Skip to main content

ভবিষ্যতের মানুষ

                                                   ভবিষ্যতের মানুষ

১৭ নভেম্বর, সদ্যসমাগত বিশ্ব দর্শন দিবস। সেকেলে অর্থে দর্শন মূলতঃ জ্ঞানের প্রকৃত স্বরূপ অন্বেষণের তৎপরতা। বিষ্ময় নয়, সংশয় ও বিভ্রম থেকেই দর্শনের উৎপত্তি (সায়মন ক্রিশলী, ২০১০)। কাজেই জ্ঞানকাণ্ডের দিক থেকে দর্শন জ্ঞানচর্চার বিশেষ পদ্ধতি ও প্যারাডাইম সম্বলিত বিষয়। জীবন ও জগত সম্পর্কিত মানবীয় সমস্যার যৌক্তিক ব্যাখ্যা দ্বারা নতুন বোধোদয় ঘটিয়ে মানুষের সংবিৎ ফেরানো দর্শনের কার্যকরী দিক। সমাধান নয়, বরং সমস্যার নতুন অর্থ তৈরি করা, সেন্স তৈরি করা এবং নতুন ব্যাখ্যা দেওয়াই দার্শনিকের কাজ। তাই, দর্শনের চিন্তাগত ঐতিহ্য ও গুরুত্ব অনুধাবন করে অধুনা বিশ্বে মানুষের যাবতীয় সমস্যা মোকাবেলার ক্ষেত্রে দর্শনের উপযোগ নিশ্চিত করার লক্ষে ইউনেস্কোর পক্ষ থেকে ফিবছর বিশ্বজুড়ে দর্শন দিবস পালন করা হয়। এই দিবস উপলক্ষে ইউনেস্কো সদরদপ্তরসহ বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে দার্শনিক, বিজ্ঞানী ও শিল্পবোদ্ধাদের বহুবিভাগীয় চিন্তার আদানপ্রদান ঘটে। সেই সূত্রে, এই বছর দর্শন দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারিত হয়েছে 'ভবিষ্যতের মানুষ'।

 

প্রতিপাদ্য ঘিরে ইউনেস্কোর ওয়েবসাইটে কিছু পর্যবেক্ষণ সন্নিবেশিত হয়েছে। তাদের প্রারম্ভিক জিজ্ঞাসা, "অতিমাত্রিক প্রযুক্তি অধ্যুষিত বিশ্বে খোদ মানবের ধারণাটাই ক্রম বিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। মানুষকে আমরা, তাহলে, এখন কী বলে ডাকবো? মানুষকে, তার স্পষ্ট ঐতিহাসিক বিবর্তন এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখে, কী বলে সাব্যস্ত করবো? আমরা কি এমন কোন রূপান্তর দেখছি, যে জন্য, মানবীয় দিগবলয়ের বাইরে, খোদ মানুষের সংজ্ঞাটাই সেকেলে হয়ে পড়েছে? ভবিষ্যতে আমরা মানুষের কোন রূপটির ওপর গুরুত্বারোপ করবো?

 

এসব প্রশ্নের সরল জবাব নেই বটে, দ্রুত ডিজিটালকরণের নিঃসন্দেহে একটি প্রভাব আছে। ইউনেস্কোর সমাজ ও মানবীয় বিজ্ঞান বিভাগ এসব নৈতিক ও জ্ঞানতাত্ত্বিক হেঁয়ালি আলোচনার পাটাতন হিসেবে কাজ করে, বিবিধ জ্ঞানকাণ্ডকে একত্রে এনে বহুসাংস্কৃতিক এবং বহুবিভাগীয় পরিপ্রেক্ষিত হাজির করার প্রয়াস নেয়”।

 

