Skip to main content

উত্তরাধুনিকতাবাদঃ কাল ও কালান্তর

                  উত্তরাধুনিকতাবাদঃ কাল ও কালান্তর
                                      সরওয়ার কামাল
প্রস্তাবনা
শুরুতে দু’কলম কৈফিয়ত। কাল ও কালান্তরের অভিযাত্রায় তত্ত্বের জন্ম হবে, এটা কালের গুণ। কালের অধিবাসীরা তত্ত্বের জন্মকে স্বাগত জানাবে, কালান্তরের প্রজন্মকে জ্ঞানিক ও বৌদ্ধিক বিকাশের উত্তরাধিকার দান করতে। এটা কালান্তরের ধর্ম। কালের গুণে ‘আধুনিকতাবাদ’ কালান্তরের বোরাকে চড়ে উত্তরাধুনিকতাবাদ হওয়ার পাঁয়তারা করছে। এ ক্রান্তিকালে কালান্তরের ধর্ম পালন করতে গিয়ে আমরা আজ যোগসূত্রের সূত্রধার হয়ে উত্তর প্রজন্মের দায় বহন করছি। সাথে, বিশ্ববিদ্যালয়ের মত একটি বিরাট বিদ্যাঙ্গনে বসে সমকালীন জ্ঞানকাণ্ডের সাথে নিজেদের চিন্তার ও বুদ্ধিবৃত্তির যোগাযোগ ঘটানোর ঘটকালি করছি।
কুয়োর মাছ যেমন নালায় পড়লে সমুদ্রের ঢেঁকুর তুলে, তেমনি তৃতীয় বিশ্বের একটি প্রায় অনুর্বর ও নিস্ফলা দেশ হিসেবে বাংলাদেশেও এই ‘উত্তরাধুনিকতাবাদ’ নামক এক ক্ষুদ্র দার্শনিকতত্ত্ব নিয়ে সমুদ্রের গর্জনসম ধুমধাম পড়ে গেছে। তবে, এ উত্তরাধুনিকতাবাদকে কেন্দ্র করে বিশ্বব্যাপী যে দার্শনিক তাপ সঞ্চারিত হচ্ছে, তার কিছুটা তাপ এই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কেও স্পর্শ করেছে। দেখা যাক তাপিত বেগের নতুন শক্তি আমাদের কতটা আন্দোলিত করতে পারে। এটা ঠিক যে আমাদের চর্বিত ও চর্চিত প্রায় সকল দর্শনই পশ্চিমা বস্তাপচা বইয়ের পাতা থেকে উৎকলিত। আমরা জ্ঞানে ও চিন্তায় অতিমাত্রায় পশ্চিমমুখী। এটা দোষের কিছু না। পরের জ্ঞান ধার করে যদি নিজের প্রয়োজনীয়টুকু যথাযথ উদ্ধার করতে পারি, তাহলে নিজের চিন্তা বুদ্ধি প্রসারিত ও সমৃদ্ধ হয়। দোষটা অন্যখানে, ওরা একটা দর্শন নিয়ে যখন এগিয়ে যায় সেটা গিলতে গিয়ে আমাদের জীবন, যৌবন, সৃষ্টিশীল মেধা সবকিছু নষ্ট হয়ে যায়। শেষ বয়সে পচনধরা মগজ নিয়ে ঝিমুই। না পারি ঠেকাতে, না পারি পালাতে। না পারি নিজের অক্ষমতা সইতে, না পারি মনকষ্ট কইতে। নিজস্ব দর্শন সৃষ্টির ক্ষমতাতো শুরুতেই শেষ করে দিই। এ যখন অবস্থা, তখন উত্তরাধুনিকতাবাদ নিয়ে এই মাথা ব্যথাটা এক ধরণের পরচর্চাই বটে। হালে তত্ত্বের দুনিয়ায় এই নয়া কিসিমের ‘মেহমান’ নাযিল হয়েছে। নাম উত্তরাধুনিকতাবাদ। তো উত্তরাধুনিকতা কোন ব্র্যান্ডের পণ্য, তা বুঝার আগেই আমাদের মাথা বিগড়ে গেছে। আমাদের শিল্প, সাহিত্য, অর্থনীতিতে এর প্রয়োগ এবং চর্চা হরদম চলছে।ঠিক চলছে নয়, চলার ভাব হচ্ছে কিংবা চালানোর স্বভাব হচ্ছে। আমরা বুঝে বা না বুঝে কেবল উত্তরাধুনিকতার তত্ত্ব কচলাই। কবে, নিজের অজান্তেই বহু ভাগে বিভক্ত হয়ে আমরা বহু সত্যের সন্ধানে বহুমাত্রিক অস্থিরতায় ছুটছি। আর কোন কূল- কিনারা না পেয়ে এ তত্ত্বের বহুরূপী ম্যাজিক দেখার কোশেশ করছি। আমাদের আতঙ্ক, অস্থিরতা, বহুধাবিভক্তি যে রোগের উপসর্গ তার নাম ‘উত্তরাধুনিকতাবাদ’ বা ‘postmodernism’যদিওবা Postmodernism’ কথার অর্থ উত্তরাধুনিকতাবাদ হবে কি না সে বিতর্ক এখনও অমীমাংসিত এটাকে বাংলা করে কেউ বলছেনউত্তর আধুনিকতাবাদ’,কেউ বলছেননয়া আধুনিকতাবাদআবার কেউ বলছেন আধুনিকতার পরের আধুনিকতা বর্তমান প্রবন্ধে বিষয়টির শাব্দিক বিতর্কে না গিয়ে অধিকতর গুণগত বিশ্লেষণের অভিপ্রায়ে ‘Postmodernism’ এর বাংলা হিসেবে উত্তরাধুনিকতাবাদকেই গ্রহন করছি।
উত্তরাধুনিকতাবাদ মূলত আধুনিকতার সমালোচনার সামস্তিক রূপ। কালের ব্যবধানে এর প্রকৃতি যাচাই করলে আধুনিকতার পরের দর্শন বা আন্দোলনই উত্তরাধুনিকতাবাদ, কিন্তু এর বিশেষ ধরণ, রূপ, বৈশিষ্ট্য কালিক বিচারকে গৌণ করে রেখেছে। উত্তরাধুনিকতাবাদের দার্শনিক ভিত্তি কী, এ নিয়ে এখন পর্যন্ত স্থির ও সুনির্দিষ্ট কোন অবস্থান তৈরি হয়নি। ‘সময়’ ও ‘চিন্তার’ মাপকাঠিতে উত্তরাধুনিকতাবাদকে সাধারণত মাপঝোঁকের একটি প্রয়াস তাত্ত্বিকদের মধ্যে প্রবণতা আকারে দেখা যায়। তাও তর্কাতীত নয়। ‘কালকেন্দ্রিক’ ও ‘কালানুকেন্দ্রিক’ দৃষ্টিকোণ থেকেও উত্তরাধুনিকতাবাদের একটি অবস্থান নির্ণয়ের প্রয়াস চলছে। মার্ক্সবাদী ও অমার্ক্সবাদী তাত্ত্বিকদের মধ্যকার একটি চরিত্রগত দ্বন্ধ এ উত্তরাধুনিকতাবাদকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। বুর্জোয়া দর্শনের বুদ্ধিবৃত্তিক উপনিবেশ বিস্তারের একটি নয়া কৌশল হিসেবে উত্তরাধুনিকতাবাদের চরিত্র চিত্রণের প্রয়াসও দেখা যায়।
উত্তরাধুনিকতাবাদ অর্থনৈতিক উপনিবেশতত্ত্ব, গোলোকায়ন ও মুক্তবাজার অর্থনীতির একটি নয়া বৌদ্ধিক পণ্য কি না তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ইত্যাকার নানামাত্রিক, বহুবৈচিত্রিক প্রশ্ন, শংকা, আলোচনা, সমালোচনা, বিতর্ক, উল্লাস এবং দ্বান্ধিকতা প্রকারান্তরে উত্তরাধুনিকতাবাদকে পরিণত করেছে শিল্প, সাহিত্য, ধর্ম, অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব, বিজ্ঞান ও দর্শনের একটি আগ্রহ বিন্দুতে। যার ধারাবাহিকতায় কাল ও কালান্তরের একটি দার্শনিক চিন্তার ও বৌদ্ধিক সংকট হিসেবে আজকে উত্তরাধুনিকতাবাদের এ উপস্থাপন। ‘উত্তরাধুনিকতাবাদের’ তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ ও সংশ্লেষণের প্রারম্ভবনায় কতিপয় সংশ্লিষ্ট প্রত্যয়, তত্ত্ব এবং বিষয়াদি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকা আবশ্যক। যেমন, আধুনিকতা, উপনিবেশবাদ, উত্তর উপনিবেশবাদ, কাঠামোবাদ, উত্তর কাঠামোবাদ ও নারীবাদ প্রভৃতি।

