Skip to main content

কবিতার তাপস, সবুজ তাপস


সরওয়ার কামাল

শ্রাব্য কিংবা লেখ্য যে রূপেই হোক, কবিতার বাহন ভাষা, আর  ভাষার প্রধান অবলম্বন কবিতা। বাঙ্গালির ভাবচর্চা কবিতাশ্রয়ী। বাঙালি সংস্কৃতির নান্দনিক অভিব্যক্তিগুলো কাব্যময়, জ্ঞাপনকৌশল কলাময়বাংলা সাহিত্যেরও প্রধান ধারা কবিতা। শুধু বাংলায় কেন, পৃথিবীর সমস্ত ভাষার, ভাষিক উৎকর্ষতার, চিন্তা ও সাহিত্যের শ্রেয়তার নিদর্শন হল কবিতা। কথাশিল্পীদের ওপর কবিতার আছর না পড়া পর্যন্ত আমরা তাদেরকে কথাশিল্পী বলা যাবে কি না ভেবে দেখি। মানুষের সৃজনশীল কল্পনার ও নান্দনিক চিন্তাকল্পের মূল জায়গা কবিতা। কাজেই কবিতা বাদ দিয়ে সাহিত্যকে ঠিক শিল্পের জায়গায় আনা যায় না। সুনির্দিষ্ট জরিপের নজীর না দিয়েও বলা যায়, বাঙালি মাত্রই কবি হতে চায়, কবি হতে না পেরেই কেবল অন্য কিছু হয়। অথচ জীবনানন্দ দাশতো বলেছেনই যে সবাই কবি না, কেউ কেউ কবি। অদ্যাবধি সেই স্বীকার্য সত্যের বিপরীতে দাঁড় করানো যায় এমন আরোহমূলক প্রামাণ্যযুক্তি সাহিত্য জগতে পাওয়া যায় নিনিছক গায়ের জোরে আর প্রভাবের বলে কেউ চাইলেই কবি হতে পারে না। তেমনিভাবে অযৌক্তিকভাবে ঘোষণা দিয়ে কাউকে কবি অভিধায় ভূষিত করা যায় না। কবিতার বইয়ের বিপণনকর্মী হিসেবে সফল হলেই কাউকে বড় কবি বলা যায় না, তা কবিতার পাঠক মাত্রই বোঝতে পারেন। আর যারা কবিতা লেখেন বা কবিতার স্বাদ পরখ করে দেখেন, তাদের জন্য ইশারাই কাফী। অতএব, কে কবি, কে অকবি অথবা কার কবিতা কতটুকু কবিতা তা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করা নিছক সমারূঢ়ীয় বাতুলতা। তাই আমি সে দিকে না গিয়ে সদর্থক বচনেই একজন সার্থক কবিকে হাজির করতে চাই। সমকালীন কবিতা ও সমকালীন কাব্যশিল্পীর নাম নিলে যার নাম অনিবার্যভাবে আসতে পারে, তার নাম সবুজ তাপস। সবুজ তাপস কবি হিসেবে নতুন নয়, আবার পুরনোও নয়, এক কথায় পরিণত কবি মাত্রসম্প্রতি প্রকাশিত (ফেব্রুয়ারি, ২০১৫) সবুজ তাপস সবুজ তাপসের প্রথম কাব্যগ্রন্থ। কাব্যগ্রন্থ নিয়ে তার বিলম্বিত উদ্ভাসন যে কারও জিজ্ঞাসার বিষয় হতে পারে। তবে কাব্যহিংসার যুগে বিষাক্ত নাগিনীরা প্রশ্নের ফণা তুলুক কবি তা চান না। গ্রন্থবিনাশীতার যুগে গ্রন্থিত হওয়ার শেকল এবং ধকল দুইই মোকাবেলা করতে করতে কবি সবুজ এরই মধ্যে পাড়ি দিয়েছেন দীর্ঘ পথ। দর্শনের চৈতন্যগলি ঘুরে, চাটগাঁর ছাটে চিত্রকল্প সাজিয়ে পঙক্তি বুননের শৈলী রপ্ত করতে করতে পার করেছেন অনেক বছর, সবুজ তাপসের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী অন্তত পনের বছরকবিতার উপাদান সংগ্রহ, শব্দসজ্জা, পঙক্তি বিন্যাস, চিহ্নের খেলা, উপমায় ব্যক্তিগত কল্পনা ও নৈর্ব্যক্তিক অভিব্যক্তির সমাহার, চিত্রকল্পে স্থানের ও গতির ব্যবহার, নিজের চেতনবোধ দিয়ে পাঠকের আবেগ উসকে দেয়া এবং পাঠককে নির্বিকার না রেখে অর্থ সৃজনের খেলায় টেনে নেয়া সবকিছুতেই তিনি পারঙ্গমতা দেখিয়েছেন