ইউনেস্কো লো ফেনোঁয়া'(Le Fesnoy)র সাথে নব দর্শন চর্চার এক অনুপম অভিজ্ঞতা অর্জনের লক্ষে সহযোগী হিসেবে কাজ করে। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় 'ভবিষ্যতের মানুষ' বহু বছরের গবেষণা এবং শিল্পী, বিজ্ঞানী ও দার্শনিকদের মধ্যে নিবিড় আলাপের ফলশ্রুতি। নতুন প্রতিপাদ্যকে ঘিরে সামগ্রিক উদযাপন পর্বে দুই প্রতিষ্ঠানের যৌথ সহযোগিতা পরিলক্ষিত হচ্ছে।

 

প্রযুক্তির অভিঘাতে, বিশেষ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও উচ্চপ্রযুক্তির প্রভাবে, মানুষের চিরন্তন রূপ পরিবর্তিত হতে যাচ্ছে। এই পরিবর্তনগুলো নিয়ে ইতিমধ্যে বিভিন্ন ধারণা, তত্ত্ব ও ব্যাখ্যা প্রচার-প্রসার পেয়েছে। মানুষের সমকালীন চ্যালেঞ্জের মধ্যে সংকরতা (Hybridity), তারল্য(Liquidity) ও অনিশ্চয়তা(Uncertainty) অন্যতম। সংকরতা একটি জীববৈজ্ঞানিক ধারণা হলেও তা হোমি ভাবা কর্তৃক সাংস্কৃতিক অধ্যয়নে ব্যবহৃত হয়েছে। পরে উত্তরাধুনিক সংস্কৃতির একটি লক্ষণ হিসেবে মানুষের সাথে প্রযুক্তির সংকরায়ন দার্শনিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্ধুতে এসেছে। মানুষের জীবসত্তার সাথে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও উচ্চপ্রযুক্তির সংযোগ, মানবীয় সক্ষমতা ও কার্যক্ষমতা বৃদ্ধিকারী জৈবরাসায়নিক ড্রাগ ও ডিভাইস ব্যবহার, কৃত্রিম অঙ্গ প্রতিস্থাপন, রোবোটিক ক্যাপাবিলিটি অঙ্গীভূতকরণ ইত্যাদি নানা প্রযুক্তির অভিঘাতে মানুষের স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক সত্তা এখন জৈব ও কৃত্রিমবুদ্ধিমত্তায় সংকরায়িত হয়ে পড়েছে। মানুষের সত্তা যেন অর্ধেক মানুষ, অর্ধেক প্রযুক্তি। মানুষের সাথে প্রযুক্তির সংমিশ্রণে নতুন ধরনের যন্ত্রমানব তৈরি হতে যাচ্ছে। এই নবমানবের বিষয়ীকে আমরা কিভাবে বুঝবো, তাদের মধ্যে কোন ধরনের বোধ বা সচেতনতা কাজ করবে, এসব নিয়ে মানুষের মধ্যে যুগপৎ বিষ্ময় ও সংশয় কাজ করছে।

 

স্নায়ুসক্ষমতা বৃদ্ধিকারী ঔষধ ও ডিভাইস ব্যবহারের নৈতিক দিক নিয়ে বিতণ্ডায় লিপ্ত হয়েছে অসংখ্য দার্শনিক। এসব স্নায়ুসক্ষমতা বৃদ্ধিকারক ব্যবহারের নিরাপত্তাগত দিক, বণ্টনমূলক ন্যায়, আইন ও নৈতিক অবনমন, বলপ্রয়োগ ইত্যাদি নিয়ে নানা বিতর্ক রয়েছে। বিদ্যালয়ের পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করানোর লক্ষে পিতামাতারা তাদের বাচ্চাদের মস্তিষ্কের শক্তি বৃদ্ধিকারক দিচ্ছে। কিন্তু এই ঔষধ সবাই ব্যবহার করতে পারছে না। ফলে একটি বিশেষ কৃত্রিম সক্ষমতা নিয়ে অসম প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে বাচ্চারা অন্যায্যতার শিকার হচ্ছে। অনুরূপভাবে, কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের নির্বাহীরা দীর্ঘসময় ক্লান্তিহীনভাবে কাজ করার জন্য স্নায়ুবর্ধক ঔষধ নিচ্ছে, শরীরে স্নায়ু সংবেদনশীল রোবোটিক ডিভাইস প্রতিস্থাপন করছে। ফলে নির্বাহীদের কৃত্রিম সক্ষমতা কোম্পানীগুলোর সাফল্য ও দক্ষতাভিত্তিক প্রতিযোগিতায় বিসদৃশ প্রভাব ফেলছে।