আধুনিকতাবাদঃ
উত্তরাধুনিকতাবাদ মূলত আধুনিকতাবাদের সাথে বিবাদ বিতর্কের উত্তর ফল। অর্থাৎ ‘আধুনিকতাবাদ’ কী তার উপরই নির্ভর করছে উত্তরাধুনিকতাবাদের বয়ান। তো এই বয়ানেরও নানা মাত্রিকতা আছে, যেমন; ‘আধুনিকতাবাদ’( modernism), ‘আধুনিকতা’ ( modernity) ও ‘আধুনিক’ ( modern) ইত্যাদি।
প্রথমত, আধুনিকতাবাদ ইতিহাস ও জন্মগতভাবে শিল্পক্ষেত্রে এক আন্দোলনের নাম। এই আধুনিকতাবাদী আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ পরিগ্রহ করে ১৯১০ এবং ১৯২০ এর দিকে, বিশেষ করে খ্যাতিমান লেখক জয়েস, কাফকা,প্রাউস্ত ( Proust), মহান চিত্রশিল্পী মাতিস ( Matisee) এবং পিকাসোর চিত্রকর্ম ও জৌলুষে। এছাড়া মহান গীতিকার এবং সংগীতজ্ঞ যেমন, স্ত্রাভিনস্কি, বারগ এবং সোয়েনবারগের কীর্তি দ্বারা।
দ্বিতীয়ত, আধুনিককাল হচ্ছে পশ্চিমা ইতিহাসের এক কালিক পর্যায়। উনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দি এ পর্যায়েরই অন্তর্ভুক্ত। এই কালিক পর্যায় শুরু হয় ১৭৮৯ সালে সঙ্ঘটিত ফরাসি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে, যার মাধ্যমে পুরনো ধাঁচের সরকারকে উচ্ছেদ করা হয় এবং নব্য সামাজিক নিরীক্ষা শুরু হয়। এর সাথে সাথেই শিল্প- সাম্রাজ্যবাদের দৃঢ়করণ ও ভৌগোলিক বিস্তার ঘটে।
তৃতীয়ত, ‘আধুনিক চেতনা’ হচ্ছে বৈজ্ঞানিক ও যুক্তিবাদি চিন্তার চালিকা শক্তি। এই আধুনিক চেতনা গত সাড়ে তিনশ বছর ধরে পশ্চিমা চিন্তকদের প্রাণিত ও প্রণোদিত করেছে। এটা দেকার্ত, নিউটন, লক, জেফারসনের মত চিন্তাবিদদেরকে মানব চিন্তার শক্তি জাহির করতে তাড়িত করেছে। তারা বুঝতে পারলেন, চিন্তার মাধ্যমে প্রকৃতির রহস্যে ডুব দেয়া সম্ভব অথবা এমন সরকার গঠন করা যায় যাতে মানবাধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব এবং মানব স্বাধীনতা বৃদ্ধি করা যায়। এ সময়কালে পশ্চিমা রাষ্ট্রসমূহে ধর্মান্ধতা, সংস্কারগত গোঁড়ামি এবং মানুষের মৌলিক ও মানবিক অধিকারের ওপর চার্চ ও রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব লোপ পায়।মানুষের মানবিক জীবন ব্যবস্থার যুক্তিশীল, বিজ্ঞানভিত্তিক অভিযাত্রার মধ্য দিয়েই আধুনিক চেতনার বিকাশ ঘটে।