 সবুজ তাপসের ব্যক্তিগত স্থান ভবানীপুর থেকে চাটগাঁ পর্যন্ত প্রসারিত কিন্তু তার কবিতার নৈর্ব্যক্তিক স্থান-কাল সুনির্দিষ্ট পরিসীমায় সীমাবদ্ধ নয়। পাখির চোখে তাকালে তার কবিতার ভূমিচিত্র চট্টগ্রাম আর ফেনীর সীমানা অবধি প্রত্যক্ষণ করা যায় কিন্তু মাটিলগ্ন কেঁচোর মতো নেত্রহীন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখলে তার কবিতার স্বাদ, শিল্পসীমা ও বিস্তৃতি টের পাওয়া যায়। সামষ্টিক পাঠের চেয়ে ব্যষ্টিক পাঠেই তার কবিতা ধরা দেয় পাঠকের মনে। তার কবিতা সমজদার পাঠকের পরিচিত হয়ে উঠেছে অনেক আগেই। সমসাময়িক কবিদের থেকে সবুজের স্বাতন্ত্র্য শৈলীগত, চেতনাগত, ভাষাগত, শব্দগত, চিত্রগত, আরও আরও নানামাত্রিকতায় বৈশিষ্ট্য মণ্ডিত। সবুজের প্রতিটি পঙক্তি, বাক্যাংশ, উপমা, অনুপ্রাস, এমনকি প্রতিটি শব্দ ও প্রতিটি চিহ্ন ব্যবহৃত হয়েছে সার্থক কবিতার অন্বিষ্টে। কবিতা কীভাবে কবিতা হয়ে ওঠে তার উদাহরণ হতে পারে সবুজের কবিতাগুলো।

কবিতা সাধনার বিষয়, সযত্ন প্রয়াসের বিষয়। যে মগ্নতার অতলে কবি থাকেন, তার বহির্জগতের সংবেদন, চেতনের আরশিতে বিম্বিত হয়ে ভাষার জগতে হাজির হয়, যেখানে পাঠকের সামনে চিত্রকল্পগুলো দোল খায় ঝুলিয়ে রাখা কোন চিত্রকর্মের মতো। কবিতা সরাসরি চিত্রকর্ম নয়, তবে কবিতায় স্বাভাবিকভাবেই চিত্র থাকে। সে চিত্র স্থির ও গতিময়, কখনোবা প্রবহমান হতে পারে। আবার নব্য বিচারবাদি মানদণ্ডের নিরিখে দেখলে কবিতা প্রতিভাত হয় ক্ষুদ্র নাটক হিসেবে, যেখানে বিভিন্ন বিরোধাত্মক ভাবনা ও মনোভঙ্গির সমন্বয়ে নির্মিত হয় নান্দনিক সমগ্র, এবং যেখানে চরিত্রের চেয়ে ঘটনাগুলো মুখ্য ও পূর্ণপটেই ঘটনাগুলো প্রদর্শিত হয়। সবুজের কবিতায়ও নাটকীয়তা আছে, তবে সরাসরি নাটক নেই, কিংবা ঘটনার বিস্তার নেই। যা আছে তা কেবল ইঙ্গিত। কলাময় চিহ্নের লীলাময় ইঙ্গিত। শিল্প হচ্ছে চিহ্নের খেলা। একাধিক চিহ্নের সম্পর্কের ভিত্তিতে একটি বিশেষ প্রেক্ষিত থেকে আমরা চিহ্নের অর্থ বুঝি। তাই শিল্প যা ব্যক্ত করে তা একাধিক চিহ্নের বিন্যাস মাত্র। তার মানে আমরা যা চিহ্নের ব্যবহার ছাড়া সত্যকে বোঝতে কিংবা উপস্থাপন করতে পারি না। সবুজ চিহ্ন নিয়ে খেলেছেন তার প্রতি পঙক্তিতে। একটি বিশেষ প্রেক্ষিত থেকে তিনি বিন্যস্ত করেছেন চিহ্নের পর চিহ্ন। সামাজিক-সাংস্কৃতিক চিহ্নের কাঠামোতেই উপস্থাপন করেছেন, একটি বিশেষ ভাষ্য। এই ভাষ্যে ব্যবহৃত সমস্ত চিহ্ন ও ধারণাগুলো একে অপরের সাথে সম্পর্কের জালেই তৈরি করে অর্থ, আর সেই অর্থই জানান দেয় সত্য। সবুজের সত্য গোঁড়া নয়, ইন্টার‌্যাক্টিভ। কাজেই পাঠক কবিতার ভোক্তা হিসেবে না থেকে নিজেই উৎপাদন করতে শুরু করে তার কাছে ধরা দেয়া অর্থ। পাঠকের সাথে কবিতার, ফলে কবির সাথে পাঠকের আন্তঃ-সম্পর্ক তৈরি হয়। সবুজ তাপসের আছে কিছু বিশেষ শব্দ, আবার কিছু বিশেষ পঙক্তি, যেগুলোতে চিহ্নের খেলা তুমুল। যেমন, তত্ত্বপাঠ কবিতায় কামনা সাম্পানদেহের দৌলত, রাসলীলা উৎসবে কবিতায় রূপের সন্দেশ কামদার কাপড়কামরাঙা কুঁড়োজালি, স্বপ্নাদ্য-১ কবিতায় ঘুমের ডিম, স্বপ্নাদ্য-২ কবিতায় চৈতন্য সেতু,  স্বপ্নাদ্য-৩ কবিতায় স্বপ্নবস্তুবাদ, বাঁচনভঙ্গি-১ কবিতায় সফরি মাছ নজর নোঙর, প্রশ্নের ফণা, প্রশ্নের পিনাক, হুমায়ুন আজাদ কবিতায় শব্দ তীরপঙক্তি বোমা ইত্যাদি।    
    