 

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষের জীবনে ব্যাপক ও নিবিড় প্রভাব রাখছে। অলক্ষিত কিন্তু প্রায়শই গভীর পরিণতি সহ, এটি আমাদের সমাজকে রূপান্তরিত করছে; মানুষ হওয়ার অর্থ ও তাৎপর্য কী, তার মূল ধারণাগুলোকে চ্যালেঞ্জ করে বসেছে৷ জরুরিকালে, কোভিড-১৯ অতিমারীর বিস্তার এবং পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবেলায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আমাদের নিবিষ্ট সহায়তা করেছে। একাধিক সুবিধার পাশাপাশি, এইসব প্রযুক্তি নেতিবাচক ঝুঁকি এবং চ্যালেঞ্জ তৈরি করে, যা থেকে উদ্ভূত হয় অসমতা এবং গভীর সামাজিক বিভাজন। অতিমারির কালে মানুষের শরীর নিয়ে, বাঁচার অধিকার পাওয়ার অগ্রাধিকার নিয়ে, বায়োপলিটিক্স ও জীবনবাঁচানো ক্ষমতার সার্বভৌমত্ব লক্ষ করা গেছে। ইতালীয় দার্শনিক জর্জিও আগামবেনের মতে, অতিমারি ও অতিমারির মতো জরুরিকালে কে বাঁচবে আর কে মরবে, এমন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষমতাই চূড়ান্ত সার্বভৌম ক্ষমতা। এই ক্ষমতার রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক স্বরূপ নিয়ে চিন্তাজগতে নতুন আগ্রহ তৈরি হয়েছে।

 

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দায়িত্বশীল ব্যবহার নিশ্চিতকরণে যথোপযুক্ত আইন তৈরি করা দরকার। ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপব্যবহার নিয়ন্ত্রণই সব নয়, মানবজীবনের যে ব্যাপক পরিসরে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার হচ্ছে, তাতে অনেকগুলো নৈতিক সংকটের ইস্যু আবির্ভুত হয়েছে। সেইসব ইস্যু বোঝাপড়ার মাধ্যমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করে মানুষের কল্যাণ ও প্রভাবগত অন্যায্যতা দূরীভূত করা প্রয়োজন।

 

যদি মানুষের মস্তিষ্কের সক্ষমতা বৃদ্ধিকারী ঔষধ ও ডিভাইসের ব্যাপক ব্যবহার ঘটে, এবং বর্ধিত ক্ষমতা সম্পন্ন মস্তিষ্কের মানুষ ভিন্ন ধরনের অপরাধ করে, তাদের হাত থেকে মানবসমাজকে বাঁচানোর জন্য কি নতুন ধরনের ফৌজদারি আইনের প্রয়োজন হবে? প্রচলিত ফৌজদারি আইন দীর্ঘ ঐতিহাসিক বিবর্তন ও পরিমার্জনার ভেতর দিয়ে বর্তমান রূপ পেয়েছে। হঠাৎ করে এই আইন পরিবর্তন করতে গেলে পুরানো ঐতিহ্য ও নতুন নৈতিকতার মধ্যে সমন্বয় করতে হবে। এই ধরনের পরিবর্তিত আইন প্রয়োগ ও সংশোধনের দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে হবে। ভবিষ্যতের মানুষ যখন নতুন বাস্তবতার সম্মুখীন হবে, নিশ্চয়ই তাদের উন্নত দর্শন নির্ভর নৈতিকতার সাথে লাগসই আইন ও প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন হবে। নৈতিক বুঝাপড়ার সাথে উপযুক্ত আইন ও কার্যকর প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে তাদের বিবেচনায় নিতে হবে ঐতিহ্য, মানুষ ও নতুন প্রযুক্তির প্রভাবকে।  