উপনিবেশবাদঃ   
উপনিবেশবাদ হচ্ছে ভিনদেশী মানুষের উপর প্রভাব খাটানো, কর্তৃত্ব করা, শাসন করা এবং রক্ষণাবেক্ষণ করা। কিন্তু বাম তাত্ত্বিকদের মতে উপনিবেশবাদ হল কোন নির্ভরশীল দেশের সামরিক অথবা অর্থনৈতিক দাসত্ব, যাতে করে আমজনতা পাশবিক শোষণে শোষিত হয়ে ধ্বংসে নিপতিত হয়। উপনিবেশবাদেরও আবার ধরণ আছে; এক, রাজনৈতিক উপনিবেশবাদ, দুই, অর্থনৈতিক উপনিবেশবাদ, তিন, বুদ্ধিবৃত্তিক উপনিবেশবাদ।
রাজনৈতিক উপনিবেশবাদঃ
আধুনিক উপনিবেশবাদ শুরু হয় পনের শতকের দিকে যখন পর্তুগিজ নাবিকরা আফ্রিকার পশ্চিম উপকূল হয়ে ১৮৯৮ সালে ভারতে পৌঁছে। পর্তুগিজরাই প্রথম ভিন্ন দেশের উপর কর্তৃত্ব করতে সক্ষম হয়। ‘উপনিবেশবাদ’ নামক পদ ও পদার্থও ভিন্ন ভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করেছে। ১৯৫০ সালে প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান উপনিবেশবাদ বলতে ‘কোন সম্প্রদায়, দেশ, জাতির অধস্থনতা বুঝিয়েছেন যারা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিকভাবে অন্য ঊর্ধ্বতন দেশের কর্তৃত্বের অধীনে থাকে’এটা প্রকার ও প্রকৃতিগতভাবে রাজনৈতিক উপনিবেশবাদ। পরবর্তীতে ১৯৫৫ সালের ১৮ এপ্রিল বান্দুং সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট আহমদ সুকরণ ‘ একই জাতির মধ্যে ক্ষুদ্র অথবা ভিন্ন সম্প্রদায়ের অর্থনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক নিয়ন্ত্রণকে উপনিবেশবাদের হাল জামানার রূপ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। আধুনিককালে উপনিবেশবাদের দৈশিক চর্চা যে হয় না তা নয়, আমরা আফগানিস্তান, ইরাক এবং ফিলিস্থানে তা দেখছি। কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তিক এবং অর্থনৈতিক উপনিবেশবাদই এখন গরীব, নিরীহ ও শিক্ষায় পশ্চাদপদ জনগোষ্ঠী , সম্প্রদায় ও দেশকে অধীন করে রেখেছে।
অর্থনৈতিক উপনিবেশবাদঃ
অর্থনৈতিক উপনিবেশবাদই গত চল্লিশ বছর ধরে অনগ্রসর জাতি ও দেশের উপর আধিপত্যবাদিরা চর্চা করে আসছে। বেনিয়াতন্ত্রের একচেটিয়া ব্যবসা , পূঁজি পাচার এবং বাজার দখলের মাধ্যমে তারা ফায়দা লুটছে। সম্প্রতি পূর্ব ইউরোপ সমাজতন্ত্রের পতনের পর এই অর্থনৈতিক উপনিবেশবাদ দানবের আকারে গ্রাস করেছে অনুন্নত দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোকে। পূঁজি নিয়ন্ত্রন, বাজার নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক পলিসি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে পুরো তৃতীয় বিশ্বই ক্ষমতাশালী ইউরোপ- আমেরিকার উপনিবেশে পরিণত হয়েছে। গোলোকায়ন ও মুক্তবানিজ্যনীতি এই উপনিবেশবাদেরই নতুন মুখোশ। উৎপাদন ,বণ্টন,বাজারজাতকরণ সর্বক্ষেত্রেই পাতা রয়েছে অর্থনৈতিক উপনিবেশবাদের ফাঁদ।
বুদ্ধিবৃত্তিক উপনিবেশবাদঃ
বুদ্ধিবৃত্তিক উপনিবেশবাদ হল জ্ঞান বুদ্ধি দিয়ে অন্যদের উপর আধিপত্য বিস্তার করা। ঐতিহাসিকভাবে এটাও উপনিবেশবাদেরই সংস্করণ মাত্র। আধিপত্যবাদী দেশগুলো সারা বিশ্বকে শোষণ করে অর্থনৈতিকভাবে যেমন এগিয়ে গেছে, তেমনি বুদ্ধিবৃত্তিতেও স্বাভাবিকভাবেই এগিয়ে রয়েছে। জ্ঞান- বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রতিটি অর্জনই তাদের করতলগত। আমরা ভোগ্য পণ্যের মত তাদের বৌদ্ধিক পণ্যের ভোক্তা। স্যাটেলাইট ও কম্পিউটারের কথা বিবেচনায় নিলে এটা পরিষ্কার যে, বৌদ্ধিক পণ্য আমাদের নিয়ন্ত্রণ করছে, এমনকি একেবারে জিম্মি করে রাখছে। কারণ কম্পিউটার ও স্যাটেলাইট ছাড়া আমরা একদিনও চলতে পারিনা। অন্যদিকে তাদের তত্ত্ব, পরামর্শ ও তাদের পলিসিও আমাদের নীতি নির্ধারণে, উন্নয়ন পরিকল্পনায় একেবারে নাকে রশি বেঁধে ঘুরাচ্ছে। বৌদ্ধিক কূটচাল কিংবা জ্ঞানিক অগ্রগতি দ্বারা উপনিবেশবাদিরা অনুন্নত দেশকে শাসন ও শোষণ উভয়ই করছে।

কাঠামোবাদঃ
কাঠামোবাদের সূত্রপাত ঘটে একটি বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন হিসেবে। ভাষাতাত্ত্বিক ফারদিনান্দ সস্যুর ভাষা এবং বাস্তবতার সম্পর্ক বুঝাতে গিয়ে কাঠামোবাদের কথা বলেন। তার মতে বাস্তবতা এবং ভাষার মধ্যে একটি সম্পর্কযুক্ত কাঠামো থেকে শব্দের অর্থ সৃষ্টি হয়। শব্দের অর্থ বিচ্ছিন্নভাবে বুঝা সম্ভব নয়। তার মতে, ভাষা বাস্তবতাকে গঠন করে, বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি নয়। অন্যদিকে ফরাসি নৃবিজ্ঞানী ক্লদ লেভি স্ত্রস নৃবিজ্ঞানে কাঠামোবাদের ব্যাখ্যা দেন। তার মতে ‘প্রত্যেক মানুষের মস্তিষ্কের ধরণ এবং কাজ যেহেতু একই, সেহেতু মানুষের মনোজগৎ কিভাবে কাজ করে সেটা সংস্কৃতি বিশ্লেষণের মাধ্যমে বুঝা সম্ভব’।

উত্তর কাঠামোবাদঃ
১৯৬০ দশকের শেষ ভাগে ফ্রান্সে ‘উত্তর কাঠামোবাদী’ তত্ত্বের উদ্ভব ঘটে। অনেকে এ পদটিকে বিনির্মাণের প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহার করেন। উত্তরাধুনিকতাবাদের সাথে উত্তর কাঠামোবাদের সম্পর্ক কি রকম তা নিয়ে অস্পষ্টতা বিদ্যমান। কারো মতে, এটি হল উত্তরাধুনিকতাবাদের অধিপতিশীল ধারা, যার দাবি জ্ঞান তত্ত্বীয়। ৩০ এর দশকের শেষ দিকে রোঁলা বার্থ ‘গ্রন্থের স্বাধীনতা’ র কথা ঘোষণার মাধ্যমে উত্তর কাঠামোবাদের মোড় ঘুরিয়ে দেন। তার মতে, লেখকের উদ্দেশ্য, কারিগরি কৌশল ইত্যাদি পরিসীমা হতে গ্রন্থ মুক্ত। অন্যদিকে জাঁক দেরিদা বিশ্বে চূড়ান্ত কিছুর অস্থিত্ত্ব অস্বীকার করেন। বিশ্বসংসারকে বিকেন্দ্রীভূত ও আপেক্ষিক হিসেবে আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, যেহেতু কোন কিছুরই গুরুত্বপূর্ণ কোন কেন্দ্র নেই, সেহেতু এ জগতে কোন সত্য নেই।  আছে কেবলমাত্র ব্যাখ্যা।

