগ করে, যার জন্য তারা নিজেরা দায়ী নয়। আর যারা দায়ী তারা এর পরিণতি ভোগ করেন না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষ বয়সের দিকে এই প্যার...

মহেশখালীর সমাজ ও সংস্কৃতি

সরওয়ার কামাল সাগর কূলে গিরিকুন্তলা মোহিনী মহেশখালী দ্বীপের ৩৮৮ বর্গকিলোমিটার ভূত্বকে প্রায় পাঁচ লক্ষ লোকের বসতি। তাদের বসতি ঘিরে গড়ে উঠেছে উপকূলীয়-দ্বীপাঞ্চলীয় সমাজ। এই সমাজসভ্যদের মানসিক ঐক্য ও জীবনযাপন পদ্ধতি নিয়ে তৈরি হয়েছে শনাক্তযোগ্য বিশেষ স্থানীয় সংস্কৃতি। মানবজাতির চিরকালীন অভিযাত্রার অংশ হিসেবে দেশের নানা জায়গা থেকে হিজরত করে লোকজন এসে বসতি গেড়েছে মহেশখালীতে। তাই তাদের ভাষা ও আচরণে শনাক্ত করা যায় এমন বৈচিত্র্য ও তারতম্য, যা দিয়ে কক্সবাজারের অন্যান্য অঞ্চলের অধিবাসীদের তুলনায় মহেশখালীবাসীকে স্বতন্ত্রভাবে চিহ্নিত করা যায়। যে পার্থক্যসূচক বৈশিষ্ঠ্যাবলী নিয়ে মহেশখালীর সমাজ ও মানুষের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য তৈরি হয়েছে, চাটগাঁইয়া ভাষার উপভাষাতুল্য মহেশখালীর দ্বীপাঞ্চলীয় বুলি তার মধ্যে বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। [1] তবে সমস্যা হলো, লিখিত সাহিত্য ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের অভাবে স্থানীয় ইতিহাসের মতোই কালিক সূচকের নিরিখে এর জনসংস্কৃতি বর্ণনা করা দুরূহ। একেতো সংস্কৃতি স্বয়ং একটি ব্যাপক ধারণা, তদুপরি, এটি সতত পরিবর্তনশীল। ভাষা ও সংস্কৃতি স্রোতস্বী নদীর মতো বহমান। মানুষের কথা, স্মৃতি, পুরা...