 

 

প্রগতি ও প্রযুক্তির অভিঘাতে মানুষের জীবনে ব্যাপক গতি এসেছে। যে কোন গতিই মানুষের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে জাড্যতা দূর করে গতিময়তা নিয়ে আসে। গতিময়তার কারণেই মানুষের বাস্তবতা নিরেট নয়, এটা টলটলায়মান পানির মতোই তরল। তাই বাস্তবের রূপ সদাগতিশীল ও রূপান্তরশীল। তারল্যগুণেই মানবসমাজ ও শ্রেণির এখন স্থির কোন রূপ নেই। মানুষের স্থির কোন শ্রেণিগত পরিচয় নেই আর। তাই, প্রাসঙ্গিকভাবেই বলা যায়, শ্রেণিসংগ্রামও নেই। মূলতঃ মানুষের এখন স্থির কোন বাস্তবতা নেই। মানুষ ক্রমাগত কিছু একটা, কোন এক সত্তা, হয়ে ওঠার পর্যায় অতিক্রম করে যাচ্ছে। মানুষ, সমাজ, পরিচয়, ব্যক্তিসত্তা, এমনকি, ঘটনা ও প্রতিষ্ঠানের স্থির রূপ আছে, এমন ধারণার বিলোপ ঘটেছে। জৈববিবর্তনের মতোই 'বাস্তব' সদা রূপান্তরশীল অবস্থায় আছে। এই ধরনের সত্তাগত তারল্য মানুষের জীবনে অনিশ্চয়তা নিয়ে এসেছে। পোলিশ দার্শনিক জিগমুন্ট বাউম্যান মানুষ ও সমাজের তারল্য নিয়ে সামাজিক সংকটের স্বরূপ ব্যাখ্যা করার প্রয়াস পেয়েছেন। তার মতে, সারা বিশ্বে যে দ্বন্ধ-সংঘাত ও অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে, এটার মূল কারণ তারল্য; হোক সেটা মানবসত্তা, সামাজিক মূল্যবোধ, মানুষের পরিচয় কিংবা বৈশ্বিক শাসনপরিচালন পদ্ধতির।

 

এনথ্রোপসিনের কারণে ধ্বংসোন্মুখ পৃথিবী ছেড়ে ভবিষ্যতের মানুষ কি বাইরের কোন গ্রহে বসতি স্থাপন করতে পারবে? বিজ্ঞানলব্দ উপাত্ত বিশ্লেষণ করে আমাদের অনুমান, মানুষ অদূর ভবিষ্যতে পৃথিবীর বাইরে কেন, খোদ পৃথিবীর অভ্যন্তরে বেশ কিছু জায়গায় বসতি স্থাপনের চিন্তা বাদ দিতে বাধ্য হবে। তাকে পৃথিবীর বিশেষ কিছু আরামদায়ক ও বাসযোগ্য অঞ্চলে আবদ্ধ হয়ে থাকতে হতে পারে। মানুষ যেমন উত্তর মেরুতে বসতি স্থাপনের চিন্তা করতে পারে না, তেমনি হিমালয়ের চূড়ায় বাসা বাধার স্বপ্নও দেখে না। তাকে জীবনযাপন উপযোগী স্থানের মধ্যে আবদ্ধ থাকতে হয়। ফলে তার যে পরিমিত সম্পদ ও প্রাকৃতিক উৎস আছে তার যথাযথ সদ্ব্যবহার করতে হবে। ভবিষ্যতের মানুষ বাসযোগ্য স্থান ও প্রাকৃতিক উপকরণের অভাবে ভুগবে। তার খাদ্যাভাব ও প্রাকৃতিক সম্পদের অপ্রতুলতাকে মানিয়ে নিতে মানুষ ধারাবাহিক অভিযোজনের মধ্য দিয়ে যেতে পারে। মানুষের খাদ্যাভ্যাসে মৌলিক পরিবর্তন আসতে পারে। খাদ্যের পরিমাণ কমার কারণে মানুষের দৈহিক অবয়বও ক্ষুদ্রতর হয়ে যেতে পারে।