নারীবাদঃ
নারীবাদ মার্ক্সবাদের মতই শুধুমাত্র তত্ত্ব নয়, সমাজে বাস্তবিক পরিবর্তন ঘটানোর আন্দোলন বা সংগ্রামেরই অবিচ্ছিন্ন দিক। নারীবাদের কেন্দ্রীয় প্রস্তাবনা হচ্ছে, ‘নারী মানুষ নয়, নারী’। নারী কখনও সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে মানুষের মর্যাদা পায় না। নারী সর্বদা মর্যাদাহীন, নিপীড়িত এবং নির্যাতিত। আর এই নির্যাতনের অপর দিক হচ্ছে পুরুষ আধিপত্য। ‘নারীর নিপীড়ন’ এবং ‘পুরুষ আধিপত্য’ নির্দিষ্ট ক্ষমতা কাঠামো দ্বারা সৃষ্ট, এটা ঈশ্বর প্রদত্ত নয়। এ কারণেই পুরুষ, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সুবিধাদি ভোগ করে। এই বৈষম্য দূর করতে উদারনৈতিক নারীবাদীরা আইনী সংস্কারের মাধ্যমে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা ব্যক্ত করেন। অপরদিকে সমাজতান্ত্রিকরা বলেন, লিঙ্গীয় বৈষম্য শ্রেণী বৈষম্যের মতই গুরুত্বপূর্ণ । ব্যক্তি মালিকানা ব্যবস্থা ভেঙ্গে ফেললেই নারী নিপীড়ন আর থাকবে না।তবে এ ধরণের নারী তত্ত্বেও পুরুষ আধিপত্য কেন্দ্রীয়।
Luce Irigaray এর মতে, ‘নারীর সামাজিক মর্যাদা নির্যাতিত, বিব্রতকর এবং সব সময় পুরুষের সাথে দ্বান্দ্বিক এবং সাংঘর্ষিক’। এমন কি নারী পুরুষালী ভাষা আধিপত্যের শিকার এবং নারীর চিন্তার উপাদানগুলোও পুরুষ কর্তৃক সরবরাহকৃত। ফলে, নারীর স্বাধীন ও পুরুষ নিরপেক্ষ একটা সত্ত্বার স্বীকৃতি প্রতিস্তার তাগিদ অনুভূত হয়। তাদের ভাষ্য হল, পুরুষের বিপরীতে অথবা তুল্য কিংবা প্রতিতুল্য সত্তা হিসেবে নয়, একেবারে স্বাধীন এবং পুরুষহীন ( পুরুষাধিপত্যহীন) সত্তা হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠাই নারীবাদের শেষ গন্তব্য।

ক্রান্তিকালীন সময়ঃ
আধুনিকতাবাদ থেকে উত্তরাধুনিকতাবাদঃ ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ইউরোপের সমাজে এবং জ্ঞানজগতে যখন ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হল,আর অন্ধ বিশ্বাসের পরিবর্তে এবং চার্চ- গির্জার বিপরীতে মানবীয় বুদ্ধির দ্বারা জাগতিক বস্তু ও ঘটনা সমূহের ব্যাখ্যা দানে প্রবৃত্ত হল, তখন মানুষ বুঝতে পারল যে মানুষ যদি তার বুদ্ধিবৃত্তিকে কাজে লাগায় তাহলে প্রকৃতির রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারবে এবং মানব বুদ্ধির দ্বারা পরিচালিত হয়ে মানুষের পক্ষে এমন সমাজ গঠন করা সম্ভব যাতে মানবাধিকার ও স্বাধীনতা সর্বোচ্চ পরিমাণে রক্ষিত হবে।তবে এখানেও দুটি দল দেখা যায়। যথার্থ মানব সমাজ গঠনে মার্ক্সবাদীদের অবস্থান এক রকম, অন্যদিকে পুঁজিবাদী ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদিদের অবস্থান আরেক রকম। মার্ক্সবাদীরা দাবী করলেন যে একমাত্র সাম্যবাদী সমাজেই মানবমুক্তি সম্ভব এবং মানব সমাজ সেদিকেই এগুচ্ছে। বস্তুত, সমগ্র আধুনিক যুগটিই হচ্ছে এই দুই বিপরীতধর্মী সমাজব্যবস্থা এবং মতাদর্শের দ্বন্দ্বের যুগ। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর পদপ্রান্তে এসে বিরাটসংখ্যক লোক তিনটি বিষয় উপলব্দি করতে পেরেছে।
১। পুঁজিবাদে যেমন মানুষের সামগ্রিক কল্যাণ অর্জিত হয়নি তেমনি সমাজতন্ত্রের গবেষণাও পুরোপুরি সফল হয়নি। উভয় ব্যবস্থারই সাফল্যের রেকর্ড হচ্ছে আংশিক, তাছাড়া সাম্যবাদী সমাজ আজও কল্পনা হিসেবেই রয়ে গেছে। ন্যায় ভিত্তিক আদর্শ প্রতিযোগিতামূলক পুঁজিবাদও কল্পনা হিসেবে রয়ে গেছে।
২। জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রতিটি ক্ষেত্রে আজ বিশেষত, দর্শন, ইতিহাস, নৈতিকতা, সামাজিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা প্রশাখায় এত বেশি মতান্তর ও বাদানুবাদ বিদ্যমান যে কোনটি প্রকৃত সত্য তা বলা মুশকিল। তাই সত্য এক নয়, একাধিক। প্রকৃত সত্যেরও রয়েছে বহু অর্থ-দ্যোতনা।
৩। দ্রুত পরিবর্তনের যুগে এই মুহূর্তে যা সত্য পর মুহূর্তে তা মিথ্যে হয়ে যাচ্ছে।
এই যে আধুনিক যুগের জ্ঞান ও সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কে হতাশা, সংশয় ও নেতিবাচক মনোভাব এ থেকে জন্ম নিয়েছে নানা বিদ্রোহী চিন্তার; এগুলোর সমস্টিবদ্ধ নামই হচ্ছে ‘ উত্তরাধুনিকতাবাদ’। শেষ পর্যন্ত আধুনিক পর্যায় থেকে উত্তরাধুনিক পর্যায়ে রূপান্তরের ধারায় তারা পুঁজিবাদও চান না, সমাজতন্ত্রও চান না। এরা পুঁজিবাদী নয়, ভাববাদীও নয়। এরা কোন কিছুই বিশ্বাস করেনা, এমন কি নিজেকেও নয়। এটা এক ধরণের আত্মনৈরাশ্যবাদীতা । এরা নিজেকে তো বটে, ‘পর’কে এবং ‘অপরকে’ও অবিশ্বাস করে। সন্দেহ ও সমালোচনার পাল্লায় তুলে মাপজোক করে সব কিছুকে। তাই উত্তরাধুনিকতাবাদ কিছুটা আত্মধ্বংসীও বটে। পুরো কাঠামো ভেঙ্গে নির্মিত জিনিসকে বিনির্মাণ করাই উত্তরাধুনিকতাবাদের উদ্দেশ্য। তাই উত্তরাধুনিকরা বহুধা বিভক্ত অনু আন্দোলন, যেমনঃ নারী আন্দোলন, পরিবেশ আন্দোলন, নদী বাঁচাও, মানবাধিকার, পশু-পাখির অধিকার, ছেলের পোশাকে মেয়ের অধিকার, মেয়ের পোশাকে ছেলের অধিকার, উলঙ্গভাবে ক্যাম্পাসে চলার অধিকার আদায়ের আন্দোলনে মেতে আছে। আজব ব্যাপার। উত্তরাধুনিকতাবাদিরা খণ্ডিত দর্শনের চর্চা করতে গিয়ে পূর্ববর্তী দর্শনের প্রতি যে দ্রোহী মনোভাব পোষণ করলেন তার মাজেযা এই যে, অধিবিদ্যিক বা মহাবয়ানের জ্ঞান চর্চায় মানুষ অযথা কালক্ষেপণ করছে এবং শব্দের মায়া জালে আটকা পড়ছে। এভাবে সত্যের সন্ধান পাওয়া সম্ভব নয় এবং মানবমুক্তিও সম্ভব নয়। তাই সর্বদা মহাবয়ান এবং অধিবিদ্যিক জ্ঞান চর্চার বিপরীতে অবস্থান নিয়ে এরা দার্শনিক কাঠামোকে চুরমার করতে প্রবৃত্ত হন এবং নতুন করে বিচ্ছিন্ন অভিযাত্রার মাধ্যমে সত্য উদ্ধার করতে চান, যদিওবা এধরণের মনোভাব তাদেরকে সত্য হতে আরও বেশি দূরে সরিয়ে দেয় আর জীবন সংগ্রামে পরাজয়ের পথে ঠেলে দেয়। উত্তরাধুনিকতাবাদীরা মহাবয়ানের সামষ্টিক নিউক্লিয়াসকে ভেঙ্গে মূলত এর বিক্ষিপ্ত এবং বিচ্ছিন্ন উপাদানগুলো নিয়ে এক অস্থির মুক্ত ক্রীড়ায় মেতে উঠেছে। তাই শিল্পের ক্ষেত্রে উত্তরাধুনিকরা দুর্বোধ্য ও জটিল, সাহিত্যের ক্ষেত্রে বিনির্মাণবাদী, দর্শনের ক্ষেত্রে অধিবিদ্যা বিরোধী, সমাজের ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে কার্যকারণগত নিশ্চয়তা ও পূর্বতসিদ্ধ অবধারণের বিরোধী।