পি বি শেলীর মতে, কবিরা হলেন বিশ্বের অসনাক্ত আইন প্রণেতাতারা গড়ে দেন ভাষার স্টাইল, চিন্তার ঐতিহ্য। তারা নির্ধারণ করে দেন শব্দের সীমানা আর অর্থের খতিয়ান। কবির বোধ ধারণ করে প্রয়োগযোগ্য হয়ে ওঠে আইনি পদের সংজ্ঞা। কবিরা নির্মাণ করে দেন একটি জাতির চিন্তার দৃশ্যকল্প, মস্তিষ্কের কোটরে কোটরে প্রবিষ্ট করে দেন চিন্তা (বি)জ্ঞাপনের বিলবোর্ডমানুষের গভীর গোপন বোধের উৎসারণ, তার জ্ঞাপনকৌশল, বাঙময় অভিব্যক্তি একান্তই কবিতার কাছে ঋণী।

ক্রোচের কাছে কবিতা হল এমন এক অভিব্যক্তি যা কবির গভীর চেতন বোধকে প্রকাশ করে। কবি তার শিল্পে শব্দ, উপমা, রং, চিত্র, সঙ্গীত ও গতিকে ব্যবহার করে তাতে নিজের আবেগকে চারিত করে দেন, যেন পাঠক বা শ্রোতা সেই একই আবেগ দ্বারা উদ্দীপ্ত হন। কবিতারও যে রঙ ও গন্ধ আছে, তা আমরা জীবনানন্দ দাশ ও সুইডিশ কবি টমাস ট্রান্সট্রোমারের কবিতা পড়ে বুঝি। সবুজের কবিতায় রং ও গন্ধ অস্পষ্ট। তবে বিশেষ স্বাদ আছে, সাথে আছে কল্পনা ও কলাময় অভিব্যক্তিযদি শিল্পের প্রধান দুইটি গুণ, কলিংউডের মতে, অভিব্যক্তি ও কল্পনা ধরি, তাহলে বলতে হবে সবুজের কবিতা শিল্প হিসেবে অত্যন্ত সফল। সবুজ শব্দ, ছন্দ, ধ্বনির সুষম বিন্যাসে এনেছেন উপভোগ্য তাল। অভাব কবিতায় দেখি- ওর/ বুকের ওপর/ দুটো.., ফোঁটার মতন পতন-উন্মুখ/ আসে পাশে। বসে হাসে।/ ভেতরে ঘাই../ গোপন হাত দেয় আঘাত;/ আমার নাই।/ সর্বদাই তড়পাই। দুইঠোঁট ঐক্যজোট../ কম্পমান শিস-/ ইশ!  