 

মানুষ কি আদৌ তার চেতনলোক ও বিষয়ীসত্তাকে জানতে পারবে? প্লাতো থেকে শুরু করে এডমুণ্ড হুসার্ল, দেরিদা মায় লাঁকা পর্যন্ত অনেকেই বিষয়ীসত্তা নিয়ে আলোকপাত করেছেন। সমকালীন বিজ্ঞানের আবিষ্কার বিবেচনায় নিলেও বিষয়ীসত্তাকে স্বরূপে জানা এখনো সম্ভব নয়। যদিও বিজ্ঞানীরা ত্বকে কৃত্রিম ডিভাইস স্থাপনের মাধ্যমে অপরের মনোভাব, সংবেদন ও আবেগ অনুধাবনের প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন, এর মাধ্যমে আবহাওয়া বার্তার মতোই মানুষের আচরণগত আগামবার্তা বলা সম্ভব হবে কিনা সেই সংশয় রয়েছে। আবহাওয়া বার্তার সঠিকতার শতকরা হার নিয়ে বিভ্রমতো আছেই, মানুষের ভাবাবেগ নিয়ে আগাম বলা কোন ধরনের মানসিক দোলাচল তৈরি করবে বলা মুশকিল।

  

অধিকারের প্রশ্নে আমরা প্রায়ই আশাবাদি বাক্যে বলে থাকি, পৃথিবীর সব মানুষই কি একদিন সমান স্বাস্থ্যসেবা পাবে? সাম্প্রতিক কোভিড পীড়িত অতিমারি মানুষের জীবন ও জগত সম্পর্কিত উপলব্ধিতে নতুন মাত্রা নিয়ে এসেছে। মানুষ বাস্তবিক অর্থেই স্বাস্থ্যসেবার গুনগত মানের দিকে দৃষ্টিপাত করেছে। মহামারির মতো স্বাস্থ্যসেবার চ্যালেঞ্জগুলো বৈশ্বিক বিষয়; বিভিন্ন জাতি, রাষ্ট্রের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত আদানপ্রদানের এবং দায়ভাগের বিষয়। কিন্তু বাস্তবে ডাক্তারের সংখ্যা অপর্যাপ্ত, রোগীর সক্ষমতার সাথে ডাক্তারের প্রতুলতা অসম বলয়ে বিন্যস্ত। এই ক্ষেত্রে বাজেট, সম্পদ ও সুযোগের অপচয় কমিয়ে একীভূত, বৈষম্যহীন স্বাস্থ্যসেবার প্রয়োজন রয়েছে।

 

ভবিষ্যতে সন্তান জন্মদানের জন্য যৌনক্রিয়ার বিলোপ ঘটতে যাচ্ছে। এক দশকের মধ্যেই স্টেম সেল থেকে শুক্রাণু ও ডিম্বানু উৎপাদন করার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে, জীবিকার তাগিদে অত্যধিক খাটুনি এবং অপ্রত্যাশিত কর্মস্থলে স্বামী-স্ত্রীর কর্মস্থল হওয়ায় দাম্পত্য জীবনে যৌনতার অবকাশ হ্রাস পেয়েছে। মানুষের যৌনসত্তা এবং যৌনতার মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে। জেনেটিক মোডিফিকেশন ও এমব্রায়ো পরিমার্জন করার সুযোগ তৈরি হওয়ার ফলে নতুন প্রজন্মের শারিরীক ত্রুটি হয়তো কমে আসবে। এমন দিনও আসতে পারে, যখন মানুষের শরীরের সমস্ত কোষ পরিবর্তন ও প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হবে। তখন নৈতিক-অধিবিদ্যক প্রশ্ন দেখা দিবে; এই নবায়িত মানবদেহ কি পূর্বের ব্যক্তিসত্তাকে বজায় রাখতে পারবে? পূর্বের পরিচয় অক্ষুণ্ণ রেখে পূর্ব-সত্তা কর্তৃক সম্পাদিত কাজের দায়ভার নিতে পারবে? মানুষের মানবীয় পরিচয় ও সত্তাগত বাস্তবতা নিয়ে তত্ত্ববিষয়ক বিবাদ তৈরি হলে দর্শন এইক্ষেত্রে মানবজাতিকে চিন্তাগত সহায়তা করবে।