প্রধান তাত্ত্বিকঃ
ষাটের দশকে প্রাতিষ্ঠানিকতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে গিয়ে পূর্বেকার কাঠামোবাদ ভেঙ্গে এক ধরণের সংশয়বাদী পণ্ডিতের আবির্ভাব ঘটে ফ্রান্সে। এদেরকে বলা হয় উত্তরাধুনিকতাবাদের আদিগুরু, যাদের মধ্যে জাঁক লাকা, মিশেল ফুঁকো , জ্যাক দেরিদার নাম উল্লেখযোগ্য।

জাঁক লাকাঃ
জাঁক লাকার মতবাদ দিয়েই শুরু করা যাক।লাকা প্রাথমিকভাবে যে বিষয়টির উপর আক্রমণ করেন তা হল কাঠামোবাদীদের বিশ্বাস। কাঠামোবাদীদের ধারণা, বাস্তব সত্যের অস্থিত্ব রয়েছে এবং তা জানা সম্ভব। কিন্তু জাঁক লাকার যুক্তি হল, ‘ মানুষ বাস্তবকে প্রথমে অনুভব করে এবং পরে বর্ণনা করে। আর বর্ণনার জন্য দরকার শব্দের , কিন্তু শব্দ এবং শব্দের পেছনের বাস্তবতা এক হতে পারেনা’। আমি একটা জিনিস যেভাবে অনুভব করলাম এবং যে শব্দ দিয়ে প্রকাশ করলাম তা অন্যের কাছে ঠিক সেভাবে নাও ধরা পরতে পারে। শব্দের অর্থ এবং ব্যাখ্যা ব্যক্তি ভেদে ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। আমার ইচ্ছাকৃত শব্দার্থ এবং অন্যের ব্যাখ্যাকৃত শব্দার্থ এক নাও হতে পারে। এছাড়া তার মতে, শব্দের অর্থ কেবল শব্দের ভেতরে থাকেনা, থাকে তার চার পাশে, বাইরে , সমগ্র ভাষা জুড়ে । ভাষার সমস্ত এলাকা থেকে শব্দ আপনার অর্থ কুড়িয়ে আনে অর্থাৎ অভিধানের প্রত্যেকটা শব্দের ব্যাখ্যা অভিধানের আর সমস্ত শব্দের ওপর ভর করে। শব্দ বস্তু বা ধারণার প্রতিনিধিমাত্র নয়, বরং বস্তুর সাথে শব্দের সম্পর্কই ভাষায় অর্থ সঞ্চার করে। ফলে আমরা নিরন্তর যা বুঝাই তা অপরে ভুল বুঝে এবং অপরে যা বুঝে আমরা তা বুঝাই না। নিরন্তর কথোপকথনের মধ্যে পলায়নপর শব্দের পেছনে ছুটতে গিয়ে আমরা সত্যকে কিছুতেই ধরতে পারছি না। বাস্তব সত্য এভাবে অবচেতন মনেই থেকে যাচ্ছে। মনোঃসমীক্ষণের মাধ্যমে তার কাছে যাওয়ার চেষ্টা চালানো গেলেও, সেক্ষেত্রে সত্য নির্ধারণের স্থির কোন মাপকাঠি পাওয়া সম্ভব নয়।
একটা শব্দের কথাই ধরা যাক, যেমন, ‘সুন্দর’। এই ‘সুন্দর’ শব্দ দ্বারা কি কি বুঝানো হচ্ছে তা সবাই একইভাবে ধরতে পারবে না। কারণ স্থান-কাল-পরিবেশ ভেদে এর ভিন্ন ভিন্ন অর্থ হতে পারে। ব্যাখ্যা হতে পারে। এছাড়া একেক জনের সৌন্দর্যবোধ একেক রকম। আমি একটি শব্দের মাধ্যমে ব্যাখ্যা দিতে গেলেও সৃষ্টি হবে অসংখ্য শব্দের মায়াজাল। আমার উপলব্ধিগত সৌন্দর্যকে কিছুতেই স্বরূপে প্রকাশ করা যাবে না। তার মানে কি জগতে প্রকৃত সুন্দরের অস্থিত্ব নেই? আমি সুন্দরের অস্থিত্ব প্রমাণ করতে পারছি না, আবার সুন্দর যে নেই তাও প্রমাণ করতে পারছি না। তাই বলে কি নিছক সংশয়ের দোহাই দিয়ে এবং মনঃসমীক্ষণের ব্যর্থতার খাতিরে সুন্দরকে আমি অস্বীকার করব? কিংবা সুন্দরকে সুন্দর বলার দায়িত্বকে এড়িয়ে যাব? না। আমরা যদি মহাবয়ানের অজুহাত দেখিয়ে সত্য জানার প্রচেষ্টাকে প্রত্যাখ্যান করি তাহলে আত্মধ্বংসী শয়তানের গাড্ডায় পড়ে যাব। এখন তা থেকে মুক্তির উপায় কি? মার্ক্সের মতে, ‘চিন্তার সত্যতা তর্ক- বিতর্কের বিষয় নয়। সংখ্যাগরিষ্ঠতারও বিষয় নয়, চিন্তাকে বাস্তবে নির্মাণ করে,  বিপরীত চিন্তাকে মিথ্যা প্রমাণিত করে তার সত্যতা প্রতিষ্ঠা করতে হয়’। হুঁশওয়ালাদের জন্য মার্ক্সের এই ইশারাটাই কাফী।