কালোপাহাড়ী কবিতা প্রবর্তনার ( ব্ল্যাক মাউন্টেন স্কুল ) মূল প্রবর্তক, চার্লস অলসন তার প্রক্ষেপযুক্ত পঙক্তি সৃজনের শিল্পে ব্যক্তিগত বিশ্বাস থেকে উৎসারিত টেকনিক থাকতে পারে বলে মনে করেনতার মতে কবিতা হচ্ছে এক ধরণের শক্তি যা উৎস হতে কবিতায়, এবং কবিতা হয়ে পাঠকের মধ্যে সঞ্চারিত হয়। কবি তার বিষয়ীকে আড়াল করে শুধুমাত্র বিষয়কে পাঠকের কাছে পৌঁছাবে, সে জন্য বিশেষ কৌশল ও কাব্যিক গতিবিদ্যা প্রয়োগ করতে হবে। তবে বিশ্বাসকে সাধারণ প্রথায় রূপান্তর করা যায় না। কবিতা শিল্পের মূল বিষয় টেকনিক। কবি সবুজ তাপসও এই টেকনিকের ব্যবহারজীবী। সেই ছাত্র জীবন থেকে তিনি কবিতার কলাকৌশল রপ্ত করতে শুরু করেন। একটি দৃশ্যকে, আবেগের ক্ষণিক বুদ্বুদকে কীভাবে পঙক্তিতে ধরা যাবে, এবং সেই পঙক্তিতে কীভাবে শব্দ চয়ন করা হবে, বাক্য বিন্যাস করা হবে, যুক্তিসাম্য রক্ষা করা হবে অথবা শব্দের ভেতর কিভাবে অর্থ প্রবেশ করানো হবে, সেই অর্থ দ্বারা শব্দটি পীড়িত বোধ করছে কি না বা বিকার বেদনায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে কি না ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হচ্ছিল। তার নন্দন তরিকার মধ্যে একটি সহজিয়া ভাব আছে, আর আছে সহজ স্বগতোক্তি। আমরা যদি তেমন একটি কবিতার প্রত্নতত্ত্বের সন্ধান করি তাহলে একটু ফ্ল্যাশব্যাকে যেতে হবে সময়টা তখন অগ্রবর্তী মার্চের রৌদ্রোজ্জ্বল সকাল। ক্যাম্পাসের একটি সভায় বক্তব্য রাখছেন ভিসি। মঞ্চের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে চকচকে চুলের এক ঝকঝকে তরুণী। বিউটিবোনের মাঝখানে নতুন পিতলের পাতের মতো করে টিকটিক করছে দুইটি চঞ্চল রগ। টিকরে পড়ছে কিছু ম্যাগনেটিক আলো। দর্শক সারিতে বসা বিমোহিত কবি মনে দোলা লাগল। দিনের পর দিন ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে,পথে পথে ঘুরা হল মেয়েটির খোঁজে। প্রেমের প্লাবনে তখন আবেগের উচ্ছ্বাস। মেয়েটিকে বলতে হবে ভালবাসি। কারণ তার লাস্যময়ী চিকন চুলে আটকে গেছে কবির চোখ। আবেগের বেগে ক্যাম্পাসের সমস্ত সবুজ যেন কথা বলতে শুরু করেছে কবিতার ছাঁচে, মাত্রার মাপে। দিনের পর দিন শব্দগর্ভে আবেগ পুরে পোয়াতি উপমারা প্রসব বেদনায় কাতর। ততদিনে চুল নিয়ে লেখা হয়ে গেলো কবিতা, তোমার একটি চুল আমার একটি কবিতা....../ তোমার মাথায় আমার হাজার হাজার কবিতাপত্রিকায় ছাপা হলো অথচ মেয়েটি এখনো জানলো না । একদিন মোক্ষম সময়ে আবিষ্কৃত হল মেয়েটি, পাওয়া গেল সাক্ষাত। কিন্তু কবির নান্দনিক প্রক্ষেপ সরে গেছে অন্যত্র। কবিতা জন্মের মাধ্যমে অব্যক্ত প্রেমের গর্ভপাত ঘটল। নতুন করে অন্য কোন বিষয়ে মনোযোগের মধ্য দিয়ে বিয়োগ ঘটল ক্ষণিক প্রেমের। সবুজ কবিতা লিখেছেন, কবিতা যাপন করেছেন এভাবেই। কিন্তু কতটুকু সফল হয়েছেন? এই কবিতাগুলো কতটুকু সফল তার একটি নগদ পরীক্ষা হতে পারে। আর মানদণ্ড হতে পারে, কিছু কিছু লাইনের চুরি যোগ্যতা। বিশ্লেষণী দর্শনে যেমন মিথ্যা প্রতিপাদন যোগ্যতাকে সত্যের মাপকাঠি ধরা হয়, তেমনি মনস্তাত্ত্বিকভাবে কবিতা পাঠকের আবেগকে কতটুকু ছোঁয় তার মাপকাঠি হতে পারে কবিতার চুরি যোগ্যতা। অর্থাৎ কবিতার কিছু লাইন অন্য কবিদের দ্বারা কিংবা নতুন প্রেমিকদের দ্বারা চুরি হওয়ার মতো প্রলোভনীয় হলেই বোঝব তা পাঠকের মন ছুঁয়েছে, এবং সফল হয়েছে। সবুজের কবিতা নিশ্চয়ই, ইতিবাচক অর্থে,  চুরিযোগ্য।


