অর্জন
ও সৃজনে বুদ্ধিজীবীগণ
সরওয়ার
কামাল
Nations are born in the heart of poets;
They prosper and die in the hands of politicians.
Muhammad Iqbal/ Stray Reflection.
সেই এক সোনালী সময়
ছিল যখন বুদ্ধিজীবীগণ সভ্যতা বিনির্মাণের মূল কারিগর বলে বিবেচিত হতেন। জ্ঞানে ও
সৃজনে, মানুষের সামগ্রিক বিকাশ ও উন্নতি নিশ্চিতকরণে তারা অগ্রণী ভূমিকা রাখতেন। মূঢ়তার
নিকষ অন্ধকারে জ্বালাতেন আশাপ্রদ আলোর চেরাগ। তারাই জ্ঞানের আলো ফেলে মহাকালের গহ্বর
থেকে সমকালের উন্মোচন ঘটান। প্রকাশ্যে ও নেপথ্যে থেকে মানুষ ও সভ্যতার ইতিহাসকে
নির্মাণ করে অনাগত কালের অভিমূখে নিয়ে যান। অতীত ইতিহাসের প্রতিটি বাঁক বদলে দিক
নির্দেশনা যুগিয়েছেন বুদ্ধিজীবীরাই। সমাজ বিপ্লবে, রাজনৈতিক বিপ্লবে, সাংস্কৃতিক
বিপ্লবে, দার্শনিক ও ধর্মীয় সংস্কার সাধনে মান্যতা পেয়েছে তাদের প্রজ্ঞা, বীক্ষা ও
দীক্ষা। এমনকি তাদের মানবীয় ভুলগুলো পর্যন্ত দৈববাণী আকারে গ্রাহ্যতা পেয়েছে কখনো
কখনো। কারণ আগে ক্ষমতা ছিল জ্ঞাননির্ভর ও জ্ঞানমুখি। স্বাভাবিকভাবেই ক্ষমতার
কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন বুদ্ধিজীবীগণ। ফলে ক্ষমতাকেন্দ্রে অবস্থান করেই তারা সভ্যতাকে
ও বিশ্বব্যবস্থাকে দেখেছেন ও গড়তে ভূমিকা রেখেছেন। এই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে পর্যন্ত
বুদ্ধিজীবীরাই ছিলেন রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতা চর্চার মূল এজেন্ট। প্রাচীন যুগের
কৃষক বিদ্রোহ, রাজনৈতিক বিপ্লব, ভূমি সংস্কার, এমনকি আমাদের অতি চেনা ফরাসি বিপ্লব
আর রুশ বিপ্লবসহ ভারতের জাতীয়তাবাদি আন্দোলন, সবই বুদ্ধিজীবীদের চর্চা ও সাধনার
ফল। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন অপ্রত্যাশিত সমস্যা মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে নতুন
নতুন বিবেচনা অগ্রাধিকার পাওয়ায় ক্ষমতার
কাঠামো ও কর্তৃত্বের বণ্টন নতুনভাবে বিন্যস্ত হয়েছে। যুদ্ধ ব্যবস্থাপনা,
যুদ্ধকালীন উৎপাদন, শাসন চাহিদা ও প্রয়োজনের নিরিখে বদলাতে হয়েছে ক্ষমতার ছক। যার
ফলে বুদ্ধিজীবীর স্থলে চলে এসেছে, রাজনীতিক ও জেনারেলগণ। কালক্রমে সেই ক্ষমতার
জায়গাটি চলে যায় রাজনীতিকদের হাতে। আরও পরে আইএমএফ, ডব্লিউটিও, বিশ্বব্যাংক
ইত্যাদি প্রতিষ্ঠার দ্বারা বিশ্বপুঁজিবাদের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পরিগ্রহ করার মধ্য
দিয়ে ব্যবসায়ীরাও বিশ্বনীতি ও আইন প্রণয়নের অধিকার পেয়ে বসে। এভাবে ধীরে ধীরে বুদ্ধিজীবীরা
ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে কিনারের দিকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে। সামাজিক বিবর্তনের
ধারায় তাদের প্রথাগত ভূমিকা পরিবর্তিত হয়েছে। শেষ পর্যন্ত, কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্টে
আপসহীন বুদ্ধিজীবীদের লড়াকু চেতনা নিঃশেষ হতে হতে বুদ্ধিজীবীতা বিদ্যায়তনের নিছক