 

পারমাণবিক যুদ্ধ কিংবা জলবায়ু পরিবর্তনজাত, বড় ধরনের কোন, বাস্তুতান্ত্রিক বিপর্যয় মানুষের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়েই রয়েছে। শীতলযুদ্ধের অবসান ঘটলেও আঞ্চলিক শক্তিগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রাখার বৈশ্বিক ফোরামগুলো অকার্যকর হয়ে পড়েছে। ফলে বিশ্বশিষ্টাচারের দিক থেকে মানব সভ্যতার বিপর্যয় শুরু হয়েছে। তাই পারমাণবিক যুদ্ধ কিংবা পরিবেশ বিপর্যয়ের সম্ভাবনা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। মানুষে মানুষে ক্ষমতার সাম্য যেমন একটি কাম্য বিষয়, প্রাতিষ্ঠানিক কার্যকরতার দিক থেকে ক্ষমতার সাম্য একটি বিপর্যয়কর বিষয়। সমপর্যায়ের একাধিক প্রতিষ্ঠান ও সাংগঠনিক শক্তি কেউ কাউকে মানতে চায় না। তাই নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরি হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সামাজিক চুক্তি মতবাদে হবস বর্ণিত শক্তিশালী লেভিয়াথান না থাকলে মাঝারি শক্তি থেকে দুর্বলদের রক্ষা করার কেউ থাকে না। তাই, অনুগতদের শান্তি ও নিরাপত্তা বিধানের জন্য সম্মতিভিত্তিক সার্বভৌম ক্ষমতার অনুপস্থিতিতে মাঝারি ও ক্ষুদ্রশক্তির উৎপাত শুরু হয়।

 

দোকানদারি ও বেয়াদবি সমকালীন জমানার লক্ষণ। দুইটার মধ্যে একটি আন্তঃসম্পর্ক রয়েছে। মানুষের যে এজমালি সম্পত্তি, সাধারণ পরিসেবা, সাধারণ প্রাকৃতিক উৎস, এসবের বাণিজ্যিকীকরণ ঘটেছে। মানুষ সর্বদিক থেকেই স্থান ও পরিসর সংকটে ভুগছে। মানুষের বিকল্পগুলো নাই হয়ে যাচ্ছে। পানির মতো একটি স্বাভাবিক প্রাকৃতিক পণ্য টাকা দিয়ে কিনে খেতে হচ্ছে। একটা স্বাভাবিক প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করার জন্য অর্থ ব্যয় করে প্রবেশ করতে হচ্ছে। পৃথিবীতে মানুষ ব্যতীত অন্য কোন প্রাণীকে অর্থ ব্যয় করে মুত্র নির্গমন করতে হয় না। এজমালি সম্পত্তি নিয়ে এই ধরনের দোকানদারি মানুষের সামাজিক স্বার্থকে ক্ষুণ্ণ করেছে। মানুষের সামাজিক ভদ্রতা ও সৌজন্যের জায়গাটা সংকুচিত করেছে।

 