মিশেল ফুঁকোঃ
মিশেল ফুঁকো এসে ভাষায় ক্ষমতার আধিপত্যের কথা উল্লেখ করেন। তাঁর মতে আমরা ভাষার মাধ্যমে জ্ঞান উৎপাদন করি। আর ভাষার অর্থ সকল সামাজিক অনুশীলনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই সামজিক ইতিহাসে ক্ষমতাবানরা জয়ী হয়েছেন। আর সংজ্ঞা নির্মাণে এবং শব্দের অর্থ প্রকাশের ক্রিয়ায় তাদের ক্ষমতার আধিপত্য ও দাপট দেখিয়ে নিজেদের বিশ্বাসকে গৌরবান্বিত করেছেন। ফুঁকো ক্ষমতার একটি নিজস্ব, সার্বজনীন এবং প্রায়োগিক সংজ্ঞা নির্মাণের চেষ্টা করেন। ফুঁকোর মতে, ‘ক্ষমতা হল ব্যক্তি মানুষের স্বার্থ দ্বারা সামষ্টিক মানুষের অধিকার হরণের প্রক্রিয়ায় অবৈধ নিয়ন্ত্রণ, অসম বণ্ঠন এবং অনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠাকরণ’। ফুঁকো প্রশ্ন তুলেছেন, ‘পাগল’ বলে, ‘ভবঘুরে’ বলে, অপরাধী বলে যাদেরকে উপনিবেশে উনবিংশ-বিংশ শতাব্দীতে আটকে রাখা হত, তারা কি আসলেই পাগল/ ভবঘুরে/অপরাধী ছিল? ফুঁকো এসব প্রান্তিক লোকদের জবানবন্দী বিশ্লেষণ করে দেখালেন যে, ক্ষমতাবানরা নিজেদের স্বার্থে এসব সংজ্ঞা নির্মাণ করেছেন। এসব সংজ্ঞা অসহায় হয়ে শোষিত জনগণ মেনে নিয়েছে, কারণ ক্ষমতার অদৃশ্য সূত্র সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। এখান থেকে শোষিতদের রেহাই পাওয়ার রাহা নাই। অন্যদিকে, ক্ষমতাবানরা নজরদারি, নিয়ন্ত্রণ এবং শাস্তিদানের প্রক্রিয়া থেকে বিরত নাই। ফুঁকো এর নাম দিয়েছেন Disciplinary power’ যা শুধু অর্থনৈতিক শ্রেণী ভিত্তির ওপর নয় বরং নেতৃত্বদানকারী এজেন্টদের প্রযুক্তিগত ক্ষমতার ওপর নির্ভরশীল। এ ধরণের ক্ষমতার আধিপত্য সর্বত্র বিদ্যমান। তবে ফুঁকোর মত থেকে দুটো জিনিষ বেরিয়ে আসতে পারে। একটি অনুসংগ্রামের মাধ্যমে বৃহৎ শক্তির কাছে পরাজিত হওয়া। অপরটি সংগঠিত বৃহৎ সামষ্টিক সংগ্রামের মাধ্যমে একটি অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বকে মোকাবেলা করা। সাংগঠনিক সংযোগ এবং সুচারু পরিচালনার মাধ্যমে দ্বিতীয় প্রকার আন্দোলনে মঙ্গল নিহিত থাকলেও বর্তমান, অর্থাৎ উত্তরাধুনিক সমাজে প্রথমটির বাস্তবায়নই দেখা যায়।

বর্তমানে ক্ষমতাবানরা গরীব ও নিরীহ দেশ এবং জনসমাজের ওপর তাদের মনগড়া মতবাদ ও তত্ত্ব চাপিয়ে দিচ্ছে। মৌলবাদী, সন্ত্রাসী, শয়তানের অক্ষ, সাম্প্রদায়িক এসব শব্দ আমরা এখন হর হামেশা শুনি। এসব ‘প্রত্যয়’ তারা তৈরি করে নিজেদের স্বার্থেই সেগুলোকে জনপ্রিয় করেছে এবং লাভজনকভাবে ব্যবহার করছে। গরীব ও কমবুদ্ধিওয়ালা জনগণ তাদের প্রচারিত ‘পদ’ ও ‘পদার্থ’ বুঝতে অক্ষম হয়েই মোল্লা ওমর বেশি বিপদজনক নাকি বুশ বেশি বিপদজনক কিংবা সাদ্দাম বিপদজনক নাকি বুশ বেশি বিপদজনক অথবা প্যালেস্টাইন নাকি ইসরাইলের রয়েছে রাষ্ট্রনৈতিক ভিত্তি তা অনুধাবন করতে পারছে না। ক্ষুদ্র এবং অণুআন্দোলনের কারণে তারা ক্ষমতাবানের কাছে পরাজিত হচ্ছে আবার নির্যাতিত, নিপীড়িত সাদ্দামের পক্ষ নেয়ার সাহসও পাচ্ছে না।

জ্যাক দেরিদাঃ
জ্যাক দেরিদাও লাকার অবচেতন অনুভবকে শব্দ দিয়ে প্রকাশ করার তত্ত্বকে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছেন। দেরিদার মতে, শব্দকে দ্যোতক ( signifier) এবং এর পেছনের ঘটনাকে যদি দ্যোতিত ( signified) ধরা হয় তাহলে এদের মধ্যে আদৌ কোন ধ্রুব সম্পর্ক নেই এবং শব্দ বাস্তবকে পুরোপুরি প্রকাশ করতে পারে না। শব্দ দ্বারা বাস্তবকে প্রকাশ করতে গেলেই নতুন শব্দ যোগ করতে হবে। আবার নতুন শব্দটিকে বোধগম্য করার জন্য আরও কিছু শব্দের দরকার হয়।এভাবে অসংখ্য শব্দের শৃঙ্খল আমরা পেয়ে যাই। ফলে ভাষার মধ্যে এক ধরণের বিচ্ছেদ ( Difference) কাজ করে, যার ফলে বাক্যের মধ্যে শব্দ নিজস্ব মূল্য হারিয়ে ফেলে এবং শেষ পর্যন্ত ঐ শব্দের অস্থিত্বই বিলীন হয়ে যায়। প্রতিটি শব্দ মুহূর্তের জন্য উপস্থিত হয়ে আবার অনুপস্থিত হচ্ছে, তার পূর্বাপর শব্দগুলোদ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে পার্থক্য রচনা করছে। এভাবে দেরিদার মতে, যে সব মূল শব্দের ওপর পাঠ(text) দাঁড়িয়ে আছে তাদের বিপরীতার্থক প্রয়োগ একই  text এ আবিষ্কার করা গেলে সমগ্র text টাই ভেঙ্গে পড়বে এবং পাঠকের ইচ্ছা ও ঝোঁক অনুযায়ী বিনির্মিত (Deconstructed) হবে। ভাষার পেছন থেকে যদি বিশেষ করে কেন্দ্র সৃষ্টিকারী অর্থের ( Meaning) উপস্থিতিকে সরিয়ে দেয়া যায়, তাহলে অধিবিদ্যাজাত ভাষাকেন্দ্রিক গোলোক ধাঁধা থেকে আমরা মুক্তি পাই যা আমাদের চিন্তা-চেতনায় অনর্থক কালক্ষেপণ করছে। আর এই কাজটি বিনির্মাণ তত্ত্বের (Deconstruction Theory) মূল উদ্দেশ্য।অধিবিদ্যা (Metaphysics) এবং মহাবয়ানকে (Metanarratives) ধ্বংস করার চিন্তা দেরিদার মাথায় থাকলেও বিনির্মাণ মানে এখানে একেবারে ধ্বংস নয়। তার মতে, শব্দ সর্বদা হ্যাঁ-না এই দুই বিপরীতের দ্বারা তার বক্তব্যকে তুলে ধরার প্রয়াস পায়। হ্যাঁ এবং না টাইপের দ্বিঘাত বৈপরীত্যগুলো পরস্পর নির্ভরশীল এবং অনুপ্রবিষ্ট। পরস্পর কার্যকর সূত্রে আবদ্ধ। কিন্তু বৈপরীত্যগুলো নিজেদের স্বস্থানে রাখার খাতিরেই কখনও কখনও নিজেকে উল্টে দেয় কিংবা ধ্বসিয়ে দেয়। দ্বান্দিকতার অমোঘ নিয়ম অনুযায়ী ‘হ্যাঁ না’ এর দ্বন্ধই হল প্রগতি, অন্যদিকে দেরিদার দ্বান্ধিকতা নিছক বিনির্মাণের মুক্তক্রীড়ায় পর্যবসিত হয়ে আমাদের দর্শন, সমাজ, অর্থনীতির প্রতিটি উপাদানকে বিক্ষিপ্ত, বিচ্ছিন্ন, অনুউপাদানে বিভক্ত করে বিকেন্দ্রীভূত করছে। যার ফলে দেখা দিয়েছে পৌণপুনিক বিখণ্ডায়ন, অন্তহীন বিশৃঙ্খলা, সংগ্রাম এবং বিরোধ।