বির্যহীন জ্ঞান ব্যবসায় পর্যবসিত হয়েছে। ইতিহাসে খুব কম লোকই আছে, যারা গ্রীক
দার্শনিক সক্রাতেসের মতো সত্যের জন্য জীবন দিতে সাহস দেখিয়েছে। ক্ষমতার বিপরীতে
দাঁড়িয়ে সত্য বলার সাহস লোপ পেয়েছে, তাই বিপ্লবী সত্যের ধারক বুদ্ধিজীবীদের আকাল
পড়েছে। বরং ক্ষমতাই জ্ঞানরূপে আভির্ভূত হচ্ছে। সত্য এখন আবিষ্কারের বা উদ্ঘাটনের
নয় বরং নির্মাণের বিষয়। বিশেষ ক্ষমতা কাঠামোতে, জ্ঞানের কারখানায় বিশেষ ছাঁচে ফেলে
এখন সত্য উৎপাদন করা হয়। এতে ক্ষমতা চর্চার নানা এজেন্ট নানাভাবে ভূমিকা রাখে। এভাবে
সত্য ও জ্ঞান আবিষ্কারের একক কর্তৃত্ব বুদ্ধিজীবীদের হাত ছাড়া হয়েছে। জ্ঞানবাচক
কর্তৃত্বে অসম্পৃক্তি ও ক্ষমতাবিযুক্তির
দ্বারা সমাজে তাদের অবস্থান, ক্ষমতা চর্চার ব্যাপ্তি, প্রভাবের বলয় নতুনভাবে
বিন্যস্ত হয়েছে। এখন ঘটনা ও সত্যকে, সে সাথে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকাকেও ভিন্ন
দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার অবকাশ আছে। মন্ত্রের
মতো করে সত্যের বাণী প্রচার করে যাওয়ার দিন গত হয়েছে।
ইদানিং অকুপাই
ওয়ালস্ট্রীট ও পরিবেশবাদি আন্দোলনের মতো পৃথিবী ব্যাপী বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলন
হচ্ছে, বহুমাত্রিক সাংস্কৃতিক যুদ্ধ চলছে।
এতে বুদ্ধিজীবীরা পরস্পর বিরোধী অবস্থান থেকে নিজেদের মত, মন্তব্য ও মতবাদ প্রচার
করছেন। সে সাথে রাজনীতিকদের লেজুড় আকারে বা এজেন্ডার ভিত্তিতে নিজেদের মধ্যেও
মেরুকরণ ঘটাচ্ছেন। প্রতিটি সামাজিক আন্দোলনে তারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, প্রণোদনা
দিচ্ছেন, জনমত গঠন করছেন, মিড়িয়ায় ও পত্রিকায় মতামত স্তম্ভ লিখছেন। কিন্তু কোন
আন্দোলনকেই তারা পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে পারছেন না। প্রতিটি আন্দোলনই বেহাত হচ্ছে,
লক্ষ্যচ্যুত হচ্ছে। তারা কর্পোরেট গ্রুপ ও রাজনীতিকদের দ্বারা ব্যবহৃত হচ্ছেন,
রাজনৈতিক চক্রে আবর্তিত হচ্ছেন। মূলত রাজনীতির সমাজ পরিমণ্ডলে বিনোদন যোগানো ও
নাগরিক হতাশা উৎপাদন করা ব্যতীত এখন বুদ্ধিজীবীদের উল্লেখযোগ্য কোন সাফল্য নেই।
পদ-পদবির লোভে পড়ে অপরের দ্বারা ব্যবহৃত হওয়া ও ক্ষণিকের বিনোদন যোগানোর কারণে, একালের
দার্শনিক স্লাভোজ জিজেক ও সাইমন ক্রিশলি, বুদ্ধিজীবীদের ডেকেছেন Whore to power বা ‘ক্ষমতার বণিতা’ হিসেবে।
এই ধরণের ঐতিহাসিক ও বিশ্বপ্রেক্ষাপটে
এবং সমকালের বিপরীতে যদি আমরা বাংলাদেশের গর্ভকালের ইতিহাস দেখি, তাহলে এক
ঐতিহাসিক গৌরবের স্মৃতি রোমন্থন করতে হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে ও জাতি সৃজনে
বুদ্ধিজীবীদের আছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। পরাধীনতার উপলব্ধি ও স্বাধীনতার বোধ
সৃষ্টিতে, নিজস্ব চিন্তা বিনির্মাণে কিংবা কৌশলগত পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে
তাঁরা কখনও প্রকাশ্যে, কখনও নেপথ্যে কাজ করেছেন। মূলত সাংস্কৃতিক