মানুষের অভিবাসন ও শরণার্থী দেশান্তরের বিষয়গুলো যে কোন মানববসতি স্থলের জিনপুলে ব্যাপক জীনবৈচিত্র্য  নিয়ে আসবে। এভাবে মানুষের অভিবাসন এবং জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তরের ফলে মানুষের টিকে থাকার সক্ষমতা বাড়বে। প্রজনন ক্ষমতা বিবেচনায় পৃথিবীতে কালো মানুষের সংখ্যা সাদা মানুষের তুলনায় দিন দিন বৃদ্ধি পেতে পারে। যে তারল্য ও গতিময়তার ভেতর দিয়ে মানবসমাজ স্থান-কাল পাড়ি দিচ্ছে, তাতে মানুষের ক্রমাগত রূপান্তর একটি অনিবার্য বাস্তবতা।   

 

কাজেই মানুষের জৈবিক বিবর্তন, সত্তাগত রূপান্তর এবং সামাজিক পরিবর্তন, মানুষের আচরণগত পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। স্বার্থ তাড়না এবং টিকে থাকার লড়াইয়ে সবাই অপ্রস্তুতভাবে সামিল হয়েছে। ভবিষ্যতের মানুষ কী হবে, এটা একইসাথে তার জৈবিক, আত্মিক, আধ্যাত্মিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক রূপান্তরের ফলে সত্তাগত ও বিষয়ীগত রূপান্তর ঘটার সম্ভাবনার ওপর নির্ভর করবে। অর্গানিক মানুষ যখন হাইব্রিড মানুষ নিয়ে চিন্তা করে, সেটা হাইব্রিডদের বাস্তবতাকে গ্রাহ্য করতে পারছে কিনা, সেই পর্যালোচনাও দরকার হতে পারে। তারপরও আমাদের রক্ষণশীল প্রত্যাশা, ভবিষ্যতের মানুষ অভিযোজনের মাধ্যমে, সৃজনশীলতার মাধ্যমে, মানুষ পরিচয়ে টিকে থাকুক আরও দীর্ঘকাল।

 

সরওয়ার কামাল।। ১৮ নভেম্বর, ২০২২

Comments

Popular posts from this blog

মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার কারণ ও প্রতিকার

সরওয়ার কামাল শিক্ষাক্ষেত্রে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য সাফল্য রয়েছে। সামাজিক উন্নয়ন সূচকেও বাংলাদেশের অবস্থান প্রতিবেশি দেশগুলোর তুলনায় ভালো, যা সম্পর্কে প্রশংসা করে বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন প্রবন্ধ লিখেছেন “ ল্যানসেট ” নামক মেডিক্যাল জার্নালে। কিন্তু এতে আমাদের বগল বাজিয়ে আত্মতৃপ্তিতে ভোগার অবকাশ নেই। কারণ শিক্ষার্থী ঝরে পড়া এবং বিজ্ঞান শিক্ষা সংকুচিত হয়ে পড়া আমাদের সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভুত হয়েছে। শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার কারণে আমাদের শিক্ষার মূল লক্ষ্যগুলো হাসিল হচ্ছে না, যার একটি হলো সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করা, অপরটি হলো শিক্ষাক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় প্রণোদনার ন্যায্য বণ্টন নিশ্চিত করা। অর্থাৎ সব শিশুই যাতে সরকারের সুযোগ ব্যবহার করে উন্নত জীবনের সন্ধান করতে পারে, তার শতভাগ নিশ্চয়তা প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না। শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার বিভিন্ন কারণ রয়েছে, তার মধ্যে বিভিন্ন স্তরের শিক্ষার ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন কারণ রয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার প্রধান কারণ দারিদ্র্য ও অপুষ্টি বা স্বাস্থ্যহীনতা । মাধ্যমিক পর্যায়েও শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার ক্ষেত্রে দারিদ্র্য সমস্যার ...

তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি বিচিত্র ছলনা জালে

তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি বিচিত্র ছলনা জালে ............................................................................... সাম্প্রতিক কালে আমাদের নৈতিক উপলব্ধিতে, সামাজিক উদ্বেগে কিংবা মূল্যবোধে দৃশ্যমান পরিবর্তন এসেছে। প্রযুক্তির নিবিড় ব্যবহার, বিশ্বায়নের প্রভাব, বিশ্বরাজনীতির অভিঘাত, বাজার সংস্কৃতির ধাক্কা ও চরমপন্থী ভাবাদর্শের টানাপড়েনে আমাদের চিরকালীন মূল্যবোধ ভেঙ্গে পড়েছে। নৈতিকতার সীমানা সরে যাচ্ছে প্রথাগত বিশ্বাস ও প্রতিষ্ঠানসংলগ্নতা থেকে। গতিময় জীবনের অভিঘাতে চরম অস্থিরতা ব্যক্তি থেকে ব্যষ্টির ব্যাপ্তিতে বিরাজ করছে। সর্বত্র আহাজারি, শোনার অবসর নিয়ে হাজির নেই কেউ। মানুষ যে নির্বিকার তাও নয়, তারা বিকারগ্রস্থ, পূর্ণমাত্রায় ঘোরগ্রস্থ, কেবল অপ্রত্যাশিত ঘটনাপ্রবাহের সাথে তাল মেলানোতে। তারা এখন এমন সব বিষয়ে আলোড়িত হয়, যে বিষয়ের সাথে তাদের সরাসরি যোগ নেই। থাকলেও তা অনেক ক্ষীণ ও দূরবর্তী কার্যকারণ সম্পর্কে আবদ্ধ। একইভাবে, তারা এমন সব পরিণতি ভোগ করে, যার জন্য তারা নিজেরা দায়ী নয়। আর যারা দায়ী তারা এর পরিণতি ভোগ করেন না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষ বয়সের দিকে এই প্যার...

মহেশখালীর সমাজ ও সংস্কৃতি

সরওয়ার কামাল সাগর কূলে গিরিকুন্তলা মোহিনী মহেশখালী দ্বীপের ৩৮৮ বর্গকিলোমিটার ভূত্বকে প্রায় পাঁচ লক্ষ লোকের বসতি। তাদের বসতি ঘিরে গড়ে উঠেছে উপকূলীয়-দ্বীপাঞ্চলীয় সমাজ। এই সমাজসভ্যদের মানসিক ঐক্য ও জীবনযাপন পদ্ধতি নিয়ে তৈরি হয়েছে শনাক্তযোগ্য বিশেষ স্থানীয় সংস্কৃতি। মানবজাতির চিরকালীন অভিযাত্রার অংশ হিসেবে দেশের নানা জায়গা থেকে হিজরত করে লোকজন এসে বসতি গেড়েছে মহেশখালীতে। তাই তাদের ভাষা ও আচরণে শনাক্ত করা যায় এমন বৈচিত্র্য ও তারতম্য, যা দিয়ে কক্সবাজারের অন্যান্য অঞ্চলের অধিবাসীদের তুলনায় মহেশখালীবাসীকে স্বতন্ত্রভাবে চিহ্নিত করা যায়। যে পার্থক্যসূচক বৈশিষ্ঠ্যাবলী নিয়ে মহেশখালীর সমাজ ও মানুষের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য তৈরি হয়েছে, চাটগাঁইয়া ভাষার উপভাষাতুল্য মহেশখালীর দ্বীপাঞ্চলীয় বুলি তার মধ্যে বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। [1] তবে সমস্যা হলো, লিখিত সাহিত্য ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের অভাবে স্থানীয় ইতিহাসের মতোই কালিক সূচকের নিরিখে এর জনসংস্কৃতি বর্ণনা করা দুরূহ। একেতো সংস্কৃতি স্বয়ং একটি ব্যাপক ধারণা, তদুপরি, এটি সতত পরিবর্তনশীল। ভাষা ও সংস্কৃতি স্রোতস্বী নদীর মতো বহমান। মানুষের কথা, স্মৃতি, পুরা...