এখন প্রযুক্তির যুগ, গতির যুগ। জীবনের সর্বত্র প্রযুক্তিজাত গতির অভিঘাত পড়েছে, বিশেষ করে গাড়ি, বিমান, মোবাইল, কম্পিউটার, ট্যাব, টিভি, স্যাটেলাইট, সামাজিক মিডিয়া সবকিছু নিয়ে জীবন যেন ছুটছে পাগলা ঘোড়ার মতো। স্বাভাবিকভাবেই আমরা বাস করছি ছুটন্ত দৃশ্যকল্পের মাঝে দূরন্ত অভিযাত্রী   হিসেবে। স্থিরচিত্রের মাধ্যমে উপস্থাপনার দিনও বিগত প্রায়, এখন গতিচিত্রের, ভিডিও চিত্রের কাল, ফলে কবিতাও আর স্থিরচিত্রকল্পে আবদ্ধ নেই। যুগের গতি কবিতার চিত্রকল্পগুলোকে যেন ধাক্কা দিয়ে চলমান করে দিচ্ছে। চিত্রগুলো নিরেট স্থান ও রঙের খেলা নয়, বরং কবিতার চিত্রকল্পগুলো এখন একই সাথে বাঙময় ও গতিময়। নিরেট ও স্থির শব্দসজ্জার মাঝে গতিময় চিত্র প্রবাহিত করে দেয়ার পাক্কা কাব্যক্ষমতা কবি সবুজ রপ্ত করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, মা বিষয়ক কবিতায় কবি লিখেছেন, তোমার কথা মনে পড়তেই দেয়ালের পালকিটা নড়ছিলো, কলসিটা উঠে যাচ্ছিলো পরিচিত কারোর কাঁকেদেয়ালের পালকিটা এখানে স্থির নয়, নড়ছে। কলসিটাও সম্মুখ থেকে ঘুর পাক খেয়ে উঠে যাচ্ছিলো পরিচিত কোন নারীর কোমরে। ক্ষমতা কবিতায়  দেখি গাছ, আমার তুমিগুলো পাখি হয়ে যায় কিংবা আমার মৃত্যু হলেও কবিতায় আমার মৃত্যু হলেও/ দোহাজারির ট্রেনটি চলবে,তার পেছনে ছুটে বেড়াবে/ বস্তির বিবস্ত্র শিশুরা। ধাতব পদ্যে অথচ ছেলেটির মুখে মেয়েটির চড় মাখানো এ ধরনের চিত্রকল্পের মধ্যে এক ধরণের গতিময়তা আছে যেখানে চিত্রগুলো স্থির নয় বরং সচল। এ ধরণের সচল দৃশ্যকল্প নিয়ে তিনি রচনা করেছেন সচল ইমেজ, যেখানে মোরগেরা হাঁটছে, সিমগাছেরা লতাচ্ছে,/ চড়ুই ডাকছে পোঁতা বাঁশের মাথায়...সমকালে যারা কবিতা চর্চা করছেন, তাদের মধ্যে কবি ময়ূখ চৌধুরীর কবিতায়ও গতিবিদ্যার প্রয়োগ লক্ষ্যণীয়। সবুজের কবিতার সাথে ময়ূখ চৌধুরীর পলাতক পেণ্ডুলাম-এ সন্নিবেশিত নৈতিক মূল্যবোধ কবিতাটি পাঠ করলে বোঝা যাবে সমকালীন বাংলা কবিতায় গতিচিত্রের অনুপম ব্যবহার। কবি লিখেছেন, প্রতিদিন কেউ না কেউ দরজা খুলে নেমে যাচ্ছে নিচে।/ গতকাল টমেটোর লাল মাংস ছুটে গেছে ক্যামেরার মুখে।/ আজ, গাড়ির দরজার মতো খুলে যাচ্ছে ফ্রিজ,-নামছে/ উপছে পড়া ফুলকপি, স্বামীকে ছাড়িয়ে/ মাছের সন্ত্রাসী লেজ মুড়োসহ চলে যাবে কাল/ বর্ধিত সভায়।/  