পরিমণ্ডলে, গণচেতনা বিকাশে ও গণজাগরণের মাধ্যমে গণশক্তির উদ্বোধনে, বিভাগপূর্বকাল
থেকেই বুদ্ধিজীবীদের ধারাবাহিক ও সক্রিয় প্রচেষ্টা ছিল। কিছু পোষা, লেজুড় ও সুবিধাবাদি
বুদ্ধিজীবীর কথা উনুল্লেখিত রাখলে, চল্লিশের দশক থেকে বাঙ্গালির মানসনেত্র
পরিস্ফুটনে সহায়তা করেছেন এক ঝাঁক কলম সৈনিক, যাদের অনেকে প্রথাগত বুদ্ধিজীবী হলেও
একইসাথে তারা অর্গানিক বুদ্ধিজীবীর ভূমিকা পালন করেছেন, দায়বদ্ধতার নিরিখে সময়কে
বিচার করেছেন এবং সমাজ ও মানুষের প্রতি ত্যাগ স্বীকার করেছেন। আমরা তাঁদের কাছে ঋণী।
তাঁদের কথা ও অবদান শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা আমাদের একটি জাতীয় দায়িত্ব।
আমাদের সমস্ত
কর্মযজ্ঞের পেছনে কোন না কোন চিন্তা কাজ করে, কিন্তু চিন্তাবৃত্তি ও বুদ্ধিবৃত্তির
ক্ষেত্র বিমূর্ত ধারণার পর্যায়ে । চিন্তাবৃত্তি হতে বিমূর্ততাজাত বিচ্ছেদ সরল বস্তুবাদি
মানুষকে একটি কালিক দূরত্বে ঠেলে দেয়, তাই তারা চিন্তাবৃত্তির ভূমিকা উপলব্ধি করতে
পারেন, কিছুটা দেরীতে। তারা চিন্তাজাত ঘটনার দৃশ্যমান রূপ, অবভাস, প্রায়োগিক কৌশল,
প্রেরণা এবং তার বাস্তব ফল দেখতে চায়। এ ক্ষেত্রে ক্রান্তদর্শী কবি, দার্শনিক,
প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক ও সাহিত্যিকগণ চিন্তাবৃত্তি অবলম্বন করেন, আর বৌদ্ধিক আবেগে
সৃজন করেন স্বাধীনতার স্বপ্ন। সেই স্বপ্নের ভিত্তিতে রাজনীতিকগণ প্রণয়ন করেন
স্বাধীনতার রূপকল্প । আর সর্বস্তরের জনগণ দৃপ্ত শপথ নিয়ে, জীবন বাজি রেখে অর্জন
করেন স্বাধীনতা। সেই ১৯২২ সালে কবি কাজী নজরুল ইসলাম “বাংলাদেশ” শিরোনামে
কবিতা যে লিখলেন, রক্তমাখা দ্রোহের বাতাবরণে, ইতিহাসের গহ্বর থেকে তার উদয় ঘটল
১৯৭১ সালে। রবীন্দ্রনাথের সোনার বাংলা, নজরুলের বাংলাদেশ, জীবনান্দের রূপসী বাংলা,
বঙ্গবন্ধুর স্বাধীন বাংলাদেশ সবই একই রাজনৈতিক সম্পর্কের নিগড়ে বাঁধা। কিন্তু সাধারণ
জনগণের সাথে চিন্তাগত তৎপরতা, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক তৎপরতার যোগ ঘটে ভিন্ন
মাত্রায়, ভিন্ন পর্যায়ে। যে কোন রাজনৈতিক বিপ্লবের পূর্বে সাংস্কৃতিক রূপান্তর ঘটে। সাংস্কৃতিক রূপান্তর প্রথমে ঘটে মানুষের মননে, রুচিতে ও চিন্তায়, পরে
সামগ্রিক সংস্কৃতি ও জীবন কৌশলে। বাংলাদেশেও একাত্তরের সশস্ত্র বিপ্লবের পূর্বে
ঘটেছে সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ ও আধিপত্য মোকাবেলার সংগ্রাম। বাংলা বর্ণমালা, বাংলা
ভাষা, রবীন্দ্রসঙ্গীত, শিল্প-সাহিত্য দ্বারা স্বকীয় স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার দুর্বার
আকাঙ্ক্ষা থেকে বাঙালি কলম ধরেছে, জেল খেটেছে, রক্ত দিয়েছে। সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের
জায়গায় নতুন করে আত্মপরিচয় অন্বেষণ করতে হয়েছে। ইতিহাস ও ঐতিহ্যের পাটাতনে
দাঁড়িয়ে, সাংস্কৃতিক ঐক্যের বল দিয়ে রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের সংগ্রাম করার জন্য