বাংলাদেশ পরিপ্রেক্ষিতঃ
প্রত্যেক তত্ত্বই দেশ-কাল নির্বিশেষে চর্চিত হয়, বাংলাদেশেও হয়ে আসছে। ‘উত্তরাধুনিকতাবাদ’ একটা স্থির ও সর্বজন গ্রাহ্য মতবাদ হিসেবে আবির্ভূত না হলেও এদেশে আমরা তিনটি ক্ষেত্রে এর প্রভাব এবং প্রতিক্রিয়া দেখতে পাই। সাহিত্যের প্রসঙ্গে আসলে, বর্তমানে যেসব কবিতা লেখা হচ্ছে, তাতে লোকজ উপাদান, প্রান্তিক বিষয়, ঐতিহ্য চেতনার একটি স্বকীয় ও মৌলিক ... উত্তরাধুনিকতার একটা আঞ্চলিক অবয়ব তৈরির প্রয়াসও দেখতে পাই। এক্ষেত্রে চট্টগ্রাম এবং কলকাতায় ‘উত্তরাধুনিকতাবাদের’ আঞ্চলিক বিনির্মাণের এক ইতিবাচক ও গুণগত প্রয়াস দেখা যায়। শিল্প ও চিত্রকলায়ও বিমূর্ত ভাবের উপর গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে। আধুনিক ধারা থেকে উত্তরাধুনিকতায় উত্তরণ হচ্ছে জটিল, দুর্বোধ্য-বিমূর্ত চিত্রকলা। সাহিত্য, সমাজবিজ্ঞান, নৃবিজ্ঞান কিংবা দর্শনে এর প্রাতিষ্ঠানিক ও বিদ্যায়তনিক চর্চাও কম-বেশি চলছে। অন্যদিকে পুঁজিবাদী অর্থনীতির চূড়ান্তরূপ সারা বিশ্বের মত বাংলাদেশেও প্রধান কাঠামো হিসেবে বিস্তার লাভ করেছে। তাই আমরা মদদদাতাদের মদদে বিশ্বায়নের বিষ ও পুঁজিবাদের পুঁজ বুঝে হোক বা না বুঝে হোক গিলেছি বা নিত্য গিলছি। সাথে সাথে আমাদের দেশে বিক্ষিপ্ত অণুআন্দোলনকারী কিছু উত্তরাধুনিকতাবাদি চিন্তক ও সিভিলিয়ানের ক্ষোভ ও বিক্ষোভ দেখতে পাচ্ছি, কখনো পরিবেশ আন্দোলনকারী রূপে, কখনো নারী আন্দোলনকারী, আবার কখনওবা যৌন কর্মীর অধিকার আন্দোলনকারী রূপে। প্রান্তিক এবং অবহেলিত সামাজিক উপাদানগুলোর উপর গুরুত্বারোপ করাটা ইতিবাচক বটে, তবে বিক্ষিপ্ত এবং বহুধাবিভক্তির কারণে আমরা কোন সুসংহত মানব মুক্তির পথ খুঁজে পাচ্ছি না। তাই কেউ কেউ একা জিতছে অথবা কোন কোন দল জিতলেও বাংলাদেশের আমজনতা বার বার পরাজিত হচ্ছে।
উত্তরাধুনিকতাবাদের বিখণ্ডায়ন, বিকেন্দ্রীকরণ এবং পুঁজিবাদের সাথে এর সখ্য মার্ক্সবাদীদের চক্ষুশূল হিসেবে দেখা দিয়েছে। এরূপে বামপন্থী তাত্ত্বিকরাও উত্তরাধুনিকতাবাদ নিয়ে কম বেশি মাতামাতি করেছেন এবং এর ধংসাত্ত্বক উপসর্গগুলোও তারা সনাক্ত করার চেষ্টা করেছেন। পাশাপাশি আমাদের মত তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র দেশে এ ‘উত্তরাধুনিকতাবাদ’ কোন ধরণের গুনগত উন্নয়ন আদৌ আনতে পারবে কি না তা তর্কাতীত নয়। তবে তত্ত্বের গুণ বৈদেশিক ভাবুকদের কল্যাণে যাই থাকুক না কেন এর অন্তঃসারটুকু যদি আমাদের সমাজ- অর্থনীতি- রাষ্ট্রনীতির কাঠামোয় নিজেদের বৃহত্তর কল্যাণ চিন্তায় ব্যবহার করতে পারি, সেটাই হবে কাজের কাজ। পাশ্চাত্য তত্ত্বের নিত্য দাসত্ব পরিহার করে তত্ত্বের দেশীয়করন করা প্রয়োজন। দেশীয় প্রেক্ষাপটে তত্ত্বের বিনির্মাণ। তাহলে, সেটা হতে পারে ‘উত্তরাধুনিকতার বাংলাদেশী সংস্করণ’ কিংবা ‘বাংলাদেশি উত্তরাধুনিকতাবাদ’।

শেষ কথাঃ
আধুনিকতাবাদের প্রতি এক ধরনের ক্ষোভ এবং বিক্ষোভ থেকে পশ্চিমা অঞ্চলে উত্তরাধুনিকতাবাদের চর্চা শুরু হলেও তা সারা বিশ্বে ব্যাপক পরিবর্তনের সূচনা করেছে। বাংলাদেশও এ প্রভাব বলয়ের বাইরের কিছু নয়। এর বহুরূপী প্রকাশের জন্য হয়তোবা আমরা এর সাথে তাল মেলাতে পারছি না বা যথাযথভাবে পারবনা। তাই বলে একে ঠেস দিয়ে আটকাতে পারব, তাও নয়। এ অবাধ তথ্যের যুগে ঘরে সিঁদ কেটে ঢুকে পড়বে। আমরা এতক্ষণ আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে যে কাজটি করতে পারি বলে মনে হচ্ছে, তা হল, নতুন দর্শনে আমরা পশ্চিমা পুঁথি পাঠ ও প্রচারে বুঁদ হয়ে না থেকে নিজস্ব জ্ঞান হতে স্বকীয় দর্শনের উৎসারণ করতে পারি। এই ক্ষেত্রে আমদের দৈন্য অভাব দোষে নয়, স্বভাব দোষে। উত্তরাধুনিকতাবাদের গাড্ডায় পড়ে খণ্ডিত দর্শন চর্চা নয়, একটি সামস্টিক ও সামগ্রিক দর্শন যদি আমাদের দেশ-কাল উপযোগী করে সৃষ্টি করতে পারি, তাহলে আমাদের মুক্তির পথ হয়তো কণ্টকমুক্ত হবে। পরের ধনের পোদ্দারি নয়, নিজের ধনের গৌরব করব। দ্রুত পরিবর্তনশীল এ বিশ্বে অপরের সাথে তাল মিলানো নয়, নিজস্ব ও স্বকীয় তালে চলাই হোক আমাদের দর্শন। হয়তো এটাই হবে আমাদের ‘উত্তরাধুনিকতাবাদ’। যে ‘আধুনিকতাবাদ’ আমাদের পাশ্চাত্য ধরণের ধ্যান-মগ্ন করে পরিবর্তনশীল করেছে, ‘উত্তরাধুনিকতাবাদ’ আমাদের পাশ্চাত্য বিমুখ করে ‘আত্মনির্ভরশীল’ হতে প্রাণিত করবে। ‘আধুনিকতাবাদ’ আমাদের পরমুখী করেছে, আর ‘উত্তরাধুনিকতাবাদ’ আমাদের করুক ঘরমুখী।এই হোক আমাদের সত্যিকারের ‘উত্তরাধুনিকতাবাদ’।   