গতিচিত্রের সাথে সাথে সবুজের কবিতায় আছে আনুপাতিক স্থানের ব্যবহার, যেখানে বিপ্রতীপ দৃশ্যে চিহ্নের দূরত্ব আর বয়ানের ভাষায় পুরে দেয়া অব্যক্ত অবধারণ। দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে ধাবিত হওয়ার মাঝখানে আছে বিশেষ উল্লম্ফন। ভিন্ন দৃশ্যের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের জন্য পাঠককেই ডুব দিতে হয়, এক অতল তলে। এগুলো সক্ষম পাঠকের কবিতা।  তার প্রযুক্তি কবিতায়, দেখছি/ গাড়িগুলো দৌড়ছে/ হাঁটছে.../ আসে পাশে, আশেপাশে/গাড়ির আশায়.../ শান্তিহাটখালগুলো উঠে এসেছে এখানে রাস্তায়/ বাটালিপাহাড়গুলো ঝুলছে।/ ব্রহ্মপুত্র পড়ছি কামসূত্র, ওয়াসার পানি/ সরছে.../  দেখছি/ ছিটকে পড়ছে/ আমার লিঙ্গ থেকে / বীর্যফোঁটাগুলো,/ গাড়ি হয়ে দৌড়ছে... যে সমাজে জন্ম নিই তার সাথে আমরা একাত্ম হয়ে যাই। অনুভূতিগুলো বিমূর্ত আকারে আত্মীকৃত করে তুলে চার পাশের নানা প্রতীক ও জীবনের চিহ্নকে। এক ধরণের ঘোরের ভেতর আমাদের নিরাকার সত্তা নিজের সাথে মিলিয়ে নেয় পার্শ্বস্থ আকার ও বিকার  প্রাপ্ত অনুষঙ্গকে। এদিকে বাস্তবের ওপর আমাদের আস্থা ও মনে গ্রথিত বিশ্বাসগুলো ধীরে ধীরে ভেঙ্গে পড়তে থাকে। সমাজ, রাষ্ট্র, আইন, ধর্ম, নৈতিকতা, প্রযুক্তি ও সংস্কৃতি দ্বারা আমাদের আমাদের চিন্তা ও আকাঙ্ক্ষাগুলো বাধা প্রাপ্ত হয়। অবদমিত হতে হতে নিঃসঙ্গতা পেয়ে বসে এবং নিসঙ্গতার ভেতরই ব্যক্তিসত্তা শূন্য হয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে পরিবেশ ও অপরের বিপরীতে নির্মিত হয় নিজস্ব বিষয়ীসত্তা। এই সত্তারই কেরামতিতে অপারগতাগুলো পারঙ্গমতায় রূপান্তরিত হয়।  আমাদের বিষয়ী সত্তায় ওঁত পেতে থাকা অপর দিনে দিনে আমাদের অজান্তেই আমাদের দ্বারা কাজ করিয়ে নেয় ।
 আমরা যা করি তা কেন করি, তা জেনেও যেন জানিনা। নিজের ভেতরে এক ধরণের অচেতনের দ্বারা তাড়িত হয়ে আমরা চেতনকে ছুঁই। ফ্রয়েডিয়ান মনস্তত্ত্ব অনুযায়ী  মানুষের চেতন সত্তা তার পার্শ্বস্থ জগতকে তার আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী বিন্যস্ত করতে না পেরে কল্পজগতে শিল্পের মাধ্যমে আকাঙ্ক্ষাগুলোকে রূপায়িত করে। সবুজের স্বপ্নাদ্য কবিতাগুচ্ছে এবং বাঁচনভঙ্গিতে আমরা এ ধরণের  ফ্রয়েডীয় স্বপ্ন বিশ্লেষণের সূত্রগুলো পেয়ে যাই। সে সাথে অবদমিত আকাঙ্ক্ষার অচেতন কীভাবে স্বপ্নের ভেতর দিয়ে বাস্তবের প্রাঙ্গণে হাজির হয় তা দেখি। যেমন স্বপ্নাদ্য-১ কবিতায়, গায়ে তার কামদার কাপড়, চোখে কামরাঙা কুঁড়োজালি, বুকে/ বাঁধা বিজ্ঞাপন ...কড়া নড়ে, জানালার ঝাপও, ভেঙে যায় ঘুমের ডিম। আমার/।   