প্রস্তুতি নিতে হয়েছে। বুদ্ধিজীবীগণ সে কাজগুলো করেছেন এবং করার মাধ্যমে সমাজের
উদীয়মান শ্রেণি, বিশেষ করে ছাত্র সমাজকে সচেতন করেছেন। জাতীয়তার শর্ত ও স্বাধীনতার
দাবী হঠাৎ করে আসে নি। তা তৈরি করতে হয়েছে, এবং সেই শর্ত তৈরিতে কোদালির কাজ
করেছেন বুদ্ধিজীবীরা। সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামীলীগ থেকে যারা প্রার্থী হয়েছিলেন
তাঁদের বেশিরভাগই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন, যাদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক
চেতনা বিনির্মাণে ভূমিকা রেখেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ। বাংলাদেশ নামক
রাষ্ট্র কায়েমের জন্য শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব ও বিকাশে যে বুদ্ধিবৃত্তিক
পাঠের দরকার ছিল, তা ঐ সময়ের শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবীগণ যুগিয়েছিলেন।
বাঙ্গালির জাতীয়তাবাদি
চেতনা তৈরি ও জাগরণ সৃষ্টিতে যাদের অবদান আছে তাদের সবার কথা বলতে গেলে বাঙ্গালির
আলোকসম্পাতকাল থেকে শুরু করতে হবে। তবে সময় ও পরিসর বিবেচনা করে আমরা যদি পূর্ব
বাংলা বা পূর্ব-পাকিস্তানের তিরিশের দশক থেকে শুরু করি তাহলে শিখা গোষ্ঠীর বুদ্ধির
মুক্তি আন্দোলনের ঋণ স্বীকার করতে হবে। কাজেই তার একজন প্রধান আলোকবর্তিকাবাহী মনীষী
আবুল ফজলের নাম আসবে। কামরুদ্দিন আহমদ “পূর্ব বাংলার সামাজিক
ইতিহাস” রচনা করে চেতনা সৃষ্টিতে গুরুত্বপুর্ণ অবদান রাখেন।
বাংলা ভাষার অধিকার আদায়ের পক্ষে ড মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা
রাখেন। ১৯৫২ সালে অধ্যাপক অজিত গুহ, মুনীর চৌধুরী, মোজাফফর আহমদ চৌধুরী, পুলিন দে গ্রেফতার
হওয়ায় গণমানুষ ও ছাত্রদের মধ্যে এক ধরণের বিপ্লবী আবেগ তৈরি হয়। বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের
প্রভাবে শিক্ষকদের নিরুপদ্রব মানসে সক্রিয় রাজনৈতিক চেতনা দানা বাঁধে। তাই আমরা
মুনীর চৌধুরীর মতো অনেক ইংরেজির শিক্ষককে দেখি বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক হতে। অধ্যাপক
আবদুর রাজ্জাক লিখেছেন, জেলে যাওয়ার আগে মোজাফফর আহমদ চৌধুরী ছিলেন একজন সার্থক
শিক্ষক, আর জেল থেকে বেরিয়ে নতুন চিন্তার, নতুন দৃষ্টিভঙ্গির, নতুন মাত্রার এক
আকর্ষনীয় শিক্ষক। আগে ছিলেন শ্রেণিকক্ষে নিমগ্ন, পরে হয়েছেন বাইরেও নিবিষ্ট। সিকান্দার
আবু জাফর সমকাল পত্রিকা প্রকাশের মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবাদি চেতনা সৃষ্টিতে অবদান
রাখেন। ১৯৫৪ সালে যুক্ত ফ্রন্টের ২১ দফা প্রণয়ন করেন আবুল মনসুর আহমদ। ৬২ সালের
শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬’র ছয়দফা আন্দোলনে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা ইতিহাসে মাইলফলক
হয়ে থাকবে। যে ধরণের রাজনৈতিক অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে
ছয় দফা দাবি উত্থাপিত হয়েছিল তার বুদ্ধিবৃত্তিক সূত্রধর হলেন রেহমান সোবহান,
আনিসুর রহমান, নুরুল ইসলাম, মোশারফ হোসেন, এম এন হুদা প্রমুখ অর্থনীতিবিদগণ। অর্থনীতিবিদদের
গবেষণা ও প্রকাশনা থেকেই অর্থনৈতিক বৈষম্য সম্পর্কে রাজোনৈতিক বোধোদয় ঘটে। মূলত
পাকিস্থানের দুই অর্থনীতি নিয়ে অধ্যাপক রেহমান সোবহান কর্তৃক প্রকাশিত প্রচারপত্রের
বা পামপ্লেটের অনুকরণে ছয় দফা রচিত হয়েছিল। ছয় দফার ইংরেজি ড্রাফট লিখেছিলেন
বাঙালি অফিসার রুহুল কুদ্দুস। পরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন
লাহোরে ছয় দফা ব্যাখ্যা করার জন্য যান, তখন তাঁর সাথে বিশেষজ্ঞ টীমে ছিলেন,
অধ্যাপক মোশারফ হোসেন, অধ্যাপক খান সারওয়ার মুর্শিদ প্রমুখ । ছয় দফা দাবির ভিত্তিতে
স্বাধিকার আন্দোলন বেগবান হয়। আয়ুবী শাসনের মসনদ উৎখাত করা থেকে সত্তরের নির্বাচন
পর্যন্ত বুদ্ধিজীবীগণ নিবিড় রাজনৈতিক তৎপরতায় ব্যাপৃত থেকে সভা সেমিনার করেছেন, রাজনীতিকদের
পরামর্শ দিয়েছেন, ছাত্র নেতাদের নির্দেশনা দিয়েছেন। আহমদ শরীফ ১৯৭১ সালের ২৫
মার্চের পূর্ববর্তী উদ্দীপ্ত দিনগুলোতে ঢাকার বিভিন্ন সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন এবং
শপথ পরিচালনা করেন। বস্তুত, কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল ফজল, সিকান্দার
আবু জাফর, সত্যেন সেন, রনেশ দাশগুপ্ত, আহমদ শরীফ, আবদুল হক, বদরুদ্দীন উমর, শামসুর
রাহমান, আল মাহমুদ উজ্জ্বল ভূমিকা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণযোগ্য। ১৯৭১ সালের যুদ্ধ
চলাকালে কলকাতায় বসে আহমদ ছফা লিখেছিলেন “জাগ্রত
বাংলাদেশ”।
মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী ও দেশের জন্য জীবন
দানকারী পেশাজীবী বা শ্রেণীগোষ্ঠী হিসেবেও অন্য যে কোন শ্রেণির তুলনায় সব চেয়ে
বেশি ত্যাগ স্বীকার করেছেন শিক্ষকরা। ২৫শে মার্চ গণহত্যার দিন হতে ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যার দিন পর্যন্ত
প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন অনেক শিক্ষক, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী। দার্শনিক জি সি দেব,
ইতিহাসের শিক্ষক গিয়াস উদ্দিন আহমদ, অজিত গুহ, আনোয়ার পাশা, সিরাজ উদ্দীন হোসেন, শহীদুল্লাহ
কায়সার, ডা আলীম, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীসহ প্রায় সহস্রাধিক বুদ্ধিজীবী হানাদারের
হামলায় প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। অনেকে ভাগ্যবশত মৃত্যু এড়াতে পেরেছেন। পরে বিক্রমের
সাথে যুদ্ধেও অংশ নিয়েছেন কিংবা মুজিবনগর সরকারের পক্ষে বিদেশে জনমত গঠনে কাজ
করেছেন। দিল্লী ও কলকাতাস্থ লেখক বুদ্ধিজীবীরাও সে সময় বাংলাদেশের পক্ষে কলম
ধরেছেন। জনমত গঠনে ভূমিকা রেখেছেন। শাবানা আজমির বাবা বিখ্যাত উর্দু কবি কাইফি
আজমি নিজের টাকা খরচ করে লঙ্গরখানা খুলেছিলেন। বুদ্ধিজীবীদের সেই গৌরব গাঁথা
বিস্মৃত হওয়ার নয়।
Comments