     



Comments

খুব সুন্দর প্রতিবেদন। অজস্র ধন্যবাদ প্রতিবেদককে ।

Popular posts from this blog

মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার কারণ ও প্রতিকার

সরওয়ার কামাল শিক্ষাক্ষেত্রে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য সাফল্য রয়েছে। সামাজিক উন্নয়ন সূচকেও বাংলাদেশের অবস্থান প্রতিবেশি দেশগুলোর তুলনায় ভালো, যা সম্পর্কে প্রশংসা করে বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন প্রবন্ধ লিখেছেন “ ল্যানসেট ” নামক মেডিক্যাল জার্নালে। কিন্তু এতে আমাদের বগল বাজিয়ে আত্মতৃপ্তিতে ভোগার অবকাশ নেই। কারণ শিক্ষার্থী ঝরে পড়া এবং বিজ্ঞান শিক্ষা সংকুচিত হয়ে পড়া আমাদের সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভুত হয়েছে। শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার কারণে আমাদের শিক্ষার মূল লক্ষ্যগুলো হাসিল হচ্ছে না, যার একটি হলো সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করা, অপরটি হলো শিক্ষাক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় প্রণোদনার ন্যায্য বণ্টন নিশ্চিত করা। অর্থাৎ সব শিশুই যাতে সরকারের সুযোগ ব্যবহার করে উন্নত জীবনের সন্ধান করতে পারে, তার শতভাগ নিশ্চয়তা প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না। শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার বিভিন্ন কারণ রয়েছে, তার মধ্যে বিভিন্ন স্তরের শিক্ষার ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন কারণ রয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার প্রধান কারণ দারিদ্র্য ও অপুষ্টি বা স্বাস্থ্যহীনতা । মাধ্যমিক পর্যায়েও শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার ক্ষেত্রে দারিদ্র্য সমস্যার ...

তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি বিচিত্র ছলনা জালে

তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি বিচিত্র ছলনা জালে ............................................................................... সাম্প্রতিক কালে আমাদের নৈতিক উপলব্ধিতে, সামাজিক উদ্বেগে কিংবা মূল্যবোধে দৃশ্যমান পরিবর্তন এসেছে। প্রযুক্তির নিবিড় ব্যবহার, বিশ্বায়নের প্রভাব, বিশ্বরাজনীতির অভিঘাত, বাজার সংস্কৃতির ধাক্কা ও চরমপন্থী ভাবাদর্শের টানাপড়েনে আমাদের চিরকালীন মূল্যবোধ ভেঙ্গে পড়েছে। নৈতিকতার সীমানা সরে যাচ্ছে প্রথাগত বিশ্বাস ও প্রতিষ্ঠানসংলগ্নতা থেকে। গতিময় জীবনের অভিঘাতে চরম অস্থিরতা ব্যক্তি থেকে ব্যষ্টির ব্যাপ্তিতে বিরাজ করছে। সর্বত্র আহাজারি, শোনার অবসর নিয়ে হাজির নেই কেউ। মানুষ যে নির্বিকার তাও নয়, তারা বিকারগ্রস্থ, পূর্ণমাত্রায় ঘোরগ্রস্থ, কেবল অপ্রত্যাশিত ঘটনাপ্রবাহের সাথে তাল মেলানোতে। তারা এখন এমন সব বিষয়ে আলোড়িত হয়, যে বিষয়ের সাথে তাদের সরাসরি যোগ নেই। থাকলেও তা অনেক ক্ষীণ ও দূরবর্তী কার্যকারণ সম্পর্কে আবদ্ধ। একইভাবে, তারা এমন সব পরিণতি ভোগ করে, যার জন্য তারা নিজেরা দায়ী নয়। আর যারা দায়ী তারা এর পরিণতি ভোগ করেন না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষ বয়সের দিকে এই প্যার...

মহেশখালীর সমাজ ও সংস্কৃতি

সরওয়ার কামাল সাগর কূলে গিরিকুন্তলা মোহিনী মহেশখালী দ্বীপের ৩৮৮ বর্গকিলোমিটার ভূত্বকে প্রায় পাঁচ লক্ষ লোকের বসতি। তাদের বসতি ঘিরে গড়ে উঠেছে উপকূলীয়-দ্বীপাঞ্চলীয় সমাজ। এই সমাজসভ্যদের মানসিক ঐক্য ও জীবনযাপন পদ্ধতি নিয়ে তৈরি হয়েছে শনাক্তযোগ্য বিশেষ স্থানীয় সংস্কৃতি। মানবজাতির চিরকালীন অভিযাত্রার অংশ হিসেবে দেশের নানা জায়গা থেকে হিজরত করে লোকজন এসে বসতি গেড়েছে মহেশখালীতে। তাই তাদের ভাষা ও আচরণে শনাক্ত করা যায় এমন বৈচিত্র্য ও তারতম্য, যা দিয়ে কক্সবাজারের অন্যান্য অঞ্চলের অধিবাসীদের তুলনায় মহেশখালীবাসীকে স্বতন্ত্রভাবে চিহ্নিত করা যায়। যে পার্থক্যসূচক বৈশিষ্ঠ্যাবলী নিয়ে মহেশখালীর সমাজ ও মানুষের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য তৈরি হয়েছে, চাটগাঁইয়া ভাষার উপভাষাতুল্য মহেশখালীর দ্বীপাঞ্চলীয় বুলি তার মধ্যে বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। [1] তবে সমস্যা হলো, লিখিত সাহিত্য ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের অভাবে স্থানীয় ইতিহাসের মতোই কালিক সূচকের নিরিখে এর জনসংস্কৃতি বর্ণনা করা দুরূহ। একেতো সংস্কৃতি স্বয়ং একটি ব্যাপক ধারণা, তদুপরি, এটি সতত পরিবর্তনশীল। ভাষা ও সংস্কৃতি স্রোতস্বী নদীর মতো বহমান। মানুষের কথা, স্মৃতি, পুরা...