বিমূর্ত চিত্রকলার মতোই সবুজের কবিতার চিত্রকল্পে স্থান করে নিয়েছে এক ধরণের অধরা অর্থের বিমূর্ততা। তার কবিতায় পঙক্তিগুলো, শব্দগুলো যেন পরোক্ষভাবে হাজির আছে, ফলে কবিতার মূল বয়ান সদাপলায়নপর, রূপকগুলো পিচ্ছিল,  কবিতা যেন মিহি বুননে আটকে থাকা রেশমি শব্দের জাল।

সবুজের কবিতায় নানা বিষয় স্থান পেয়েছে। এছাড়া দীর্ঘ সময় ব্যাপ্তিতে লিখিত বলে কালান্তরের অভিঘাতও পড়েছে। লোকজ সংস্কৃতির ঐতিহ্যকে তলা থেকে তুলে এনে মেট্রোপলিটন সংস্কৃতির জায়গায় স্থাপন করে, হাইব্রিড সংস্কৃতিকে খারিজ করার সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের চর্চাও দৃষ্টি এড়ায় না। আছে নানা স্বীকারোক্তি, আত্মজৈবনিক খুঁটিনাটি, নিরীক্ষাধর্মী  নমুনায়ন, রাজনৈতিক ভাবাদর্শ, প্রান্তিক জীবনের প্রতি পক্ষপাত, ও পিছিয়ে পড়া গোষ্ঠীর প্রতি বিশেষ মনোযোগ। এতকিছুর ভেতরেও রেখেছেন এক ধরণের নির্মোহ দূরত্ব। সার্বিক অর্থেই তার কবিতা সমাদরযোগ্য, কারণ সবুজের কিছু কবিতা একান্তই সিরিয়াস ও সংক্ষেপিত অথচ গোছানো ও সরল। সবুজের কাব্যভাষা নতুন নয় কিন্তু কাব্যভঙ্গি নতুন। সবুজ তার কবিতায় সহজ আত্মচৈতন্যের উন্মোচন ঘটিয়েছেন, করেছেন আবেগের পরিমিত ব্যবহার অথচ নির্মাণ করেছেন শনাক্তযোগ্য নান্দনিক ফ্রেম। তার কবিতায় নেই রতি বিলাস, চিন্তার ক্লেশ, আছে নন্দনের আয়েশ। সবুজের কবিতায় দেখা যায় এলিয়টীয় ঢং, ময়ূখ চৌধুরীর ম্যাজিক, মিহি ও স্বচ্ছন্দ ফিনিশিং।  তার কাব্য প্রবর্তনার জয় হোক। 

Comments

Popular posts from this blog

মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার কারণ ও প্রতিকার

সরওয়ার কামাল শিক্ষাক্ষেত্রে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য সাফল্য রয়েছে। সামাজিক উন্নয়ন সূচকেও বাংলাদেশের অবস্থান প্রতিবেশি দেশগুলোর তুলনায় ভালো, যা সম্পর্কে প্রশংসা করে বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন প্রবন্ধ লিখেছেন “ ল্যানসেট ” নামক মেডিক্যাল জার্নালে। কিন্তু এতে আমাদের বগল বাজিয়ে আত্মতৃপ্তিতে ভোগার অবকাশ নেই। কারণ শিক্ষার্থী ঝরে পড়া এবং বিজ্ঞান শিক্ষা সংকুচিত হয়ে পড়া আমাদের সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভুত হয়েছে। শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার কারণে আমাদের শিক্ষার মূল লক্ষ্যগুলো হাসিল হচ্ছে না, যার একটি হলো সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করা, অপরটি হলো শিক্ষাক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় প্রণোদনার ন্যায্য বণ্টন নিশ্চিত করা। অর্থাৎ সব শিশুই যাতে সরকারের সুযোগ ব্যবহার করে উন্নত জীবনের সন্ধান করতে পারে, তার শতভাগ নিশ্চয়তা প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না। শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার বিভিন্ন কারণ রয়েছে, তার মধ্যে বিভিন্ন স্তরের শিক্ষার ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন কারণ রয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার প্রধান কারণ দারিদ্র্য ও অপুষ্টি বা স্বাস্থ্যহীনতা । মাধ্যমিক পর্যায়েও শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার ক্ষেত্রে দারিদ্র্য সমস্যার ...

তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি বিচিত্র ছলনা জালে

তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি বিচিত্র ছলনা জালে ............................................................................... সাম্প্রতিক কালে আমাদের নৈতিক উপলব্ধিতে, সামাজিক উদ্বেগে কিংবা মূল্যবোধে দৃশ্যমান পরিবর্তন এসেছে। প্রযুক্তির নিবিড় ব্যবহার, বিশ্বায়নের প্রভাব, বিশ্বরাজনীতির অভিঘাত, বাজার সংস্কৃতির ধাক্কা ও চরমপন্থী ভাবাদর্শের টানাপড়েনে আমাদের চিরকালীন মূল্যবোধ ভেঙ্গে পড়েছে। নৈতিকতার সীমানা সরে যাচ্ছে প্রথাগত বিশ্বাস ও প্রতিষ্ঠানসংলগ্নতা থেকে। গতিময় জীবনের অভিঘাতে চরম অস্থিরতা ব্যক্তি থেকে ব্যষ্টির ব্যাপ্তিতে বিরাজ করছে। সর্বত্র আহাজারি, শোনার অবসর নিয়ে হাজির নেই কেউ। মানুষ যে নির্বিকার তাও নয়, তারা বিকারগ্রস্থ, পূর্ণমাত্রায় ঘোরগ্রস্থ, কেবল অপ্রত্যাশিত ঘটনাপ্রবাহের সাথে তাল মেলানোতে। তারা এখন এমন সব বিষয়ে আলোড়িত হয়, যে বিষয়ের সাথে তাদের সরাসরি যোগ নেই। থাকলেও তা অনেক ক্ষীণ ও দূরবর্তী কার্যকারণ সম্পর্কে আবদ্ধ। একইভাবে, তারা এমন সব পরিণতি ভোগ করে, যার জন্য তারা নিজেরা দায়ী নয়। আর যারা দায়ী তারা এর পরিণতি ভোগ করেন না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষ বয়সের দিকে এই প্যার...

মহেশখালীর সমাজ ও সংস্কৃতি

সরওয়ার কামাল সাগর কূলে গিরিকুন্তলা মোহিনী মহেশখালী দ্বীপের ৩৮৮ বর্গকিলোমিটার ভূত্বকে প্রায় পাঁচ লক্ষ লোকের বসতি। তাদের বসতি ঘিরে গড়ে উঠেছে উপকূলীয়-দ্বীপাঞ্চলীয় সমাজ। এই সমাজসভ্যদের মানসিক ঐক্য ও জীবনযাপন পদ্ধতি নিয়ে তৈরি হয়েছে শনাক্তযোগ্য বিশেষ স্থানীয় সংস্কৃতি। মানবজাতির চিরকালীন অভিযাত্রার অংশ হিসেবে দেশের নানা জায়গা থেকে হিজরত করে লোকজন এসে বসতি গেড়েছে মহেশখালীতে। তাই তাদের ভাষা ও আচরণে শনাক্ত করা যায় এমন বৈচিত্র্য ও তারতম্য, যা দিয়ে কক্সবাজারের অন্যান্য অঞ্চলের অধিবাসীদের তুলনায় মহেশখালীবাসীকে স্বতন্ত্রভাবে চিহ্নিত করা যায়। যে পার্থক্যসূচক বৈশিষ্ঠ্যাবলী নিয়ে মহেশখালীর সমাজ ও মানুষের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য তৈরি হয়েছে, চাটগাঁইয়া ভাষার উপভাষাতুল্য মহেশখালীর দ্বীপাঞ্চলীয় বুলি তার মধ্যে বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। [1] তবে সমস্যা হলো, লিখিত সাহিত্য ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের অভাবে স্থানীয় ইতিহাসের মতোই কালিক সূচকের নিরিখে এর জনসংস্কৃতি বর্ণনা করা দুরূহ। একেতো সংস্কৃতি স্বয়ং একটি ব্যাপক ধারণা, তদুপরি, এটি সতত পরিবর্তনশীল। ভাষা ও সংস্কৃতি স্রোতস্বী নদীর মতো বহমান। মানুষের কথা, স্মৃতি, পুরা...